নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয় মানুষেরা

জীবনের এই গতিপথ...পূর্ব-পশ্চিমে যেন এক নিছক অন্বেষণ

আরাফাত৫২৯

দূর থেকে দূরে, আরো বহুদূর......... চলে যেতে হয়, কত স্মৃতির ছায়ায়, এই রোদ্দুরের নীচে, নীল সবুজের খেলাঘরে জীবন মেতে থাকে কত নিয়মের প্রতীক্ষায়...

আরাফাত৫২৯ › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ের সাথে পরিচয়ের কাহিনী

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ২:৪৬



১/
প্রায় এক যুগ আগের কথা। সেই সময় মালয়শিয়াতে মাস্টার্স করতাম।

একবার এয়ার-এশিয়া এয়ারলাইন্স টিকেটের উপর বিশাল ছাড় দিল। মালয়শিয়া-টু-ভিয়েতনাম রিটার্ন টিকেটের দাম মাত্র এক রিঙ্গিট। সেই সময়ের হিসাবে বাংলাদেশি পঁচিশ টাকায় মালয়শিয়া থেকে ভিয়েতনাম প্লেনে করে ঘুরে আসা যাবে। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না।

উল্লাস ভাই আমাকে না বলে টিকেট কেটে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “চ, এইবার ভিয়েতনাম থেইকা ঘুইরা আসি।”

আমি টিকেটের দাম দিতে চাইলাম, কিন্তু উনি টাকা নিতে চাইলেন না। বললেন, “টাকা লাগবে না, পরে চা খাওয়াইয়া দিস।”

চা মানে তেতারে। সেই সময় এক গ্লাস তেতারের দাম এক রিঙ্গিট বিশ সেন। “সেন” মানে মালয়শিয়ান পয়সা আরকি! এদিকে টিকেটের দাম এক রিঙ্গিট। উল্লাস ভাইকে তেতারে খাওয়ালে পাক্কা বিশ সেন লস। আমি মনে মনে বললাল, “ধুশ শালা, বিশাল লস হয়ে গেল।”

এদিকে বাংগালিদের অবশ্য খালি প্লেনের টিকেট কাটলেই হয় না। ভিসা বলে একটা জিনিস আছে, সেটাও ম্যানেজ করতে হয়।

তাই একদিন সকালে উল্লাস ভাই আর আমি কুয়ালালামপুরের ভিয়েতনাম এম্বাসির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। কিন্তু এম্বাসির সামনে গিয়ে আর ভিতরে ঢুকার ইচ্ছা হল না। কারণ, এম্বাসির সামনের নোটিশবোর্ডে বিশাল হরফে লেখা ছিল, “বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা দয়া করে নিজ নিজ দেশের এম্বাসি থেকে ভিসা এপ্লিকেশন জমা দিন।”

এর মানে ভিয়েতনামের ভিসা পেতে হলে আমাকে বাংলাদেশে এসে এপ্লাই করা লাগবে। উল্লাস ভাই আর আমি বললাম, “খাইয়া দাইয়া আমাদের আর কাম নাই! গেলাম না তোর ভিয়েতনামে।”

প্লেনের টিকেট ছিড়ে ফেলে দিলাম। সত্যি কথা কি, পাকিস্তান আর নাইজেরিয়ার পাশে বাংলাদেশের নাম দেখে সেদিন মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

২/
ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এসে সোজা ভিসা সেকশনে গেলাম। আমার পাসপোর্টে মালয়শিয়ান ভিসা রিনিউ করতে ইউনিভার্সিটির ভিসা সেকশনে জমা দিয়েছি। সেটাও বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। এখনো সেটার কোন খবর নেই।

ভিসা সেকশনের ফ্রন্ট ডেস্কে একটা মেয়ে বসে ছিল। ওকে গিয়ে বললাম, “কি ব্যাপার, আমার ভিসা তোমরা কেন আটকিয়ে রাখছ? তোমাদের কি ধারণা আমাদের ভিসা নেওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই?”

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, “আমরা তো তোমাকে আলাদা ডকুমেন্ট দিয়েছি। ভিসা পেতে দেরী হলেও তো তোমার মালয়শিয়ায় থাকতে বা কাজ করতে কোন সমস্যা হবার কথা না?”

