নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যের সন্ধানে ....

সত্যান্বেসী

কলকাতা হাই কোর্টের উকিল

সত্যান্বেসী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ওয়াহাবী আন্দোলন: ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের উত্স

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৪১


বহুদিন ধরে ইচ্ছা ছিল যে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ যা আজ বিশ্বে এক জ্বলন্ত সমস্যা তার উত্সমুল কোথায় তার অনুসন্ধান করব | এইটুকু শুধুমাত্র জানি যে সৌদি আরবের ওয়াহাবিরা জিহাদিদের বিশ্বজুড়ে সাহায্য করছে | কিন্তু এই ওয়াহাবিরা কারা ? এদের সাথে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের কি সম্বন্ধ ? এটা জানা দরকার ছিল | এই চক্করে কলেজ স্ট্রিট ঘুরছিলাম | তখন মল্লিক ব্রাদার্সে ওয়াহাবী আন্দোলনের উপর একটা গোটা বইই পেয়ে গেলাম | আব্দুল মউদুদের লেখা | এই বইতে আব্দুল ব্রিটিশ আমলে মুসলিম সমাজের উপর যে তিনটি প্রবন্ধ জনৈক ইংরাজ লিখেছিলেন সেই তিনটি প্রবন্ধ দিয়েছেন | এবং তাদের জবাবও নিজের মত করে পরিশিষ্টে দিয়েছেন | আমি আমার এই লেখায় নিরপেক্ষতা রাখতে ওই ইংরাজ আর আব্দুল দুজনেরই বক্তব্য রাখব এবং তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখব কোনটি সঠিক এবং সত্য কি ? যেখানে দুজনের মধ্যে মতবিরোধ আছে সেখানে তারকা চিহ্ন দেয়া আছে |

*ওয়াহাবী আন্দোলনের উত্স

এবিষয়ে দুজনেই একমত যে আব্দুল ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তি এই আন্দোলন শুরু করেন | আব্দুল ওয়াহাবের শিক্ষা হলো সকল মুসলমানেরই উচিত যে এক আল্লাহের উপর বিশ্বাস রাখা | হজরত মহম্মদ বা অন্য কোনো ওলীদের মর্যাদা অযথা বাড়িয়ে না তোলা যাতে আল্লার মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় | মুহম্মদের পর যত অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে সেগুলি বর্জন করা এবং ইসলাম শুরুতে যেমন সহজ সরল ছিল তেমন অবস্থায় ফিরে যাওয়া |চার শতাব্দীর মধ্যে ইসলামে বহু পৌত্তলিকতা বা বেদাত প্রবেশ করেছিল |ওয়াহাব সেইসব বেদাত দূর করতে বলেছিলেন | তিনি তলোয়ারের মুখে ইসলাম প্রচারের শিক্ষা দেন কারণ এটাই মুহম্মদের সময় প্রচলিত ছিল | ইংরেজ প্রাবন্ধিকের এইটাই লেখা |মউদুদ বলেন যে তলোয়ারের মুখে ইসলাম প্রচার কখনই হয়নি |

এছাড়া মউদুদ বলেন যে ওয়াহাব আরব জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা | ইংরেজ এবিষয়ে কিছু বলেন না |

আরবে ওয়াহাবী আন্দোলন

ওয়াহাবের শিষ্য ইবন সউদ ওয়াহাবী মত নিয়ে রাজনীতি করতে থাকেন এবং ক্রমে মধ্য আরব দখল করেন | এটা যুদ্ধের মাধ্যমেই করা হয়েছিল | এই বিষয়ে ইংরাজ ও মউদুদ দুইজনেই একমত | ইংরাজ বলেন যে ওয়াহাবের পুত্র, সৌদের মুরুব্বিয়ানায় মধ্য আরবের শাসক হন | মউদুদ বলেন যে বেদুইনরা ওয়াহাবীদের পতাকার তলায় আসতে থাকে | মূলত তাদের নিয়েই ওয়াহাবী বাহিনী তৈরী হয় | মূলত এই বেদুইনরাই আরব দখল করে |

*কিভাবে ওয়াহাবী আন্দোলন ভারতে এলো ?

