নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

দিনলিপি: ‘কুরবানির ঈদের আগেই দুই ছাত্র কুরবানি হয়ে গেল’

২৭ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:১২

১৩৯৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস। রাজধানী ঢাকার সরকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে গিয়েছি বি.এ (সম্মান) বাংলা শ্রেণিতে ভর্তি হতে। প্রথমেই গেলাম তখনকার মিলন ছাত্রাবাসে। স্বৈরাচারী সরকার প্রধান এরশাদকে হটানো গণ-আন্দোলনে শহীদ ডা. মিলনের নামে এই ছাত্রাবাসের নতুন নামকরণ করা হয়েছিল।
আমি প্রথমেই মিলন ছাত্রাবাসের আবাসিক এক ছাত্রের কাছে গেলাম। তার বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানায়। আমার হাইস্কুল জীবনের বিজ্ঞানের শিক মনিরুজ্জামান ভর্তির ব্যাপারে তথ্যগত সাহায্যের প্রয়োজনের কথা ভেবে সেই আবাসিক ছাত্রের ঠিকানা আমাকে দিয়েছিলেন। মনিরুজ্জামান স্যারের বাড়ি আমাদের গ্রামেই এবং সম্পর্কে তিনি আমার কাকা হন।
গেলাম সেই ছাত্রের কাছে এবং তার দেখাও পেলাম। নাম সালাহ্উদ্দিন। কিন্তু ভাগ্য আমার খারাপই ছিলো বলা চলে। আমি মিলন ছাত্রাবাসের চতুর্থতলার যে কে অবস্থান করছিলাম, ঠিক সেই কইে তখন দু-তিনজন ‘ছাত্র’ আরেকজন ছাত্রকে টানাহেঁচড়া করে এনে ঢুকালো। ঢুকিয়েই দরজা এবং দরজার দিকের সবগুলো জানালা বন্ধ করে দিলো যেন , যেন কোনো কিছুই বাইরে থেকে দেখা না যায়। তারপর ‘ছাত্রনেতা’ মতো হ্যাংলা একটি ছেলে খাটের নিচ থেকে একটা লোহার রড বের করে, সেটা দিয়ে যে ছেলেটাকে ধরে এনেছে, তার কোমরের দু’পাশ দিয়ে ইচ্ছেমতোই পেটাতে লাগলো। ঐ কে বাকি যেসব নিরপে ছাত্র ছিল, তাদের কয়েকজন নেতামতো হ্যাংলা ছেলেটাকে বাধা দিতে গেলে , সে তার ট্রাঙ্ক থেকে একটি সাইকেলের চেইন এবং আরেকটি বড় আকৃতির ধারালো ছুরি বের করে সবাইকে হুমকি দিলো যে, যদি এ পেটানোর কাজে তাকে কেউ বাধা দেয়, তবে সে দু’তিনটা খুনই করে ফেলবে। তবু পাঁচ-ছয়জন ছাত্র সাহস করে ঝুঁকি নিয়েই জোর করে তার কাছ থেকে ছুরিটা ছিনিয়ে নিলো। কিন্তু তখনও তার হাতে সাইকেলের চেইনটা বহাল আছে এবং ধরে আনা ছেলেটার শরীরে সেটা সে অবিরাম ব্যবহার করছে। আর ঐ ছেলেটিও মার খেয়ে খেয়ে কান্নাকাটি করছে। তবে আক্রান্ত ছেলেটিকে দেখলাম, আক্রমনকারী ছেলেটিকে একবারেই প্রতিরোধ করছে না। হয়তো খুন হওয়ার ভয়ে। এদিকে নেতামতো ছেলেটা ধরে আনা ছেলেটাকে প্রহার করার ফাঁকেই চিৎকার করে বললো, কেউ যেন দরজা খোলার চেষ্টা না করে এবং তা করলে পরিণতি কখনোই ভালো হবে না। অন্যদিকে তিন-চারজন ছাত্র তাকে জোর করেও এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারছে না। তার শরীরে যেন কী এক অলৌকিক শক্তির সমাবেশ। কুমিল্লা শহর থেকে যাওয়া ভতিচ্ছুক এক সাধারণ ছাত্র আমি। আমিও সে কে তখন প্রচন্ড আতঙ্কিত। মনে হলো চোখের সামনেই একটা খুন দেখবো আমি।
অনেকণ ধরে এভাবে মারধোরের পর আক্রান্ত ছেলেটি এক সময় গুরুতর আহত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর নেতামতো ছেলেটার ক্রোধের অর্ধেকাংশ হাওয়ায় মিশে গেল। তারপর এ সমস্যার সমাধান স্বরূপ একটা বিচারকার্য সংঘটিত হলো। সে বিচারকার্য ছিলো পপাতিত্বে ভরা। সব দোষ গেল সেই আক্রান্ত ছাত্রের ঘাড়ে। সেই ছাত্র মন থেকে মানলো না সেই বিচার। এ ঘটনা দেখে আমি ভয় পেলেও আমি মূলত যার কাছে গেলাম, সে বললো, আরে ছোটভাই, এটা কোনো ব্যাপারই না। ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীাতে আমরা যে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে থেকে প্রায় প্রায় তিন হাজার ছাত্রের রোল নম্বর মেধা তালিকার ফলাফলে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। সেখানে আমার ভর্তি পরীার রোল নম্বর লিপিবদ্ধ ছিল না। সুতরাং আপাতত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রেশনে, সিলেবাসে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই, যেহেতু কোনো ‘ইয়ার’ বা শিাবর্ষও ‘লস’ করতে চাই না এবং ঢাকাতেই থাকতে চাই। সুতরাং সালাহউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে ভর্তিসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে নেমে গেলাম সে দিনের মতো।
