নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করেছি; অবসর নিয়েছি কর্নেল পদবীতে ২০০৬ সালে। এরপর এযাবৎ প্রিন্সিপাল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; এখন অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা-তে। ‘স্কুল সাইকোলোজি’ নিয়েও কাজ করছি।

আশরাফ আল দীন

কবি, শিক্ষাবিদ ও প্যারেন্টিং এক্সপার্ট

আশরাফ আল দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৭

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান
আশরাফ আল দীন
বাংলাদেশ। একই ভাষা, একই পোষাক-আসাক, একই খাদ্যাভ্যাস, একই সংস্কৃতি এবং একই (প্রায়) ধর্মের অনুসারী একটি জনগোষ্ঠির অনন্য এক দেশ। সমিল ও ঐক্যের ব্যঞ্জনা নিয়ে গর্ব করার মতো এতোবেশী মানুষের অধিবাস-সমৃদ্ধ অন্য কোন দেশ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সকল মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, সেটা হলো আমাদের প্রিয় ভাষা বাংলা। বাংলাদেশে বাংলা ছাড়া অন্য কোন সাহিত্য-সমৃদ্ধ লিখিত ভাষা নেই। তবে, পৃথিবীর অপরাপর অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও বেশ কিছু আঞ্চলিক ভাষা বিদ্যমান। অঞ্চলভিত্তিক এসব মৌখিক ভাষা নিজ নিজ অঞ্চলের জনগণের সাচ্ছন্দ্যবোধের কারণে ওই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে টিকে আছে। কোন একটি মূল ভাষার সাথে আঞ্চলিক ভাষার সামঞ্জস্য থাকতে হয়। বাংলাদেশের সব ক’টি আঞ্চলিক ভাষার সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য বাংলা ভাষার সাথেই। তবে, কোনটার সাথে কম আর কোনটার সাথে বেশী। এই পরিমাপের ভিত্তিতেই আমরা চিহ্নিত করে থাকি, কোন আঞ্চলিক ভাষাকে সহজ এবং কোন আঞ্চলিক ভাষাকে কঠিন হিসেবে। বাংলাদেশের ভেতর তেমন একটি অন্যতম কঠিন আঞ্চলিক ভাষা হলো ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা’, কেউ কেউ বলবেন ‘চাটগাঁইয়া কথা’। অধিকাংশ মানুষের মন্তব্য এমন যে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বুঝা অত্যন্ত কঠিন এবং তা বলতে অভ্যস্ত হওয়া আরো বেশি কঠিন। এটা বাস্তব সত্য এবং একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এমনটা হয়েছে এই কারণে যে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তার নিজস্ব শব্দ রয়েছে অনেকগুলি। ভাষা গবেষক ডঃ এনামুল হক এর একটা হিসাবও বের করেছেন।
এই ধরণের নিজস্বতা নিয়েই চট্টগ্রামের মানুষ তাদের আনন্দ-বেদনা ও উচ্ছাস প্রকাশের জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই অসংখ্য কবিতা ও গান, এমনকি গদ্যও রচনা করেছেন। এসব চর্চা সাধারণতঃ মৌখিক ও স্মরণ শক্তি নির্ভর। তবু, সংরক্ষণের সুবিধার্থে অনেকেই এসব গদ্য-পদ্য-গান-লোকজ ছড়া-ধাঁধাঁ-বচন-শ্লোক ইত্যাদিকে বাংলা ভাষার অক্ষর ও ধ্বনি ব্যবহার করে লিখে রেখেছেন। যেহেতু এসবই মৌখিক সাহিত্য ও স্মরণশক্তি-নির্ভর তাই হাজার হাজার বছরে সৃষ্টি হওয়া এই সুবিশাল সস্পদের সামান্য অংশ মাত্র টিকে আছে। আর, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মৌখিকভাবেই তা হস্তান্তরিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের ভাষাকে পদ্য চর্চার আঙ্গিনায় তুলে এনেছেন প্রধানত কবিয়ালরাই। কবিয়ালরা কবি নন। তাঁরা সাধারণতঃ সুশিক্ষিত সাহিত্যিকদেরও কেউ নন। তাঁরা হলেন গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে আসা অত্যন্ত মেধাবী মানুষ যাঁরা ক্রমাগতভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ছন্দোবদ্ধভাবে, কাব্যিক পয়ার ঠিক রেখে, প্রতিটি বাক্যের অন্ত্যমিলসহ কথা বলে যেতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন এবং অন্যের ত্ৎক্ষণিক প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দিয়ে যেতে পারেন। সে এক অসাধারণ ক্ষমতা! হাতে একটা একতারা বা কাঁধে একটা বেহালা রেখে তাতে সুর তুলে নিমগ্ন হয়ে যান আর অসংখ্য দর্শক-শ্রোতার সামনে, কখনো নেচে নেচে কখনো শরীর দুলিয়ে, কবিতা বুনে যান। অসংখ্য মানুষ, সাধারণত সারা রাত জেগে, বুঁদ হয়ে শোনে এসব সুরেলা কিন্তু তাত্বিক কথা, বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তি আর কখনো বা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে রসালো কথায়। সমগ্র বাংলার আনাচে-কানাচে ঘরে ফসল তোলার পর শীতের শুরুতে শুকনো খড়ের উপর বসে মানুষেরা রাত জেগে কবির লড়াই উপভোগ করে। চট্টগ্রামেও কবির লড়াই হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়।
কবিয়াল আব্দুল করিম, কবিয়াল রমেশ শীল এবং আরো অনেকেই চট্টগ্রামের ভাষায় তাৎক্ষণিকভাবে পদ্য রচনা করে অসংখ্য শ্রোতার মনোরঞ্জন করেছেন সারারাত জেগে উপভোগ করা 'কবির লড়াই' অনুষ্ঠানগুলোতে। শরিয়ত ও মারিফাতের মতো বিষয় নিয়েও কবির লড়াই হয়। কবিরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই কবিতা বুনে যান। একজন কবিয়াল শরীয়তের ব্যাখ্যা দেন এবং মারেফাতের বিপক্ষে বলেন, পদ্যাকারে এবং অন্যজন মারেফাতের পক্ষ নেন এবং শরীয়তের বিপক্ষে বলেন, তা-ও পদ্যাকারে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্ন করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবেই জবাব দেয়া হয়। এর মধ্যে আনন্দের বিষয় আছে, চিন্তার গভীরতার বিষয় আছে এবং উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা কবিদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব উপভোগ করেন। তাদের জ্ঞান গভীরতা এবং প্রকাশভঙ্গি মানুষকে মুগ্ধ করে। সবকিছু হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা যে এত সুন্দর, এত মধুর এবং এত উপভোগ্য হতে পারে তা এই ধরনের অনুষ্ঠান না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেন না।