এই বিষয়ে ইংরেজ বলেছেন যে আরব থেকে আসা হাজীদের দ্বারা ওয়াহাবী মতবাদ ভারতে প্রচারিত হয়েছিল | হাজী শরীয়তুল্লা নিম্নবঙ্গে এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন | তিনি ছিলেন ফারাজী মতবাদের স্রষ্টা | আরেক হাজী শাহ আব্দুল আজিজ দিল্লিতে এই মতবাদ প্রচলন করেন | অন্য দিকে মউদুদ বলেন যে আরবে ওয়াহাবী নামে কোনো মত নেই | এই ওয়াহাবী নামটা ইউরোপিয়ান আর তুর্কীদের সৃষ্টি |

*সৈয়দ আহমেদের জীবন

ইংরাজ বলেন আহমদ প্রথম যৌবনে পিন্ডারী নাম একজনের দলে দস্যুবৃত্তি করত | তারপর তিনি দিল্লি আসেন আর শাহ আব্দুল আজিজের মুরিদ হন | সেখান থেকেই ওয়াহাবী মত গ্রহণ করেন | দুজন মুসলিম পন্ডিত আহমেদের অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠেন : আজিজের ভাইপো মৌলানা মুহাম্মদ ইসমাইল আর জামাই মৌলানা আব্দুল হাই | এরা দুজনেই আহমেদের মুরিদ হন | আহমেদের আরো বহু মুরিদ হন | এদের নিয়ে তিনি ভারতে শিখ আর ইংরাজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেন | এই মুহাম্মদ ইসমাইল সিরাতুল মুস্তাকিম নাম গ্রন্থ রচনা করেন | এটা ভারতে ওয়াহাবীদের কোরানতুল্য | তিতুমীরও আহমদের মুরিদ ছিল | এখানে মউদুদের সাথে বিরোধ | তাঁর মতে তিতুমীরের সাথে মক্কায় তাঁর সাক্ষাত হয় |

মউদুদ সৈয়দ আহমেদের সম্বন্ধে বিস্তারিত তার দ্বিতীয় প্রবন্ধে বলেছিলেন | তিনিও সৈয়দ আহমেদের শিখ আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার কথা বলেছেন | সেটাও বিস্তারিত ভাবে | তিনি বলেছেন যে ভারত জুড়ে মুসলিমদের উপরে শিখ আর ইংরেজদের অত্যাচারে তিনি ব্যথিত | সারা দেশ তাঁর মতে কুফুরী আর বেদাতিতে ছেয়ে গেছে | তাই তিনি হিজরত আর জিহাদ করতে চান | এইজন্যই আহমেদ জিহাদ করেন | তিনি আহমেদকে গ্লোরিফাই করেছেন |

সৈয়দ আহমেদ ধর্ম থেকে সমস্তরকম জাঁকজমক আর অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন | তিনি ইসলামের সোজাসাপ্টা পথে চলতেন আর তার মুরিদদের চলতে বলতেন | তিনিও সবরকম আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করার শিক্ষা দিয়েছিলেন | এটা মউদুদ নিজের প্রবন্ধে বলেছেন |
তিনি আল্লার পথে চলতে গেলে সামরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এবং নিজে পিন্ডারির অধীনে সামরিক শিক্ষা নিয়েছিলেন | এখানে একটা বিরোধ আছে | ইংরাজ বলেন পিন্ডারী দস্যু ছিল আর মউদুদ বলেন সে টংক-এর নবাব ছিল |

