![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি যে লাগাতার কর্মসূচি জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, দলটির ভাষায় তা ‘গণআন্দোলন’। কিন্তু সাধারণ সূত্রেই বলা যায়, গণসম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো কর্মসূচি গণআন্দোলন পদবাচ্য হতে পারে না। এছাড়াও বিএনপির লাগাম ছাড়া অবরোধ এবং হরতাল সাধারণ মানুষের জীবন সংহারী, গণস্বার্থ বিরোধী এবং দেশের অর্থনীতি ধ্বংসকারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কায়েমি স্বার্থ অর্জনের জন্য একটি রাজনৈতিক দলের বা জোটের অত্যাচারে এভাবে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন উদাহরণ পৃথিবীতে হয়তো বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক হিসেবে প্রচারিত দল ভুল পদক্ষেপের কারণে এভাবে গণআস্থাহীন দলে পরিণত হবে তা ভাবা যায়নি। ভুল পথে চলায় বিএনপি দল হিসেবে শুধু নিজেরই ক্ষতি করেনি দেশের রাজনীতিকেও ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে। আমরা জানি না বিএনপি নেতৃত্ব ভুল পথে হাঁটতে গিয়ে দলের যে ক্ষতি করলো তা থেকে আবার কবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, একটি অপরিপক্ব আন্দোলনে নেমে বিএনপি নেতৃত্ব নিজের ইচ্ছেয় হোক বা জঙ্গি বন্ধুদের প্রভাবে অথবা পরিচালনাতেই হোক জঙ্গি আচরণে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেললো। এখন নিজেদের তৈরি চোরাবালিতে নিজেরাই তলিয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন ‘এবার ফেরাও মোরে’। রাজনীতির মাঠে বিএনপি এতটাই খেই হারিয়ে ফেলছে যেন নিজেকে ফিরিয়ে আনার কথাও বলতে পারছে না। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলারও উপায় নেই।
যখন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে হাঁটার কথা, বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য মাঠ পর্যায়ে জনমত তৈরি করার কথা তখনই ছেলেমিসুলভ লাগাতার অবরোধের ডাক দিয়ে ফেললেন ‘দূরদর্শী’ বিএনপি নেত্রী! যুদ্ধের ময়দানে সিপাহসালার আর সিপাহী পৌঁছার অনেক আগেই যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেল। বিএনপি নেত্রী রাজনীতির গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। ফলে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই গাড়ির ব্রেক ফেল করালেন। এখন যত দক্ষতায় স্টিয়ারিং ধরে থাকুন না কেন গাড়ি থামানোর উপায় নেই। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে আঘাত করে থামাবেন—দুর্বল গাড়ি নিয়ে সে ভরসাও করতে পারছেন না। বালুচর থাকলে না হয় বালুতে চাকা আটকে গতি থামাতে পারতেন। জামায়াতের মত নানা খানাখন্দ জড়ো করেছেন চারপাশে। সুতরাং গর্তে ফেলার সাহসও নেই বিএনপি নেত্রীর। একেই বুঝি বলে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়েছে বিএনপি। এখন দেশ জুড়ে লাগাতার অবরোধ প্রায়োগিক ক্ষেত্র না পেয়ে এসে জড়ো হয়েছে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে। নিজেদের ডাকা অবরোধ এভাবে নেত্রীকেই অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তখনও হয়তো বিএনপির গাড়িতে ব্রেক হালকাভাবে কাজ করতো। অপরিণামদর্শিতা না থাকলে দ্রুত আত্মচৈতন্যে ফিরে আসে মেধাবীরা। কিন্তু সে পথ মাড়ালেন না বেগম জিয়া। আগেও অনেকবার লিখেছি বেগম জিয়ার ঘাড়ে ‘আপসহীন নেত্রীর’ তকমা যারা চাপিয়েছেন তারা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী নন। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছিলেনই, ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি’। বইতে পারবেন কিনা সে বিবেচনা না করে বেগম জিয়াও সম্ভবত ‘আপসহীন’ তকমা ঘাড়ে নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। তাই সোত্সাহে এর প্রয়োগ অপপ্রয়োগ করতে গিয়ে নিজের, ক্ষমতার বলয়ে রাখা নিজ পরিবারের এবং দলের ক্ষতি করে ফেললেন। না হলে যে কথা বলছিলাম—অবরোধ ডাকার পর রাজনীতির গাড়ির দুর্বল ব্রেক ধরা পড়তেই আপাতত বিরতি দিয়ে ব্রেক ঠিক করা জরুরি ছিল। