নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয় মানুষেরা

জীবনের এই গতিপথ...পূর্ব-পশ্চিমে যেন এক নিছক অন্বেষণ

আরাফাত৫২৯

দূর থেকে দূরে, আরো বহুদূর......... চলে যেতে হয়, কত স্মৃতির ছায়ায়, এই রোদ্দুরের নীচে, নীল সবুজের খেলাঘরে জীবন মেতে থাকে কত নিয়মের প্রতীক্ষায়...

আরাফাত৫২৯ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চায়না সিরিজ ৬ - চায়নার উন্নতির রহস্য

১৫ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪৩


- জিবু শহরের রাজপথ

আগের পর্বের লিংকঃ চায়না সিরিজ ৫ - খাওয়া আর কালচারাল শক

১৬/
চীনে এসে একটা সমস্যা বেশ প্রকট হয়ে গেল। ব্যাপারটা খুলে বলছি।

দিনের বেলা আমরা বিভিন্ন কারখানাগুলোতে ব্যস্ত সময় পার করলেও রাতের বেলা হোটেলে ফিরে করার মত তেমন কিছুই ছিল না। কারণ হল চীনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা। আসল কথা হল চীনে গুগোল, ইউটিউব, ফেসবুক কিছুই কাজ করে না। এমনকি দেশে ফোন দিব সেটারও তেমন যুৎসই কোন উপায় নেই। ভিডিও কল করা যায় এমন বেশিরভাগ এপই কাজ করে না চীনে। হোয়াটস-এপ, মেসেঞ্জার কোনটাই কাজ করে না এখানে। যেসব এপ কাজ করে সেসব আবার বাংলাদেশে ভালো কাজ করে না।

এদিকে বাংলাদেশে রেখে এসেছি আমার বিদেশি বউ। সে নিজেও ভালো বাংলা বলতে পারে না। তার উপর বউয়ের কোলে আমাদের মাত্র কয়েকমাস বয়েসী ছেলে। এর আগে দীর্ঘদিন আমরা মালয়শিয়াতে ছিলাম। মালয়শিয়া আবার আমাদের দুইজনেরই বিদেশ ছিল। মানে আমার বউ ইন্দোনেশিয়ান আর আমি বাংলাদেশের। বউ মালয়শিয়াতে বড় কোম্পানিতে চাকরি করত। এছাড়া মালয়শিয়ান আর ইন্দোনেশিয়ান সোসাইটিতে মেয়েরা অনেক স্বাবলম্বী। এরা গাড়ি চালায়, বাইক চালায়, বাস-ট্রাক চালায়, বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানি চালায়, আবার বাজারের দোকানে শাক-সবজিও বিক্রি করে। এদিক দেশে এসে বউ বাসা থেকে নিচেই নামতে পারত না। শহরে কোন পার্ক নাই, মেয়েরা নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারে না। স্বামী বউয়ের সেবা করলে আবার দেশের মানুষ সেটা ভালো চোখে দেখে না। এইসব নিয়ে বউ কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হলেও সবার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবে তার মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করে। সেটা হল, বিপদ-আপদে এই বাংলাদেশে কোন তরিকায় কি করতে হবে সেটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অবশ্য ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি নিজেও বাংলাদেশে বিপদের সময় কি করতে হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। বউকে বাংলাদেশে রেখে চীনে আসার পর বউয়ের মন থেকে সংশয় কাটতেই চায় না। যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে কি করতে হবে সেটা নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকে।