সৈয়দ আহমেদের শিক্ষা

ইংরাজ বলেন যে আহমেদের শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে চরম অদৃষ্টবাদ ও এক আল্লাহে অকুন্ঠ বিশ্বাস | মানুষের কিছুই করার যোগ্যতা নেই নিজের প্রচেষ্টায় | তাকে একান্তভাবে আল্লার ওপর নির্ভর করতে হবে | আল্লা মানুষের জন্মের বহু পূর্বেই সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন |মানুষ স্বাধীন সত্তা নয় , কিন্তু সে নিজেকে স্বাধীন মনে করে কর্মফলের জন্য নিজেকে দায়ী করে | এসবই সিরাতুল মুস্তাকীমে লেখা আছে | অনেকটা গীতার কর্মযোগের মত শোনাচ্ছে |

মউদুদ বলেছেন যে আহমেদের শিক্ষার মূল কথা হলো ধর্ম থেকে জাঁকজমক দূর করা | সাধাসিধে জীবন যাপন করা যাতে করে মানুষ একটা মহৎ জীবন যাপন করে ও আল্লার করুনার পাত্র হয় | তিনিও নিজের ইচ্ছা আশা আকাঙ্খাকে বিসর্জন দিয়ে আল্লার পথেই চলতে বলেছিলেন |

*ভারতে ওয়াহাবী বা সংস্কার আন্দোলন

ইংরেজ প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন যে সৈয়দ আহমেদই ভারতে এই সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছেন এবং তিনি একাই এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিলেন | তিনি ভারতজুড়ে মুরিদ বানিয়েছেন, খলিফা বানিয়েছেন আর ভারত্টাকে তার খলিফাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন | তিনি পাঞ্জাবে শিখদের বিরুদ্ধে আর ভারতে ইংরাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন | তিনি এমনকি পেশোয়ার আর সিন্ধের মধ্যবর্তী ইউসুফজাই পাহাড়ের আদিবাসীদেরও জেহাদে সামিল করতে গিছ্লেন |

অন্যদিকে আব্দুল মউদুদ দেখিয়েছেন যে আহমেদ ছিল গোটা ভারতব্যাপী মুসলিমদের সংস্কার আন্দোলনের এক নগন্য কর্মিমাত্র | তাঁর সাথে আরো অনেকে এই সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন | তিনি দেখিয়েছেন যে আহমেদের অনেক আগে থেকেই মুসলিম সমাজে হিন্দুদের থেকে যেসমস্ত কুসংস্কার যেমন পিরপুজা , কবরপূজা, সিন্নি ইত্যাদি ঢুকেছিল তার সংস্কার শুরু হয় | আহমেদ জাস্ট একজন সংস্কারকমাত্র ছিলেন | তিনি কোনো বড় কিছু ছিলেন না | আর মউদুদ এটাকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলে মানেন না | তাঁর মতে এটা সংস্কার আন্দোলন আর ওয়াহাবী শব্দটা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র | অনেক সংস্কারক ছিলেন : দুদু মিঞা, তিতুমীর, কেরামত আলী ইত্যাদি |
এছাড়াও মুসলিমরা ইংরাজের হাত থেকে পুনরায় শাসন ছিনিয়ে নেবার জন্য লড়েছিল | তারা ভারতকে দারুল হারব থেকে দারুল ইসলাম বানাতে চেয়েছিল |

এটাই ওই ইংরাজের সঙ্গে মউদুদের বিরোধের আসল পয়েন্ট |

এছাড়া ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে ভারতের আন্দোলনের যোগ নেই কারণ আহমেদ যখন এটা শুরু করেন তখন তিনি আরবে যাননি |

জেহাদী সাহিত্য

ইংরাজ প্রবন্ধকার জিহাদী সাহিত্য বলতে সিরাতুল মুস্তাকিমকে বলেছেন | মউদুদ আরো কতগুলি জিহাদী সাহিত্যের কথা বলেন : রিসালা ই জিহাদ, কাসিদা,শিররকায়া, আসার মাহাসার, তাকিয়াতুল এমাম, নাসিহাতুল মুসলেমিন, হিদায়াতুল মুমেনীন, তানবীর উল আইনাইন, তামবিহ উল গাফেলীন, চিহিল হাদিস ইত্যাদি | এদের শিরোনাম থেকেই বিষয়বস্তুর আঁচ পাওয়া যায় |

তাহলে সত্যি কি ? কে ঠিক ?

