নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয় মানুষেরা

জীবনের এই গতিপথ...পূর্ব-পশ্চিমে যেন এক নিছক অন্বেষণ

আরাফাত৫২৯

দূর থেকে দূরে, আরো বহুদূর......... চলে যেতে হয়, কত স্মৃতির ছায়ায়, এই রোদ্দুরের নীচে, নীল সবুজের খেলাঘরে জীবন মেতে থাকে কত নিয়মের প্রতীক্ষায়...

আরাফাত৫২৯ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চায়না সিরিজ ৪ - এবার জিবু শহরে

০২ রা জুন, ২০২২ বিকাল ৫:১৮


Zhuozhou শহরের ট্রেন স্টেশন যেখান থেকে আমরা জিবু শহরে যাবার টিকেট কেটেছিলাম।

আগের পর্বের লিংকঃ চায়না সিরিজ ৩ - Zhuozhou শহরে

৮/
হেবেই প্রভিন্সের Zhuozhou শহরে কিছুদিন থাকার পর চীনের আরেক শহরে যাবার প্রয়োজন পড়ল। এবারের গন্তব্য শানডং প্রভিন্সের জিবু শহর। Zhuozhou শহরের নাম উচ্চারণ করতে না পারলেও, জিবু শহরের নাম বেশ অনায়াশেই উচ্চারণ করা যাচ্ছে। তাই সবাইকে শুনিয়ে বেড়াচ্ছি, “এবার শানডং প্রভিন্সের জিবু শহরে যাচ্ছি। নাম শুনছো এই শহরের?”

আমাদের দেয়া ডিজাইনে যে যন্ত্রটি Zhuozhou শহরে তৈরি হচ্ছে সেটার মত কিছু যন্ত্র আছে জিবু শহরের বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রিতে। সেই যন্ত্রগুলো কিভাবে কাজ করে সেটা দেখা ও বুঝার জন্য জিবু শহরে যেতে হবে। এই জন্য বেশ অনেকগুলো ইন্ড্রাস্ট্রিতে ঘুরতে হবে। বেশ কয়েক দিনের মামলা। এই শহরের আমাদের সাথে যোগ দিবেন বাংলাদেশের সেই স্বনামধন্য ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক, যার নাম আমি কখনোই আর কোন অবস্থাতেই মুখে আনব না। উনি অবশ্য উনার নিজস্ব কাজেই আসবেন, মাঝখানে আমাদের সাথে বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবেন।

Zhuozhou থেকে সরাসরি জিবুতে যাবার ট্রেন নেই। বেইজিং-এ গিয়ে হাই-স্পিড ট্রেন ধরতে হবে। তবে Zhuozhou শহরের রেল-স্টেশন থেকেই বেইজিং-টু-জিবু টিকেট কাটা যায়। তাই Zhuozhou শহরের রেল-স্টেশন থেকে আগেভাগেই টিকিট কেটে ফেললাম। এখন মূল কাজ বেইজিং-এ গিয়ে ট্রেন ধরা।

একদিন সকালে Zhuozhou শহর থেকে গাড়ি নিয়ে বেইজিং-এর উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। আমাদের চাইনিজ হোস্টরাই তাদের গাড়ি ড্রাইভার সমেত দিয়ে দিল। সেই গাড়ি আমাদের নিয়ে Zhuozhou শহর থেকে বের হয়ে গ্রামের ভিতরের আঁকাবাঁকা পথে চলা শুরু করল। সেই সময়ে চীনের গ্রামীণ জনপদের কিছুটা দেখা হল। সেই গ্রামীন চীনের সাথে ঝা-চকচকে শহরগুলোর বেশ অমিল। রাস্তার দুই দিকে বিভিন্ন সবজির ক্ষেত আর ছোট ছোট টাউনের মত এলাকা। টাউনের মত এলাকাগুলোতে ছোট ছোট দোকানপাট আর বাড়িঘর। গ্রামগুলোতেও অবশ্য লাল রঙের আধিক্য বেশি বলেই মনে হচ্ছে। যদিও দিনের বেলা তেমন কোন লাল রঙের বাতি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অনুমান করলাম রাতের বেলা এই এলাকাগুলোও লাল রঙের বিভিন্ন বাতিতে শোভিত হয়।

