নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করেছি; অবসর নিয়েছি কর্নেল পদবীতে ২০০৬ সালে। এরপর এযাবৎ প্রিন্সিপাল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; এখন অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা-তে। ‘স্কুল সাইকোলোজি’ নিয়েও কাজ করছি।

আশরাফ আল দীন

কবি, শিক্ষাবিদ ও প্যারেন্টিং এক্সপার্ট

আশরাফ আল দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

যতটুকু দেখাশোনা: আল মাহমুদ

২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:২৭

কবি আল মাহমুদের সাথে আমার প্রথম দেখা শিল্পতরুতে। শিল্পতরুর স্বত্বাধিকারী ছিলেন কবি আবিদ আজাদ। তখন তাঁর অফিসটা ছিল হাতিরপুলের কাছে, সোনারগাঁ রোডে। শিল্পতরু একটি প্রকাশনা সংস্থা। আবিদ ভাই এখান থেকে প্রধানত সাহিত্যের বিভিন্ন বই প্রকাশ করতেন এবং 'শিল্পতরু' নামে ঢাউস আকারের এবং উঁচু মানের একটি সাহিত্য সাময়িকী বের করতেন। সে কারণেই শিল্পতরুতে সাহিত্য আড্ডা হতো। সেখানে আমার যাতায়াত ছিল। এই আড্ডায় অন্যদের সাথে প্রায়ই দেখা হতো কবি আল মাহমুদ, কবি আব্দুস সাত্তার ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতাও হতো এঁদের প্রত্যেকের সাথে। আর কাউকে না পেলে অন্তত সজ্জন মানুষ কবি আবিদ আজাদকে তো পেয়েই যেতাম। নানা কথাবার্তা হতো, সাহিত্যের ব্যাপারগুলো তো থাকতোই।

আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নির্জন এসেছিল আজ'-এর দ্বিতীয় প্রকাশ ঘটেছিল শিল্পতরু থেকে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০-তে। এর প্রথম প্রকাশ হয়েছিল আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুরাতন ঢাকার একটি প্রেস থেকে, একেবারেই নিজস্ব খাটাখাটুনিতে, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭-তে। আমার বইটা হাতে নিয়ে আল মাহমুদ হাসতে হাসতে মন্তব্য করেছিলেনঃ "প্রথম কবিতার বই প্রথম সন্তানের মতো। এতে আবেগ থাকে প্রচুর, প্রস্তুতি-অপ্রস্তুতি মিলিয়ে ভুল ভ্রান্তিও থেকে যায় প্রচুর। কিন্তু সেটাই প্রথম সন্তান!" তাঁর মুখ থেকে আমার কবিতার প্রশংসা শুনে আমি বরং ভেবেছি এভাবেই হয়তো তিনি সবাইকে বলে থাকেন উৎসাহ দেয়ার জন্যে। তবে স্বীকার করতেই হবে যে আল-মাহমুদের কথাবার্তার প্রক্ষেপণ ছিলো সরাসরি, স্বাভাবিক এবং কোন রকম ভনিতা বিহীন। এত বড় মাপের মানুষ হয়েও তাঁর ব্যবহার ছিল নিরহঙ্কার; তবে অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন তিনি।

আল মাহমুদ সম্পর্কে আমরা জানি স্বাধীনতার বহু পূর্ববর্তী কাল থেকেই। আমরা যারা কবিতা পাগল ছিলাম তাদের মুখে শামসুর রহমান ও আল মাহমুদ এই নাম দু'টি প্রায় একই সাথেই উচ্চারিত হতো। আমার মনে আছে, চট্টগ্রামের 'পাকিস্তান কোপারেটিভ বুক সোসাইটি' থেকে আমি কবি আল মাহমুদের 'কালের কলস' বইটি কিনেছিলাম সেই ১৯৭০ সালে। সুন্দর জ্যাকেটসহ চতুষ্কোণ আকৃতির বইটির সম্ভবত তখন দাম ছিলো মাত্র সাড়ে তিন টাকা। অবশ্য তখনকার দিনে আমাদের মতো ছাত্রদের জন্য এতো দাম দিয়ে কবিতার বই কিনতে গেলে আবেগ আর সৌখিনতার সাথে সাহসকেও মিশাতে হতো বলা যায়।

