![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭২ সাল। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওয়াল্টার মিশেল এক অদ্ভুত কিন্তু অত্যন্ত গভীর এক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করেন শিশুদের উপরে। যা পরে ‘মার্শমেলো টেস্ট’ নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।
অধ্যাপক মিশেলের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছিল এই গবেষণার পেছনে। তাঁর দুই মেয়ে টিনা ও সাবরিনার বয়স ছিলো চার এবং ছয় বছর । তারা একটি স্কুলে যেতো যেখানে আরও বিশজন শিশু ছিল। মিঃ মিশেল সেই স্কুলের শিশুদেরকেই তাঁর পরীক্ষার অংশ করেন।
প্রতিটি শিশুকে একে একে একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের সামনে রাখা হয় একটি মার্শমেলো এক ধরণের নরম ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যা শিশুরা খুবই পছন্দ করে।
তারপর অধ্যাপক প্রতিটি শিশুকে আলাদা করে বলেন: তুমি চাইলে এখনই এটা খেয়ে নিতে পারো। তাহলে এই একটিই পাবে।
কিন্তু যদি ১০ মিনিট অপেক্ষা করো তাহলে তুমি আরও একটি পাবে। মোট দুটি।
এরপর তিনি কক্ষ ত্যাগ করেন এবং প্রতিটি শিশুর প্রতিক্রিয়া নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে থাকেন।
তিনি দেখেন- কেউ সঙ্গে সঙ্গেই মার্শমেলো খেয়ে ফেলে। কেউ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। কেউ চোখ বন্ধ করে অথবা মুখ ঘুরিয়ে নেয় যেন দেখতেই না পায় লোভনীয় খাবারটিকে। কেউ হাত দুটো পেছনে রাখে। আবার কেউ অদ্ভুত উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে যাতে সময় পেরিয়ে যায়।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়।
সময় গড়িয়ে যায়। দুই দশকেরও বেশি পেরিয়ে গেছে। অধ্যাপক মিশেল তখন বয়সের ভারে নত। আর টিনা, সাবরিনাও প্রাপ্তবয়স্ক।
থ্যাংকস গিভিং ডে হলো আমেরিকার একটি বিশেষ হলিডে। সেদিন মোটামুটি সবাই আপনজনের টানে বাড়ি ফিরে আসে। টিনা,সাবরিনাও এসেছে। মধ্যাহ্নভোজের পর তারা মিলে শৈশবের বন্ধুদের গল্প করছিল। পাশে বসে থাকা তাদের পিতা শুনছিলেন সেই স্মৃতিচারণা।
হঠাৎ তাঁর সেই পুরনো গবেষণার ডায়েরিটির কথা মনে পড়ে । তিনি ডায়েরিটি বের করে প্রত্যেক শিশুর নাম ধরে জানতে চান, কে এখন কী করছে।
ফলাফল ছিলো অবিশ্বাস্য সুন্দর।
যারা শিশু বয়সেই নিজেকে সংবরণ করতে পেরেছিলো। তারাই ভবিষ্যতে শুধু শিক্ষা আর ক্যারিয়ারে সফল হয়নি। তাদের পারিবারিক জীবনও হয়েছে সুন্দর, শান্ত, সুখি,সমৃদ্ধ। তাদের জীবনে মানসিক স্থিতি এসেছে, জীবনদর্শনেও এসেছে পরিপক্কতা।
নরওয়ের খ্যাতিমান সাইকোলোজিস্ট ফিন স্কারদেরোড বলেছিলেন- একজন মানুষের চেতনা বা কনসাসনেস যা শৈশবে গড়ে ওঠে তাই সারাজীবন তাকে চালিত করে।
এরপর ঘটে আরেক ঘটনা। যা খুবই চিন্তার এবং বেদনার।
অনেক বছর পর স্ট্যানফোর্ডে আবার সেই একই পরীক্ষার আধুনিক সংস্করণ করে। এবার শুধু মার্শমেলো নয় । সাথে যোগ হয়েছে স্মার্ট ডিভাইস।
ফলাফল?
২০ জন শিশুর মধ্যে ১৮ জনই মার্শমেলো ছেড়ে আগে হাত বাড়িয়েছে ডিভাইসের দিকে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আজকাল মানুষের মন প্রতি চার সেকেন্ডে একবার বিভ্রান্ত হয়। আর একবার মন বিভ্রান্ত হলে সেই মনকে আবার আগের কাজের কেন্দ্রে ফেরাতে গড়ে লাগে প্রায় ৩২ মিনিট। আমাদের মন এখন একটি পিং পং বলের মতো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে অনবরত। কোনো গভীরতায় সে আর স্থির থাকতে পারছে না।
এই ডিভাইস-নির্ভরতা শিশুদের কনসাসনেসে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করছে। শুধু শিশুরা নয়। প্রাপ্তবয়স্করাও এই নেশার ফাঁদে বন্দী।
আজকাল কেউ আর দীর্ঘ লেখা পড়তে চায় না। প্রতি চার সেকেন্ডেই আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি পড়বো কি পড়বো না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যেই তৈরি হয়েছে নতুন আসক্তি। আমরা জানি না ঠিক কবে থেকে আমাদের আঙুল নিজের ইচ্ছেতেই স্ক্রিনে ওপরে নিচে নেমে যাচ্ছে, এক রিল থেকে আরেক শর্টসে। এক মিম থেকে আরেক গিফে।
ঠিক যেমন ক্যাসিনো মালিকেরা জানেন ক্যাসিনোতে সবাই জিতে না, বেশিরভাগই হারে। তারপর যায় এক নেশায়। আজকের প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা জানি রিলস বা শর্টস দেখে বড় কিছু শিখছি না। তবু আমাদের মন যেন বাধ্য হচ্ছে দেখতে। আমাদের আঙুল, চোখ আর মন সব যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।
আমরা বসে থাকতে পারি না। মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না, গভীর চিন্তা করতে পারি না। ফিলানত্রোপিস্ট ওয়ারনে বাফেট প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচশত পাতা পড়েন। আগামী পৃথিবীতে হয়তো মহাযুদ্ধ হবে। কিন্তু মহাকাব্য আর রচিত হবে না। কারণ আমাদের এখন পাঁচ শ রিল দেখার সময় আছে কিন্ত পণ্চাশ পাতা পড়ার সময় নাই। আমাদের এই ব্যাধির শুরু হয়তো আমাদের অজান্তেই হয়েছে কারো মার্শমেলো দিয়ে আর কারো একটা স্মার্ট ডিভাইস দিয়ে।
এই অবস্থা সত্যই আশংকাজনক আর এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। শিশুদের মধ্যে ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে। বয়স্কদের মন ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে।
আর আপনি যদি এই লেখাটি ধৈর্য ধরে এতোক্ষণ পর্যন্ত পড়ে থাকেন তবে আপনি ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন আপনার ভেতরে এখনো অপেক্ষার, মনোযোগের, চিন্তার শক্তি বেঁচে আছে। যে শক্তিটা এই অস্থির সময়ে সবচেয়ে মূল্যবান। আর এজন্য আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.