সেই সময়ে বেইজিং-এ চীনের জাতীয় কংগ্রেসের কোন এক অধিবেশন হচ্ছিল। আমাদের চাইনিজ হোস্টেরা আগেই বলে দিয়েছিল এটা খুব বিশাল অধিবেশন এবং চীনের রাজনীতিতে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এই অধিবেশনে সারা চীন থেকে বিভিন্ন নেতা আর পাতি-নেতারা বেইজিং-এ এসে দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করে। সেই বছরের অধিবেশনটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কারণে যে সেই অধিবেশনের পরপরই ওদের জাতীয় নির্বাচন হবে। ক্ষমতাশীন দল বিশ্বাস করে এই অধিবেশনের সাফল্যের উপর জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা নির্ভর করবে। এই জন্য সারা চীনেই নিরাপত্তার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি চলছে। জায়গায় জায়গায় পুলিশের চেক-পোস্ট। সব গাড়ি পুরোদমে চেক করা হচ্ছে। গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষজনকে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে তারা কোথায় আর কি কারণে যাচ্ছে। ব্যাখ্যা মনোপুত হলেই পুলিশেরা গাড়ি ছাড়ছে। না হলে গাড়ি ফেরত পাঠাচ্ছে। আর কারো কপাল খারাপ হলে হয়ত কেউ কেউ শ্রীঘরে যাচ্ছে। চীন গণতান্ত্রিক দেশ না, তাই সেখানে নাগরিক অধিকার ফলিয়ে তেমন কোন লাভ নেই। চীনের লোকজনও কোন নাগরিক অধিকার ফলাবার চেষ্টা করছে না। যদিও চীনের ক্ষমতাশীন কমিউনিস্ট দলের নেতারা তাদের দেশকে “সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র”-এর দেশ বলে অভিহিত করে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট এর তৈরি ডেমোক্রেসি ইনডেক্স অনুসারে চীন দশের ভিতর পেয়েছে মাত্র তিন দশমিক এক। এর মানে চীনের সরকার আসলে গণতান্ত্রিক না, এই সরকার স্বৈরাচারী। এই বিষয়ে চীনের সাংহাই শহরের Fudan ইউনিভার্সিটির গবেষক Zhengxu Wang এক বিবৃতিতে বলেন “চীনের নব্বই ভাগ মানুষ মনে করে তাদের দেশের জন্য গণতন্ত্র মঙ্গলজনক। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই গণতন্ত্র পাওয়ার জন্য যে চেস্টাটা করা দরকার সেটা করার জন্য প্রস্তুত নয়।” এর মূল কারণ হিসাবে তিনি বলেন যে “চীনের বেশিরভাগ মানুষের কাছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার গুরুত্ব বাক-স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার চেয়ে বেশি।”

কি এক বৈপরীত্য এদের মাঝে!

