![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একটি উপহার চাই আপনার কাছে
রেহনুমা বিনতে আনিস
তারিখ: ১১ এপ্রিল, ২০১৩
আর মাত্র ক’দিন পর আমার মেয়ের বয়স তেরো হবে। তেরো বছর আগে স্বাধীনতা দিবসের পরদিন সে পৃথিবীতেএসে পৌঁছল। এ কঠিন দিনও একসময় কেটে গেল। স্কুল ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলাম। মেয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন হাঁটতে শুরু করল। দেড় বছর বয়সেই নিজের হাতে ভাত খেতে শিখে গেল, দুই বছর বয়সে কাপড় পরা। তিন বছর হতে না হতেই সে মাতৃরূপে আবির্ভূত হলো। আমি খেতে বসলে চামচ দিয়ে তরকারি বেড়ে দেয়, খেলা শেষ করে নিজেই তুলে রাখে খেলনা, মাথাব্যথা করলে চুপচাপ পাশে বসে থাকে যদি কিছু প্রয়োজন হয়।
যে মুহূর্তে আমার মেয়ে জন্ম নিলো তখন থেকেই একটা ভাবনা আমার ভেতর বড় হচ্ছে। মেয়েটিকে আমি এত কষ্ট করে বড় করে একদিন কারো হাতে তুলে দেবো। হয়তো সে ওকে আমার মতো ভালোবাসবে না, যতœ কিংবা মূল্যায়ন করবে না। হয়তোওর লেখাপড়া, যোগ্যতা বা অন্য কোনো মাপকাঠি ওর সম্মান নিশ্চিত করতে পারবে না; যদি না তারা ওকে ভালোবেসে আপন করে নেয়। আমার এত আদরের মেয়েকে কেউ কষ্ট দেবে, তা ভাবতেই হৃদয়ে রক্তরণ হয়। স্বামীর পরিবারে সবাই যদিসহনশীল ও সহানুভূতিশীল নাহয়, তাহলে স্বামী ভালো হলেও কি কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? এমন অনেক ভাবনাই তাড়িত করে আমাকে।
তবুও মেয়ে যত বড় হচ্ছে, মনে হয় যেন ওকে নিয়ে আমার পরিশ্রম আর স্বপ্ন ততই পূর্ণতার কাছাকাছি যাচ্ছে। ও যখন আমার জামা পরে তখন এর মধ্য দিয়ে এই পূর্ণতার প্রতিবিম্ব অবলোকন করেই হয়তো আনন্দেউদ্বেল হই। ভাবছিলামÑ একজন সরকারপ্রধান, বিশেষ করে যিনি নিজে একজন মা, যিনি তার সব নাগরিকের প্রতি সমভাবে মাতৃসুলভ, তিনি এই বাংলাদেশের কল্যাণ এবং উন্নয়নে কতটাআবেগাপ্লুত হওয়ার কথা! কিন্তু গত কয়েক মাসে আমার জন্মভূমিতে বহু মা সন্তানহারা হয়েছেন, অকালে বিনষ্ট হয়েছে অনেকসম্ভাবনাময় জীবনÑ এটাকেকিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? তেরো বছর বয়সের কন্যাকে নিয়ে আমার কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা। তাহলে যে মায়েরা এতগুলো বছর ধরে সন্তানদের নিয়ে না জানি কত স্বপ্ন বুনেছিলেন, কত আশার প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন, তাদের কেমন লাগছে? যে পুলিশ ভাইটি মারা গেলেন, সে যেমন এই বাংলা মায়ের সন্তান; যে ছেলেটি আল্লাহ এবং তার রাসূল সা:-এর ভালোবাসায় উদ্বেল হয়ে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মারা পড়ল, সে-ও তো এই বাংলা মায়ের সন্তান। ওরা কেন পরস্পরকেমারছে? কেন ভাবছে না, ওরা তো আমারই দেশবাসী, ভাই, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুবান্ধব?!