আপনারা চাইলে আমার বউয়ের বরাতে বাংলাদেশ সিরিজ নামে একটা সিরিজ করতে পারি। বাংলাদেশে আমার বউয়ের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছিল। এর আগে সে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার ঘুরে গেলেও, যখন সে বাংলাদেশে পাকাপাকিভাবে থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে আসল তখনকার অভিজ্ঞতা আগেরগুলোর চেয়ে বেশ আলাদা ছিল। তার উপর নতুন মা হবার কারণে সেই অভিজ্ঞতায় আবার বেশ ক্লাইমেক্স ছিল। সর্বোপরি, বাংলাদেশ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা মিশ্র। এদিকে আমিও পি-এইচ-ডি ডিগ্রী নিয়ে দেশে এসে বেশ ক্লাইমেক্সপূর্ণ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গেছি। সেসব নিয়ে হয়ত আলাদা সিরিজ হবে। এর বাহিরে আপনারা চাইলে ইন্দোনেশিয়া নিয়েও একটা সিরিজ হতে পারে। অসম্ভব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত আর হাসি-খুশি মানুষের সেই দেশটার বিভিন্ন অঞ্চলে আমি অনেকবার গিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় থেকেছি। খুব জনপ্রিয় জায়গাগুলোর বাহিরেও ইন্দোনেশিয়াতে অন্য যেসব জায়গা রয়েছে সেসব জায়গাতে আমি গিয়েছি। সেই দেশের একেবারে সাধারণ আটপৌরে মানুষের জীবন আমার খুব কাছ থেকে দেখা হয়েছে, যেটা হয়ত কোন টুরিস্টের লেখাতে আপনারা পাবেন না। চাইলে সেই সিরিজ হতে পারে। কমেন্ট করে জানাবেন।

যাইহোক, আগের কথা ফিরে আসি।

সকালে আর রাতে বিভিন্ন চাইনিজ এপ দিয়ে দেশে বউয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। যতটুকু দেখা যায় সেটাতেই খুশি থাকতে হয়। সারাদিন তেমন কারো সাথে কথা না বলার কারণে বউয়ের অনেক কথা জমে থাকে। তারউপর ছেলেকে নিয়েও অনেক গল্প থাকে। সব শুনতে শুনতে অনেক সময় চলে যায়। জীবনটাকে তখন আর খারাপ লাগে না।

এর ফাঁকে যা সময় পাই সেটা ল্যাপটপের হার্ড-ডিস্কে জমে থাকা বিভিন্ন মুভি দেখে পার করে দেই। এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। বিকাল পাঁচটা-ছয়টা বাজতে না বাজতেই চীনে সব দোকান-পাট, শপিং-মল বন্ধ হয়ে যায়। ছুটির দিন ছাড়া দেশের জন্য কেনাকাটারও কোন উপায় নাই। কি আর করা। যেই দেশে যেই নিয়ম। যস্মিন দেশে যদাচার।

১৭/
চীনে আসার আগেই এখানকার ইউনিভার্সিটিগুলোর কিছু কিছু প্রফেসরের সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ করেছিলাম যারা মূলত আমার ফিল্ডে রিসার্স করছেন। উদ্দেশ্য হল যদি কোনভাবে রিসার্স কোলাবরেশন করা যায়। তাহলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকায় চীনে আসাও হল, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাজ করাও হল আবার নিজের রিসার্স ক্যারিয়ারটাকেও একটু এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা হল। মানে একসাথে রথ দেখাও হল আবার কলা বেঁচাও হল।

তেমনি একজন প্রফেসর হলেন ডঃ ইয়ু। উনি শানডং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে অধ্যাপনা করেন।

উনি অধ্যাপনার পাশাপাশি একটা রিসার্স কনসালন্টেন্সি ফার্ম খুলে বসেছেন যেটা আমার হোটেল থেকে খুব কাছেই। একদিন উনি নিজেই এসে আমাদের সবাইকে উনার রিসার্স কনসালন্টেন্সি ফার্মে নিয়ে গেলেন। সেখানে উনি দেখালেন কিভাবে উনার ইউনিভার্সিটির গবেষণাগুলোকে তিনি বানিজ্যিক রূপ দেবার চেষ্টা করছেন। সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করে সন্ধ্যার দিকে উনি উনার কনসালন্টেন্সি ফার্মে বসেন। উনার ফার্মে যারা কাজ করছে সবাই উনার বর্তমান বা সাবেক ছাত্র-ছাত্রী। উনি ইচ্ছা করেই উনার ছাত্র-ছাত্রীদের ফার্মে নিয়োগ দেন যাতে তাদের কিছু উপার্জন হয় আর কাজের অভিজ্ঞতা হয়। আমি সত্যি সত্যি উনার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ভালোবাসা আর রিসার্সের উপর আগহ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