তবে এই কয়দিন চীনে থেকে আমি লক্ষ্য করেছি যে চীনের মানুষের চিন্তাতে বৈপরীত্য থাকলেও সবার চিন্তাতে মিল আছে। এর মানে চীনের একজনের ভিতরে কোন একটা বিষয়ে “চিন্তার বৈপরীত্য” থাকলে আশা করা যায় মোটামুটি সবার চিন্তাতেই সেই “একই বৈপরীত্য” আছে। এদের সবার চিন্তা-ভাবনার প্যাটার্ন একই। যেমন, উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক কোন এক চাইনিজ ভাবছে “ধূমপান মানুষের মৃত্যুর কারণ। তাই ধূমপান করা ঠিক না। কিন্তু ধূমপান করলে আমার কর্মস্পৃহা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে আমি বেশি রোজগার করতে পারি। বেশি রোজগার করতে না পারলে আমি বাঁচব না”। দেখা যাবে বেশিরভাগ চাইনিজ “ধূমপান” করার ক্ষেত্রে এই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। যে ধূমপান করার জন্য একজন চাইনিজ ভাবছে যে সে মারা যাবে, সেই একই লোক ধূমপান করছে বেশি রোজগার করার জন্য যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে। এটাই এদের “চিন্তার বৈপরীত্য” এবং সবার ভিতরের “একই বৈপরীত্য”। যদি যে কোন বিষয়ে চীনের কোন এলাকায় কোন সার্ভে করা হয়, দেখা যাবে ৯৯ ভাগ লোকের উত্তর একই। সেখানে দশ জনের কাছ থেকে যে উওর পাওয়া যাবে হাজার জনের কাছ থেকেও সেই একই উওর পাওয়া যাবে। আমাদের দেশের মত “নানা মুনির নানা মত” সেখানে অচল। সবারই এক মত। ওদের চিন্তাতে বৈপরীত্য থাকতে পারে, কিন্তু সেই বৈপরীত্যটাই ওদের মিল।

আর চীনের মানুষের কাছে বাক-স্বাধীণতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার চেয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। অর্থনৈতিক ব্যাপারটা এদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ওদের টাকা-পয়সার জন্য প্রার্থণা করার একটা দেবতা পর্যন্ত আছে। আমার ভারতীয় বন্ধু রাজীভ একবার ঠাট্টা করে বলেছিল যে ভারতে একবার চীন বিরোধী সমাবেশ হবে। এই সমাবেশে যারা অংশ নেবে তাদের সবাই একই রকমের টি-শার্ট আর ক্যাপ পড়ে আসবে যেখানে লেখা থাকবে “বয়কট চায়না”। প্রায় কয়েক লক্ষ টি-শার্ট আর ক্যাপ লাগবে। এত লক্ষ লক্ষ টি-শার্ট আর ক্যাপ তৈরির অর্ডার পেল চীন, কারণ ওদের চেয়ে সস্তায় আর তাড়াতাড়ি অন্য কেউ এত জিনিস বানাতে পারবে না। পরে দেখা গেল ভারতের সেই চীন বিরোধী সমাবেশে লক্ষ লক্ষ কর্মী “বয়কট চায়না” লেখা টি-শার্ট আর ক্যাপ পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যার এক কোণায় আবার ছোট করে লেখা আছে “মেড ইন চায়না”। এই হল ভারতের “বয়কট চায়না”-এর নমুনা। আর চীনের মানুষের কাছে অর্থনৈতিক দিকটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে দেশের জন্য সম্মানজনক না এমন কিছু লিখতেও তাদের দ্বিধা হয় না যদি তাতে তাদের টাকা-পয়সার দিক দিয়ে লাভবান হবার ব্যাপার থাকে। কিন্তু এর মানে আবার এই না যে চীনের লোকেরা টাকা-পয়সার জন্য তাদের সার্বভৌমত্ব অন্য দেশকে দিয়ে দিবে। আসলে ওদের দেশপ্রেমের চেতনাটা আমাদের উপমহাদেশীয়দের মত লৌকিক চড়া সুরে বাঁধা না। সেটা ভাষাতে ব্যাখ্যা করা যাবে না বরং চীনে গিয়ে অনেকদিন থাকলে হয়ত বোঝা যাবে। আমি যেহেতু চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না, সেহেতু এই বিষয়ে আর বেশি কথা না বলি। তবে ছোটবেলায় আমরা বাংলা পরীক্ষার জন্য একটা ভাবসম্প্রসারণ পড়তাম যেটা এমন ছিল, “যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার, অমূল্য রতন।”