এবার বিচার বিশ্লেষণের পালা | আমরা শুধু ওয়াহাবী আন্দোলন আজকের ইসলামী সন্ত্রাসবাদের উত্স কিনা তাই বিচার করব | প্রথমে বিরোধগুলো দেখা যাক |

ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলন কিভাবে এলো এই নিয়ে ইংরাজ আর মউদুদের বিরোধ | ইংরাজ বলে ভারতে আরব ফেরত হাজীদের মাধ্যমে ওয়াহাবী এসেছে | মউদুদ ওয়াহাবীদের অস্তিত্বই অস্বীকার করেন | কে সত্য ? যদি ওয়াহাবীদের কোনো অস্তিত্বই না থাকত তাহলে ইসলামী দুনিয়ায় প্রলয় করেছিল কারা ? কারা হজরত মহম্মদের মাজার ভেঙ্গেছিল ? কারা সমস্ত মাজার আর মকবেরা ভেঙ্গে দিয়েছিল ? কেন ভেঙ্গেছিল যদি তারা চার ইমামের মতেই বিশ্বাস করবে ? এই মতে বিশ্বাসী অন্য কেউ মাজার মকবেরা আগে ভাঙ্গেনি কেন ? এদের এইসব কাজই দেখায় একটা পৃথক মতের অস্তিত্ব | সেটাই ওয়াহাবী মত | সুতরাং ইংরেজ ঠিক আর মউদুদ ভুল | ওয়াহাবী মতের অস্তিত্ব ছিল | তবে তুর্কিরা ওয়াহাবীদের শেষ করে দিলে ওই মতে বিশ্বাসীরা শেষ হয়ে যায় কিন্তু ভারতে ওই মত এবং তাতে বিশ্বাসীরা টিকে থাকে |

এছাড়া আছে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের হাস্যকর কারণ : আহমেদ আন্দোলনের আগে আরবে যাননি | যেন আরবে না গেলে ওয়াহাবী মত জানা যায় না | ঠিক কথা আহমেদ আন্দোলনের আগে আরবে যাননি কিন্তু তিনি আরব ফেরতা হাজীদের মুখে ওয়াহাবী মত শোনেন ও তাতে প্রভাবিত হন |

মউদুদ আরেকটা প্রবন্ধে নিজেই ভারতের আন্দোলনকে ওহাবী আন্দোলন বলেছেন | বিপ্লবী আহমদুললাহ-এর উপর লেখা আরেকটা প্রবন্ধে ভারতের মুসলমানদের জিহাদকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলেছেন | অথচ তিনিই প্রথমে বলেছিলেন যে ভারতের আন্দোলন ওয়াহাবী মত্পুষ্ট নয় | এপ্রসঙ্গে তিনি ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের উক্তিও দিয়েছেন | উপরে তাই নিয়ে বললাম |
এছাড়া মউদুদ বলেছিলেন তলোয়ারের মুখে ইসলাম কখনই প্রচারিত হয় নি | তাহলে সীরাতুন নবীতে যে মুহাম্মদের যুদ্ধযাত্রার বর্ণনা আছে তা মিথ্যে হয়ে যায় | ইসলামের নামে যে ক্রুসেড হয়েছিল তা মিথ্যে হয়ে যায় | ভারতে মুঘলরাও ইসলামের নামে ঢুকেছিল | এটাও মিথ্যে হয়ে যায় | কিন্তু এগুলো সত্যি অতএব মউদুদ মিথ্যে | ইংরেজ ঠিক |

