![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পবিত্র কোরআন শরীফে যে জিনিসটার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু যে জিনিসটা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে আছি তা হলো মাইন্ডফুলনেস। শব্দটি খুবই ছোট কিন্তু এর ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। মহানবী সাঃ সদা সত্যের আশ্রিত হয়ে, আজীবন চিন্তাশীল- সহনশীল হয়ে, অন্যের প্রতি দয়াবান হয়ে, হেরা গুহায় ধ্যান করে এই মাইণ্ডফুলনেস নিজের মাঝে তৈরি করেছিলেন। আর তাঁর মাঝে যখন এর পূর্নতা এসেছিলো- তখনই আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের ওহি তাঁর কাছে পৌঁছেছিলো।
এই জিনিসটা যার মাঝে তৈরি হয়- সে তার কর্মে নিষ্ঠাবান হয়, ভালোবাসায় বিশুদ্ধ হয়, চিন্তায় শানিত হয়, মননে উন্নত হয়। তার হৃদয় হয় কুসুম কোমল, কিন্তু তার দৃঢ়তা হয় হিমালয়ের মতো অবিচল। খুব সহজেই তাকে ম্যানুপুলেট করা যায়না। সে একটা ঘাসের ওপর পা রাখতেও চিন্তা করে, মুখ থেকে একটা জবান বের করতেও ভাবনা করে। সে লোভের উর্ধ্বে ওঠে । ঘৃণা থেকে দূরে থাকে। সে নিজের ব্রেণে একটা সিগন্যাল তৈরি করে। সে ভাবে- কোনটা করা ঠিক, আর কোনটা করা বেঠিক।
বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত সবাই ধার্মিক। পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নাই- যার ধর্ম নাই। অনলের ধর্ম হলো পুড়ানো, সলিলের ধর্ম হলো বয়ে যাওয়া, পবনের ধর্ম হলো প্রবাহিত হওয়া, বৃক্ষের ধর্ম হলো পত্রপল্লবিত হওয়া। এমনকি যে ধর্ম করেনা সেও ধার্মিক। ধর্ম না করাটাই হলো তার ধর্ম। যার যার ধর্ম যেমন থাকে তার তার কর্মও তেমন থাকে। কিন্তু যেটা ফারাক তৈরি করে দেয় সেটা হলো এই মাইণ্ডফুলন্যেস।
ধর্ম নিয়ে মিস্টিক সাধক শামস তাবরিজি একটা সুন্দর গল্প বলেছিলেন।
বিষাক্ত বৃশ্চিক নদীর এই পাড় থেকে ঐ পাড়ে যাবে। কিন্তু নদীর কোনো মাছ তাকে পার করাতে চায়না। শেষে এলো এক কচ্ছপ। বৃশ্চিক বলে-ও ভাই কচ্ছপ আমাকে একটু নদী পার করে দাও।
কচ্ছপ বলে- তোমাকে আমি পাড় করে দিতে পারি। এতে আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হলো- তুমি তো খুবই বিষাক্ত। তোমার এক কামড়ে আমার জীবনাবসান হতে পারে। মাঝ নদীতে গিয়ে যদি তুমি আমাকে কামড়ে দাও- তখন আমার কি হবে।
বৃশ্চিক বলে - এ কেমন কথা। তোমাকে যদি আমি কামড়ে দেই - তাহলে তো শুধু তুমি ডুববে না। আমিও যে ডুবে মরবো।
এ কথা শুনে কচ্ছপ রাজী হয়। কচ্ছপের পিঠে ওঠে বৃশ্চিক।
মাঝ নদীতে এসেছে দুজন। আর ঠিক এই সময় বৃশ্চিক কচ্ছপকে কামড়ে দেয়।
বিষাক্ত বৃশ্চিকের যণ্ত্রণাদায়ক কামড়ে নীল হয়ে যাচ্ছে কচ্ছপ। তীব ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তার পুরো দেহ অবশ হয়ে যাচ্ছে। সে অল্পক্ষণেই মারা যাবে।
কচ্ছপ তখন বৃশ্চিককে বলছে- ও ভাই বৃশ্চিক - তুমি কি বললে আর কি করলে। আমাকেতো তোমার কামড়ানোর কথা ছিলো না।
বৃশ্চিক বলে- কি করবো বলো ভাই। কামড় না দিয়ে যে আমি থাকতে পারিনা। কারণ- এটাই যে আমার ধর্ম। এটাই যে আমার স্বভাব।
