![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।
জসীম অসীম
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ হইতে হইবে, এই যার পণ।’
এই কবিতা কার? কুসুমকুমারী দাশের (১৮৮২-১৯৪৮)। কে এই কুসুমকুমারী দাশ? আমাদের বাংলা কবিতার মহারাজ জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) জননী। মা যেখানে কবি, সেখানে ছেলে তো এমন কবিতার মহারাজ হবেনই। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, কবিতার কেমন মহারাজ তিনি?
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো কেমন? ‘ডযধঃ শরহফ ড়ভ ঢ়ড়বস ফড় ুড়ঁ ষরশব? ও ষরশব লরনধহধহধফড়’ অধিকাংশ লোকেরই এমন সেরা পছন্দের তালিকায় থাকেন জীবনানন্দ দাশ-বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। এ রকম উত্তরদাতাদের মধ্যে কবিতাবোদ্ধাদেরই গণ্য করা হচ্ছে। তাই কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা চলে বাংলা কবিতার সম্রাট। কিন্তু কেমন সম্রাট তিনি?
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবননানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্র“য়ারী বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত তাঁর মা কবি কুসুমকুমারী দেবীর প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘বর্ষা আবাহন’ ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন। জীবদ্দশায় তাঁর সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ঝরাপলক। এর বেশ কিছু সময় পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ প্রায় সাড়ে ৮০০ কবিতা লিখলেও জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও কাব্য সংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ শিরোনামে একটি কাব্যগ্রস্থ তাঁর মৃত্যুর পর আবি®কৃত হয় এবং ‘রূপসী বাংলার’ প্রচ্ছদ নামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পান্ডুলিপি জীবনানন্দের মৃত্যু পরবর্তীকালে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ নামে প্রকাশিত হয়। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করছেন। ১৯৪৫ সালের ২২ অক্টোবর ট্রাম দুর্ঘটনার অকালমৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছেন, যার একটিও জীবদ্দাশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেঁছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় প্রধান কবি হিসেবে তিনি স্বীকৃতি। ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশ একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষ ছিলেন। এ সমাজের বিশৃঙ্খলতার সঙ্গে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাই এত মেধাবী শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও বারবার চাকুরি ছেড়েছেন-বেকার থেকেছেন। একজন কবি অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে সহজ দু:খে কি ইনসিওরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হয়? কিংবা এই যে ট্রাম দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু-এটাও কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়-কেউ কেউ তো একে আত্মহত্যাও বলছেন।
৩০ বছর বয়সে জীবনানন্দ দাশ বিয়ে করেন লাবণ্যগুপ্তকে। লাবণ্য ঢাকার মেয়ে-জীবনানন্দ বরিশালের। এখানেও বিশেষ পার্থক্য ছিল। দু’জনের মতের অনেক অনেক পার্থক্য ছিল বলেও জানা যায়। তারপরও কবিতায় তিনি ছিলেন রাজা। সম্রাট। বাংলার প্রকৃতির চিত্রায়নের রাজা চিত্রকর-জীবনের হতাশার রাজা-নি:সঙ্গতার রাজা-রোমান্টিকতার রাজা কিংবা সম্রাট। তিনি ছিলেন এক আধুনিক জীবনসম্রাট।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম দিককার কিছু কবিতা পড়লে মনে হবে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাই পড়ছি। কী ছন্দে-কী বক্তব্যে। কিন্তু এ অবস্থা থেকে খুব দ্রুতই উত্তীর্ণ হন তিনি। যেমন হিন্দু-মুসলিম মিলনের পক্ষের তার এ কবিতাংশও সে কথার প্রমাণ দেয়। ‘মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে/পুণ্য ভারতপুরে/পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে/নামাজের সুরে সুরে/এ ভারতভূমি নহেকো তোমার/নহেকো আমার একা/, হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ/মুসলমানের রেখা.../...