আমি মেজাজ দেখিয়ে বললাম, “মালয়শিয়া ছাড়া কি আমাদের দুনিয়াতে আর কোন কাজ থাকতে পারে না? আমি ভিয়েতনাম যাবো। আমার পাসপোর্ট লাগবে। খুব আর্জেন্ট।” মেয়েটাকে ফাঁপড় মারার জন্য ইচ্ছা করে ভিয়েতনামের কথা বললাম।

মেয়েটা থতমত খেয়ে বলল, “তাহলে ভিয়েতনামের টিকেট সহ এপ্লিকেশন জমা দাও। ইমিগ্রেশন অফিসার তাড়াতাড়ি ভিসা প্রসেস করে দিবে।”

এদিকে আমার কাছে তো টিকেটই নেই, আমি টিকেট ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। তাই উল্টা ফাঁপড় মেরে বললাম, “তুমি যে আমার পাসপোর্ট প্রসেস করছ সেটার প্রমাণ কি আমি দেখতে চেয়েছি? তাহলে তুমি কোন হিসাবে আমার কাছে টিকেটের প্রমাণ চাও।”

ঝাড়ি খেয়ে মেয়েটা থতমত খেয়ে ভিতরে চলে গিয়ে আরেকটা মেয়েকে নিয়ে আসল। এই মেয়েটাকে আগের মেয়ের চেয়ে একটু বেশি ঝাঁড়ি মেরে বললাম, “পাসপোর্টের উপর বসে ডিম পাড়লে তো হবে না। আমার পাসপোর্ট আজকেই লাগবে।”

ভিতর থেকে আসা মেয়েটা অনেক ধৈর্য নিয়ে আমার সব কথা শুনে আমাকে বুঝাল যে বিভিন্ন কারণেই ভিসা পেতে দেরি হতে পারে। এতে চিন্তার কিছু নেই। সে আমার ভিসার আপডেট জেনে অতিশীঘ্রই পাসপোর্ট ফেরত দিবে।

ভিতর থেকে আসা সেই মেয়েটাকে ইমেইল এড্রেস আর আমার অফিসের ফোন নাম্বার দিয়ে চলে আসলাম (ছাত্র হলেও আমাদের আলাদা অফিস রুম ও ফোন নাম্বার ছিল। কারণ, মালয়শিয়ায় আমাদের পড়াশোনাটাই একটা রিসার্স জব হিসাবে করতাম। ফলে আমাদের পড়াশোনার কোন টাকা-পয়সাও লাগত না, আবার মাস শেষে বেতনও পেতাম। এছাড়াও নিজের বই, খাতা, ল্যাপটপ সহ প্রয়োজনীয় যেকোন রিসার্স রিলেটেড জিনিস অফিসের টাকায় কিনতে পারতাম।)।

যাইহোক, পরেরদিন ভিসা সেকশন থেকে ফোন পেলাম যে আমার পাসপোর্ট রেডি। আমি যেকোন সময়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসতে পারব।

ভিসা সেকশনে গিয়ে দেখি আগের সেই ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা বসে আছে। আমাকে দেখে কোন কথা না বাড়িয়ে পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দিল। আমি পাসপোর্ট নিয়ে খুশিমনে অফিসে চলে আসলাম। ভিসা সেকশনের ভিতর থেকে যে মেয়েটা আগের দিন বের হয়ে কথা বলেছিল, সেই মেয়েটাকে সেদিন কোথাও দেখলাম না।

৩/
এই ঘটনার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ চলে গেছে।

একদিন দুপুরবেলা আমি আর উল্লাস ভাই ফ্যাকাল্টির ক্যাফেতে লাঞ্চ করতে গিয়েছি।

আমাদের ইউনিভার্সিটিটা বিশাল এবং পুরো ইউনিভার্সিটিতে অন্তত পঞ্চাশটা ক্যাফে আছে। একেক ক্যাফের একেক থিম। কোনটাতে মালয়শিয়ান খাবার, আবার কোনটাতে ভারতীয়, কোনটাতে তামিল, কোনটাতে চাইনিজ, কোনটাতে ইন্দোনেশিয়ান, কোনটাতে ইরানি খাবার। বাংলাদেশেরও বেশ কয়েকটা দোকান ছিল। অনেকেই একেকদিন একেক ক্যাফেতে লাঞ্চ করে বেড়াত। আমি খাবারের ব্যাপারে সবসময় অলস হবার কারণে সবচেয়ে কাছের ক্যাফেতেই নিয়মিত যেতাম। সেটা ছিল এক মালয়শিয়ান ক্যাফে।

