নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।।

অংকনের সাতকাহন

আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।।

অংকনের সাতকাহন › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরী ( একটি সাতকাহনীয় অণুগল্প )

২৫ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩৬

পরী__________$$



পরীর মার চোখেমুখে আজ এক অন্যরকম বিষণ্ণতা খেলা করিতেছিল। তাহার কোন কাজেই মন লাগিতেছিল না। যথারীতি সকল কার্য সমাপনের তাগিদে প্রবৃত্ত হইলেও তাহার উৎকন্ঠতা ও অন্যমনষ্কতা ঠিকই তাহার সকল কার্যে বিকটভাবে প্রতীয়মান হইতেছিল। চুলায় ভাতের জন্য পানি চড়াইয়া প্রায় আধঘন্টাখানেক জ্বাল দিবার পরেও পানি না ফুটিতে দেখিয়া অতঃপর সে খেয়াল করিল সে চুলায় অগ্নিসংযোগ করিতে ভুলিয়া গিয়াছে। মাছ কাটিতে গিয়া দীর্ঘ আটাশ বৎসরকাল যাহা ঘটে নাই তাহাই ঘটিল। এক মাছ কাটিতে গিয়া সে আজ বার চারেক তাহার হাত কাটিয়া ফেলিল। আজ কিছুতেই কোনপ্রকারে তাহার মন লাগিতেছিল না।



মেমসাহেবের সিল্ক সাটিন কাপড়গুলি ধুইবার সময় অন্যদিন সে প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করিলেও আজ তাহার সেইদিকে মনোনিবেশ করিবার অবসরও রহিল না। এমনকি কাপড় কাঁচিতে গিয়া সাবানের জলে তাহার হাতের নব্য কাটা ঘাগুলিতে যে জ্বলন অনুভূত হওয়ার কথা তাহাও আজ তার মরমে পশিল না।



তাহার মন আজ পড়িয়া আছে চাঁনমিয়ার বস্তির এককোণে কোনরকমে অন্তঃপুরের সম্ভ্রমটুকু হাতে করিয়া জবুথুবু দাঁড়াইয়া থাকা একখানা জীর্ণ ঘরে। সেই ঘরে পনের দিনের জ্বর প্রাণে ধরিয়া অর্ধচেতন হইয়া শুইয়া আছে তাহার এ জগতসংসারের একমাত্র যক্ষের ধন। তাহার পরী।

ষষ্ঠবর্ষীয়া পরী ব্যতীত তাহার রক্তসম্পর্কেই কেহই আর তাহার তিনকূলে নাই। স্বামীরত্ন তাহার গর্ভে পরীকে সমর্পণ করিয়াই তাহার দায়িত্ব সম্পাদন করিয়াছেন ভাবিয়া নুতন দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে রাতের অন্ধকারে তাহাকে ফেলিয়া করিমনের হাত ধরিয়া সেই যে চম্পট হইয়াছে সে অবদি মিনসের চেহারাখানা দেখিবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই তাহার হয় নাই।



প্রেম করিয়া বিবাহ করিয়াছিল সে।

মানুষটা চিনতে বড় বেশি ভুল হইয়া গিয়াছিল তাহার। কিন্তু মানুষটা যাওয়ার সময় বিশ্বাসের সাথে সাথে তাহার সে যাবতকালের সঞ্চিত সমুদয় সঞ্চয় লইয়া যাইতে ভুল করে নাই।



বাকি যেটুকু ছিল তাহাও লুন্ঠিত হইতে সময় লাগে নাই। পরী এবং তাহার ভরণপোষণের নিমিত্তে সে বস্তিতে আসিয়া মাথা গোঁজে কোন প্রকারে বস্তি সর্দারের হাতে পায়ে ধরিয়া। বস্তিরই আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে সে একখানা পোশাক কারখানায় চাকুরী জুটাইয়া লয়। স্বপ্ন দেখিতে সে বড়ই ভালোবাসে। আবার সে স্বপ্ন ভাঙিতেও তার বেশি সময় লাগে না। সুযোগের সদ্বব্যবহার করিয়া তাই আপিসেরই বড়কর্তা তাহাকে ফুসলাইয়া রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখাইয়া যখন শব্দনিরোধক কক্ষের রোশনাইয়ে তার রূপসুধা আর যৌবন চিঁড়ে খায় নিজের আর্তনাদের সাথে স্বপ্নভাঙার আওয়াজটাও বেশ স্পষ্ট শুনতে পায় সে।