আমাদেরকে ডঃ ইয়ু যেভাবে আদর-আপ্যায়ণ করলেন সেটাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। উনি অনেক চাইছিলেন আমাদের সাথে কোন কলাবোরেটিভ রিসার্স করা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে চীন থেকে ফিরে আসার পর আমাদের অর্ডার করা যন্ত্রটা নিয়ে এমন বিপাকে পড়ছিলাম যে সেটা আর বলার মত না। সবশেষে যা বুঝছিলাম যে বাংলাদেশে রিসার্স করা মানে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এত রাত জেগে কাজ করা, গবেষণা করা ইত্যাদির তেমন কোন দাম নেই বাংলাদেশে, বরং এতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ, আমার জন্য যা গবেষণা সেটা হতে পারে অন্যের স্বার্থের উপর আঘাত। তাই এই বিষয়ে আর কথা না বাড়াই। শুধু এতটুকু বলে রাখি, ‘রিসার্স কালচার’ একটা লিগ্যাসি। এটা হুট করে হয় না। কয়েক জেনারেশন ধরে একটু একটু করে এই কালচার তৈরি করতে হয়। দেশের মানুষের মাইন্ড-সেট ঠিক করতে হয়। বাংলাদেশের এখনও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা গবেষকরাও যদি বাংলাদেশে এসে কাজ করে, তাও তেমন কোন সুফল বাংলাদেশ এখন পাবে না। আগে বাংলাদেশের রিসার্স কালচার ঠিক করতে হবে। তা না হলে, চায়ের দোকানের আড্ডাবাজেরা (রূপর অর্থে) এসে সেই বিশ্বসেরা গবেষকদের বলবে, ‘আপনে আমাত্তে বেশি বুঝেন। এই আপনার শিক্ষার দৌড়!’

আমি চীন থেকে ফিরে আসার এক বছর পরে দেশ ছেড়ে আবার দেশ ছেড়ে চলে আসি, যদিও আমি দেশে মোটামুটি থাকার উদ্দেশ্য নিয়েই ফেরত এসেছিলাম। আসলে আমার বাংলাদেশে কাজ করার মত মানসিক শক্তি আর অবশিষ্ট ছিল না। কারণ, দিনশেষে আমিও রক্ত-মাংসের একজন মানুষ, এবং আমারও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু চাওয়া-পাওয়া আর আশা-আকাঙ্খা আছে। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দেশের তরে সব বিলিয়ে দেবার ব্রত নিয়ে চলা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এজন্য অনেকেই আমাকে স্বার্থপর ভাবতে পারে। আমি নিজেও এটা অস্বীকার করি না। তবে দেশে থাকাকালে অনেককেই বলতে শুনেছি অনেক দায়িত্ববোধের কথা - আমরা নাকি রিশকাওয়ালার ঘামে ভেজা টাকা দিয়ে বুয়েটে পড়েছি। কথাটা এক অর্থে সত্য হলেও এটা বলা হয় একটা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কারণ, রিশকাওয়ালার ঘামে ভেজা টাকাতে আমি না, এই দেশের মোটামুটি সবাই পড়াশোনা করেছে। এর বাহিরেও আমরা যারা বুয়েট বা ভালো জায়গাগুলোতে জায়গা করে নেই, তারা নিজেদের মেধা-পরিশ্রমের কারণেই নেই। রিশকাওয়ালার ঘামে ভেজা টাকাটাকে শ্রদ্ধা করি বলেই আমরা বিগত যৌবণে রাতের বেলা টাংকি না মেরে দুইটা অংক বেশি করতাম, টিভিতে মুভি-নাটক-খেলা না দেখে ফিজিক্সের দুইটা সূত্র বোঝার চেষ্টা করতাম। এখন সেই ঘামে-ভেজা টাকা পরিশোধ খালি আমাদেরকেই নিজের জীবন-যৌবণ সব বিলিয়ে পরিশোধ করতে হবে? আর দেশের ভালো অনেকভাবেই করা যায়। কিন্তু আসলে দেশ কি সেই ‘ভালো’-টুকু নিতে ইচ্ছুক? আর এরপরেও যারা এসব কথা বলে, তারা নিজেরা কেন রিশকাওয়ালার ঘামে ভেজা টাকাটাকে শ্রদ্ধা করে কিছু করে দেখায়নি? দেশ সেবার মহান ব্রত শুধু মেধাবীদের না, এটা সবার। যদিও আমি মেধাবীদের কাতারে পড়ি না, তবে এইসব কথা এত শুনেছি যে বলার মত না। যারা এসব কথা আমাদের বলে তারা পারলে একটু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অথবা ক্ষমতাশালী কাউকে ঠিক এই কথাগুলোই আমাদেরকে যেভাবে বলেছে সেভাবে যেন তাদের বলে। সাথে যেন এটাও যোগ করে যে রিশকাওয়ালার ঘামে ভেজা টাকাকে সম্মান করে কিভাবে তারা হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে? আশাকরি, তখন তারা এই প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে পেয়ে যাবেন যে ভবিষ্যতে এই প্রশ্ন কাউকে জিজ্ঞেস করার আর সাহস পাবেন না। তাদের পাছাতে কাপড়ও থাকবে না, পাছার চামড়াও থাকবে না।