কবিয়াল রমেশ শীলের বাড়ি আমাদের গ্রামেই; বোয়ালখালী থানার পূর্ব গোমদন্ডী গ্রামে। সময়কাল বোঝার সুবিধার্থে বলছি, তাঁর এক নাতি ছিল আমার সহপাঠী। কবিয়াল রমেশ শীল ছিলেন মাইজভান্ডার দরবার শরীফের ভক্ত। তাই তার গানে ইসলামী ভাবধারার শব্দাবলী ও আবেগ উপস্থিত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। "ওরে, প্রেমের মরা জলে ডোবে না"-র মতো অসংখ্য ভাবের গান ও ভান্ডারী গান তিনি রচনা করেছেন। সবগুলো গানের ভাষা 'খাঁটি বাংলা ভাষা' বলা যাবে না। কারণ, অনেক গানের ছত্রে ছত্রে বাংলা ভাষার সাথে অনেক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ মিশে গেছে অবলীলায়।

চট্টগ্রামের খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এবং গাওয়া অত্যন্ত প্রসিদ্ধ যে গানের কথা আমার মনে পড়ে তা হলোঃ
"চাটগাঁইয়া নওজোয়ান আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান,
দইজ্জার কুলত বসত গরি
আঁরা ঠেকাই ঝড় তুয়ান।----------"
পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে রেডিও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ভাষার একটি গানের অনুষ্ঠান প্রচার করতো। তাতে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন অত্যন্ত সুন্দর কিছু গান গাইতেন, মনে পড়ে। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় একটি গান হলোঃ
"মাদার পাতা তুইষের আগুন ভুঁসি ভুঁসি মন জ্বলে
সোনা বন্ধুয়ারে,
এইবার তোরে বন্দি গরিলাম প্রেম ডোরে।----------"

আমাদের শৈশবেই অর্থাৎ ষাটের দশকে আমরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান শুনেছি গ্রামোফোন রেকর্ডে। সে সময়ে বিনোদনের এটাই ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম। গ্রামের যে কোন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া করে আনা হতো এবং তাতে বিরতিহীনভাবে রেকর্ডের গান বাজতো। রেকর্ডগুলো হতো নানা রকম গানের। তারমধ্যে উর্দু, বাংলা, রবীন্দ্র-নজরুল ইত্যাদি গানের সাথে সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কিছু রেকর্ড বাজানো হতো। এই গানগুলো আঞ্চলিক ভাষার গান হলেও এর অর্থ ও ভাব অনেক গভীর এবং মার্জিত রুচির ছিলো। বিশেষ করে ভান্ডারী, মুর্শিদি ও ভাবের গানগুলো। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন রেডিওতে আঞ্চলিক গানের অনুষ্ঠান শুরু হলো, তখন সেখানে এমন সব চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান গাওয়া হলো যা ছিল অত্যন্ত চটুল এবং হালকা মেজাজের। এই অনুষ্ঠানের প্রধান দুই গায়ক-গায়িকা শেফালী ঘোষ এবং শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব তাদের চটুল গানের মাধ্যমে অল্প কালের মধ্যেই সাধারণ জনগণের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। শেফালী ঘোষের গাওয়া একটি গানের কথা ছিল এরকমঃ
"ন'জাইয়ুম, যাইতাম'ন লাল মিয়ার বাড়ি;
হিতে আঁল্লয় কথা কয়দে চোখ মারি মারি।-------"
তার আরেকটি গান হলোঃ
“যদি সোন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি মনের মতো মুখ পাইতাম,
মহেশখাল্যা পানর খিলি তারে বানাই খাওআতাম।-----”

