রাজন হত্যা, আমাদের দায়

১৩ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:৪১

দু'পায়ের হিংস্র পশুর দ্বারা সিলেটের রাজন হত্যার ভিডিওটা আমি দেখিনি, দেখার 'দু:সাহস' করিনি। অনেকেই এটা দেখেছেন। ফেসবুক, ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করছেন। হত্যাকারী পশুদের বিচার চাইছেন। ভালো। এমন সচেতনতা ভালো। এতে ওই 'পশু'রা প্রেসারে থাকবে। ভতিষ্যতে এমন কাজের আগে তারা দশবার চিন্তা করবে।

বলবেন, কিন্তু আপনি এ ভিডিওটি দেখেননি কেনো? বলতে পারেন, আমার হার্ট 'দূর্বল'। এমন অমানবিক কাণ্ড দেখার 'সাহস' আমার হয়নি। যেমন দেখতে পারিনি ভারতের একটি চিড়িয়াখানায় বাঘের আক্রমনে নিহতো হওয়া সেই মানুষটির করুণ মৃত্যুর বিষয়টি। এড়াতে পারিনি এ হত্যায় আমাদের দায়।

তবে এবারের ভিডিওটি না দেখার আরেকটি কারন আছে। এ সমাজের যারা এখন রাজনের বিষয়টি নিয়ে লেখছেন, বা অন্যের লেখা শেয়ার করছেন, তাদের বেশীরভাগই কিন্তু এর আগে হরতাল, অবরোধের নামে বিএনপি, জামায়াতের নির্মম হত্যাকাণ্ডকে নীরব, বা প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছেন। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে, যে দেশের অনেক মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে 'নীরব সমর্থন' জানিয়েছেন, তাদের পক্ষে রাজনের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া মানায় না। কারন, তাদের নীরবকির কারনেই বিএনপি, জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট অনেক মানুষকে পুড়িয়ে মারার দু:সাহস দেখিয়েছে। আর সেখান থেকে উৎসাহিতো হয়ে এখন এরা রাজনকে মারার সাহস পেয়েছে! বিশ্বজিতের বেলায়ও হয়েছে একই কাহিনী।

এমন অনেক নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তো। অনলাইন, অফলাইনে লেখালেখির কারনে আমরা ইতোমধ্যে হারিয়েছি বিজ্ঞানমনস্ক কয়েকজন লেখককে। আমারদেশ'র মাহমুদুর রহমান গ্যাং বললেন, প্রচার করলেন ব্লগার মানেই নাস্তিক! আর তাদেরকে খুন করার জন্য চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো হায়েনার দল! এসবের সম্মিলিতো প্রতিবাদ আমরা দেখলাম না। এরা রাজন হত্যার প্রতিবাদ করছে, অথচ একইসঙ্গে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবদুল গাফফার চৌধুরীদেরকে ঠিক একইভাবে, পৈশাচিক কায়দায় খুনের জন্য লাফাচ্ছে, উন্মাদনা ছড়াচ্ছে, বৈধ ঘোষণা করে, ফতোয়া দিয়ে খুনের পক্ষে সাফাই গাইছে! সেজন্যই ওই হায়েনারা বারবার হত্যাকাণ্ড'র সাহস পাচ্ছে। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে। যুক্তির জবাবে যুক্তি, লেখার জবাব লেখা দিয়েই দিতে হবে। এই জানোয়াররা রাজনকে তার আত্নপক্ষ সমর্থন করতে না দিয়ে, তার বক্তব্য না শুনে 'চুরি'র অপবাদ দিয়ে যেভাবে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে আর যারা কোনো কথা, যুক্তির বিপরীতে হত্যা, 'কল্লা কাটা'র জন্য উন্মাদ হয় তাদের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না।

আরেকটা বিষয়, আজ যারা রাজনকে নিয়ে 'মায়াকান্না' করছেন, লেখছেন, বা অন্যের লেখা শেয়ার করছেন তাদের অনেকেই নিজের বাসায় রাজনের বয়সী কাজের কোনো ছেলে, বা মেয়ে নির্যাতিতো, বা এভাবে মারা গেলে ওই বিষয়টাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন! নিজেকে বাঁচানোর জন্য এমন কোনো কাজ নাই যা তারা করতে পারেন না! এটাকে আমার কাছে ভণ্ডামি মনে হয়। আগে মানসিকতা ঠিক করে আসুন আমরা মানুষ হই। যার যার অবস্থান থেকে মানবিকতার চর্চা শুরু করি। তবেই রাজনরা এভাবে হারিয়ে যাবে না অকালে, ঝরে পরবে না প্রস্ফুটিতো হওয়ার আগেই।

এর মানে আমি রাজন হত্যার বিচার চাই না, তা কিন্তু না। তবে এও জানি, আমাদের মানসিকতা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত, সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী না হওয়া পর্যন্ত খুনি পশুগুলো মানুষ হবে না। আর এ হত্যাকারীদের এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর এমন কোনো পশু জন্মাবার সাহস না পায়। অথবা খুন করে বিষয়টাকে ধামাচাপা দেয়ার চিন্তাও করতে না পারে। বিচারের পাশাপাশি রাজনের পরিবারকে এর জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়ারও ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও একটা জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। তারপরেও রাজনের পরিবারকে যেনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা, অভাবের কারনে তেরো বছরের এই শিশুটাই স্কুলে না গিয়ে সবজি বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছিলো। ছোটো ভাই, বোনদের মুখে খাবার দেয়ার চেষ্টার পাশাপাশি স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহতো রেখেছিলো। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর সেই আস্থা আমার আছে। তবে এ মানবিক বিষয়টা তার কাছে আরেকবার দেখতে চাই।

আহসান কামরুল
১৩.০৭.২০১৫ খ্রি.
ঢাকা।

৪ টি +০/-০