![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার নাম আয়শা আক্তার। মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে যারা নিয়মিত যান তাঁরা কেউ কেউ আমাকে চেনেন। ভালো নার্স হিসেবে দুই-চারজন আমাকে খাতির করেন। আমি নিজেকে ভালো নার্স মনে করি না। কারণ আমি ভালো সেবা দেই না। রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি। তাই আমি ভালো নার্স। আর যেটুকে সেবা একজন রোগীর পাওয়া দরকার, তা সব নার্সই করে। বেশি সেবা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক রোগী থাকায় আমরা পারি না।
হাসপাতালের তিনতলায় উঠে ডানদিকে এলে আমাকে পাবেন। কেমোথেরাপি দেওয়ার দুটো ওয়ার্ড আছে। একটাতে রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। যাদের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ, যারা তেমন চলাফেরা করতে পারে না, তারা ভর্তি হয়। এখানে থাকে। অন্যটাতে যাদের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তারা বাসা থেকে এসে-যেয়ে থেরাপি নেয়।
আমার ডিউটি দুই কেবিনেই থাকে। যেদিন আমি ভর্তি কেবিনে থাকি, সেদিন কাজ বেশি থাকে । রোগীকে বেশি সেবা দেওয়া লাগে। বেশিরভাগ রোগী খুব দুর্বল হয়। এপাশ থেকে ওপাশে ফিরতে পারে না। মুখে কথা জড়িয়ে যায়। তাই সেবার বাইরে আমাদের অন্য কিছু ভাবার সময় থাকে না।
এক মঙ্গলবার সকালে আমি ডিউটিতে চলে এসেছি সাতটার আগে। কাপড় বদলে হাসপাতালের পোষাক পরলাম। আজ আমার ডিউটি সাধারণ ওয়ার্ডে। প্রতিদিনের মতো লোকজনের অনেক ভীড়। মানুষের ছোটাছুটি আর শব্দে ভরে আছে।
ঠিক সকাল আটটায় রোগীদের জন্য ওয়ার্ডের দরজা খুলে দিয়েছে দারোয়ান। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন স্রোতের মত ঢুকেছে। মরা স্রোতের মতো এক একজন এক একটা সিটে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কেমোথেরাপি দেওয়ার সময় রোগী ছাড়া অন্য কেউ থাকা নিষেধ। আমি খানিক পরে রোগীর আত্মীয়দের কেবিনের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য বললাম। কেউ কানই দিল না। যেন শুনতে পায়নি। প্রতিদিন এমন হয়। আমরা যা বলি, কেউ তা শোনে না।
চল্লিশটা সিট আছে এই কেবিনে। রোগীরা যার যার সিটে কেমোথেরাপি নেওয়ার জন্য শুয়ে আছে। অপেক্ষা করছে নার্সদের জন্য। রোগীর আত্মীয় স্বজন ভীড় করে আছে বেডের চারপাশে। আমরা আমাদের স্যালাইনগুলো ঠিকঠাক আছে কি না দেখছি। আমরা চারজন নার্স এই ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছি। দশটা করে বেড প্রতিজনের দায়িত্বে। চারজনের মধ্যে আমি বয়সে বড়। প্রায় বিশ বছর ধরে নার্স হিসেবে কয়েকটা হাসপাতালে সেবা দিয়েছি। অন্য তিনজন আমার তুলনায় বেশ কম বয়সের। সব থেকে ছোট মেয়েটার নাম লিজা। লিজা প্রতিদিনের মতো সিকিউরিটি গার্ডদের দুইজনকে ডেকে আনে। তারা রোগীর আত্মীয়দের কেবিনের বাইরে বের করে দেয়।
লিজা আমার কাছে ছুটতে ছুটতে আসে সকাল নয়টার দিকে। অদ্ভুত এক লোককে দেখায় লিজা। ওর দায়িত্বে থাকা ছয় নম্বর বেডে অনিক সরকার নামে এক বৃদ্ধ প্রথমবারের মতো কেমো নিতে আসে৷ বেশ বয়স্ক লোক। কাঁচা-পাকা চুল। ছিপছিপে শরীর। দেখে অসুস্থ মনে হয় না। সবাই শুয়ে থাকলেও লোকটা নাকি বসে ছিল। সঙ্গে কেউ নেই। লিজা এক এক করে আগের পাঁচজনের স্যালাইন চালু করেছে। এরপর ও লোকটার কাছে এসে তাকে শুয়ে পড়তে বলেছে। লোকটা শুয়ে পড়ার পরে ঘটনা শুরু হয়।
লিজা নাকি প্রথমবার ওনার শিরাটা খুঁজে পায়নি। ক্যানেলা লাগানোর সময় আমরা সাবধান থাকি। সুঁই ফোটানোর সময় আমরা একবারেই শিরা খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। রোগীকে ব্যাথা না দিয়ে কাজ করা নার্সের দায়িত্ব। লিজা দ্বিতীয়বার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার এক ফোঁটা রক্ত লিজার হাতে লেগে যায়। স্যালাইন চালু হয়। এক ফোঁটা রক্ত দেখে লিজা আমার কাছে ছুটে আসে। হাতের কাজ সাড়ার অপেক্ষা না করে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। অবাক হয়ে লিজার সঙ্গে আমাদের ছোট্ট বিশ্রাম করার রুমে যাই। ও আমাকে দেখায় ওর হাতে লেগে থাকা একটু নীল জায়গা। আমি অবাক হই। নীল লেগেছে কোনভাবে। জিজ্ঞেস করি, কী? লিজা বলে, "রক্ত"। আমি বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করি, কই? ও আঙ্গুল দিয়ে নীল রঙের জায়গাটুকু দেখায়। ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
আমি অনিক সরকারের বেডের কাছে যাই। অনিক সরকার আমাকে দেখে উঠে বসে। আমার হাত ধরে বলে, আমি অসুস্থ। অনেক দূর থেকে তোমাদের কাছে এসেছি। আমার ক্ষতি করো না। আয়শা আমাকে বাঁচাও!
