নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার কথা

আহমেদ রশীদ

আহমেদ রশীদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিজামীর প্লট ঘিরে পদে পদে অনিয়ম

০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৮:৩৭


'দেশসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ' রাজধানীতে সরকারি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় বহু কোটি টাকা দামের এই তিন প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা চিহ্নিত ব্যক্তিদের 'দেশসেবায় বিশেষ অবদানের' জন্য সরকারি প্লট দেওয়া নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ও ক্ষোভ ছিল জনমনে। তার ওপর ওই তিন ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার পরও তাঁদের নামে প্লটের বরাদ্দ বাতিল না করায় ক্ষোভ আরো বাড়ছে। এ ছাড়া নিজামীর নামে বনানীতে পাঁচ কাঠার প্লটটি বরাদ্দই দেওয়া হয়েছিল সম্পূর্ণ অনিয়মের মাধ্যমে। অন্যের নামে বরাদ্দ দেওয়া প্লট তিন লাখ টাকা কিস্তি পরিশোধ করার পর অবৈধভাবে দেওয়া হয় একাত্তরের ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধানকে। ওই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পর সেখানে ভবন নির্মাণ ও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন করার প্রমাণ পেয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।

প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সময় চিহ্নিত তিন স্বাধীনতাবিরোধীর দুজন মন্ত্রী এবং একজন এমপি ছিলেন। তাই শুরুতে এ নিয়ে জনমনে চাপা ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে তেমন বিরোধিতা হয়নি। পরে নবম জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন ওই সব প্লটের বরাদ্দ বাতিল করারও সুপারিশ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু এত দিনেও সে সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। একপর্যায়ে বলা হয়, মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের প্লটের বরাদ্দ বাতিল করা ঠিক হবে না। এরই মধ্যে সাঈদী ও মুজাহিদের আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে মুজাহিদের প্রাণদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে, আর সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড। নিজামীর আপিল বিচারাধীন। এ অবস্থায়ও মুজাহিদ ও সাঈদীর প্লটের বরাদ্দ বহাল থাকায় এর সমালোচনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন মহলে।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ দেশের বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে তাদের রাষ্ট্র যে পুরস্কৃত করেছে, তা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তাদের শাস্তি হয়েছে বিধায় এখন তাদের কাছ থেকে কথিত এসব পুরস্কার কেড়ে নেওয়া উচিত। এসব সম্পদ ফিরিয়ে নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত যে কেউ নরহত্যা করার পর তাকে পুরস্কৃত করা হলে তা স্থায়ী হয় না। এটি এখন রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।'

এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই তাদের এ সম্পদ বাজেয়াপ্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে নিতে চায় না। যখন এসব বিষয় নিয়ে সবাই সোচ্চার হবে তখন সরকার বাধ্য হবে ব্যবস্থা নিতে। এ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তা চলতেই থাকবে। কোন হিসেবে তারা দেশে অবদান রেখেছে, তা যারা প্লট বরাদ্দ দিয়েছে তাদের কাছ থেকে জানা উচিত।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আলী আহসান মুজাহিদকে দেশসেবার নাম করে যে প্লট দেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ ছাড়া নিজামী ও সাঈদীও ইতিমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়েছে। তাদের এসব প্লট মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সভা ডেকে বাতিল করা হবে। আমরা ইতিপূর্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডিতদের প্লটের বরাদ্দ বাতিল করেছি।'

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্লট রাজউক কর্তৃপক্ষও বাতিল করতে চায়। কিন্তু কোনো বরাদ্দ বাতিল করার ক্ষেত্রে যেসব আইনিপ্রক্রিয়া মেনে চলতে হয় তা আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ছাড়া এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলে আমাদের পক্ষে কাজ করতে অনেকটা সহজ হবে।'

রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নিজামীকে প্লট দেওয়া হয়েছে। প্লটটি আগেই আরেকজনের নামে বরাদ্দ ছিল। কোনো ধরনের আইনগত কারণ ছাড়াই তাঁর অনুমোদন বাতিল করে সেই সময়ে অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এ কাজটি করেছেন। একইভাবে মুজাহিদ ও সাঈদীকে তাঁরা প্লট দিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন।'

রাজউকের পরিচালক (পূর্বাচল নতুন শহর) মো. আহসান ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০১ সালে পূর্বাচল থেকে পাঁচ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। ওই প্লটের নম্বর ৮৬, রোড-১০৩ ও সেক্টর-৭। আমরা ফাইল পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হব।'