কাউকে আঘাত করার জন্য আমি কথাগুলো বলিনি। তবেই এটাই এখনকার বাস্তবতা। যাইহোক, অনেক আলগা কথা হয়ে গেল। শেষকথা, আমি ওয়ার্ড ব্যাংকের প্রজেক্টটা ভালোভাবে শেষ করেই বিদেশে ফেরত এসেছিলাম।

১৮/
চীনে বেশ কিছুদিন থেকে আমি একটু একটু করে এদের এত উন্নতি করার কারণটি বুঝতে শুরু করলাম। চীনের উন্নতির মূল গুপ্ত রহস্যেটি খুব সহজ।

প্রথম কথা হল, কোন দেশ উন্নত হতে গেলে দেশের মানুষের ভিতর সেই আকাংখাটা সত্যিকারের থাকতে হবে। অলস কিন্তু দিবা-স্বপ্ন দেখা মানুষ দিয়ে উন্নতি করা যায় না। মানুষের ভিতর কর্ম-স্পৃহা থাকতে হবে, নতুন জিনিস শেখার মানসিকতা থাকতে হবে, নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং আত্ম-উপলোব্ধি থাকতে হবে।

উন্নতি হল একটা লিগ্যাসি। এটা একদিনে হয় না। কয়েক প্রজন্মের চেষ্টাতে উন্নতি হয়। যারা দশ বছরে একটা দেশ উন্নত বানানোর স্বপ্ন দেখেন বা দেখান তারা নিশ্চিত প্রতারক না হয় বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। চীন একদিনে এত উন্নতি করে নাই। চীনের কয়েক প্রজন্মের ত্যাগ আর কষ্টের ফল আজকের চীন যেটা হয়ত ভবিষ্যতে বিশ্বে এক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবে।

একদিন আমি আমার দল আর হোস্ট সহ জিবু শহর থেকে অনেকদূরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গেলাম সিলিকন কার্বাইটের খোঁজে। যাত্রাপথে চীনের অনেক গ্রামাঞ্জলের ভিতর দিয়ে যাবার সুযোগ হল। এমন জায়গাতে হালাল খাবার পাওয়া খুবই অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু আমাদের দলের সবাই যেভাবে হালাল খাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠেছে তাতে হয়ত হোস্টেরাও কিছুটা বিরক্ত। কারণ, পর্ক হয়ত মুসলিমরা খাবে না সেটা মানা গেলেও, মুরগিটাও হালাল-মতে জবাই করা হতে হবে এটা এই রকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশা করা আসলে বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক কম ধারণা থাকার নামান্তর। এদিকে হয়ত ফলমূল, মাছ বা সবজিতে রয়েছে পর্কের তেল বা সস। বাকি যেসব খাবারে হয়ত পর্ক নেই, সেটা হয়ত হালাল মতে জবাই করা না বা রুচী-সম্মত না। যে কারো ধর্মবোধ অনেক প্রবল হতেই পারে। সেক্ষেত্রে বাস্তবতা মেনে নিয়ে যা ধর্মমতে সয় সেটা খেলেই হয় বা একদিন না খেয়ে থাকলেও চলে। কিন্তু কেউ যদি বাস্তবতাও না মেনে, পারিপার্শ্বিকতাও না বুঝে পুরো জাতিকে অভিশাপ দিতে থাকে সেটা অনেকের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে।