আমি তাঁর কথা ঠিক বুঝতে পারি না। আমি সিরিঞ্জ দিয়ে একরকম জোড় করে একটু রক্ত টানি লোকটার হাত থেকে। লিজা আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। আমার মাথা ঘুরায়। অথচ আমি বিশ বছরের অভিজ্ঞ নার্স। রক্ত দেখে আমার কখনো মাথা ঘুরায় না।
এই লোকের পাশের বেডে এগারো বছরের একটা মেয় পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করে। মেয়েটার কোলন ক্যান্সার এই বয়সেই। আগেও দুইবার এসেছে। বয়স কম থাকায় আমি মেয়েটাকে খেয়াল করেছি আগে। একটু মায়াও ছিল। মেয়েটা একটা মরণ চিৎকার দেয়। নীল রক্ত!
মেয়েটার বাবা ওয়ার্ডের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে ছুটে আসে মেয়ের কাছে। মেয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় লোকটাকে। মুখে আবার বলে ওই লোকটার গায়ে নীল রক্ত! এরপর কেমন করে জানি অনেক ভীড় জমে যায়। আমি লিজাকে আর দেখতে পাই না৷ চোখে অন্ধকার দেখি। কী করব বুঝতে পারি না। এরই মধ্যে কেউ লোকটার হাতের সেলাইনের পাইপ খুলে ফেলেছে। আরেকজন টান দিয়ে খাট থেকে নামিয়ে ফেলেছে। টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেছে। একদম বিল্ডিংয়ের বাইরে।
লোকটা তখনো বিরবির করছে। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আমায় মেরো না আয়শা।
আমি নার্সিং সুপার ভাইজারকে ফোন করলাম। বললাম, এক রোগীকে লোকজন বাইরে টেনে নিয়ে গেছে। সুপারভাইজার আমাকে বললেন, তোমরা কী করলা?
আমি ফোন রেখে দৌঁড়ে তিনতলার বারান্দায় এলাম। নিচে উঁকি দিয়ে দেখি খুব ভীড়। শতশত মানুষ লোকটার ওপর হামলে পড়েছে। মারছে। খামচি দিচ্ছে। চিড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। একজন কলা বিক্রেতার হাতে দেখলাম কলার ছড়া কাটার ছোট্ট ছুড়ি। কলাওয়ালাকে আমি আসতে যেতে প্রতিদিন দেখি। ফুটপাথে কলা বিক্রি করে। নিরীহ গোছের মানুষ। আজ অন্য রুপ দেখলাম।
কলাওয়ালাসহ শতশত মানুষ লোকটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলছে। ছিটকে ছিটকে বের হচ্ছে নীল তরল। মানুষজন দুই কোশে রক্ত নিচ্ছে। মুখে গায়ে মাখছে। আমি মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
চোখ খুলে দেখি আমি আমাদের পাশের ওয়ার্ডের একটা বেডে শুয়ে আছি। মাথার পাশে লিজা বসে আছে। চারপাশে উজ্জ্বল আলো। বাইরে রাত হয়ে গেছে মনে হল। জ্ঞান ফিরেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকটার কী হল?
সব শেষ হয়ে গেছে। পুলিশ এসে নিয়ে গেছে। লিজা জানাল।
কেমোথেরাপি দেওয়ার আগে ক্যান্সার নিশ্চিত কি না জানার জন্য অনেকগুলো পরীক্ষা করতে হয়। লোকটা এগুলো পার করল কীভাবে? নীল রঙের রক্ত নিয়ে এসব পরীক্ষা পার করা সম্ভব না। নাকি অন্য কারো বদলে এখানে এসেছে? লোকটা এলই বা কোত্থেক? আমি জানি না। ক্যান্সার হাসপাতালের কেউ জানে না।
পরদিন সকালে হাসপাতালের সবাইকে আস্বস্ত করে লিজার হাত ধরে নিচে নামলাম। দুইদিন ছুটি নিয়েছি। বেড রেস্ট দরকার।
জায়গাটা পুলিশের ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা। দুইচারজন কৌতুহলী মানুষ আশপাশে ঘুরঘুর করছে। পাশেই একটা কুকুর মুখ নামিয়ে শুয়ে আছে। এখনো হালকা ভেজা রাস্তার কালো পিচ। চকচক করছে। লোকটার কিছুই নেই। শুধু পড়ে আছে একটা ক্যানোলা। একদম নীল।
আমার কানে বাজতে লাগল লোকটার গলা। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আমাকে মেরো না আয়শা। লোকটা অনেক দূরে চলেও গেছে।
©somewhere in net ltd.