নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তোমাকেই জ্বালাতে হবে আশার রবি, সোনালি প্রভাতের রাঙ্গা ছবি, তোমাকেই আঁকতে হবে......
বেশ কিছু দিন ধরে একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, 'ইসলামি সাহিত্য' নামে এক উদ্ভট সাহিত্যের উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। মাদরাসাপড়ুয়া তালিবুলইলম, উস্তাদ, এবং মাদরাসা অংঙ্গনের সাহিত্যচর্চাকারীরা এই নয়া জীবটার আবিষ্কারক। তারা কথিত 'নাস্তিক-মুরতাদদের' কবল থেকে 'বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে' রক্ষা করতে এবং বাংলাসাহিত্যের 'ইমামতের মসনদে' আসীন হতে ভাষাভিত্তিক নতুন এই খেলাফতের ধারা চালু করেছে।
অনেকেই আবার সাহিত্য দিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে 'কলমি যুদ্ধ' চালিয়ে যান। সে যুদ্ধে ধর্মকেন্দ্রিক এক নূতন সাহিত্যের সৃষ্টি করেছেন।
সাহিত্যচর্চাকে ছোট দেখার বা সংকীর্ণ দৃষ্টিতে বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমেও আমরা দ্বীন প্রচার করি। কিন্তু সমস্যা হলো, কখনো কখনো চিরাচরিত অতি আবেগের বশে ও স্বীয় সত্ত্বার সৃষ্টিশীল দক্ষতার উপর অত্যধিক নির্ভরতার ফলে নূতন কিছু সৃষ্টি করার মানসে আমরা অনেক সময় বিষয়বস্তুর খেই হারিয়ে ফেলি। যার দরুণ নিজেদের অজান্তেই অনেক কিছুই বিচার-বিবেকের আয়ত্তের বাহিরে চলে যায়। এবং নতুন নতুন মত, পথ, মতবাদ ও অভিনব পরিভাষার জন্ম নেয়। কথিত 'ইসলামি সাহিত্য' তার মধ্যে একটি।
সাহিত্য দিয়ে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে।তার আচার-প্রকৃতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সমাজভাবনা, রাষ্ট্রচিন্তা ও শান্তিময় পৃথিবীর চিত্র তুলে ধরে সাহিত্য দিয়ে। সুস্থধারার লেখকেরা সমাজের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের দুঃখগাঁথা লিখেন। সমাজে প্রচলিত ভুল - ভ্রান্তি ও কুসংস্কার দূর করেন। ধর্মের নামে চালিয়ে দেয়া অধর্মের মুখোশ উন্মোচন করেন।
কিন্তু মনে রাখতে হবে সাহিত্যের নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নেই। সাহিত্যের প্রতিপাদ্য বা উপজীব্য হলো মানুষ, মানবতা, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী। 'ইসলামি সাহিত্য' বলে যে সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের জন্ম দেওয়া হচ্ছে বা হয়েছে এর শেষ পরিণতিটা কতো ভয়ংকর হতে পারে কেউ কি ভেবেছেন?
'ইসলামি সাহিত্য' বলে বাংলাসাহিত্যে যে ধর্মীয় গোত্র তৈরি করে, নিজেদের লেখা ও লেখক-মানসকে একঘরে করা হচ্ছে, বৃহত্তর ভাবনা ও মনোভাব থেকে সংকীর্ণমনা হচ্ছে তার কি খবর আছে? যারা 'ইসলামি সাহিত্য' বলে বাংলাসাহিত্যে দুটো ধারা ও ধারণা উদ্ভাবন করছেন এর অধিকার কে দিয়েছে ? কোথায় পেয়েছেন ?
অনেকেই মনে করতে পারেন, হিন্দু লেখকরা সাহিত্যকে 'হিন্দুয়ানি সাহিত্য' বানিয়েছে তাই মুসলিমরা 'ইসলামি সাহিত্য' রচনা করেছেন।আমি মনে করি এটা সাহিত্য সম্পর্কে ভুল ধারণা। কোথাও হিন্দু লেখকেরা সাহিত্যকে ভাগ করে 'হিন্দুসাহিত্য' বলতে বা লিখতে দেখেছেন?
আমাদের অনুকরণীয় মুসলিম সাহিত্যিকদের দেখেছেন, যে তারা 'ইসলামি সাহিত্য' লিখতে?
নজরুল বা অন্য কেউ?