মানুষ যে শুধু বই পড়লে আর বিদ্যা অর্জন করলেই তার মাঝে মাইণ্ডফুলন্যেস তৈরি হবে তা না। এটা আসতে হয় হৃদয়ের একবারে গভীর থেকে। নিজের বিশুদ্ধ ভাবনার জগৎ থেকে। তখন আমি নবম কিংবা দশম শ্রেণীতে পড়ি। খেয়া নৌকা পার হতে ঘাটে এসেছি। দেখি এক মাঝি তাঁর নৌকায় বসে আছেন। আর কিছু দূরেই দু গ্রুপের মাঝে লবণ/চিংড়ি ঘের দখলেই তীব্র লড়াই হচ্ছে। আর অনেক মানুষ চারপাশে থেকে সেটা উপভোগ করছে।
মাঝিকে বললাম- ভাই - আপনি এখানে একা বসে আছেন। ঐ দিকেতো ঘের দখলের তীব্র লড়াই হচ্ছে। আপনি দেখতে গেলেন না।
মাঝি বললেন- এই দখল বেদখলের খেলা এভাবেই চলছে ভাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমার লাভ কি? ওখানে যাবো। দৈবাৎ যদি আমার মাথায় একটা বাড়ি পড়ে,তখন কে আমাকে দেখবে, কে আমার চিকিৎসা দেবে , কে আমার ঘর সংসারের ভরণ পোষণ করবে। আমি এক সাধারণ নৌকার মাঝি। যাত্রি পারাপার করে দিলে আমার দুটাকা আয় হয়। এতেই আমার ঘর সংসার চলে। ওখানে গেলে আমার পোষাবে না ভাই। সূর্যাস্তের আগেই আমার যা আয় করার করে নিতে হবে।
ওনার কথা শুনে আমি অভিভূত, মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আজকে ভাবি- কোনো উচ্চ শিক্ষা না নিয়েও একজন সাধারণ খেয়া নৌকার মাঝির মনে কি সুন্দর মাইন্ডফুলনেস তৈরি হয়েছে। ওনি ভেড়া হতে পারতেন । কিন্তু হিমালয় হয়ে বসে আছেন। এই লোককে কেউ সহজে দলে ভিড়াতে পারবে না। এই লোকের রক্তের ওপরে কেউ তার উদ্দেশ্যে হাসিল করতে পারবে না।
শেখ সাদীর একটা গল্প বলি।
একদিন উনি এক বরফ বিক্রেতাকে দেখেন। যে তার পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে মানুষকে আকুলভাবে বলছে-ও ভাই আমার প্রতি দয়া করুন। আমার মূলধন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ঐ বিক্রেতার মূলধন হলো তার বরফ হয়ে জমে থাকা পানি এবং এই পানি পড়ে গেলে তা আর বরফের কাছে ফিরে আসে না।
এরপর শেখ সাদি বলেন- ঠিক ঐ সময়েই আমি অনুধাবন করলাম- এটি হলো সূরা আসরের সত্যিকারের শপথের আসল মানে।
মানুষের জীবনের মূলধন হলো তার সময়। .যা প্রতি মুহুর্তে এভাবে গলে গিয়ে গিয়ে নিঃশেষ হচ্ছে।
খেয়া নৌকার মাঝি যেমন ভেবেছিলেন- সূর্যাস্তের আগেই উনাকে যা আয় করার আয় করে নিতে হবে। ঠিক তেমনি একজন মানুষ যার মাঝে মাইন্ডফুলন্যেস তৈরি হয়েছে-সে ভালোভাবেই বুঝতে পারে জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত সে কিভাবে পার করবে। কারো প্রতি দয়াবান হয়ে না কি ঘৃণা ছড়িয়ে, কাউকে ভালোবেসে না কি আঘাত করে, কাউকে উস্কে দিয়ে না কি শান্ত করে, কারো স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হয়ে না কি কারো শান্তির আশ্রয় হয়ে, সমাজে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে না কি সুবাসে ভরিয়ে দিয়ে, কারো চোখে অশ্রু ঝরিয়ে না কি কারো মুখে হাসি ফুটিয়ে, কারো ঘর অন্ধকার করে না কি কারো আশার বাতিঘর হয়ে, কারো দুঃখের কারণ হয়ে না কি সুখের আয়োজন হয়ে।
শুধু ব্যক্তিগত জীবন না। পুরো দুনিয়ার একমাত্র সমস্যার সমাধান হলো পবিত্র কোরআনে যে মাইন্ডফুলন্যেস তৈরি করার জন্য বারবার মানুষকে তাগিদ দেয়া হয়েছে-সেটার দিকে ফিরে যাওয়া। আমাদের সবার ধর্ম আছে, কর্ম আছে কিন্তু মানুষের মাঝে এই মাইন্ডফুলন্যাস না থাকার কারণে- পুরো বিশ্ব আজ এতো বেশী সাফার করছে।
©somewhere in net ltd.