আহমেদের জীবন নিয়ে খুব কমই বিরোধ আছে | তবে ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনের রূপরেখা অংশটাই মূল বিরোধ | কে এই সংস্কার আন্দোলন চালিয়েছিল ? সৈয়দ আহমেদ না মুসলিম ধর্মগুরুরা ? যদি ধর্মগুরুরা আহমেদের আগে থেকে সংস্কার আন্দোলন চালান তাহলে আহমেদের সময় সারা দেশ কুফুরী আর বেদাতিতে কি করে ভরা থাকে ? যা দেখে আহমেদ জিহাদ করতে চেয়েছিলেন ? যদি আহমেদ একজন নগন্য সৈনিকমাত্র হন তাহলে আর সব ধর্মগুরুদের জিহাদের গপ্প কেন শোনা যায় না ? কেনই বা আব্দুল আজিজ আহমেদের কাজেকর্মে বিরক্ত হয়ে তাকে বাদ দিয়ে অন্য একজনকে উত্তরসুরী বানিয়েছিলেন ? কিভাবেই বা আহমেদের এত মুরিদান হয় ? এইসব গপ্পো তো মউদুদ শুনিয়েছেন | সুতরাং মউদুদ এখানে নিজেই নিজের প্যাঁচে পড়ে গেছেন | অতএব আহমেদই এই ওয়াহাবী আন্দোলন চালান ও সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন | তিতুমীর , দুদু মিঞা ছিলেন তারই সহযোদ্ধা | এই বিষয়ে ইংরাজ সঠিক ছিলেন |

তাহলে দেখা যাচ্ছে ইংরাজ ঠিক আর মউদুদ ভুল | মউদুদের দোষ নাই | মুসলিম জিহাদিদের পিঠ বাঁচাতে মডারেট মুসলিমরা এইভাবেই মিথ্যার জাল বোনে | জিহাদকে জায়েজ বানানোর জন্য মডারেট মুসলিমদের এই প্রচেষ্টাই তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে | এই চেষ্টা করতে গিয়ে মউদুদ নিজেই স্ববিরোধিতা করেছেন অর্থাৎ নিজের জালে নিজেই ফেসেছেন | মউদুদ একটা ডাহা মিথ্যেবাদী |

তবে এইলেখা থেকে বামপন্থীদের মুসলিম তোষণের উদাহরণ পাওয়া যায় | আমরা ছোটবেলায় তিতুমীর আর দুদু মিঞার কাহিনী পরেছিলাম স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে | ইংরেজদের বিরুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবে | কিন্তু তাদের আসল চেহারা কি ছিল তা মউদুদের এই বইটা থেকে জানা যায় | তারা আসলে ওয়াহাবী ছিল | ভারতে আবার মুসলমানের শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছিল | হিন্দুদের সাথে তাদের অজস্র বিরোধ ছিল | এইসব তথ্য উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে চেপে যাওয়া হয় |চেপে যাওয়া হয় মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের কথা ভেবে |

এছাড়াও আছে সৈয়দ আহমেদের হাস্যকর কাজ | তিনি একদিকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে মানুষ নিজের ইচ্ছে কিছু করতে পারে না | তাকে প্রতিপদে আল্লার ওপর নির্ভর করতে হয় | তার নিজের স্বাধীন সত্তা নেই | আবার নিজেই মহা উদ্যমে সৈন্যসামন্ত জোগার করে জিহাদ করছেন | কিন্তু কেন ? তিনি কেন আল্লার উপর নির্ভর করে বসে রইলেন না, কখন আল্লা দারুল হার্বকে দারুল ইসলাম বানান ? তিনি নিজে অদম্য উদ্যমে কেন ময়দানে নামলেন ? এতেই বোঝা যায় যে আহমেদ কতবড় ঝুটা মাল | এইজন্যই কি আহমেদের গুরু আব্দুল আজিজ শেষে তার উপর বিরক্ত হয়েছিলেন ? অবশ্য রাগের কারনটা বুঝা যায় |

তাহলে ওয়াহাবীদের সাথে আজকের ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের কি মিল আছে ? নিশ্চই কিছু মিল থাকতে হবে নাহলে ওয়াহাবী আন্দোলনকে আজকের সন্ত্রাসবাদের জনক বলা যাবে না | আসুন দেখা যাক কি মিল আছে ?