মনুষ্যত্বের মৃত্যু মানুষের মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি মর্মান্তিক, পীড়াদায়ক। আদর্শের মৃত্যু তার চেয়েও বেশি হৃদয়বিদারক। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মাঝে যে চেতনা কাজ করেছে, তা ছিল যেকোনো মূল্যে দেশকে মুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকারপ্রধান ছিলেন,তিনি তালিকার পর তালিকা করেও কেন রাজাকারের শাস্তির ব্যবস্থা করেননি?কারণ স্বাধীনতার পর বহু রাজাকারকে স্থানীয় জনগণইমেরে ফেলে। পাঁতি রাজাকারদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার পরিবর্তেতিনি চেয়েছিলেন জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে সমুন্নত করতে। তার এই সিদ্ধান্তেরফলে পরবর্তী চল্লিশ বছর আমরা একটি এক ও অভিন্ন জাতি হিসেবে মোটামুটি মিলেমিশেই থেকেছি। আজ চল্লিশ বছর পর পুরনো ক্ষত আবার কেন জেগে উঠল? বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতাকর্মীদের অন্যায় অত্যাচার অনাচার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে দমননীতি এবং বাকস্বাধীনতা রহিত করার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তার দলের লোকজন জানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধুয়া তুলে তারা এক দিকে রাজনৈতিক প্রতিপকে কুপোকাত করতে পারেন, অপর দিকে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারেন। নইলে প্রধানমন্ত্রী নিজে সবার আগে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতেন এবং তার কন্যাকে রাজাকার পরিবারে বিয়ে দিতেন না। তিনি নিজেই স্বীকার করতেন, দেশের সব রাজাকার কেবল তার প্রতিপ দলের সদস্য হতে পারে না এবং কয়েকজন বুড়োকে ফাঁসি দিলেই বাংলাদেশের ঘাড়ে যে কোটিটাকার ঋণের বোঝা, তা লাঘব হবে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির উত্তরণ হবে না কিংবা উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাটের কলঙ্কÑ দূর হবে না। কিন্তু দেশপ্রেমের ধ্বজাধারীরা দেশের আইনশৃঙ্খলাকে কাঁচকলা দেখিয়ে আদালত অমান্য করেআল্লাহ, রাসূল সা: এবং ইসলামকে হেয় করে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেবসল। পুলিশ বাহিনীকে নামাতে গিয়ে দেশে গণহত্যা শুরু হয়ে গেল।
তাই ভাবি, আমরা কেন বুঝতে পারছি না এদিকে আমরা মারামারি করে মরছি আর ওদিকে এমন কেউ ফায়দা লুটে যাচ্ছে যারা এই দেশটাকে ভালোই বাসে না। কেন আমরা এক হয়ে দেশটার জন্য কাজ করতে সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি না? কেন আমরা ভাই, বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সাথে এমন বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করছি? কেন অকালে ঝরে যাচ্ছে এমন সব তাজা প্রাণ, যাদের একাত্তরে জন্মই হয়নি, যারা এই দেশটাকে ভালোবাসতে শিখেছে কেবল।
আমার শৈশব বিদেশে কেটেছে।দেশের রাজনীতির ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না; কিন্তু ছোটবেলা থেকে বাবা চাচা দাদার মুখে মুক্তিযুদ্ধেরগল্প শুনতে শুনতে দেশটাকেভালোবাসতাম। সাথে ছিল আমার বামপন্থী পরিবারের আদর্শÑ আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিার গোড়াপত্তন। দেশ থেকে বই আসত ভূরিভূরিÑ গল্প, উপন্যাস,কবিতা, বিজ্ঞান, ইতিহাস আরমুক্তিযুদ্ধের বই। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনেক বইÑ পড়তে পড়তে মনে হতো আমিও স্টেনগান নিয়ে যুদ্ধ করছি শত্রুপরে সাথে, কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে গাদাবন্দুক উঁচিয়ে রেখেছি শত্রুর দিকে তাক করে! ভারতে ছিলামকয়েক বছর। আমাকে একদিন আমার ভারতীয় প্রতিবেশী, বান্ধবী অর্চনা এসে খুব খুশি হয়ে বললÑ ‘জানো, আমরা তোমাদের ফারাক্কায় পানি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমরাই তো বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, তাই এটা আমাদের অধিকার!’ হঠাৎ আমার চেহারার দিকে নজর পড়ায় সে ভয় পেয়ে গেলÑ ‘স্যরি, তুমি প্লিজ, আমার ওপর রাগ কোরো না। এগুলো আমাদের কাসে শেখানোহয়েছে। আমি ভেবেছি, তুমিও জেনে খুশি হবে!’
দেশকে ভালোবাসি, তাই দেশের এই করুন অবস্থা সহ্য করতে পারি না; যেখানেএক ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয় আরেক ভাইয়ের হাত, যেখানে নিত্য ঝরে পড়ে মুকুলিত
©somewhere in net ltd.