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালের ২১ মে রাজউকের বোর্ড সভায় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীকে পাঁচ কাঠার একটি প্লট দেওয়া হয়। বনানীর ১৮ নম্বর রাস্তার এই ৬০ নম্বর প্লটটি ১৯৯৫ সালে আজিজুর রহিমের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যা বাতিল করে দেওয়া হয় নিজামীকে। কিন্তু আগের বরাদ্দগ্রহীতা এ নিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে সচিব বরাবর অভিযোগ করলে শুরু হয় তদন্ত। তদন্তে দেখা যায়, আজিজুর রহিমের পক্ষ থেকে ওই প্লটের বিপরীতে তিন লাখ টাকা কিস্তি পরিশোধ করার পরও তা নিজামীকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিজামী প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার পর জামায়াত নেতাদের পরিচালিত মিশন ডেভেলপার লিমিটেডের নামে আমমোক্তারনামা দেন, যা রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত নয়। কর্মকর্তার যে স্বাক্ষরে আজিজুর রহিমের বরাদ্দ বাতিল করা হয় সেটিও জাল বলে তদন্তে ধরা পড়ে। তদন্তে নিজামী ও তাঁর নিয়োজিত ব্যক্তি পরস্পর যোগসাজশে রাজউক থেকে প্লটের মূল ফাইল গায়েব করেন বলেও উঠে আসে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মত দেন, রাজউক থেকে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর আবেদন করলে তা লটারির মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু নিজামী তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী বরাবর আবেদন করলে মন্ত্রী আবেদনপত্রের গায়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এ সুপারিশে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনোভাবেই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার এখতিয়ার বা আইনগত সুযোগ নেই। রাজউকে দেওয়া নিজামীর হলফনামায় তাঁর স্বাক্ষরও নেই। এ ছাড়া মিশন ডেভেলপারকে নিজামী আমমোক্তারনামা দিয়ে তা বাতিল না করেই নিজে তড়িঘড়ি করে ইমারত নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন, যা বিধিবহির্ভূত। এরপর আবাসিক এ প্লটে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করে তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু করা হয়। সেখানে গড়ে তোলা হয় জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এমনকি রাজউকের তদন্তদল ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। সব কিছু মিলিয়ে নিজামীকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া ও ইমারত নির্মাণ পুরোটাই অনিয়মের মধ্য দিয়ে করা হয়েছে। তাই এ কাজের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়।

রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) পুন্না শবনম খন্দকার সংশ্লিষ্ট পরিচালক বরাবর গত ২০ মে একটি প্রতিবেদন দেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মতিউর রহমান নিজামীর নামে বরাদ্দকৃত আবাসিক প্লটটি সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্লটে রাজউকের অনুমোদন ব্যতীত ইমারত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং শর্ত ভঙ্গ করে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করে সাইনবোর্ড অপসারণের জন্য চেয়ারম্যান মহোদয় নির্দেশ প্রদান করেছেন।'

নিজামীর এ বাড়ির সামনে দায়িত্ব পালনরত কেয়ারটেকার মো. ইশারাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এখানে বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে আছি। বাড়িটি মিশন ডেভেলপার কর্তৃপক্ষ করেছে। এখানে দ্বিতীয় তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক এবং ষষ্ঠ তলা আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।'

এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিজামীর প্লটের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে রাজউকে চিঠি দেয় সংস্থাটি। কিন্তু রাজউক থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে পরে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক এস এম রাশেদুল রেজা আরেকটি চিঠি দেন। এরপর রাজউক থেকে এ প্লটের বিপরীতে বিস্তারিত উল্লেখ করে দুদককে অবহিত করা হয়।

জানা যায়, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডের ৫ নম্বর প্লটটি (পাঁচ কাঠার) বরাদ্দ দেওয়া হয় চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। তখন মুজাহিদ ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মুজাহিদের ফাঁসি বহাল থাকার পর তাঁর প্লটের বরাদ্দ বাতিলের জোর দাবি উঠেছে।

নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনীর নীতি ও পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালি, জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা। তাদের আলবদর বাহিনী দুষ্কৃতকারী বলত। এই আলবদর বাহিনী ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর 'ডেথ স্কোয়াড'। তাদের কাজ ছিল সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা। রায়ে ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী নিজামীর অধীন ছিল। ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে নিজামী আলবদরদের মানসিকভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী শুধু পাকিস্তানকে সহায়তা করেনি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে এই আলবদর বাহিনী গঠন করে। এতে আরো বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী করা ছিল একটি বড় ভুল। এটি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোনের গালে চড় দেওয়ার শামিল। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক।

'দেশসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ' রাজধানীতে সরকারি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় বহু কোটি টাকা দামের এই তিন প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা চিহ্নিত ব্যক্তিদের 'দেশসেবায় বিশেষ অবদানের' জন্য সরকারি প্লট দেওয়া নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ও ক্ষোভ ছিল জনমনে। তার ওপর ওই তিন ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার পরও তাঁদের নামে প্লটের বরাদ্দ বাতিল না করায় ক্ষোভ আরো বাড়ছে। এ ছাড়া নিজামীর নামে বনানীতে পাঁচ কাঠার প্লটটি বরাদ্দই দেওয়া হয়েছিল সম্পূর্ণ অনিয়মের মাধ্যমে। অন্যের নামে বরাদ্দ দেওয়া প্লট তিন লাখ টাকা কিস্তি পরিশোধ করার পর অবৈধভাবে দেওয়া হয় একাত্তরের ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধানকে। ওই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পর সেখানে ভবন নির্মাণ ও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন করার প্রমাণ পেয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।

প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সময় চিহ্নিত তিন স্বাধীনতাবিরোধীর দুজন মন্ত্রী এবং একজন এমপি ছিলেন। তাই শুরুতে এ নিয়ে জনমনে চাপা ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে তেমন বিরোধিতা হয়নি। পরে নবম জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন ওই সব প্লটের বরাদ্দ বাতিল করারও সুপারিশ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু এত দিনেও সে সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। একপর্যায়ে বলা হয়, মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের প্লটের বরাদ্দ বাতিল করা ঠিক হবে না। এরই মধ্যে সাঈদী ও মুজাহিদের আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে মুজাহিদের প্রাণদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে, আর সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড। নিজামীর আপিল বিচারাধীন। এ অবস্থায়ও মুজাহিদ ও সাঈদীর প্লটের বরাদ্দ বহাল থাকায় এর সমালোচনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন মহলে।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ দেশের বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে তাদের রাষ্ট্র যে পুরস্কৃত করেছে, তা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তাদের শাস্তি হয়েছে বিধায় এখন তাদের কাছ থেকে কথিত এসব পুরস্কার কেড়ে নেওয়া উচিত। এসব সম্পদ ফিরিয়ে নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত যে কেউ নরহত্যা করার পর তাকে পুরস্কৃত করা হলে তা স্থায়ী হয় না। এটি এখন রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।'

এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই তাদের এ সম্পদ বাজেয়াপ্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে নিতে চায় না। যখন এসব বিষয় নিয়ে সবাই সোচ্চার হবে তখন সরকার বাধ্য হবে ব্যবস্থা নিতে। এ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তা চলতেই থাকবে। কোন হিসেবে তারা দেশে অবদান রেখেছে, তা যারা প্লট বরাদ্দ দিয়েছে তাদের কাছ থেকে জানা উচিত।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আলী আহসান মুজাহিদকে দেশসেবার নাম করে যে প্লট দেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ ছাড়া নিজামী ও সাঈদীও ইতিমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়েছে। তাদের এসব প্লট মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সভা ডেকে বাতিল করা হবে। আমরা ইতিপূর্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডিতদের প্লটের বরাদ্দ বাতিল করেছি।'

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্লট রাজউক কর্তৃপক্ষও বাতিল করতে চায়। কিন্তু কোনো বরাদ্দ বাতিল করার ক্ষেত্রে যেসব আইনিপ্রক্রিয়া মেনে চলতে হয় তা আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ছাড়া এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলে আমাদের পক্ষে কাজ করতে অনেকটা সহজ হবে।'

রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নিজামীকে প্লট দেওয়া হয়েছে। প্লটটি আগেই আরেকজনের নামে বরাদ্দ ছিল। কোনো ধরনের আইনগত কারণ ছাড়াই তাঁর অনুমোদন বাতিল করে সেই সময়ে অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এ কাজটি করেছেন। একইভাবে মুজাহিদ ও সাঈদীকে তাঁরা প্লট দিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন।'

রাজউকের পরিচালক (পূর্বাচল নতুন শহর) মো. আহসান ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০১ সালে পূর্বাচল থেকে পাঁচ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। ওই প্লটের নম্বর ৮৬, রোড-১০৩ ও সেক্টর-৭। আমরা ফাইল পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হব।'

