নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তোমাকেই জ্বালাতে হবে আশার রবি, সোনালি প্রভাতের রাঙ্গা ছবি, তোমাকেই আঁকতে হবে......
খোদার সাথে বান্দার যে ভাব, খালিকের সঙ্গে মাখলুকের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, রাগ, অভিমান, অভিযোগ ও অনুযোগের যে হৃদয়ঙ্গম প্রকাশ ফারসি ও উর্দু শের-গযলে আছে, ভাবের দোলাচালে, হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে বাংলাভাষায় সেগুলো প্রকাশ করতে চেয়েছেন কবি এই কিতাবে। বেশ কিছু কবিতা পড়ে এমনটাই মনে হলো। ভাষা ও ভাষ্যের প্রতি খেয়াল করলে এটাকে স্থানান্তর নয়, সৃষ্টিই বলতে হবে। বাংলাভাষায় এই প্রচেষ্টা নিতান্তই কম বললে অত্যুক্তি হবে না। যেমন ধরুন, আমরা বাংলাভাষীরা মসনভির বাংলা তরজমা ও কালিদে মসনভির উর্দু ব্যাখ্যা পড়েই হয়তো ক্ষান্ত দেই। আপনা জবানে খোদার সাথে বান্দার তাআল্লুক যাহির করার কোশেশ কম দেখা যায়। (আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান মোতাবেক)। আর যা কিছু আছে, তা নিয়ে তো চুঁ-চেরার কমতি নেই। বাঙালি মুসলমানের হজমশক্তি ভয়ংকর কম। বাহ্যপুজার ছোবলে মরম হারিয়ে ফেলেছে। ধরতে পারে না।
সাধারণ হুকুমের বাইরে আল্লাহর সঙ্গে সব বান্দার তাআল্লুক এক হয় না। যার মধ্যে আবদিয়ত ও মহব্বতের জালওয়া বেশি সেই ততো নিকটতম। 'আদিষ্ট গোলাম'-এর স্তর অতিক্রম করে 'আবদিয়ত'- এর পথিক হয়ে খালিক-মাখলুকের প্রেমময় আলিঙ্গনই ইবাদতের চূড়ান্ত পর্যায়।
ফারসি ও উর্দুভাষী সুফি সাধক বুযূর্গগণ ইশক দেওয়ানার একটি ভাষা ও সাহিত্যরীতি সৃষ্টি করেছেন। আজো সে সাহিত্য চর্চা হয়, আলেমগণ করেন, অন্যরাও করেন। এই ক্ষেত্রে ফারসি উর্দুর যে পরিপূর্ণতা, সাহিত্য ভাণ্ডার, তাকে ছাপিয়ে যাওয়া মুশকিল। যুগে যুগে তার উৎকর্ষ বেড়েই চলছে।রুবাইয়াত, কাতা, হামদ, না'ত, শের, গযল, কাওয়ালি আরো হরেক প্রকারের শায়েরি! এগুলোর উদ্ভব দ্বিতীয় কোনো ভাষায় হয়নি। আহ কী মধুর! কত রংয়ের কত তরিকার প্রকাশভঙ্গি। পড়ার সময় মনে হয়, এই তো আমি-সে সামনাসামনি বলছি। শুনলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই। কেউবা হুঁশও হারিয়ে ফেলে জোশ ও জযবার উত্তাপে। আমার অডিও শোনার ধৈর্য্য নাই। তারপরও কিছু কিছু গযল শুনি। যেহেতু হজ্বের মৌসুম, মুহাম্মাদ রাফির কণ্ঠে এইটা বারবার শুনি! আহ! কী কথাগুলোই না বলছে। খালি অনুভব করা যায়।
"আগার মিল গাঈ মুঝকো রাহে মাদিনা/মুহাম্মাদ কা নকশে কদম চুম লোংগা!"
