![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দার্শনিকেররা এযাবৎ জগৎটাকে শুধু ব্যখ্যা করেছেন , আসল কাজ হলো পরিবর্তন করা - কার্ল মার্কসের এ উক্তিটি আমার খুব প্রিয় ।
অরুনদা – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক বা মালিক । উনার বাবা প্রয়াত মধুদা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর হাতে নিহত হন । ১৯৭১ পূর্ববর্তি স্বাধীনতার সংগ্রামে এই দেশের ছাত্র সমাজ যখন দুর্বার আন্দোলনে নিমজ্জিত । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের একমাত্র রাজধানী মনে করা হত সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি পরিচালিত হতো তখন ৪ খলীফা খ্যাত ৪জন ছাত্রনেতার নেতৃত্বে । সেই ছাত্র নেতাগণ হলেন তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি শাহজাহান সিরাজ ও সাধারন সম্পাদক নুরে আলম সিদ্দিকি এবং ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন । এই ৪ জন কখনই একা চলতে পারতেন না । যখনই হাঁটতেন বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য় ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতেন সাথে ৫০-১০০ জন কর্মী সমর্থক পরিবেষ্টিত থাকতেন । আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সেই সাথে ১৯৯০ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে একটি ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথমে আহবায়ক ও পরে সাধারন সম্পাদক থাকার কারনে অনেক লম্বা সময় মধুর ক্যান্টিনে পার করতে হয়েছে । কখনও সেই সকাল ১০/১১ টা থেকে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে হয়েছে । সংগত কারনেই অরুনদা ছিল একজন কাছের মানুষ । এমনও সময় ছিল যে অনেকেরই বাড়ি থেকে চিঠিপত্র C/O অরুনদা , মধুর ক্যান্টিন এই ঠিকানায় আসতো । তখন তো আর মোবাইলের যুগ ছিল না , চিঠিপত্রই একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল । কিংবা সকল ছাত্র সংগঠনেরই তিনি ছিলেন রিলে সেন্টার । সকল খবরাখর উনার মাধ্যমেই আদান প্রদান করা হতো । কাজটি করতেনও তিনি অত্যন্ত আনন্দ ও নিষ্ঠার সাথে । সকাল ১০ টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত অরুনদা ব্যাস্ততার জন্য দম ফালানোর সময় পেত না । একদিকে উনি চিৎকার করে বলছেন এই এখানে কত বিল আর একদিকে চিৎকার করে বলছেন শাহীন ভাই অমুখ আপনাকে এই বলেছে । আমাদের সময় আমরা চাঁদা তুলে ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করতাম । বিশেষ করে মিছিলের অগ্রভাগে একটি ব্যানার থাকতো । রুটিন মিছিল ছাড়া সপ্তাহে প্রায় দুই তিন দিনই ইস্যু ভিত্তিক মিছিল থাকতো । সেই মিছিলের জন্য ব্যনার তৈরি হতো নিলখেতে । কাপরের উপর কালি দিয়ে একজন আর্টিস্ট তা লিখে দিত । এই কাজের জন্য কাপর কেনা ও লেখার খরচ বাবদ কিছু টাকা নিয়মিত প্রয়োজন পড়তো । কতদিন টাকা টাকা জোগাড় করতে না পেরে অরুনদার কাছ থেকে ধার নিয়েছি । প্রতিদিনের চা-নাস্তার খাবার তো বাকি থাকতোই । কোন ধার অরুনদাঁকে ফেরত দেয়া হয়েছে এমন রেকর্ড অন্ততঃ আমার জানা নেই । আবার ধার ফেরত দেয়া হয় নাই বলে পুনারায় ধার পাওয়া যায় নাই বা চা-নাস্তার বাকি বন্ধ হয়েছে এমন রেকর্ডও নাই । সেইটা যে শুধু আমরা করেছি তাই নয় , তৎকালীন সকল ছাত্র সংগঠনেরই একই অবস্থা এবং ত্রাতা হচ্ছে অরুনদা । এই খবর অবশ্য নেতৃবৃন্দ ছাড়া সাধারন কর্মীরাও জানে না । সাধারন মানুষতো দূরের কথা । অরুন্দা কিন্তু সেই সমস্ত বাকির খাতা ইতিহাস হিসেবে রেখে দিয়েছে । শুনেছি উনার বাবার আমল থেকে যে সমস্ত বাকি আছে সবই সেই খাতায় লিপিবদ্ধ । মাঝে মাঝে ক্যান্টিনের একদম খাস কামড়ায় অরুনদার পাশে গিয়ে বসতাম । সেটা সম্ভব হতো দুপুর আড়াইটা তিনটার দিকে । তখন হয়তো কারও জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু মধুর ক্যান্টিনে পরিচিত কেউ নেই কিংবা ক্ষিধা লেগেছে , পকেটে টাকা নেই , এখন বাকিতে খেতে হবে । সেই সময় টুকি টাকি নানান কথা হতো । উনার ছেলেবেলার কথাও উনি বলতেন । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী ছাত্র আন্দোলনের সময় উনার বয়স মাত্র ১০/১১ বা তার চেয়ে কিছু কম বেশি হবে । মধুদা সকালে বাজারে যেতেন । সেই সময়টায় অরুনদার উপর ক্যান্টিনের দায়িত্ব থাকতো । বয়সে ছোট থাকার কারনে উনি সব কিছু সামাল দিতে পারতেন না । সেই সাথে ৪ খলিফার আনাগোনা সার্বক্ষণিক ভাবে ছিল । একজন ঢুকলে কমপক্ষে ৫০-১০০ কাপ চা দিতে হতো । চা খেয়েই নেতারা চলে যেতেন । বিল লিখতে অনেক সময় অরুনদার সমস্যা হতো । মধুদা বাজার থেকে এসে জিজ্ঞাসা করতেন বাকীর খাতা ঠিকমত লেখা হয়েছে কিনা । অরুনদা তা কোনদিনই ঠিকভাবে লিখতে পারতেন না । তখন মধুদা জিজ্ঞেস করতেন রব (আসম আব্দুর রব ) কয়বার এসেছিল , যদি দুইবার আসতো তবে উনার নামে ১৫০ কাপ চা লেখা হতো, আবার জিজ্ঞেস করতেন সিরাজ (শাহজাহান সিরাজ) কয়বার এসেছিল । যদি একবার আসতেন তবে উনার নামে ৬০ কাপ চা এর দাম বাকীর খাতায় লেখা হতো । এইভাবে কোন নেতা কয়বার আসতেন তার উপর বিল লেখা হতো এবং কার সাথে আনুমানিক কতজন থাকতে পারেন তা মধুদার জানা ছিল । বাংলাদেশের বর্তমান বড় বড় রাজনীতিবিদরা প্রায় সকলেই মধুর ক্যান্টিন এর রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে জড়িত । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হউক বা না হউক মধুর ক্যান্টিনে যেতেই হতো । মধুর ক্যান্টিনই ছিল মুলত রাজনীতির অফিস । অন্তত ৯০’র আন্দোলন পর্যন্ত আমরা তাই দেখে এসেছি । মধুদা থেকে শুরু করে বর্তমান অরুনদা পর্যন্ত সেই বাকীর খাতায় যাদের নাম আছে তারা আজ সকলেই রাজনৈতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু অরুনদা এখনও ক্যান্টিন চালায় । বাকীর খাতা হয়তো শুধু ইতিহাস হয়েই থেকে যাবে ।
©somewhere in net ltd.