আমরা ক্যাফেতে লাঞ্চ টাইমের অনেক আগে আসতাম, যখন ক্যাফেটা বলতে গেলে ফাঁকা থাকত। উল্লাস ভাই আর আমি সেখানে আড্ডা দিতাম, তারপরে লাঞ্চ করতাম। লাঞ্চের পরে হয় জুস না হয় চা খেতাম। মালয়শিয়ান চা-কে বলে “তেরারে”। অতীব মিস্টি সেই পানীয়ের সাথে বাংলাদেশি চায়ের রঙ ছাড়া তেমন মিল নাই। আমাদের আড্ডাবাজী মাঝে মাঝে এত বেশি সময় চলত যে আমরা দেখতাম, খালি ক্যাফে লাঞ্চের কারণে ভরাট হয়ে আবার খালি হয়ে গেছে।

যাইহোক, সেইদিন যথারীতি উল্লাস ভাই আর আমি আগে আগে ক্যাফেতে চলে এসেছিলাম। লাঞ্চের সময় ধীরে ধীরে পুরো ক্যাফেটা ভরে গেল। উল্লাস ভাই আর আমি মুখোমুখি বসে খেতে খেতে গল্প করছিলাম।

এমন সময় ক্যাফের ম্যানেজার আমাদের টেবিলে এসে বলল দুটো মেয়ে নাকি বসার জন্য চেয়ার-টেবিল পাচ্ছে না। আমাদের দুইজনের দুই পাশের দুই চেয়ারে মেয়ে দুটো বসলে আমরা মাইন্ড করব না কি?

আমরা অবাক হয়ে বললাম, “মাইন্ড করব কেন?”

সেই দুটো মেয়ে আমাদের পাশে খাবার নিয়ে এসে বসল (ইউনিভার্সিটির ক্যাফেগুলো বেশিরভাগই ছিল সেলফ-সার্ভিস)। আমি খেয়াল করলাম, আমার পাশে বসা মেয়েটি হল সেই মেয়ে যে কি না ভিসা সেকশনে ভিতর থেকে বের হয়ে আমার ইমেইল এড্রেস আর অফিসের ফোন নাম্বার নিয়েছিল।

আমাকে দেখে মেয়েটা বলল, “তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”

যারা মালয়শিয়ার কালচার জানেন না তাদের জন্য বলছি, মালয়শিয়ান ছেলে এবং মেয়েরা খুব সহজেই অপরিচিত মানুষের সাথে অনেক কথা বলে ফেলে। ওরা অনেকই অনেক বন্ধুভাবাপন্ন।

যাইহোক, আমি মেয়েটাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমি হলাম সেই বান্দা যে ভিসা সেকশনে গিয়ে ওকে ঝাড়ি মেরেছিলাম। মেয়েটা তখন হাসতে হাসতে বলল, আমি ফিরে আসার পরেই নাকি সে ইমিগ্রেশনের সাথে যোগাযোগ করে আমার ভিসার ব্যাপারটা সুরাহা করছিল।

আমিও পাসপোর্ট পেয়ে যে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ সেটা জানালাম। মেয়েটা খেতে খেতেই আমাকে বুঝালো কি কি কারণে পাসপোর্টে ভিসা পেতে দেরী হয় আর ইউনিভার্সিটির ভিসা সেকশন আসলে ইমিগ্রেশনের কোন ব্যাপারে নাক গলাতে পারে না। আমি “ব্যাপার না” টাইপ কিছু বলে পাশ কাটিয়ে গেলাম।

ইতিমধ্য, তার নাম জানা হয়েছে। তার নাম ভেনী অগাস্ট্রিন। সে ইন্দোনেশিয়ান। মালয়শিয়ায় আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সে ইন্টার্নী করতে এসেছে।

আমিও জানালাম যে আমি বাঙ্গাল। আমার নাম আরাফাত।

কথায় কথায় মেয়েটার কাছে আরো জানলাম যে সে হিন্দী ছবির খুব ভক্ত। সে ইন্দোনেশিয়ার যে শহরে থাকে তার নাম “মেদান”। সেই মেদান শহরে “কামপুং মাদ্রাজ” বলে একটা এলাকা আছে যেখানে ইন্ডিয়ান কমিউনিটির বসবাস। সে যখন হাইস্কুলে পড়ত তখনো নাকি সে মোটর সাইকেল চালিয়ে কামপুং মাদ্রাজে আসত হিন্দি ছবির ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করার জন্য। মালয়শিয়ার মত ইন্দোনেশিয়াতেও নাকি হিন্দি ছবির বিশাল ফ্যান বেজ আছে।