'সোনালী কাবিন' আর 'কালের কলস' দিয়েই তো আল মাহমুদ নিজের অবস্থানকে বাংলা সাহিত্যের একজন সেরা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নেন জীবনের শুরুতেই। সেখান থেকে কেউ তাঁকে আর টলাতে পারেনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বরং তিনিই অনবদ্য গদ্য রচনার মাধ্যমে তাঁর প্রতিভার বহুমুখীতার প্রমাণ রেখেছেন সার্থকতার সাথে। তার লেখা ছোট গল্প, উপন্যাস এবং আত্মজৈবনিক উপন্যাস বহুল ভাবে সমাদৃত হয়েছে সুধীমহলে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি 'গণকণ্ঠ' নামের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হন। গণকণ্ঠ ছিল তৎকালীন অন্যতম প্রধান সরকারবিরোধী পত্রিকা এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ)-এর মুখপত্র। ক্ষুরধার লেখনী ছিল আল মাহমুদের। আগুনঝরা সম্পাদকীয় ও কলাম লিখতেন তিনি গণকণ্ঠে। এই কারণে সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি নিজে এবং তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা গণকন্ঠ। কোন প্রকার সমালোচনা সহ্য না করার ঐতিহ্য ছিলো তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের। ফলে আল মাহমুদকে লেখনীর মাধ্যমে সরকারের বিরোধিতা করার কারণে বন্দি করে জেলে পাঠানো হয়েছিলো। অনেকদিন পরে একবার আড্ডায় তিনি তাঁর বন্দী হওয়ার কাহিনী শুনিয়েছিলেন আমাদের।

বঙ্গভবনে সকল সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো রাষ্ট্রীয়ভাবে। সকলের সাথে আল মাহমুদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ‌ সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সাথে সরকার প্রধানের সাক্ষাতের এই সরকারী অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর সবাই যখন একে একে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন তৎকালীন সরকার প্রধান দোর্দন্ড প্রতাপ শাসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাম ধরে আল মাহমুদকে কাছে ডাকলেন। এক সময় আদর করে কবির কাঁধে হাত রেখে সাহস দেওয়ার ভঙ্গিমায় বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ সম্বোধনে বললেন, "তোর কোন ভয় নেই, আমি তো আছি! অসুবিধা হলে আমাকে বলবি।" আল মাহমুদ তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন এবং বাসায় পৌঁছে দেখলেন পুলিশ তাঁকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। একথা বলে আল-মাহমুদ হাসতে থাকলেন তার নিজস্ব ভঙ্গিমায়। সেবার তিনি জেলখানায় দীর্ঘ সময় ছিলেন এবং ওই সময়টায় কোরআন শরীফ নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। এতে তাঁর মানস জগতে এক প্রকার বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। তার প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো' আর 'বকতিয়ারের ঘোড়া' কাব্যগ্রন্থদ্বয় ছাড়াও আরো অনেক অসাধারণ কবিতা।

আমাদের প্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন "চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রে"র পক্ষ থেকে তাঁকে আমরা প্রদান করেছিলাম "ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার"। জমজমাট সুধী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল চট্টগ্রামে। সেই অনুষ্ঠানেই কবি আল মাহমুদ চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর বিশেষ ভালোবাসার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতে দেখা গেল চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথেই কবি আল মাহমুদের এক ধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে গেল, প্রগাঢ় আন্তরিকতার এবং শব্দ-সেবী মানুষগুলোর অন্তরের নিবিড় বুননে এক অনন্য আত্মীয়তার। এরপর থেকে কবি আল মাহমুদের প্রতিটি জন্মদিনে চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে কবিকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করাটা একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে গেল।

বছর তিনেক আগের কথা। সেবার চট্টগ্রাম থেকে সংস্কৃত কেন্দ্রের প্রতিনিধি দল আল মাহমুদের জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে পারছিলো না বলে আমাকেই প্রতিনিধিত্ব করতে হবে, জানানো হলো। ওই সময়টায় আমি "বনানী সাহিত্য সংস্থা" নামের প্রবীণদের একটি সাহিত্য সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলাম। আবার আমি ছিলাম একটি যুব সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা। সুতরাং ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন সংস্কৃতিপ্রেমীকে সাথে নিয়ে তিনটি ফুলের তোড়াসহ মগবাজারে কবির বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। সারাদিন ধরে ভক্ত, অনুরাগী ও বন্ধু-স্বজনদের আনাগোনা চলছে। ঘরের ভেতর ফুলের তোড়া ও ফুলের মালার স্তুপ হয়ে গেছে। জন্মদিনের কেক এসেছে অনেক ক'টি। হঠাৎ একটা কথা মনে এলো আমার। সবাই ফুল ও কেক-এর পেছনে এতো টাকা খরচ না করে নগদ টাকাটাই যদি কবির হাতে তুলে দিতো সৌজন্য উপহার হিসেবে? এটাকে 'রছম' হিসেবে আমরা চালু করলেই তো হয়ে যায়! অনেকেই হয়তো বলবেন, ছোটলোকি চিন্তা অথবা চিন্তার দারিদ্র্য! কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের মতো দেশে যেখানে অনটন কখনো কবি-সাহিত্যিকদের ঘর ছাড়ে না, সেখানে এধরনের কাজই হবে সত্যিকার সম্মান ও সহমর্মিতার প্রকাশ। যা হোক, সকাল থেকেই কবির ঘরে উৎসবের আমেজ, কিন্তু কবির শরীর অত্যন্ত দূর্বল ও নড়বড়ে। তাঁকে ধরে ধরে এনে বসানো হয় ঘরটির ছোট্ট ড্রয়িং রুমে। কিছু সময় পর, আবার তাঁকে বিছানায় রেখে আসা হয় বিশ্রাম নেয়ার জন্য। আমরা যাওয়ার পর কবিকে নিয়ে সবাই ছবি তুললো। কবির সাথে অল্প কথাও হলো আমার।