এই দুইজনের গাওয়া কিছু দ্বৈত সংগীত অত্যন্ত বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল কিন্তু এর কিছু কিছু গানের ভাষা এতটাই রগরগে ছিল যে তা পরিবারের সবাইকে নিয়ে শোনার মতো ছিল না। এমন সব গানের ব্যাপকতায় ইদানিং কালের মানুষ ভুলতে বসেছে যে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গানগুলো এককালে ছিল অত্যন্ত ভাবগম্ভীর, ধর্মীয় অনুপ্রেরণাদায়ক, শ্রোতাকে পারোলৌকিক বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেয়ার মতো এবং উজ্জীবনী শক্তির আধার।


ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম এলাকায় শত শত বছর ধরে গ্রামের মানুষ রাত জেগে কবিয়ালদের লড়াই দেখেছে, আর ব্যাকুল হয়ে শুনেছে মুর্শিদি গান, কাওয়ালী গান, ভান্ডারী গান এবং ভাবের গান। এইসবই হয়েছে খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় অথবা, কখনো কখনো, বাংলা ভাষার সাথে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে তৈরি একটি শংকর ভাষায়

শিক্ষাদীক্ষায় উন্নয়ন এবং শহুরে জীবনের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে বর্তমানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার চর্চা অনেকটা নেতিবাচক অবস্থায় অবস্থান নিয়েছে। বর্তমানে এখানকার অনেক পরিবারের সন্তানরা চট্টগ্রামের ভাষা শুদ্ধভাবে বলতেও পারে না! এমনকি গ্রামের অনেক মানুষও ইদানিং খাঁটি চট্টগ্রামের ভাষার কিছু কিছু শব্দের বদলে বাংলা ভাষার কিছু শব্দকে মিশিয়ে বলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
এ ধরনের পরিবর্তন অনাকাঙ্ক্ষিত নয় এবং অভিনবও নয়। তাই, ইতিহাস- ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে আমাদের প্রয়োজন চট্টগ্রামের ভাষায় সাহিত্য চর্চার নমুনা, পুঁথি, কবিগান এবং আঞ্চলিক গানগুলোকে সংরক্ষণ করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আর গবেষকদের গবেষণার উপাত্ত হিসেবে সহজলভ্য করে রাখার জন্য এই সব সম্পদের জাদুঘর স্থাপন করা এখন সময়ের দাবী।
আশরাফ আল দীন।।মিরপুর, ঢাকা।।২৪.১১.২০১৯

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:১০

রাজীব নুর বলেছেন: কিছু কিছু গান হুটহাট করে মাথার ভেতর বাজতেই থাকে-। এই যেমন এই গানটা সকাল থেকেই বাজছে...

লাল পাহাড়ের দেশে যা
রাঙ্গামটির দেশে যা
ইত্থাক তুকে মানাইছে না রে
ইক্কেবারে মানাইছে না রে ...

এই গানটা কার লেখা কেউ কি জানেন?

২| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:১২

চাঁদগাজী বলেছেন:


চট্টগ্রামের লোকেরা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছেন, গান টান শোনেন নাকি? বেচারী শেফালী ঘোষের ব্যবসা ছিলো না, মনে হয়!

৩| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:০২

নুরহোসেন নুর বলেছেন: চট্টগ্রাম অঞ্চলের গানগুলো হৃদয়স্পর্শী।
মিঠুন চাকারের কন্ঠে 'তরা কন কন যাবি আর সাম্পানে' আমার অন্যতম ফেভারিট গানের একটি।

৪| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:২৩

অনন্ত আরফাত বলেছেন: চট্টগ্রামের ভাষার গানগুলা খুবই আলাদা।

৫| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১০

রুমী ইয়াসমীন বলেছেন: অনেক সুন্দর পোস্ট চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ঐতিহ্য বিষয়ক।
চট্টগ্রামে থাকার সুবিশার্ত্থে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক অনেক গান শোনার সুযোগ হয়েছে বিশেষ করে শেফালি ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব জুটির গান গুলো সবাই খুব উপভোগ করত ও সবার মুখে মুখে জনপ্রিয় থাকত।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.