তারপর থেকেই সে এই বাড়িতে কাজ করে। এ বাড়ির সাহেব লোকটাও যে বড় সুবিধার তা নয়। তবে বউয়ের উপস্হিতিতে বড় একটা সুবিধা করিতে পারে না ভদ্রবেশী হায়েনা। তবে সুয়োগে আবডালে যত্রতত্র হাত বুলাইয়া দিতে বিন্দুমাত্রও কার্পন্য করেন না ভদ্রলোক। তবু পরীর মা সহিয়া যায় সব। সে এতদিন আর কিছু না হোক এটা নিশ্চিত শিখিয়াছে পুরুষ মাত্রেই কুত্তা আর মাংস পাইলে সে চাটিবেই। তাই আর প্রতিবাদ করিয়া উপবাসী থাকিবার চাইতে পরীর আদুরে মুখখানাতে দু’মুঠো ভাত তুলিয়া দেয়াটাই সে তার করণীয় স্হির করিয়াছে।

তাছাড়া প্রতিবাদ করিয়া হইবেটাই বা কি? মেমসাহেব তো আর সাহেবকে ঘর হইতে বাহির করিবে না, বরং তাহাকেই ছুঁড়িয়া ফেলিবে রাস্তায়। তাই সে সম্মানের মায়াটুকু অবহেলায় ছাড়িয়া দিয়াছে মাংশাসী জানোয়ারের লোলুপ থাবায়। সে শুধু পরীর মুখে ক্ষুধা নিবৃত্তির হাসি দেখিয়াই খুশি।



সে পরীই যখন জ্বরের ঘোরে কাঁপিতেছআর অবিরাম কাঁদিতেছে তাহার এহেন উচাটনতা তো স্বাভাবিকই। ডাক্তারবাবু ঝুপরিতে আসতে চাহেন নাই। সে শুধু ডাক্তারের পায়ে ধরিতে বাকি রাখিয়াছে। তাহাও ধরিত, কিন্তু ডাক্তার ছি ছি করিয়া পা সরাইয়া নেওয়াতেই পারে নাই। অতঃপর উপযুক্ত পারিশ্রমিক গণিয়া লইয়া রোগী না দেখিয়াই ডাক্তার সাহেব কয়টা অষুধ দিয়া কহিলেন খাওয়াইয়া দিতে। পরীর মা সে অষুধ পীরের তাবিজের মতই মাথায় ঠেকাইয়া গ্রহন করিয়াছে এবং নিয়মিত খাওয়াইয়াছে। কিন্তু পরীর স্বাস্হ্যের কোনরূপ উন্নতি এই দুই সপ্তাহকাল সময়ে দৃশ্যমান হয় নাই।

পরীর দিকে তাকানো যায়না। হাড় কয়খানা যেন চামড়ায় জড়াইয়া প্রাণকে অস্বীকার করিবার উপক্রম করিয়াছে। দ্বিতীয়বার ডাক্তার বাবুর পারিশ্রমিক জোগাড় করিবার সৌভাগ্য তার হয় নাই। আর বলাই বাহুল্য লক্ষ্মীদর্শন ব্যতীত ডাক্তার সাহেবেরও অষুধ বিতরণের বদখেয়াল হয় নাই। গতকাল সারারাত পরী কাঁপিয়াছে আর আবোল তাবোল বকিয়াছে। শরীর ছুঁইলে মনে হইতেছিল চায়ের কেতলি তাহার শরীরে রাখিয়া দিলে কিছুসময় পরে তাহা ফুটিতে আরম্ভ করিবে।



এহেন পরিস্হিতিতে আজ কাজে আসিতে তাহার বিন্দুমাত্রও প্রাণে চাহে নাই। তবুও আসিতে হইয়াছে কারণ মেমসাহেব বারবারকরিয়া বলিয়া দিয়াছেনআজ আসিতেই হইবে। কেননা, কালি রাত্তিরে সাহেবের আপিসবাবুদের দাওয়াত ছিল সাহেবদের বাসায়। তাই তার সমস্ত আবর্জনা সাফ করিতে পরীর মাকে তাহার চাইই চাই।

তাছাড়া আজ বেতন পাইবার দিন। না আসিলে সেইখানাও হাতছাড়া হইত। পরীকে ডাক্তার দেখানো দরকার। ঠিক করিয়া রাখিয়াছে সে আজ জলদি কাজ সারিয়া ফিরিবে। আর পরীকে ডাক্তারের কাছে লইয়া যাইবে।



কিন্তু মেমসাহেবকে ছুটির কথা বলিতেই উনি এমনভাবে তাকাইলেন যেন কেউ তাহার হৃদপিন্ডখানাই চাহিয়া বসিয়াছে। সচিৎকারে বলিলেন, হারামজাদী! কাজের কথা কহিলেই বাহানা করিস! মেয়ের অসুখ না ছাই। নিশ্চয়ই কোন নাগর নিয়া সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখিতে যাইবি। সে হইবার নয়। সমস্ত কাজ শেষ করিবি তারপর যেখানে খুশি মরবি মর গিয়ে। রাতের সব প্লেট ধোয়া চাই, সাথে সবার কাপড়, রান্নাবান্না শেষ করিবি, ঘর ঝাড়মোছা...