আসলে ঘটনা ছিলো এরকম,
সেই যুগে মুসলমানরা শিক্ষা দীক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে ছিলেন। ইংরেজদের কৃপায় হিন্দুধর্মের লোকজন শিক্ষায় এগিয়ে গেলো। কিছু লোক সাহিত্যমনষ্ক হলো। তাদের বেশিরভাগই ছিলো হিন্দুত্ববাদী। ফলে তারা সাহিত্যকে যবনের মুণ্ডুপাতের অস্ত্র হিসেবে নিলো। রচনা করলো মুসলিমবিদ্বেষী 'দাঙ্গাবাজ সাহিত্য'। আর তারা সমাজের মানুষের প্রচলিত ভাষা বাদ দিয়ে বেদ-পুরাণের নাসিক্যঢঙ্গের সংস্কৃত ভাষাকে অবলম্বন করে একটা ধর্মীয় পৃথক ভাষা ও সাহিত্যের জন্ম দিতে চেয়েছিলো।
কিন্তু এতে তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি।কারণ, তাদের মধ্য থেকেই কিছু গুণীজন মহাত্মা, সত্যিকারের বাংলাভাষাপ্রেমী মহামানব এগিয়ে এসে মুসলিম সাহিত্যিকদের মতো করে সমাজে প্রচলিত মানুষের মনের ভাষা দিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন।
মুসলমান কবি সাহিত্যিকগণ 'ইসলামি সাহিত্য' নামে পৃথক কোনো ধর্মীয় সাহিত্যের জন্ম দেননি। বরং তাঁরা তৎকালীন সময়ে মানবসমাজে, রাষ্ট্রের সর্বত্রে যে ভাষার প্রচলন ছিলো, যে ভাষায় মানুষ পরস্পরের ভাব আদান-প্রধান করতো সেই ভাষাকেই তাঁরা সাহিত্যের রূপ দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন। বাংলাভাষা তথা বাঙ্গালির ভাষাকে হেফাযত করেছেন।
আর এই কাজটা করতে গিয়ে সংগত কারণেই অন্যান্য বিদেশি শব্দের সাথে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য দেখা দিয়েছে। কারণ, তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্র থেকে নিয়ে সর্বত্র আরবি-ফারসি শব্দের বহুল প্রচলন ছিলো হিন্দুস্তানের রাজভাষা ফারসি হওয়ার কারণে এবং বাঙালিদের মধ্যে ফারসি কবি-সাহিত্যিকদের প্রভাবের কারণে।
কথায় আছে, প্রজারা রাজার অনুগামী হয়। সে হিসেবে সাধারণ সমাজেও কথ্যভাষায় এগুলোর বেশ প্রভাব পড়েছিলো। যেমন বর্তমানে ওপার বাংলায় কথ্যভাষা বাংলার সাথে হিন্দির ওতপ্রোত গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ও বাংলাভাষায় হিন্দির সংমিশ্রণ ঘটেছে।এবং বাংলাভাষার সর্বশেষ রূপকে পাল্টে দিচ্ছে।
বাংলাভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহারের অর্থ এটা নয় যে, তাঁরা 'ইসলামি সাহিত্য' নামে নূতন কোনো সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বরং তাঁরা তো তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ভাষাটাকে একটা লিখিত রূপ দিয়েছেন। কিন্তু এখনকার নতুন প্রজন্মের সাহিত্যচর্চাকারীরা পূর্বসূরীদের রচনাধারাকে হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে ভেবে বসেছে যে, তাঁরা 'ইসলামি সাহিত্য' বলে নতুন কোনো সাহিত্যধারা চালু করেছিলেন।
মোদ্দাকথা, সাহিত্যে কোনো গ্রুপিং নেই। আজকে 'ইসলামি সাহিত্য' বলে নিজেদের অজান্তেই আরো কয়েকটা গ্রুপ তৈরির রাস্তা খুলে দেওয়া হচ্ছে।হিন্দুয়ানি সাহিত্য, খ্রিস্টানি সাহিত্য, বুদ্ধিস্ট সাহিত্য এমন আরো যতো আছে।
যেহেতু বিভিন্ন পরিচয়ের, ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের, বিচিত্র চিন্তাধারার এবং বহু ধর্মের মানুষ বাংলাভাষী, সেহেতু তারা নিজের মাতৃভাষায় তার আদর্শ ও ধর্মের চর্চা করতেই পারে।তার গোত্রের, তার সমাজের সংস্কৃতি তুলে ধরতেই পারে এবং সেসব তার অধিকারও বটে। তাই বলে সাহিত্য কেনো ধর্মীয় হতে যাবে? ধর্মকেন্দ্রিক হতে যাবে?
ধর্ম সাহিত্যকেন্দ্রিক হতে পারে তবে সাহিত্য ধর্মকেন্দ্রিক নয়।
দ্বিপ্রহর।
18/11/2017 ঈ.
©somewhere in net ltd.