কাফের যবন টুটিয়া গিয়াছে/ ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা/, মোস্লেম বিনা ভারত বিফল/, বিফল হিন্দু বিনা।’
কিন্তু যখন তিনি বলেন ‘আবার আসিব ফিরে/ধানসিঁড়িটির তীরে/ এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল/ শালিকের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে/ এ কার্তিকের নবান্নের দেশে।...’ [রূপসী বাংলা]
তখন কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ নতুন এক কবি মনে হয়। কারণ ঠিক এভাবে আমরা আর কাউকেই তেমন পাইনা। দেশের কথা তো আমরা রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে অনেক পাই-কিন্তু এভাবে নয়। সত্যেন্দ্রনাথ যখন বলেন-‘মধুর চেয়ে আছে মধুর/সে আমার দেশের মাটি/, আমার দেশের পথের ধুলা/খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি’। তখন কিন্তু দেশকে কম বড় করে তোলা হয় না। অথবা যখন এই সত্যেন্দ্রনাথই বলেন-
‘কোন দেশেতে চলতে গেলে/ দলতে হয়রে দুর্বা কোমল/ কোথায় ফলে সোনার ফসল/ সোনার কমল ফোটে রে/সে আমাদের বাংলাদেশ/আমাদেরি বাংলারে।’ তখন কিন্তু ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকে খুব শক্তিধর এক কবিই মনে হয়। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের সুর ভিন্ন। শুধু দেশ নিয়ে নয়-প্রেম-মৃত্যু-নগর জীবন-হতাশা সব নিয়ে।
প্রেম নিয়ে জীবনানন্দের একদম সাদামাটা অথচ দৃঢ় উচ্চারণ :
‘সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে
প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি।’
অথবা
‘কেমনে ধরিব প্রাণ
তোমার বিহনে।’
অথবা
‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে
(হায় চিল)
(বনলতা সেন)
-জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় বলার পরও তিনি নিজেই ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবেসেছেন’। আসলে প্রায় সব মানুষই প্রেমের বিষয়ে এমন।
কাঙ্খিত নারী জীবন থেকে হারানোর যে বেদনা-অথবা প্রেমের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে যাওয়ার যন্ত্রণাও তার কবিতায় দীপ্ত রূপ লাভ করেছে। জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা এতই গভীর-এতই দৃঢ়-এতই প্রশান্ত যে-প্রেমের নামে এখানে কোনো শ্লোগান নেই। কবিতার ছন্দও কেমন ধীর-প্রশান্ত।
‘সেই নারী ঢের দিন আগে
এই জীবনের থেকে চলে গেছে।’
অথবা
‘তোমার সংকল্প থেকে
খ’সে গিয়ে
ঢের দূরে চলে গেলে তুমি;’
(প্রেম অপ্রেমের কবিতা)
(মহাপৃথিবী) জীবনানন্দ
সংশয়বাদেরও তিনি এক স্রষ্টা। সংশয়ের শিল্পরূপ দিয়েছেন তিনি।
‘চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল;
উনিশশো বেয়াল্লিশ ব’লে মনে হয়
তবুও কি উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল।
(ক্ষেতে প্রান্তরে)
(সাতটি তারার তিমির)
জীবনানন্দ দাশ
পৃথিবীর সব ভাষাতেই এই সংশয় প্রধান কিংবা অন্যতম বিষয় হয়ে কবিতার স্থান দখল করেছে। কেন এই সংশয় ? তাও এক উত্তর জীবনানন্দ দাশ দিয়েছেন তার কবিতায় :
‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর
অসুখ এখন।’
(সুচেতন)
বনলতা সেন তাই।
আধুনিক নগর জীবনের ক্লান্তি জীবনানন্দ দাশকে ভয়ংকররূপে আহত করেছে। কবি এমন সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করতে নারাজ। তাই তার শিল্পিত উচ্চারণ :
‘কোন দূর সবুজ, ঘাসের দেশ নদী
জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার
তারা কোথায়?
তারা কি হারিয়ে গেছে?
পায়ের তলে লিকলিকে-
ট্রামের লাইন,-
মাথার ওপরে অসংখ্য জটিল-
তারের জাল
শাসন করছে আমাকে।’
(ফুটপাথে)
(মহাপৃথিবী)
এই যে মাথার ওপরে অসংখ্য জটিল তারের জাল, [যন্ত্রসভ্যতা?] তা জীবনানন্দ দাশের শ্বাস বন্ধ করেছে বারবার। আর ঐ যে সবুজ ঘাসের বদলে লিকলিকে ট্রামের লাইন? এমন পথেও তিনি হাঁটতে অপারগ। তাই মারা গেলেনও এই ট্রাম লাইনেই। কলকাতায়। নগরে। এই মৃত্যু কি আত্মহত্যা? স্বেচ্ছামৃত্যু? কে দেবে তার উত্তর?