কিছুক্ষণ পর বিদায় নেয়ার জন্য যখোন উঠে দাঁড়ালাম তখোন খেয়াল করলাম কবির মধ্যে আমাকে বিদায় দেয়ার কোন আগ্রহ নেই। বরং ঘরের ভেতর থেকে জানানো হলো আমাকে রাতের খাবার খেয়ে যেতে হবে। আমি মানে আমি নিজে এবং আমার সাথে যে কয়জন আছেন তারা সকলকেই। আমি এর জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি 'না' 'না' করে উঠতেই কবি দরাজ হাসি দিয়ে বললেন, "ওরা ওদের প্রিন্সিপাল স্যারকে ওদের বাসায় পেয়েছে। ওরা কি না খাইয়ে ছাড়তে পারে!" তখন আমার খেয়াল হলো যে, কবির নাতি-নাতনীদের অনেকেই মানারত স্কুল এন্ড কলেজে পড়াশোনা করেছে। কবির ছেলেরা এবং নাতি-নাতনিরা আর পর্দার আড়ালে কবির পুত্রবধূদের চলাচল এবং কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম যে এই মুহূর্তে ঘরের ভেতর প্রধান আকর্ষণ আমি! তখন আমার মনে পড়লো, কবি একবার তাঁর কোন একজন নাতনির ব্যাপারে আমাকে সরাসরি টেলিফোন করেছিলেন, আমার স্কুলে ভর্তি করিয়ে নেওয়ার জন্য। নিয়ম মোতাবেক তার ভর্তির যোগ্যতায় কিছু ঘাটতি ছিলো বলেই এই টেলিফোন। আমার যতটুকু মনে পড়ে আমি এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারিনি। কারণ মানারতের প্রিন্সিপাল থাকার সময় আমি তা কখনোই করতাম না, এবং কারো জন্যেই নয়।

আমার মনে আছে, আমাকে একবার মরহুম প্রেসিডেন্ট এরশাদ টেলিফোন করেছিলেন তাঁর দলের একজন নেতার ছেলের ভর্তির ব্যাপারে। জেনারেল এরশাদ আমাকে নাম ধরেই বললেন, "আশরাফ! একজন ছাত্র গেছে তোমার কাছে। দেখো কি করা যায়!" আমিও সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন চাকরি করে কর্নেল পদে অবসর গ্রহণ করেছি এবং তখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর মধ্যে প্রখ্যাত মানারতের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেনাবাহিনীর লোক হিসেবে তিনি কিছুটা অধিকার প্রকাশ করতেই পারেন! আমার মনে আছে আমি তাঁকে সালাম জানিয়ে বলেছিলাম, "স্যার! আপনারাই শিখিয়েছেন কিভাবে লাইন টানতে হবে এবং নিয়ম মেনে চলতে হবে। আমি এখানে সেই কাজটাই করছি। আপনার দলের নেতা তাঁর সন্তানকে নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত আছেন। আমি তাদের সাথে কথা বলে দেখি। যদি সামান্য তফাৎ বা ঘাটতি হয়, নিয়ে নেয়া যাবে। দেখি কি করা যায়।" কিন্তু খুব বেশি তফাৎ হলে যে ভর্তি করানো সম্ভব নয় একথা জেনারেল এরশাদ বুঝতে পেরেছিলেন। শুধুমাত্র এটুকু বলেছিলেন, "রাজনীতি করি বলে আমাদেরকে অন্যের অনুরোধে এ ধরনের অনুরোধ করতে হয়!" আমি তাঁকে সম্মান দেখিয়ে কথা শেষ করেছিলাম এবং সম্মানের অংশ হিসেবে পরবর্তীতে আমি তাঁর কাছে স্কুলের মোহরাঙ্কিত একটি মগ এবং একটা কোট-পিন উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর সুপারিশ করা ছাত্রকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি। এ ব্যাপারে অবশ্য আমি ছাত্রের পিতাকে রাজি করিয়েছিলাম, এই কথা বুঝিয়ে যে, ছাত্রটি যে ক্লাসে ভর্তি হতে চায় সেই ক্লাসে ভর্তি হওয়ার জন্য তার কোনো রকম যোগ্যতা নেই। এমনকি এর নীচের ক্লাসের বইগুলোও তার আয়ত্তের বাইরে। এই অবস্থায় তাকে যদি আমরা ভর্তি করিয়ে নিই, পরে এই ছাত্রটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে! কারণ এ পর্যায়ে তাকে আগের বইগুলো পড়িয়ে তারপর বর্তমান ক্লাসের জন্য যোগ্য করতে হবে। যা ছাত্রটির জন্যই অত্যন্ত কঠিন এক ব্যাপার। কারণ কাজটা তাকেই করতে হবে, আমাদের কাউকে নয়! আমার কথাগুলো ছাত্রের অভিভাবক বুঝেছিলেন, মনে হয়েছিলো।