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে জামায়াতের পক্ষপুটে বসা আরেক মেধাবী পুত্র এই গাড়ির ব্রেকের খোঁজ না রেখে তার তালবে এলমদের গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দিচ্ছেন। অনন্যোপায় বেগম জিয়াকেও তার অনুমোদন দিতে হচ্ছে। তাই দুর্বল ব্রেকের গাড়িতেই চাপিয়ে দিলেন লাগাতার হরতালের বোঝা। এতে যা হওয়ার তাই হলো। ব্রেক ফেল করে বসলো বিএনপির রাজনৈতিক গাড়ি। ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পড়ার কারণে এখন বুঝতে পেরেছেন কার্যকারিতা থাকুক বা না থাকুক প্রতি সপ্তাহে প্রথমে ৭২ ঘণ্টা এবং পরে আরো ৪৮ ঘণ্টা হরতাল দিয়ে যেতেই হবে। আর স্টিয়ারিং ধরে সতর্কতায় কেবল রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। অন্তত গাড়িতে যতক্ষণ জ্বালানি অবশিষ্ট থাকে। তারপরে না হয় বড় দুর্ঘটনা বাঁচিয়ে ছোট দুর্ঘটনার বিনিময়ে গাড়ি থামানো যাবে। তবুওতো ‘আপসহীনের’ গরিমা অক্ষুণ্ন থাকবে। একেই কি ‘বোকার স্বর্গে বাস করা’ বলে? কারণ আন্দোলনের নামে যেভাবে হিংসা ছড়ানো হয়েছে, যেভাবে শিক্ষা শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, যেভাবে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে সাধারণ বিবেচনার মানুষও বলবে কোনো দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক দল এমন কাজ করতে পারে না। বিএনপির রাজনীতিবোদ্ধা জ্যেষ্ঠ নেতারা যে তা বুঝতে পারছেন না এমনটি নয়। তাঁরা তারেক জিয়া ও বেগম জিয়ার যৌথ প্রযোজিত কর্মসূচি নিয়ে কথা বলারও যেন আধিকারিক নন। বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল যেদিন বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে না পেরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফিরে গিয়েছিলেন। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অনেকেই সেসময় বাড়ির ভেতরে ছিলেন। তাঁরা যে এতটা মাথা মোটা আমাদের মনে হয় না। তাদের সাথে পরামর্শ না করেই অফিস কর্মীরা প্রবাসী নেতাকে হাজির-নাজির জেনেই সম্ভবত তার নির্দেশে এই রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অপকর্মটি করেছেন। এসব কারণে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মনোকষ্টটি বোঝা যায়। তাই এই দুঃসময়ে এখন গোপন আস্তানা থেকে একজন নিম্ন-মাঝারি নেতার বিবৃতি ছাড়া আর কারো কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না। সরকারি নেতামন্ত্রীদের একক কণ্ঠশীলনই চলছে চারদিকে। আমাদের সামপ্রতিক রাজনীতিতে চালু সংস্কৃতিতে একপক্ষের কোনো নেতা-নেত্রীর কোনো বক্তব্য মাটিতে পড়ার আগেই অন্য পক্ষ সাংবাদিকদের ডেকে সাথে সাথে জবাব দিয়ে ফেলতেন। এখন ঠিক জমছে না। কেবল এক পক্ষই কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে চলছে।
বেগম জিয়া এবার ভাষা শহীদ স্মরণে পুষ্পাঞ্জলি দিতে শহীদ মিনারে যাননি। একইসূত্রে গাঁথা ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। এদিন বিএনপি দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ডেকেছিল। সামপ্রতিক সময়ের ধারাবাহিকতায় কেন্দ্রীয় বা মাঝারি নেতা কেউ এদিন বিক্ষোভ দেখাতে পথে নামেননি। সবচেয়ে বিস্ময়কর, বেগম জিয়া গুলশান অফিসে প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত থেকেও নিজ কর্মসূচিতে অফিসের বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন না। তিনিতো গৃহবন্দী নন। যেন স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন পার্টি অফিসে। এতটা নিভৃতে আছেন যে মন্দির শৈলীর স্থাপত্যিক ভাষায় বলা যায় গর্ভগৃহে আছেন। যেমন কোনো আধ্যাত্মিক গুরু