পরের দিনের ঘটনা। খুব সকালে কলেজে গিয়েছি। দৈনিক পত্রিকা সে দিনের মতো তখনও আমার হাতে ওঠেনি। সুতরাং দিনের খবর বলা চলে কিছুই জানি না। কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই দেখি ক্যাম্পাসের মধ্যে আতঙ্কমাখা পরিবর্তন। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে পুলিশের শক্তিশালী প্রহরা। ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিও আশঙ্কাজনক কম। গেলাম সেই মিলন ছাত্রাবাসের দিকে। পরিচিত সেই বড় ভাই সালাহউদ্দিনের খোঁজ নিলাম। কিন্তু সেই মিলন ছাত্রাবাসের কাছেই ঘেঁষতে দিলো না পুলিশ। উঁকি দিয়ে দেখলাম, ছাত্রাবাসটির সবগুলো ব্লক ও তলায় পুলিশ কনষ্টেবলদের গিজগিজ করা প্রহরা। ছাত্রাবাসের প্রবেশপথে অবস্থানরত পুলিশ কনষ্টেবলকে প্রথমে কারণ জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার ! হয়েছে কী বলুনতো ভাই ! সে আমার পরিচয় জেনে বললো, ‘আরে ভাই খুন হয়েছে খুন।’ আমি বললাম, কে-কোথায়-কখন-কিভাবে-কেন খুন হলো। সে তো আর এত কথার উত্তর দিতে রাজি নয়। মেশিনগান, ষ্টেনগান ও কাঁটা রাইফেলের এলোপাথারি গুলিতে মিলন ছাত্রাবাসের অসংখ্য জানালার ভাঙ্গা কাঁচ দেখিয়ে বললো, বেশি জানতে চাইলে পত্রিকা কিনেন গিয়ে। এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার কর্ম নয়। আমি চলে এলাম সেখান থেকে। অস্থিরতা মাথায় নিয়েই ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম। গেলাম সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্রে। কিনলাম একটি দৈনিক পত্রিকা। প্রথম পাতার সংবাদ শীর্ষেই দেখলাম, ক্যাপশনসহ নিহত দু’জন ছাত্রের ছবি। ছবির নিচেই দেখলাম, লিড নিউজ: ‘ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে আটঘন্টা ধরে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া: জগন্নাথ কলেজে ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধে দুই ছ্ত্রা নিহত।’ খবরটি পড়ে জানতে পারলাম, মিলন ছাত্রাবাসের ‘ক’ শাখার ৫০৪ নম্বর করে মানব কুমার দে স্বপন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রলীগ সমর্থিত ছাত্র ও একই ছাত্রাবাসের মনিরুজ্জামান মনির নামে ‘খ’ শাখার ৩০৭ নম্বর করে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সম্মান সমাপনী পরীার্থী ও ছাত্রদল সমর্থিত ছাত্র উভয়েই সে দিনের আগ্নেয়াস্ত্র মহড়ায় নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক ছাত্র। ছাত্রদের হল ত্যাগ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধের ঘোষনা দেয়া হয়েছে। পত্রিকায় কলেজের এ মর্মান্তিক খবরটা পড়ে আবার কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলাম। দেখলাম ক্যাম্পাস খুব উত্তপ্ত। খুব গরম গরম মিছিল। উভয় পরেই। কালো পতাকা বহনকারী নিহত ছাত্রদের লাশ নিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দানকারীদের মুখে যেমন দেখলাম কষ্টের ছোঁয়া, তেমনি দেখলাম যেন আগুনের লেলিহান শিখা। এত কিছুর পরও সেদিন আমাদের ভর্তির সুযোগ ছিলো। সেটা ভাগ্যেরই কথা। আমরা ভর্তি হলাম। তারপর সবাই যার যার গন্তব্যে রওয়ানা হলাম। এর মাত্র কয়েকদিন পরেই ছিল ঈদুল আযহা। ঈদে তো সব ছাত্রের বা সন্তানেরই বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে হবে। কিন্তু যারা নিহত বা মারাত্মক আহত হয়েছে, তাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না আমরা। শুধু মনে মনে ভাবলাম, হায়! এই ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদের আগে কার স্বার্থে এই দুই মায়ের দুই সন্তান কুরবানী হয়ে গেল! কারা এই কোমলমতি ছাত্রদের হাতে এমন অমানবিক অস্ত্রপাতি তুলে দিয়ে নির্বিঘেœ রাজনীতি করে যায়! এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে ?
শ্রাবণ ১৪০০, পেয়ারাবাগিচা রোড, কুমিল্লা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.