লাঞ্চ থেকে ফিরে যাওয়ার আগে মেয়েটার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিলাম এই বলে যে এর পরে ভিসা সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে ওকে সরাসরি ফোন দিব। সাথে এটাও জানালাম, আমার খারাপ ব্যাবহারে সে যেন কিছু মনে না করে। উপমার জন্য তাকে বললাম, আমি আসলে নারিকেলের মত। উপরের আবরণটা খুব শক্ত হলেও ভিতরটা টলটলে সুমিষ্ট পানীয়তে ভরা। মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, আমাকে দেখেই নাকি সেটা বুঝা যায়।

আমি ব্যাপারটা আরো নিশ্চিত করার জন্য বললাম, “আগে যেহেতু খারাপ ব্যাবহার করছি, এর পরেরবার ভালো ব্যাবহার দিয়ে তার মনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে দিব।”

মেয়েটা হাসতে হাসতে “দেখা যাবে” বলে চলে গেল।

৪/
এখন কিছু কথা বলা দরকার তাদের জন্য যাদের বাংলাদেশি কালচারের বাহিরে তেমন জানাশোনা নেই।

মালয়শিয়াতে বা ইন্দোনেশিয়াতে ছেলে-মেয়েরা নিজেরা নিজেদের বিয়ে করার মানুষকে খুঁজে নেয়। বস্ততঃ “এরেঞ্জড ম্যারেজ” বলে যে একটা জিনিস আছে সেটা আমাদের উপমহাদেশ ব্যাতীত দুনিয়ার অন্য কোথাও নেই। বিদেশে অনেকেই “এরেঞ্জড ম্যারেজ”-এর কথা শুনে এত অবাক হয় যে সেটা বলার মত না। অনেকে হাসা-হাসিও করে যে ছেলের জন্য বউ ছেলের বাপ-মা খুঁজে এনেছে বলে। তাছাড়া মালয়শিয়ার ছেলে-মেয়েরা একে অপরকে অনেক বিশ্বাস করে। কাউকে ভালো লাগলে তার সম্পর্কে নিজে থেকে জানার চেষ্টা করে। নিজেরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়া ঠিকঠাক করে বাবা-মাকে জানায়।

আরো একটা উপমহাদেশিয় জিনিস শুনে বিদেশীরা খুব হাসা-হাসি করে। সেটা হল বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রী পক্ষ “বিয়ের সিভি” নামক এক উদ্ভট জিনিস আদান-প্রদাণ করে যেটাতে বাপ-চাচা ছাড়াও চৌদ্দ গুস্টির কে কোন পজিশনে আছে সেটা লেখা থাকে। অনেক বিদেশীর চোখে এটা “নিজেদের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস আর অনাস্থা”, আবার কারো মতে “হাস্যকর”। আমার মতে এটা এক ধরণের বড়াই বা লোক দেখানো। কারণ সেই সিভিতে বেকার কারো নাম না থাকলেও “ক্ষমতাবান” পজিশনে যারা থাকে তাদের নাম ঠিকই থাকে আর লতায়-পাতায় তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখানো হয়।

আমাদের দেশে একসাথে ছেলে-মেয়ে আড্ডা দিলে যেমন খারাপ চোখে দেখা হয়, মালয়শিয়াতে ব্যাপারটা তেমন না। এমনকি, ইউনিভার্সিটির একই ডর্মিটরিতে পাশাপাশি ব্লকে ছেলে-মেয়েরা একসাথে থাকলেও সেখানে এসবের কারণে কখনো খারাপ কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। বরং, ডর্মিটরির ছেলেদের এরকম বলতে শুনছি যে, “আমাদের ডর্মিটরিতে যদি আমার সহপাঠিনি যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে আমার দেশে ওরা কিভাবে নিরাপদে থাকবে?”