ধ্যানস্থ থাকেন। লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে চান। এ কারণেই কি বেগম জিয়া একটি বড় দলের প্রধান হয়েও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারে গেলেন না? বিএনপির পক্ষ থেকে একটি জবানি ২১ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে দেখতে পেলাম। তাতে বলা হয়েছে, নিজ ডাকা অবরোধে তাঁর বেরুনো ঠিক হবে না বিবেচনায় নিজে শহীদ মিনারে আসতে পারছেন না। খালেদা জিয়ার দুর্ভাগ্যের জন্য আফসোস হলো। আসলে ব্রেক ফেল করা গাড়িতে চাপলে এমনই হয়। তাইতো আন্দোলনে নেমে জাতীয় স্বার্থে এবং জনস্বার্থে যেটুকু স্থিতিস্থাপকতা থাকতে হয় তা হারিয়ে ফেললো অস্থির বিএনপি। ফলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে ব্রেককষা দরকার হলেও অসহায় বিএনপি তা পারেনি। যেমন জরুরি ছিল বিশ্ব ইজতেমার সময় ব্রেককষা। অতি জরুরি ছিল এসএসসি পরীক্ষা নির্বিঘ্ন করার জন্য ব্রেককষা আর অনিবার্য ছিল ২১ ফেব্রুয়ারির মত একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পাওয়া জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে ব্রেককষা। এসব দেখে মনে হচ্ছিল বেগম জিয়াদের হুইল বড়শিতে বড় মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নেই। বড়শিতে মাছ আটকালে কখনো সুতো টেনে কখনো সুতো ছেড়ে মাছকে দুর্বল করতে হয়। তারপর অনুকূল সময়ে নেটে আটকাতে হয় মাছ। ক্রমাগত সুতো টানলে সে মাছ একসময় ঝট করে বড়শি থেকে ছুটে যায়। তখন অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না।
সামপ্রতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে দলীয় সম্ভ্রম ও অস্তিত্ব ধরে রাখতে হলে বিএনপি নেত্রীকে আর কালবিলম্ব না করে প্রতি সপ্তাহে গোপন জায়গা থেকে হরতালের আদেশ জারি করা বন্ধ করতে হবে। বিষয়টি এখন অতি খেলো এবং অতি পানসে হয়ে গেছে। আরো অনেক আগেই নির্জীব হয়ে যেতো। বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের মিডিয়া।
মিডিয়ার কারণে সামান্য সজীব থাকলেও বিএনপির হরতাল এখন অনেকটাই মৃতবত্ হয়ে পড়েছে। বোমা আতঙ্ক ছড়ানোর পরও প্রথম থেকে রাজধানীতে হরতালের তেমন প্রভাব ছিল না। নাশকতার কারণে দূরপাল্লার বাস ট্রাক চলাচলে সংকট ছিল। এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতায় তাও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, শপিং মল, মিল-কারখানা সারা দেশেই সচল আছে। শুধু প্রভাব কিছুটা থেকেছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নাশকতার ভয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পাচ্ছিলেন। তারপরও শুরু থেকে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সচল রয়েছে। কলেজগুলোতে হরতালের কোনো প্রভাব নেই। কোমলমতি শিশুদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা নির্জীব ছিল স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখন একাডেমিক ক্যালেণ্ডার ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হরতালকে অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানলাম এ সপ্তাহ থেকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস নেয়ার রুটিন ঘোষণা করেছে।
এভাবে সব হারিয়ে বিএনপি জোট এখন হারাধনের শেষ ছেলেটির দশা নিয়ে একা পথে দাঁড়ানো। আমার দুঃখ হয় সারা দেশে বিএনপির লাখ লাখ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী-সমর্থকদের জন্য। তাদের অকূলে ভাসিয়ে দিলেন অপরিণামদর্শী নেতা-নেত্রীরা। আমরা মনে করি দলের প্রতি ভালবাসা থাকা এসব নেতা-কর্মী-সমর্থক যদি এখনি ঘুরে দাঁড়ায়, সুপথে আসার জন্য নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সরব হয়—তবে বেঁচে যেতে পারে দলটি।
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/drishtikon/2015/02/22/33300.html
©somewhere in net ltd.