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালের ২১ মে রাজউকের বোর্ড সভায় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীকে পাঁচ কাঠার একটি প্লট দেওয়া হয়। বনানীর ১৮ নম্বর রাস্তার এই ৬০ নম্বর প্লটটি ১৯৯৫ সালে আজিজুর রহিমের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যা বাতিল করে দেওয়া হয় নিজামীকে। কিন্তু আগের বরাদ্দগ্রহীতা এ নিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে সচিব বরাবর অভিযোগ করলে শুরু হয় তদন্ত। তদন্তে দেখা যায়, আজিজুর রহিমের পক্ষ থেকে ওই প্লটের বিপরীতে তিন লাখ টাকা কিস্তি পরিশোধ করার পরও তা নিজামীকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিজামী প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার পর জামায়াত নেতাদের পরিচালিত মিশন ডেভেলপার লিমিটেডের নামে আমমোক্তারনামা দেন, যা রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত নয়। কর্মকর্তার যে স্বাক্ষরে আজিজুর রহিমের বরাদ্দ বাতিল করা হয় সেটিও জাল বলে তদন্তে ধরা পড়ে। তদন্তে নিজামী ও তাঁর নিয়োজিত ব্যক্তি পরস্পর যোগসাজশে রাজউক থেকে প্লটের মূল ফাইল গায়েব করেন বলেও উঠে আসে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মত দেন, রাজউক থেকে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর আবেদন করলে তা লটারির মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু নিজামী তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী বরাবর আবেদন করলে মন্ত্রী আবেদনপত্রের গায়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এ সুপারিশে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনোভাবেই প্লট বরাদ্দ দেওয়ার এখতিয়ার বা আইনগত সুযোগ নেই। রাজউকে দেওয়া নিজামীর হলফনামায় তাঁর স্বাক্ষরও নেই। এ ছাড়া মিশন ডেভেলপারকে নিজামী আমমোক্তারনামা দিয়ে তা বাতিল না করেই নিজে তড়িঘড়ি করে ইমারত নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন, যা বিধিবহির্ভূত। এরপর আবাসিক এ প্লটে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করে তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু করা হয়। সেখানে গড়ে তোলা হয় জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এমনকি রাজউকের তদন্তদল ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। সব কিছু মিলিয়ে নিজামীকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া ও ইমারত নির্মাণ পুরোটাই অনিয়মের মধ্য দিয়ে করা হয়েছে। তাই এ কাজের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়।

রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) পুন্না শবনম খন্দকার সংশ্লিষ্ট পরিচালক বরাবর গত ২০ মে একটি প্রতিবেদন দেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'মতিউর রহমান নিজামীর নামে বরাদ্দকৃত আবাসিক প্লটটি সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্লটে রাজউকের অনুমোদন ব্যতীত ইমারত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং শর্ত ভঙ্গ করে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করে সাইনবোর্ড অপসারণের জন্য চেয়ারম্যান মহোদয় নির্দেশ প্রদান করেছেন।'

নিজামীর এ বাড়ির সামনে দায়িত্ব পালনরত কেয়ারটেকার মো. ইশারাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এখানে বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে আছি। বাড়িটি মিশন ডেভেলপার কর্তৃপক্ষ করেছে। এখানে দ্বিতীয় তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক এবং ষষ্ঠ তলা আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।'

এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিজামীর প্লটের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে রাজউকে চিঠি দেয় সংস্থাটি। কিন্তু রাজউক থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে পরে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক এস এম রাশেদুল রেজা আরেকটি চিঠি দেন। এরপর রাজউক থেকে এ প্লটের বিপরীতে বিস্তারিত উল্লেখ করে দুদককে অবহিত করা হয়।

জানা যায়, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডের ৫ নম্বর প্লটটি (পাঁচ কাঠার) বরাদ্দ দেওয়া হয় চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। তখন মুজাহিদ ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মুজাহিদের ফাঁসি বহাল থাকার পর তাঁর প্লটের বরাদ্দ বাতিলের জোর দাবি উঠেছে।

নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনীর নীতি ও পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র বাঙালি, জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা। তাদের আলবদর বাহিনী দুষ্কৃতকারী বলত। এই আলবদর বাহিনী ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর 'ডেথ স্কোয়াড'। তাদের কাজ ছিল সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা। রায়ে ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী নিজামীর অধীন ছিল। ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে নিজামী আলবদরদের মানসিকভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী শুধু পাকিস্তানকে সহায়তা করেনি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে এই আলবদর বাহিনী গঠন করে। এতে আরো বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী করা ছিল একটি বড় ভুল। এটি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোনের গালে চড় দেওয়ার শামিল। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/08/03/251748

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:১০

যোগী বলেছেন:
নরপশুদের নামে এখনো প্লট বরাদ্দ বহাল জেনে যেমন কষ্ট পাইলাম তেমনি ক্রদ্ধ জন্মালো।

২| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:৩৭

ভয়ংকর বিশু বলেছেন: পাকিস্তান নামক দেশের জন্য জান বাজী রেখে যুদ্বের পুরষ্কার সরূপ খা-লেডা এ তিন জন সেবা লালকে জমি দিয়েছিল।

৩| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:০৬

আমিনুর রহমান বলেছেন:


দেশসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ - মিথ্যা তো নয় উনারা পাকিস্তানের সেবায় তাদের অবদানের কথা বিশেষণ দিয়ে শেষ করা যাবে না ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.