৫/
যাইহোক, দুইদিন পরে ভেনীকে ফোন দিয়ে বললাম, “আগের খারাপ ব্যবহারের প্রতিদান স্বরুপ আমি তাকে সিনেমাতে নিয়ে একটা হিন্দী ছবি দেখাতে চাই।”

সে আমাকে পরে তার মতামত জানাবে বলে ফোন রেখে দিল।

যাইহোক, ইতিমধ্য আরো বেশ কয়েকদিন চলে গেছে। এর মাঝে আমরা কেউ কাউকে আর ফোন দেইনি। তারপরে একদিন আমি বা ভেনী (ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা ধোঁয়াশা রাখলাম) অন্যজনকে ফোন দিয়ে ছবি দেখার দিন-ক্ষণ ঠিক করলাম।

নির্দিষ্ট দিনে অফিস শেষে সিনেমাতে গিয়ে হিন্দী ছবির যেই পোস্টার দেখি সেটাই আমার পছন্দ হয় না। আমি আবার হিন্দী ছবি একেবারেই পছন্দ করতাম না। অবশেষে, আমার পছন্দ হল ইংরেজি সাইন্স ফিকশন “এভাটার” এবং ভেনীকে বললাম, “আমি এই মুভিটাই দেখব। তুমি চাইলে অন্য মুভি দেখতে পারো।”

ভেনী বলল, তাহলে সে টিকেটের টাকা দিবে।

আমি বললাম, “তাহাই সই।“

৬/
এরপরে আমাদের জীবনে আরো অনেক ঘটনাই ঘটেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই আমাদের একসাথে পার হতে হয়েছে। সময় এসেছে-দুঃসময় এসেছে। সে ইন্টার্নী শেষে আবার ইন্দোনেশিয়া ফিরে গেছে। আমরা ফোনে যোগাযগ রেখেছি। আর সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের বিয়েটাও হয়ে গেছে ২০১২ সালে মালয়শিয়াতে।

সে আরেক বিশাল কাহিনী। দুই জন দুই দেশের নাগরিক তৃতীয় একটা দেশে লিগ্যালভাবে বিয়ে করা সহজ কথা না! ডকুমেন্টেশনের শেষ নেই। বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয়, পররাস্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সার্টিফিকেট, মেজিস্ট্রেটের জবানবন্দী, চেয়ারম্যানের জবানবন্দী, বাবা-মায়ের স্ট্যাম্পে সাক্ষর, কি নেই সেখানে! আমার এহেন বীরোচিত কাজ দেখে আমার ছোট বোন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল। সেটা হল, “অকর্মরা একটা কর্মই ভালোভাবে করতে পারে। সেটা হল বিয়ে।”

আমি নিজেই আমার পিছনের দিকে তাকালে নিজের সাহসের তারিফ না করে পারি না। এখন চাইলেও এত সাহসের কাজ আমি করতে পারব না।

৭/
তবে এত কিছুর বাহিরেও যে জিনিসটা আমাকে ভাবায় সেটা হল সেই ক্যাফের ঘটনাটা।

আসলে সেই দিনটাই ছিল আমাদের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেই দিন অন্য কিছু হবার সম্ভাবনা এত বেশি ছিল যে সেগুলোর একটা কিছু হলেও আমাদের জীবন আজকের মত হত না। যেমন, সেদিন ভেনী অন্য কোন ক্যাফেতে খেতে যেতে পারত, আমি অন্য কোন টেবিলে বসতে পারতাম, অথবা সেইদিন ক্যাফেতে যারা এসেছিল তারা এমন পার্মুটেশন-কম্বিনেশন করে বসত যে অন্য কোথাও দুটো চেয়ার খালি থাকত, অথবা সেই দিন সেই সময়ে ক্যাফেতে পুরো একটি টেবিল খালি থাকত।

কিন্তু, সেদিন এসবের কোনটিই হয়নি। হয়নি বলেই, ভেনী হয়ত আজ ইন্দোনেশিয়াতে না থেকে শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমার সাথে লন্ডনে আছে। সেই দিন অন্য কিছু হয়নি বলেই আমিও আজ অন্য কোথাও না থেকে ভেনীর সাথে একসাথে আছি।

সেই দিন অন্য কিছু হলে আমরা হয়ত কোনদিও জানতাম না, ভেনী বলে একটা মেয়ে ইন্দোনেশিয়াতে জন্ম নিয়েছিল, আরাফাত বলে একটা ছেলে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিল। আমাদের দুইজনের জীবন হয়ত হত ভীষণভাবে আলাদা। আমরা কেউ কাউকে কোনদিন চিনতাম না, জানতাম না। হয়ত জানতাম না আমাদের কখনো দেখা হবার কথা ছিল, কথা হবার কথা ছিল। জীবনে চলার পথে হয়ত মাঝেমধ্যে আমাদের মনে পড়তঃ ভিসা সেকশনে একদা একটা ছেলে একটা মেয়েকে ঝাড়ি দিয়েছিল। জীবনের আরো হাজারো স্মৃতির ভিতরে এই স্মৃতিটাও একটা মামুলি স্মৃতি হিসেবে থেকে যেত। আমরা হতাম খুব আলাদা দুইজন মানুষ।