মিলগুলো নিচে দেয়া হলো :

১] দুজনেই দারুল হার্বকে দারুল ইসলাম বানাতে চাইছে | ইসলামিক স্টেটের তো উদ্দেশ্যই ইসলামিক স্টেট বানানো | হিজবুত তাহরীর খেলাফত আনতে চায় | এইটাই মূল মিল তাই প্রথমে দিলাম | কুফুরী, বেদাত এসব দুজনের মধ্যেই আছে | মতাদর্শগত মিল |

২] দুজনেই অমুসলিমদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করছে | ভারতে ওয়াহাবিরা ইংরাজ ও শিখের বিরোধিতা করেছে | এখন আল কায়দা আর ইসলামিক স্টেট আমেরিকা আর হিন্দুদের বিরোধিতা করছে |

৩] দুজনেই পৌত্তলিকতা বা তাদের মতে যা কুফুরী বা বেদাত, তার বিরোধিতা করছে | ইসলামিক স্টেট তো মিউজিয়ামের মুর্তিদেরও বাদ দেয় নি | আল কায়দা বামিয়ানের বুদ্ধ ভেঙ্গেছে | দেখে শুনে মনে হয় তাদের টাকা না দেওয়াটাই বোধহয় কুফুরী আর বেদাত |
এইসব চিন্তার কোনো কোরানিক ভিত্তি নেই |

৪] দুজনেই জিহাদ করেছে | জিহাদের শিবিরের মধ্যেও মিল আছে | আহমেদের জিহাদের শিবিরে এবাদত আর শাস্ত্রপাঠ এবং সামরিক শিক্ষা চলত | আজকের আল কায়দার শিবিরেও ঐরকম শাস্ত্রপাঠ আর সামরিক শিক্ষার মিশ্রণ দেখা যায় |

৫] দুজনেরই এজেন্টরা সাধারণ নাগরিক জীবনে ছড়িয়ে রয়েছে | আহমেদের এজেন্টরা ইংরেজ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, এমনকি আদালতেও ছড়িয়ে ছিল | বিপ্লবী আহমদুল্লাহ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন |তাঁর এজেন্ট ছিল হাজী বদরুদ্দিন নাম ঢাকার বিখ্যাত চামড়ার ব্যবসায়ী, মুকসেদ আলী নাম একজন হাই কোর্টে মুখতার ছিলেন | আজকের ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদেরও ওই রকম এজেন্ট ব্যবস্থা দেখা যায় | ভারতের প্রতিরক্ষা দফতর থেকে আকচার সন্ত্রাসবাদীদের এজেন্ট পাওয়া যায় | কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় রেলের এক লাইনসম্যান সেনা বোঝাই একটা গাড়িকে লাইন চ্যুত করে বাংলা দেশে পালিয়ে যায় | এর ফলে বহু সেনা মারা যায় |

৬] দুই দলই কোড ভাষা ব্যবহার করত | আহমেদের এজেন্টরা সোনার মোহরকে বলত তসবি দানা বা লাল মতি | যে কোনো আর্থিক লেনদেনকে বলত বই কেনা বেচা |যুদ্ধকে বলত মুকাদ্দমা | আল কায়দাও ঐরকম কোড ভাষা ব্যবহার করে |

৭] দুই দলই জিহাদের লোকজন সংগ্রহ করেছে কমবয়সী যুবকদের মধ্য থেকে | এ বিষয়ে উদাহরণ দেয়ার দরকার নেই | আকচার খবরে দেখা যায় | আহমেদ সংগ্রহ করেছেন মুসলমান গরিব চাষী ও গ্রামের বেকার ও গরিব যুবকদের মধ্য থেকে আর আল কায়দা বা ইসলামিক স্টেট জোগার করছে বেকার যুবকদের মধ্য থেকে |