চীনের কেউ যদি তাদের জাতির জন্য এমন কোন ভাবসম্প্রসারণ লিখে যেত হয়ত সেটা এমন হতঃ

যেখানে দেখিবে কিঞ্চিৎ ব্যবসার সুযোগ
উহাদের সাথে নিজ হতে করিও যোগাযোগ
পাইলেও পাইতে পারো টাকা-কড়ি ও তবারক।

দুঃখের বিষয়, আজকাল আমাদের দেশের সবাই সবকিছু কোন চেষ্টা ছাড়াই হাতেনাতে পেতে চায়। ছাই উড়ানোর মত সময় আমাদের নেই। চাইনিজরা এমন না। কোথাও ব্যবসার বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকলে তারা সেই সুযোগটা কাজে লাগানোর সাম্ভব্য সব চেষ্টাই করে।

৯/
যাইহোক, আমরা ভালোয় ভালোয় বেইজিং পৌছালাম। আমাদের কোন পুলিশ চেকিং-এর ঝামেলার ভিতর দিয়ে যেতে হল না। বরং, বিদেশি দেখে আমাদের গাড়ি সবসময় আগে যাবার অগ্রাধিকার পেয়েছে।

বেইজিং-এর রেল-স্টেশন বিশাল। আমরা পুলিশ চেকিং-এর কথা ভেবে হাতে সময় নিয়েই রওয়ানা দিয়েছিলাম। কিন্তু, পথে আমাদের কোন চেকিং না হওয়ায় আর সব জায়গাতে গাড়ি সামনে যাবার অগ্রাধিকার পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগেই রেল-স্টেশনে পৌছে গেছি। বাকি সময়টুকু স্টেশন আর আশেপাশে ঘুরে, কফি খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। তারপর যথাসময়ে ট্রেনে চেপে বসলাম।

বেইজিং থেকে জিবু শহরের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। হাই-স্পিড ট্রেনে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। যদিও হাই-স্পিড ট্রেনের গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৪০০ কিলোমিটার, সেই হিসাবে জিবু শহরে পৌছাতে সময় লাগার কথা এক ঘন্টার চেয়ে একটু বেশি। কিন্তু হাই-স্পিড ট্রেনে করে জিবুতে পৌছাতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টার মত। এই বাড়তি সময়টুকু লাগার মূল কারণ ট্রেনটাকে যাত্রাপথের বেশ কয়েকটি স্টেশনে থামতে হয় মানুষ উঠা-নামা করানোর জন্য। আর ট্রেনটাও যাত্রা-পথের পুরোটা সর্বোচ্চ গতিবেগে চলে না। বরং কোন স্টেশনে ট্রেনটাকে থামানোর জন্য অনেক আগে থেকেই ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে আনতে হয়। আবার থামা অবস্থা থেকে সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠতে ট্রেনটার সময় লাগে প্রায় বিশ মিনিট। এই কারণেই ট্রেনটার এই ৫০০ কিলোমিটার যেতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগে।

হাই-স্পিড ট্রেন একেবারে মিনিটের কাটা ধরে চলে। আমাদের ঠিক যে সময়ে জিবু স্টেশনে পৌছানোর কথা ঠিক সেই সময়েই পৌছালাম। এক মিনিটও হেরফের হয় নাই।

যখন জিবুতে পৌছালাম তখন প্রায় রাত আটটা। চীনের মানুষের জন্য বেশ রাত। তবে জিবু শহরেও আমাদের হোস্ট ছিল যারা স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। ওরাই আমাদের ডিনারে নিয়ে গেল। জিবু শহর এমন যে এখানে হালাল খাবারের বেশ অভাব। আমাদের দলে আবার বেশ কয়েকজন হালাল খাবারের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। তাই সামুদ্রিক মাছের পিজ্জা, অথবা মাছের বার্গার অথবা ফল-মূল আর সবজি খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আর চাইনিজদের যে অভ্যাস! সব খাবারেই তারা একটু হলেও শুয়োরের মাংসের কুঁচি, শুয়োরের তেল বা চর্বি দিবেই। ক্ষেত্রবিশেষে এত কিছু না জেনে খাওয়াই ভালো যখন দেখা যাচ্ছে যে খাবারের মূল উপকরণগুলো হালাল। তবে আমাদের চাইনিজ হোস্টেরা এসব ব্যাপারে খুব সজাগ এবং তারা নিশ্চিত করল যে আমাদের কথা ভেবেই তারা বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে খাবারগুলো তৈরি করিয়েছে। ওদের চেষ্টাটাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা গেল না।