যাইহোক, অবশেষে সেই প্রত্যন্ত গ্রামে পৌছালাম। সেই গ্রামে ছোট ছোট বাড়ি আর প্রতিটি বাড়ি যেন একটা ছোটখাটো ইন্ড্রাস্ট্রি। প্রতি বাড়িতেই কিছু না কিছু তৈরি হচ্ছে। এমন না যে বাড়িগুলোতে যে জিনিসগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলো খুব জটিল কিছু। যেমন, কোন বাসাতে হয়ত বালির সাথে কার্বণ মিশিয়ে সিলিকণ কার্বাইট তৈরি হচ্ছে, তার পাশের বাসাতে সেই সিলিকন কার্বাইটগুলো দিয়ে কেউ হিটিং এলিমেন্ট বানাচ্ছে আবার কোন বাসায় নাট-বল্টু তৈরী হচ্ছে। প্রতিটি বাসাই যেন এক একটা ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা। এই জিনিসগুলো বানাতে এমন জটিল কোন যন্ত্র লাগে না, বিশাল জায়গাও লাগে না। পুরো চীনেই এভাবে কোটি কোটি বাসাতে কিছু না কিছু “সহজ জিনিস” তৈরি হচ্ছে। বিন্দু বিন্দু জলে যেমন সিন্ধু হয়, তেমনি বিন্দু বিন্দু শিল্পে চীন পুরো পৃথিবীতে হয়ে গেছে অপ্রতিরোধ্য। আমাদের দেশেও মানুষ চাইলেই নিজের বাসার যেকোন একটা রুমে এমন ছোট ছোট জিনিস বানাতে পারে। হতে পারে সেটা বাচ্চাদের খেলনা, শার্টের বোতাম কিংবা চুলের ক্লিপ বানানোর মত সহজ কিছু। এসব বানাতে তেমন কিছুই লাগে না। শুধু দরকার যেকোন একটা জিনিস ভালোভাবে শেখার ইচ্ছা আর কাজ করে খাওয়ার সদিচ্ছা।

যাইহোক, আমি যখন চীনের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে পৌছালাম তখন দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষগুলোকে দেখলাম, দুপুরের খাবার খেয়ে তাসের মত কি একটা খেলা খেলছে। আমাদের হোস্টেরা জানালো এই খেলা একদম কাঁটায় কাঁটায় দুপুর দুইটা পর্যন্ত চলবে। তারপরে আবার সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময় কাজ ছাড়া অন্য কিছুতে তারা ব্যস্ত হবে না। এবং, এই ব্যবস্থাতেই তারা আনন্দ খুঁজে পায়।

আমরা দুপুর দুইটা পর্যন্ত ওদের সাথে কোন কথা বললাম না। পাছে ওদের খেলার সময়টা নষ্ট হয়ে কাজে স্পৃহা কমে যায়।

দুইটার সময় একজনের বাসাতে গিয়ে সিলিকণ কার্বাইট তৈরির সরঞ্জাম দেখলাম। ওই বাসার মালিক একেবারেই ইংরেজি পারেন না। আমাদের হোস্ট দোভাষী হিসাবে কাজ করছে। বৈজ্ঞানিক টার্ম দোভাষী দিয়ে বলানোর যে কি ঝামেলা সেটা যে না করছে সে ছাড়া কেউ বুঝবে না। কারণ, যে জিনিসটা ইংরেজিতে চট করে বলে ফেলা যায় সেটা ভাষান্তর করতে গেলে হয়ত অর্থই বদলে যায় দোভাষীর কারণে। কারণ যে ভাষান্তর করছে সে হয়ত আক্ষরিক ভাষান্তর করতে গিয়ে শব্দের অর্থ বদলে ফেলছে। তাই আমি চাইছিলাম নিজেই সেই চাইনিজ লোকটাকে বুঝাতে। সেজন্য নিজেই খাতা-কলম নিয়ে এসেছিলাম।

আমি খাতাতে কিছু একেঁ বুঝানোর চেষ্টা করতেই সেই গ্রাম্য লোকটা চট করে ধরে ফেলল আমি কি বলতে চাইছি। সেও প্রতি উত্তরে আমি যা চাইছি সেটা হুবুহু এঁকে দেখালো। কোথায় কোথায় সমস্যা আছে সেগুলোতে গোল দাগ দিয়ে দিল। কিভাবে সেটার সমাধান সে করেছে সেটাও গোল দাগগুলোর পাশে এঁকে দেখাল। আমি অবাক হওয়ার চুড়ান্ত সীমাতে পৌছালাম যখন সে কিভাবে বালির সাথে কার্বণ মিশিয়ে সিলিকণ কার্বাইট তৈরি করছে সেটার রিএকশনগুলো দেখালো।