৮] আরেকটা বড় মিল হলো আহমেদ আর ইসলামিক স্টেট তাদের জিহাদিদের বিদেশ থেকেও জোগার করেছে | আহমেদ ভারত আর সীমান্ত প্রদেশ থেকে জোগার করেছে | ইসলামিক স্টেট আর আল কায়দা সারা পৃথিবী থেকে জোগার করছে |

৯] দুজনেই একটা সুগঠিত সংগঠনের মাধ্যমে জিহাদ করার তাল করেছিল | এটাও একটা বড় মিল |

এখান থেকে আরেকটা শিক্ষা আমাদের নিতে হবে | ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের যুদ্ধকে নিছক স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে দেখা উচিত নয় | কারণ হিন্দু আর মুসলিম দুজনেই ইংরেজদের তাড়াতে চেয়েছিল দুটো সম্পূর্ণ আলাদা কারণে | হিন্দু চেয়েছিল হিন্দুরাজ্য আর মুসলিম চেয়েছিল খেলাফত | বিস্তারিত জানতে আমার লেখা দেশভাগের প্রকৃত কারণ পড়ুন | কেউই স্বাধীন সার্বভৌম সেকুলার ভারত চায়নি |

তাহলে কি দেখা গেল ? ওয়াহাবী মত মরেনি | ইংরেজরা সাময়িকভাবে তাদের দমিয়েছিল মাত্র | কিন্তু একেবারে শেষ করতে পারেনি | সৌদি আরবের বেদুইনদের মধ্যে এই ওয়াহাবী মত বেঁচেছিল | আর এখন এই ওয়াহাবী মতের লোকেরা নিজেদেরকে জিহাদী বলছে | মানুষ মরে কিন্তু মতাদর্শ মরে না | তা সকলের অলক্ষ্যে মানুষের মনে বেঁচে থাকে | আজকের জিহাদী আন্দোলনের জনক ছিল এই ওয়াহাবী মত | এই পুরো জিহাদ আন্দোলনটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত | এই জিহাদের পন্ডিতেরা কোরানের যে ব্যখ্যা দেয় তা আধ্যাত্মিক নয় , বরং রাজনৈতিক | যারা কোরানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা চান , তারা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা শুনবেন না | যখনি মুসলমানের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা অমুসলমানের হাতে গিয়েছে তখনি জিহাদের জন্ম হয়েছে | সেই অর্থে বলা যায় যে ওয়াহাবী মত কোনো নতুন বার্তা বয়ে আনে নি | মুহাম্মদের সময় থেকে জিহাদের কনসেপ্ট ইসলামে ছিল | ওয়াহাব সেটাকেই আবার পুনরুজ্জীবিত করেছেন মাত্র | আর ধর্মগুরুরা যুদ্ধে উস্কানি না দিলে মুরিদরা কি আর যুদ্ধ করবে ? অতএব ধর্মগুরুদেরও উস্কানি সমান তালে ছিল |

আমরা কি শিখলাম ?

আজ এই ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে খতম করতে গেলে পুরো জিহাদী কনসেপ্টকে আর সেই কনসেপ্ট প্রচারকারী ধর্মগুরুদেরকে খতম করতে হবে | এটা অংশত আইডিয়ার যুদ্ধ আর অংশত মানুষে মানুষে যুদ্ধ | আইডিয়া খতম না করে শুধু জিহাদী দলগুলোকে খতম করলে সন্ত্রাসবাদ খতম হবে না | ওয়াহাবী আন্দোলন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় |

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫০

অসম্ভব আলো বলেছেন: ধর্মের কবরের উপরই মানবতার পতাকা উড়বে।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৫৩

সত্যান্বেসী বলেছেন: ঠিকই বলেছেন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.