ডিনারের পর হোস্টেরা আমাদের হোটেলে নিয়ে গেল। Zhuozhou শহরের হোটেলের নাম উচ্চারণ করা না গেলেও জিবু শহরের হোটেলের নামটা সহজেই উচ্চারণ করা যাচ্ছে। হোটেলের নাম বিদেশীদের জন্য “লান-হাই”। হোটেলের অবশ্য একটা চাইনিজ নাম আছে, খুব সম্ভবত সেটা বিদেশিদের জন্য উচ্চারণ করা জটিল। তাই হোটেল কর্তৃপক্ষ বুদ্ধি করে বিদেশিদের জন্য হোটেলের নাম সহজ করে রেখেছে “লান-হাই”। জিবু শহরে দেখি সব কিছুর নামই উচ্চারণ করা যাচ্ছে। তবে একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নাই হোটেলটা বেশ সুন্দর আর বিশাল। আমার রুম পড়ল হোটেলের একদম উপরের ফ্লোরে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে জিবু শহরের অনেকটাই দেখা যায়।

১০/
জিবু শহরটি শানডং প্রভিন্সের প্রভিন্সিয়াল রাজধানী না বরং prefecture লেভেলের শহর। এর মানে, প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক ক্ষমতার বিচারে এটা চীনের দ্বিতীয় সারির শহর। শানডং প্রভিন্সের প্রভিন্সিয়াল রাজধানী জিনান থেকে জিবু শহর প্রায় একশত কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।

জিবু শহরটি সিরামিক শিল্পের জন্য বিখ্যাত। চীনে এক এক শহর এক এক কারণে বিখ্যাত। কেউ হয়ত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে এগিয়ে, কেউ হয়ত ইলেট্রনিক্সে, কেউ আবার সিরামিক শিল্পে। তাই চীনের কোন একটা প্রভিন্স বা শহরে সব কিছুর ইন্ড্রাস্ট্রি পাওয়া দুস্কর। আমরা যে যন্ত্রটা Zhuozhou শহরে অর্ডার দিয়ে তৈরি করছি সেটা দিয়ে আদতে মাটি গলিয়ে সিরামিক ফাইবার তৈরি করা হবে। এইসব সিরামিক ফাইবার “হিট ইনসুলেটর” হিসাবে খুব কাজের জিনিস এবং এগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয় না। তাই বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এসব জিনিস আমদানী করে যা দেশের প্রায় সব শিল্পকারখানাতে ব্যবহার হয়। আমরা চাচ্ছিলাম বাংলাদেশেই সিরামিক ফাইবার দেশীয় মাটি দিয়ে তৈরি করতে। তবে যারা রিসার্স করেন তারা জানেন “দেশীয় মাটি” বা “দেশীয় কাঁচামাল” যাই বলেন না কেন, কোন ইন্ড্রাস্ট্রিতে যে কোন একটি “কাঁচামাল” পরিবর্তন করলেই সিস্টেমে হাজার হাজার পরিবর্তন করতে হয়। আমাদের গবেষণার লক্ষ্য সেটাই, যাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন রকমের মাটি থেকে সেই সিরামিক ফাইবার তৈরির চেষ্টা করা এবং সবশেষে দেশের প্রেক্ষাপটে যেই মাটি সবচেয়ে ভালো সেটা নির্ধারণ করা।