আমি সেই লোকটার দিকে আবার তাকালাম। সাদামাটা একটা লোক। শরীরে কালিঝুলি লেগে আছে। একেবারে সাধারণ জামা-কাপড় পড়া একটা মানুষ। এই রকম মানুষ আমি বাংলাদেশের গ্রামে অনেক দেখেছি যারা চায়ের দোকানে দুপুর পর্যন্ত হিন্দি ছবির নায়িকা নিয়ে আড্ডা মেরে দুপুরে বাড়িতে এসে তরকারিতে লবন কম হওয়ার জন্য বউকে পেটায়, মানুষের দ্বারে দ্বারে ব্যবসা করার জন্য টাকা ধার নিয়ে বেড়ায়, যৌতুকের টাকার জন্য শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে হাঙ্গামা করে। আমার সামনে দাঁড়ানো লোকটাও এমন হতে পারত। কিন্তু এই লোকটা, চীনের এই গ্রামের মানুষগুলো এবং পুরো চীনের বেশিরভাগ মানুষ তেমন আহামরি শিক্ষিত না হলেও নিজ উদ্যোগে যতটুকু জানে সেটা আরো ভালোভাবে শিখে কিছু প্রোডাকটিভ কিছু করার চেষ্টা করে। এর ভিতরেই এরা আনন্দ খুঁজে নেয়। হিন্দি ছবি নিয়ে কথা বলার সময় এদের নাই।

চীন অনেক ভাগ্যবান যে এদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ আহামরি বুদ্ধিমান না হলেও কাজের মধ্য আনন্দ খুঁজে নেবার মত অসংখ্য মানুষ আছে। চীনের মানুষজনও ভগ্যবান যে এদের সরকার এই মানুষগুলোকে কাজে লাগানোর মত একটা ব্যবস্থা দেশে তৈরি করতে পেরেছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমার কাছে এটাই চীনের এত উন্নতির মূল কারণ বলে মনে হয়।

১৯/
যাইহোক, এই পর্বে নিজের অনেক খাজুরা আলাপ হয়ে গেল। পরের পর্বে এটা কমানোর চেষ্টা করব। এবার কিছু ছবি আর ক্যাপশন হোক।


- জিবু শহরের প্রায় জনমানবহীন পথ-ঘাট।


- জিবু শহরের এক পথে আমি। পিছনের বিল্ডিংটা মনেহয় এই শহরের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং।


- ডঃ ইয়ু এর কনসালটেন্সি ফার্ম। একদম বাম কর্নারে আমি। ডানদিকের কর্নারে ডঃ ইয়ু। তার পাশের দুইজন উনার ছাত্র-ছাত্রী। উনার আরো অনেক ছাত্র-ছাত্রী অফিসে কাজ করতে দেখেছি।


- জিবু শহরের পথ-ঘাট।


- জিবু শহরের পথ-ঘাট।


- দেশে রেখে আসা ইন্দোনেশিয়ান বউ।
______________________________________
পরের পর্বের লিংকঃ চায়না সিরিজ ৭ - ফিরে আসার গল্প (সমাপ্ত)
চায়না সিরিজের সময়কাল ২০১৭ সাল।

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৪:৫৩

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লেখা।
বাংলাদেশ আসলেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার মতো একটা দেশ। অদ্ভুত দেশ।
আপনার পিএইচডি কি শেষ?

১৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৪

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: বাংলাদেশ আসলেই আজব দেশ। পি-এইচ-ডি চায়না যাবার অনেক আগেই শেষ হয়েছিল । আর এই সিরিজের সময়কাল ২০১৭ সাল।

২| ১৫ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৫:০১

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: আপনার লেখার সাবলীলতা আমাকে খুব টানে। চমৎকার লেখা।

১৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৫

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে শুরু থেকে পাশে থাকার জন্য। লেখার প্রশংসা করার জন্য আবারো ধন্যবাদ।

৩| ১৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২৪

জগতারন বলেছেন:
এ-ই প্রথম এই লিখকের লিখা পড়লাম।
পরের পর্বের অপেক্ষায় র'লাম।

১৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪৯

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আমি আসলে ব্লগে ভীষণভাবে অনিয়মিত। ব্লগে আছি প্রায় ১৩ বছর। ২০০৯ থেকে ২০১১ এর শুরু পর্যন্ত অনেক কিছু লিখে প্রায় সাড়ে ৫ বছরের গ্যাপ নেই। ২০১৬ তে একটা পোস্ট করে প্রায় আবার দুই বছর গ্যাপ নেই। ২০১৮ তে কয়েকটা পোস্ট করে আবার লাপাত্তা। এই কারণে আমার পোস্ট হয়ত দেখেন নাই। হাহা