কিন্তু এসব কিছু হয়নি বলেই আজকে আমরা এক দশক ধরে সংসার করছি।
______________________________________________________________________________
সমাপ্ত। ইন্দোনেশিয়া নিয়ে আরো লেখা পড়তে চাইলে নিচের সিরিজটা পড়তে পারেন।

ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম শ্বশুড়বাড়ি ভ্রমণ (ইন্দোনেশিয়া সিরিজ - ১ঃ মেদানের পথে পথে)

মন্তব্য ৩৪ টি রেটিং +১২/-০

মন্তব্য (৩৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ৩:১৫

অপু তানভীর বলেছেন: আপনার জীবনের গল্প একেবারে যেন উপন্যাসের গল্পের মত। হুমায়ূন আহমেদের আয়নাঘর বইয়ের লিলিয়ান এবং তাহেরের কথা মনে পড়লো। পড়ে খুবই চমৎকার লাগলো।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ ভোর ৪:৩৭

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আয়নাঘর অনেক অনেক আগে পড়েছিলাম। চরিত্রগুলোর নাম ঠিক মনে নেই। তবে গপ্লের রেশটুকু রয়ে গেছে।

২| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ ভোর ৫:৫৪

নূর আলম হিরণ বলেছেন: এম্বাসির সামনের নোটিশবোর্ডে বিশাল হরফে লেখা ছিল, “বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা দয়া করে নিজ নিজ দেশের এম্বাসি থেকে ভিসা এপ্লিকেশন জমা দিন।”এর মানে ভিয়েতনামের ভিসা পেতে হলে আমাকে বাংলাদেশে এসে এপ্লাই করা লাগবে।
দেশে আসতে হবে কেনো, তখন কি মালেশিয়ায় বাংলাদেশের এম্বাসি ছিলো না?

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:০৫

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: আসলে আমি ঠিক বুঝাইতে পারি নাই। ঐ সময় মালয়শিয়াতে অবশ্যই বাংলাদেশ এম্বাসী ছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম এম্বাসী যেটা বলছিল সেটা হল আমাদেরকে বাংলাদেশে অবস্থিত ভিয়েতনাম এম্বাসী থেকে ভিয়েতনামের ভিসা নিতে হবে। মালয়শিয়াতে অবস্থিত ভিয়েতনাম এম্বাসী বাংলাদেশিদের ভিসা ইস্যু করবেনা। আর বাংলাদেশের এম্বাসী তো কোন অবস্থাতেই ভিয়েতনামের ভিসা ইস্যু করতে পারবে না।

৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ ভোর ৬:৩৬

প্রত্যাবর্তন@ বলেছেন: দারুণ। উপভোগ্য বর্ণনা।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:০৬

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৪| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ ভোর ৬:৪৬

স্বামী বিশুদ্ধানন্দ বলেছেন: অনেক দিন পর সামুতে আপনার লেখা পেলাম - বরাবরের মতোই আরেকটি অসাধারণ পোস্ট !

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:০৭

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: হম, প্রায় এক বছর তিন মাস পড়ে পোস্ট করলাম। আপনার আমার মত অধমের কথা মনে আছে জেনে ভালো লাগল। ভালো থাকবেন।

৫| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৮:১০

গরল বলেছেন: চমৎকার, আপনাদের জীবনটাই একটা গল্প। কিন্তু ভিয়েতনাম এম্বাসির ব্যাপারটা বুঝলাম, রেসিডেন্স পারমিট (ওয়ার্ক/স্টুডেন্ট যেটাই হোক) থাকলে তো এটা বিবেচনা করার কথা। এই ধরনের নিয়মতো শুধুমাত্র ভিজিটর দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:১০