আরো ডজনখানেক কাজ একনিঃশ্বাসে বলিয়া তবে তিনি থামিলেন।

পরীর মা বলিতে গেল, কিছু কাজ নাহয় কাল…

তাহার কথা মুখ হইতে পুরোপুরি বাহির হইবার আগেই মেমসাহেব গলা ফাটাইয়া কহিলেন, তাহলে বেতনের কথা ভুলিয়া যা মুখপুড়ী। টাকা কি আকাশ থেকে পড়ে? বলিয়া মুখ ঝামটাইয়া চলিয়া গেলেন।



কাজ করিতে করিতে বেলা গড়াইয়া সাঁঝ হইল; তবু কাজের পাহাড় অটল। পরীর মার সর্বাঙ্গ ঘামে জবজব করিতেছে। তার মন বেশ কিছুক্ষণ ধরিয়াই বড় আনচান আনচান করিতেছিল পরীর কথা ভাবিয়া। মাইয়াটা কি করিতেছে কে জানে! পাশের ঝুপরির জরিনারে বলিয়া আসিয়াছিল পরীরে একটু দেখিয়া রাখিবার জন্য। জরিনা পরীকে কিছু খাওয়াইয়াছে কিনা কে জানে!

তাহার ইচ্ছা করিতেছিল সব ছুঁড়িয়া ফেলিয়া ছুটিয়া যাইয়া পরীকে জড়াইয়া ধরে।জড়াইয়া ধরিবে আর কাঁদিয়া কহিবে, মা, আমি আইসাছি। চক্ষু মেইল্যা দ্যাখ।

পরী তাহার ডাঙর চক্ষু দুইখান মেলিয়া কইবে, মা আইছস! মা, কই ছিলি? দ্যাখ, তুই আমারে বুকে নিছস- মোর আর কুনো কষ্ট নাই।



পরীর মার চোখ ভিজিয়া উঠিল আর তার একফোটা ভাতের তপ্ত মাড়পানিতেটুপ করিয়া পড়িয়া হারাইয়া গেল। এখন তরকারি চুলায় চড়াইয়া দিয়াই তার ছুটি। সে একছুটে তার পরীর কাছে যাইবে।



এমন সময় বেল বাজিয়া উঠিল।

দরজা পরীর মা-ই খুলিতে গেল। খুলিতেই- এ কি! জরিনা!

পরীর মার বুক ছ্যাৎ করিয়া উঠিল। অসুখ বাড়ে নাই তো!

: কি অইছে জরিনা? তুই এহানে ক্যা?

: পরীর মারেএএএএ...

কহিয়াই জরিনা চোখের পানি ছাড়িয়া দিল। পরীর মা চিৎকার করিয়া কহিল, কি অইছে? ক আমারে!

: পরী আর নাইরে পরীর মা... তোর পরী হাড় জুড়াইছে!



পরীর মার সামনে পুরো পৃথিবী দুলিতে লাগিল। পায়ের নিচে মাটি কাঁপিতেছে। হাঁটু দুইটা যেন শরীরের ভার রাখিতে পারিতেছে না।

জরিনা বলিয়াই চলিয়াছে, শেষকালে তোরে একবার দেখিতে চাইছিল খুব। মা মা কইয়া কাঁনতেছিল। হেরপর সব ঠান্ডা হইয়া গেল রে পরীর মা!



মেমসাহেব ততক্ষণে সেইখানে উপস্হিত হইয়াছেন এবং সবই শুনিয়াছেন।

তিনি পরীর মায়ের হাতে তাহার বেতনের টাকা গুঁজিয়া দিলেন। দিয়া কহিলেন, পুরা টাকাই দিলাম। যে পিরিচটা ভাঙছিলি ওইটার দাম কাটিলাম না। সামনের মাসে কাটিয়া লইব। এই টাকা দিয়া মাইয়ারে মাটি দিয়া আয়। কাল কাজে আসিবার দরকার নাই। কান্নাকাটি যা করিবার তা কালই করিয়া লইবি। পরদিন সকাল সকাল আসিবি। খোকার পাঠশালার বন্ধুরা দুপুরে খাইবে। উহাদের জন্য বিরিয়ানি রাঁধিতে হইবে। আমি আবার ওইসব রান্নাবান্না করিতে পারিব না। চুলার আগুন আমার একদমই সয়না, জানিসই তো!



পরীর মার কানে সেইসব কথা ঢুকিল কিনা জানা নাই।

সে তখন ভাবিতেছে- এই টাকায় দুইজনের মাটি দেয়া হইবে তো ?



।।সা।ত।কা।হ।ন।।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:১০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: পরীর মায়েরা এই ভাবে আর কত কাল এইভাবে জীবন কাটাবে!!!!!!!!!!!!!!


অনুতে বহুত বড় ব্যাথা ফুটাইয়াছেন জনাব

২৫ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:১০

অংকনের সাতকাহন বলেছেন: বাস্তবতারই প্রতিফলন জনাব। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.