যাইহোক, আগের কথাতে ফিরে আসি। আগেই বলেছি জিবু শহর সিরামিক শিল্পের জন্য ভালো। আর Zhuozhou শহরটি যন্ত্রপাতি তৈরিতে দক্ষ। তাই আমাদের যন্ত্রটি হেবেই প্রভিন্সের Zhuozhou শহরে তৈরি হলেও এই রকম যন্ত্র কাজে লাগিয়ে সিরামিক ফাইবার উৎপাদন করা হচ্ছে শানডং প্রভিন্সের জিবু শহরে। সে কারণেই আমাদের জিবু শহরে আসা।

জিবু শহরে আমাদের মূল কাজ হল আমাদের যন্ত্রটার মত যেসব যন্ত্র এই শহরের বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রিতে রয়েছে সেগুলোর কয়েকটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা। এজন্য এই শহরের বেশ অনেকগুলো ইন্ড্রাস্ট্রিতে যেতে হবে। যদিও ইন্ড্রাস্ট্রিগুলোতে যে যন্ত্রগুলো চলছে সেগুলো এক একটা মেগা-প্ল্যান্ট। সেগুলোর দৈনিক উৎপাদণ ক্ষমতা হাজার হাজার মেট্রিক টন। অন্যদিকে আমরা বুয়েটের জন্য যেটা ডিজাইন করেছি সেটার উৎপাদন ক্ষমতা ইচ্ছা করেই একশত কেজির কম করেছি। সুতরাং, আমাদের যন্ত্রটা একটা পাইলট স্কেলের প্ল্যান্ট বলা যেতে পারে। আমাদের ডিজাইনে প্ল্যান্টটির ক্ষমতা কম রাখার একটাই কারণ যাতে গবেষণাটা অর্থ-সাশ্রয়ী হয়। দৈনিক হাজার হাজার মেট্রিক টন কাঁচামাল বুয়েটে এনে গবেষণা করা সম্ভব না আর এটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। আর আসল প্ল্যান্ট বসালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগবে সেটার যোগান দেয়া একটা ইউনিভার্সিটির পক্ষে শুধু অসম্ভবই না, একেবারেই অবাস্তব। এমনকি আমাদের পাইটল স্কেলের প্ল্যান্টটা চালানোর জন্য আমরা নিজেরাই বুয়েটে একটা সাব-স্টেশন তৈরি করে নিয়েছি। তাছাড়া একটা বড় প্ল্যান্ট চালানোর খরচ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লোকবল সহ নানাবিধ আরো খরচের ব্যাপার আছে। তবে এত কিছু কাটছাট করার পরেও আমাদের পাইলট স্কেলের প্ল্যান্টের ওজন দাঁড়িয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কেজি। তাহলে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে আসল প্ল্যান্টের ওজন কত! আর এত বড় একটা বিশাল প্ল্যান্ট একেবারে লিলিপুটের মত ছোট আকারে নিয়ে আসার জন্য আমাদের কি পরিমাণ খাটা-খাটুনি আর রাত জেগে ইঞ্জিনিয়ারিং হিসাব-নিকাষ-অংক কষতে হয়েছে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তাই সেদিকে আর না যাই।

১১/
এবার কিছু ছবি আর ক্যাপশনঃ

ইন-টাইম সিটি শপিং মল। জিবু শহরে এসে প্রথমে এই মলে আমাদের চাইনিজ হোস্টেরা নিয়ে এসেছিল উদরপূর্তি করানোর জন্য। পিজা ছাড়া উদরপূর্তির জন্য তেমন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, কারণ দলের সবাই হালাল-হারাম নিয়ে অনেক চিন্তিত। অবশ্য আমাদের চাইনিজ হোস্টরাও যথেস্ট সতর্ক ছিলেন। কিন্তু খাবারে পর্কের তেল থাকলেও সমস্যা হতে পারে, সেটা তাদের মাথাতে ছিল না।