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ভাই আমি অনেক দেশ ঘুরার পর যেটা বুঝেছি সেটা হল যেই দেশ যত ছোট, তাদের নিয়মের বাড়াবাড়ি তত বেশি। আপনার হয়ত ভিয়েতনাম এম্বাসীর কথা শুনে খটকা লাগতেছে, তাহলে বাংলাদেশ এম্বাসী আমার বউয়ের সাথে কি করছিল প্রথমবার দেশে আসার সময় সেটা শুনলে ভিমড়ি খাবেন।

৬| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৮:৫৪

শার্দূল ২২ বলেছেন: শুভ কামনা আপনাদের জন্য।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:১০

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৭| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৯:৪৩

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অসাধারণ।

শুভেচ্ছা আপনাদের দুজনের জন্য।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:১০

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৮| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১১:৪১

কোনেরোসা বলেছেন: পড়তে আসলাম কি আর পড়লাম কি ! অসাধারণ !

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:১১

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৯| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার।
জীবন সুন্দর।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:১১

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

১০| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৩:৩৯

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
সুন্দর করে আপনার
কেচ্ছা বলেছেন। পড়ে
মুগ্ধ হলাম।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:৫১

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ

১১| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২৫

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে আবার এলাম। কে কি মন্তব্য করেছেন সেটা জানতে।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:৫১

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ। একজন আপনাকে নিয়ে আমার পোস্টে খারাপ মন্তব্য করে গেল। নীচের কমেন্ট দেখুন।

১২| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ৯:৪৩

ইসিয়াক বলেছেন: চমৎকার স্মৃতি কথা।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ৯:৪৯

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার কমেন্টের জন্য।

১৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:২৫

হাসান মাহবুব বলেছেন: খুব ভাল লাগলো আপনাদের গল্প পড়ে। মালয়েশিয়ার কালচার সম্পর্কে নতুন কিছু জানলাম। আমাদের দেশে যে কবে এমন হবে! ভেনিকে একদম বাংলাদেশীদের মত লাগছে। ভালো আছেন নিশ্চয়ই দুজনে মিলে।

শুভকামনা।

০১ লা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:৪৪

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ হামা ভাই। আমাদের দেশে এমন হবে কি না, আমি অনেক সন্দিহান। এমন ভাবার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে। আর হ্যা, ভেনি দেশি পোশাকে বাংলাদেশিদের মতই লাগে অনেকটা। বেসিক্যালি যেকোন এশিয়ান মেয়েকেই আপনি শাড়ি পড়ালে দেশী মেয়ের মতই লাগে।

আমি ইন্দোনেশিয়ান কালচার সম্পর্কেও ধারণা পেতে চাইলে আমার ''ইন্দোনেশিয়ান সিরিজ ১ঃ মেদানের পথে পথে" পড়তে পারেন। লিংক এই পোস্টের শেষে দেওয়া আছে।

১৪| ০২ রা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৩৯

নেওয়াজ আলি বলেছেন: পড়ে ভালো লাগলো। সুন্দর উপস্থাপন।

০২ রা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৫৫

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

১৫| ০৩ রা এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৯:১১

সোহানী বলেছেন: ওয়াও... এতো দেখি সাক্ষাত হিন্দি ছবি!! দারুন একটা ভালোবাসার গল্প পড়লাম।

অনেক অনেক শুভকামনা। ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন হাজার বছর।

০৩ রা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:৩৭

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর মন্তব্য করার জন্য।

১৬| ১০ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১২:৪৪

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: চমৎকার লেখা। অসাধারণ বর্ণনাশৈলী।

০৯ ই মে, ২০২২ রাত ১২:০৩

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

১৭| ০৯ ই মে, ২০২২ রাত ৯:৩০

শ্রাবণধারা বলেছেন: এই লেখাটা আগে কি ভাবে মিস করলাম জানিনা। খুব ভাল লাগলো ভেনীর সাথে আপনার পরিচয় পর্বের গল্পটা পড়ে।
যতটুকু দেখেছি, মালয়শিয়ান এবং ইন্দোনেশিয়ানদের সাথে আমাদের সহজেই সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক বছরের চাকরির সুবাদে এটা দেখেছি।
দেশী সাজ আপনার স্ত্রীকে অতি সুন্দর মানিয়েছে, দেখে বুঝবার উপায় নেই যে তিনি ইন্দোনেশিয়ান।
আপনাদের জন্য অনেক শুভকামনা।

১০ ই মে, ২০২২ রাত ৩:০৩

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য? এখন কোথায় থাকেন? আপনার ব্লগে যাচ্ছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.