বারবার শুনতেই মন চায়।
মুফতি তাকি উসমানি সাহেব লিখেছেন, আরবের অনেক উলামায়ে কিরাম ফারসি ভাষা শিখেন রূমিকে পড়ার জন্য! আমার পরিচিত, আধা পরিচিত অনেকেই আছেন যারা ফারসি-উর্দু শিখেছেন, শিখছেন। এক বড় ভাই তো চবি থেকে ফারসি ভাষায় অনার্স শেষ করলেন কিছু দিন হলো।
মূল কবিতায় যে ভাবাবেগ ও আবেদন থাকে তার অর্থ ও মর্ম অনুবাদ করে প্রকাশ করা অসম্ভব। একে তো কবির দিলে ইশকের যে লহরি-জোশ থাকে তা অনুবাদকের দিলে উঠবে কিভাবে! দুজনার যে দুই হৃদয়!
দ্বিতীয়ত আমাদের ভাষা ও সাহিত্যে এসবের চর্চা খুবই অপ্রতুল। আমাদের ভাষা কাইড়া নিয়া ইশক ও মহব্বত, ভাব-আবেগের আধ্যাত্মিক প্রকাশের যে ভাষারীতি ছিলো, ফোর্ট উইলিয়ামের গারদের ভিতর তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। এজন্যই হয়তো আবুল মনসুর সাহেব আমাদের জন্য স্বতন্ত্র ভাষা তৈরির জোর দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালির ভাষার ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াবে! নাসিক্য সুরের প্রলেপে তৈরি ভাষা দিয়া ভাব প্রকাশ করা যায় না। ইশকের ভাষার কায়দা আলাদা, প্রকাশভঙ্গি ভিন্নতর, লফযের প্রয়োগরীতি আনোখা। এখানে 'আঁখে আঁখে আঁখ মিলা কর, ইশারাহ সে কাম লিয়া জাতা হ্যায়!'
যেমন ধরুন,
"নকশ ফরিয়াদি হ্যায় কিস কি শওখিয়ে তাহরির কা/ কাগজি হ্যায় পেয়রাহান হার পেয়করে তাসবির কা!"
এখানে খোদার সাথে বান্দার যে ভালোবাসা ও অনুযোগ, আল্লাহর আদি ও বান্দার অনাদি, মালিকের দরবারে গোলামের হাজিরির যে প্রকাশ করেছেন গালিব, তা বাংলায় তরজমা কেমনে করবো? এই বিখ্যাত গযলের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলে ছোটখাটো পুস্তিকা হয়ে যাবে!
যা শুধু অনুভব করা যায়।
আমাদের ভাষাকে যেভাবে পঙ্গু বানানো হয়েছে, ভাব প্রকাশের ভাষাকে বিদায় করা হয়েছে, তাতে এসব আধ্যাত্মিক মর্মভাব প্রকাশ করা কঠিন।
কিংবা,
"রগোঁ মে দৌড়তে ফিরনে কে হাম নেহি কায়েল/ জব আঁখ সে হী না টপকা তো ফির লাহূ কিয়া হ্যায়!"
এখানে গালিব শরীরের রক্ত নিয়ে যে ভাব প্রকাশ করা হয়েছে তার তরজমা আপনি কী করবেন? যে অর্থ ও মর্ম এখানে তা অনুবাদ দিয়া কেমনে প্রকাশ করবেন?
এই যে এতো কথা বললাম, খুব যে চর্চা করি এমনটা ভেবে ধোঁকা খাবেন না। টুটাফাটা যা পড়ার সুযোগ পাই সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কিছু আরজ করলাম। এতো আহামরি কিছু না।
শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহার সাহেবের 'এবাদতনামা' পড়ার সময় এই কথাগুলো মনে আসলো। তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন আমাদের একটি ভাষা হাজির করতে। বাংলাভাষায় ভাব-আবেগ প্রকাশের বয়ান কিভাবে হবে তার একটা অবকাঠামো নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এটি একটি জরূরি ও তাজদিদি কাজ। এই তরিকায় আরো রচনা দরকার। সমৃদ্ধ করা দরকার আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডার।
পুরাটা পড়তে হবে, বিসমিল্লাহ...........
©somewhere in net ltd.