হোটেল লান-হাই, যেখানে আমরা ছিলাম। আমার রুম ছিল একেবারে উপরের ফ্লোরে।


হোটেল লান-হাই এর রিশিপশন। বেশ জাক-জমকপূর্ণ হোটেল, কিন্তু আমার ক্যামেরা ভালো ছিল না।



লান-হাই হোটেলে আমার রুম ছিল একেবারের উপরের দিকের ফ্লোরে। আমার রুমের জানালা দিয়ে এই বিল্ডিং-টা দেখা যেত। এটাই সম্ভবত এই শহরে সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং।
_________________________________________
পরের পর্বের লিংকঃ চায়না সিরিজ ৫ - খাওয়া আর কালচারাল শক
চায়না সিরিজের সময়কাল ২০১৭ সাল।



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুন, ২০২২ রাত ১১:৪২

জ্যাকেল বলেছেন: দেখা যাচ্ছে আপনার ভাল ভাল জায়গা দেখার সুযোগ হয়েছে।

০৫ ই জুন, ২০২২ রাত ১:৫০

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই। কয়েকদিন শহরের বাহিরে থাকার জন্য উত্তর দিতে দেরি হল।

২| ০৩ রা জুন, ২০২২ রাত ১২:১৫

রাজীব নুর বলেছেন: লেখা এবং ছবি খুব সুন্দর।
কোনো ভান নেই। ভনিতা নেই।

০৫ ই জুন, ২০২২ রাত ১:৫০

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ভাই আমি সহজ সরল মানুষ। তাই যেইভাবে ভাবি সেইভাবেই লিখি। হাহা। পড়ার জন্য ধন্যবাদ। কয়েকদিন শহরের বাহিরে থাকার জন্য উত্তর দিতে দেরি হল।

৩| ০৫ ই জুন, ২০২২ সকাল ৯:১৭

ইমরান আশফাক বলেছেন: আপনাদের প্রজেক্ট সফলতা লাভ করুক মনে প্রানে এই কামনা করি।

০৫ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৪:৫৬

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আসলে বাংলাদেশে কি পরিমাণ বুরোক্রেসি সেটা আমার এই প্রজেক্টে কাজ করে বুঝা হয়ে গেছে। কিভাবে এই দেশের সিস্টেম পরিশ্রমী লোকদের বোকা ও সিস্টেমের চোখে অসহায় করে দেয় সেটাও আমি এই প্রজেক্ট থেকে শিক্ষা পেয়েছিলাম। আমি বিদেশ থেকে দেশে অনেক আশা নিয়ে আসছিলাম অন্তত শিক্ষা ও গবেষণা খাতে কিছু করার জন্য। দেশে আড়াই বছর থেকে সব কিছুর সাথে যুদ্ধ করে শেষে না কুলাতে পেরে আবার বিদেশে চলে এসেছি। তবে এই প্রজেক্ট আমি শেষ করছিলাম। কিন্তু সেই শেষটাই শেষ কথা না। সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। আশাকরি, যারা বর্তমান আছেন তারা সেই চেষ্টাই আপ্রাণ করে যাচ্ছেন।

৪| ০৬ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৫:২৮

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: ছবিগুলো সুন্দর হয়েছে সেই সংগে চায়না সিরিজের এই লেখাটিও। চলতে থাক পরের লেখা।

০৭ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪৩

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। আরো অনেক ছবি ছইল, কিন্তু কেন যেন এই পোস্টে এড করা যাচ্ছিল না। যাইহোক, পরের পর্ব এই সপ্তাহে দিচ্ছি। পড়ার জন্য আবার ধন্যবাদ।

৫| ২১ শে জুন, ২০২২ রাত ১১:৩৭

ভার্চুয়াল তাসনিম বলেছেন: দারুণ !

২২ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৫০

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: আবারো ধন্যবাদ ভাই। সিরিজের নতুন পোস্ট দিলাম। আশা করি দেখবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.