তিনিই বলেছেন-
‘গলিত স্থবির ব্যাং
আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়-’
[আট বছর আগের একদিন]
[মহাপৃথিবী]
কিন্তু তিনি আর একমুহূর্তকাল বেঁচে থাকারও চেষ্টা করলেন না। তবে কি তিনি আর নি:সঙ্গতার যন্ত্রণা বহন করতে পারছিলেন না? তার একাকীত্বের যন্ত্রণার কথা তিনি বলেন অনেকটা এভাবেই :
‘উড়ে গেলে মনে হয়,
দুই পায়ে হেঁটে
কতো দূর যেতে পারে
মানুষ একাকী।’
[বিভিন্ন কোরাস (২)Ñ]
মহাপৃথিবী
বরং তিনি মৃত্যুকে আহবান করেন বিভিন্নভাবে-বিভিন্ন নামে। এমনকি তিনি সাহসের সঙ্গে কুণ্ঠাহীনভাবে উচ্চারণ করেন :
‘মৃত্যুরে ডেকেছি আমি
প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে।’
[জীবন ২৬)]
ধূসর পান্ডুলিপি
আসলে যারা জীবন নিয়ে নোংরা রাজনীতি করেন-সেসব সাহিত্য সমালোচকদের কাছে জীবনানন্দ দাশের যোগ্য মূল্যায়ন আশা করা যায় না। কারণ রাজনীতি আর নন্দননীতি এক নয়। জীবনানন্দের কবিতায় নন্দনের ছড়াছড়ি-কিন্তু প্রচলিত সমাজের কাছে তার মূল্যায়ন আশা করা বৃথা। তাই কবি যখন বলেন-
‘মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো-
প্রিয়ার মতন!
চকিত শিশুর মতো তার কোলে
লুকায়েছি মুখ’
[জীবন (২৫) ধূসর পান্ডুলিপি]
তখন তাকে কিন্তু স্বাভাবিক মানুষ বলেও মনে হতে চায় না।
‘সব ভালোবাসা যার বোঝা হল,
দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে।’
[জীবন (১৭)-
ধূসর পান্ডুলিপি]
মৃত্যু-মৃত্যু-শুধুই মৃত্যু...মৃত্যুর ছড়াছড়ি। মৃত্যুই স্বপ্ন-মৃত্যুই গন্তব্য। মৃত্যুকে এত আপন করে বাংলা সাহিত্যের আর কোনো কবি উপস্থাপন করেছেন কি? মৃত্যুকে চুমো দেয়ার আনন্দ সিংহাসন জয়ের চেয়েও বেশি। তাই তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেন-
‘পাখির মতন উড়ে পায়নি যা পৃথিবীর কোলে-
মৃত্যুর চোখের ‘পরে চুমো দেয়-
তাই পাবে বলে।’
অথবা
‘কারণ, সাম্রাজ্য-রাজ্য-সিংহাসন জয়
মৃত্যুর মতন নয়, মৃত্যুর শান্তির মতো নয়।’
অথবা
‘মানুষের মতো পায়ে চলিতেছি-
যতো দিন, তাই
ক্লান্তির পরে ঘুম,-
মৃত্যুর মতন শান্তি চাই!’
[প্রেম-ধূসর পান্ডুলিপি]
অর্থ্যাৎ
শান্তি আর কোথাও নেই-আছে মৃত্যুর কাছে। শান্তির অপর নামই মৃত্যু। এমন জীবনদর্শন-খুব একটা প্রচলিত নয়। তাই কবি জীবনানন্দ দাশও অপ্রচলিত কবি। রবীন্দ্র-নজরুলের মতো তিনি ধার্মিকও নন। নজরুলের মতো রাষ্ট্র রটানো প্রেমিকাও তার দেখা যায় না। বিবাহিতা স্ত্রী লাবন্য দাশের বাইরে কোনো নারীকে তার জীবনে সরাসরি পাওয়া যায়নি-অথচ তার প্রেমের কবিতাগুলো গভীর গভীরতর গভীর। রাষ্ট্র তাকে নিয়ে কী ভাববে-সমাজ তাকে নিয়ে কী বলবে-তার ধারেকাছেও থাকেন না তিনি। মূর্খ সাহিত্যবোদ্ধাদের করেন না একবিন্দুও তোয়াক্কা। তারই নাম জীবনানন্দ দাশ। যার হৃদয়ে শুধু হৃদয় নয়-‘তার হৃদয় আজ ঘাস’। বরং বলা চলে তার হৃদয় চিরকালের ঘাস।
©somewhere in net ltd.