৪| ১৫ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫৯

শাহ আজিজ বলেছেন: ভাল লাগলো ।

১৫ ই জুন, ২০২২ রাত ৮:৫৭

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া।

৫| ১৬ ই জুন, ২০২২ রাত ১২:৫৫

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
সুন্দর গোছানো লেখা
ঠিক আপনার বউয়ের মতো।
আপনার বউ বাচ্চা আর লেখার
জন্য শুভেচ্ছা!

১৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ২:২৭

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনার শুভেচ্ছা সবাইকে পৌছে দেয়া হল।

৬| ১৬ ই জুন, ২০২২ সকাল ১০:৪০

অরণি বলেছেন: চমৎকার বর্ণনা।

১৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ২:২৮

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য আর মন্তব্যের জন্য।

৭| ১৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ১২:২৯

অপু তানভীর বলেছেন: গতকাল রাতে আপনার লেখাটা পড়লাম । মন্তব্য করতে যাবো তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল ! আপনার লেখার হাত খুবই চমৎকার আর ঝরঝরে ! সিরিজ চলতে থাকুক !


উইচ্যাট নামে একটা ম্যাসেজিং এপস আছে । আমি যতদুর জানি যে এই এপসটা বাংলাদেশ আর চায়নাতে দুই জায়গাতেই কাজ করে ।

১৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ২:৩৩

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য আর পাশে থাকার জন্য। লেখার প্রশংসা শুনে সত্যি লজ্জা পাচ্ছি।

চায়নাতে যখন ছিলাম তখন উই চ্যাট অথবা লাইন নামের কোন এপ ব্যবহার করছিলাম। ঠিক মনে নাই, তবে এই এপ গুলাতে প্রাইভেসির খুব সমস্যা। ব্যবহার করে শান্তি পাই নাই। বাই দ্যা ওয়ে, বাংলাদেশে এখনো কারেন্ট যায়?

৮| ১৬ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৫:৪৪

রাজীব নুর বলেছেন: ধন্যবাদ আমার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য।
ভালো থাকুন।

১৬ ই জুন, ২০২২ রাত ৮:২২

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: আবারো ধন্যবাদ।

৯| ১৭ ই জুন, ২০২২ ভোর ৫:০৭

সোহানী বলেছেন: চায়নার আলোক দিক নিয়ে লিখেছেন। আর সেটাই বাস্তবতা। একটি দেশকে এরকম জায়গায় দাঁড় করাতে বা চাকচিক্য ধরে রাখতে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়। যার কোনটাই ছাড় দেয়নি চীন। আর তাই তারা এখানে। তাদের অন্ধকার দিক কাউকে দেখায় না। সেটা যদি দেখতে পেতেন তাহলে আঁতকে উঠতে হতো।

সেই কঠোর পদক্ষেপ বাংলাদেশের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হবে বলে মনে করি না। বা এ নিয়ে চিন্তার করার মতো কেউ আছে কিনা সেটা ও সন্দেহের।

আর কেন আমরা দেশ ছাড়ি তা দেশের মানুষকে বলে লাভ নাই। তারা তাদের গানই শোনাবে।

যাহোক ভ্রমণ লিখায় ভালোলাগা। আর সুন্দরী ভাবীকে শুভেচ্ছা।

১৭ ই জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫৩

আরাফাত৫২৯ বলেছেন: আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এত ডিটেইলস মন্তব্য করার জন্য। আমার আগের লেখাগুলোতে চায়নার কালো দিকগুলো নিয়েও লিখেছি, যেমনঃ চায়নার গণতন্ত্র, কালকারখানার পরিবেশ, শ্রমিকের নিরাপত্তা ইত্যাদি। আপনার কথা ঠিক, বাংলাদেশকে আরো বহুপথ পাড়ি দিতে হবে। শুধু ইনফ্রাস্টাকচার না, মানুষের মন-মানসিকতাও চেঞ্জ করতে হবে। আপনার জন্য শুভকামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.