সে যা'ই হোক, কবি আল মাহমুদ আমাকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেননি। তবে তিনি যে কথাটা মনে রেখেছেন তা আমি বুঝতে পারলাম তাঁর একটা মন্তব্য শুনে যে, "আপনি প্রিন্সিপাল হিসেবে কড়াকড়িভাবে যে প্রিন্সিপল মেনে চলেন এটা আমি জানি।" তাঁর এই মন্তব্য শুনে এবং সাথে মুখের হাসি দেখে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম যে তিনি আমার উপর রাগ করেন নি। বরং মনে হলো, নিজে একজন নীতিবান ব্যক্তি হিসেবে আমার নীতিবাদীতাকে তিনি পছন্দ করেছিলেন। আমাদেরকে পুরো বাড়ির সকলেই বেশ যত্ন করে খাইয়েছিল সেদিন, অন্যমাত্রার এতো ব্যস্ততার মধ্যেও। তারপর আমরা খুশিমনে বিদায় হয়ে গেলাম। আসার সময় ভাবলাম, আমি তো এসেছিলাম কবিকে শুভেচ্ছা জানাতে, কিন্তু নিজেই যে শুভেচ্ছা নিয়ে বিদায় হবো এই কথা তো একবারও ভাবি নি!

২০১৭ সালে নোঙ্গর-এর 'কবি আল মাহমুদ সংখ্যা' বের হলো। 'নোঙর' হলো চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা। অনেক পরিশ্রমের ফসল এই পত্রিকাখানি কবির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের একটি দল ঢাকায় এলো। কবি তখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্রের অনেক ক'জন প্রতিনিধি এবং ঢাকার বন্ধুরা মিলে আমরা তাঁকে দেখতে গেলাম ইবনে সিনা হাসপাতালে। আমাদের সাথে আমাদের বন্ধু স্বনামধন্য লেখক বুলবুল সরওয়ারও ছিলেন। এখন তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ বলেই কথাটা উল্লেখ করলাম। ২০শে এপ্রিল ২০১৭ সাল। আমরা "নোঙ্গর"-এর একটি ঢাউস কপি শয্যাশায়ী কবির হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কবি যদিও তখন সবার সাথে কথা বলতে পারেন না, সবাইকে চিনতেও পারেন না, কিন্তু সাহিত্য পত্রিকা নোঙর হাতে পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন, বুঝা গেল কারণ তেমন জীবন্মৃত অবস্থায়ও তাঁর চোখ আনন্দে চিকচিক করছিল এবং দু-একটা বাক্য আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। আমাদের কেউ একজন মন্তব্য করেছিলেন, "কবি আল মাহমুদকে নিয়ে গবেষণা করার জন্য নোঙ্গরের এই সংখ্যাটিই যথেষ্ট। এই কথা শুনে আনন্দে কবি হেসে উঠেছিলেন এবং কবি বলেছিলেন, "সোনালী কাবিন আমি চট্টগ্রামেই লিখেছি।" চট্টগ্রামের সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক বোঝানোর জন্যই এই কথা তিনি বলেছিলেন। এটাই ছিল আমাদের জন্য পরম পাওয়া।

তার কিছুদিন পরেই কবি আল্লাহর কাছে চলে গেলেন, আমাদের এবং এই পরিপার্শ্বের পৃথিবী ছেড়ে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দেবেন তাঁর সত্যবাদিতার জন্য, এই বিশ্বাস আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনো লালন করি। কবি আল মাহমুদ একটি কবিতা রচনা করেছিলেন যেখানে উল্লেখ ছিল 'কোন এক শুক্রবারে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় হয়ে যাবেন' এবং হলোও তাই! কি অবাক কান্ড! আল মাহমুদের ওই কবিতাটাও যেন আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে গেছে! একটি শুক্রবারে তিনি সবাইকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। আমরা অপেক্ষা করছি জান্নাতে কখন তাঁর সাথে, একজন তৌহিদবাদী সব্যসাচী কবি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অসাধারণ সৈনিক, আল মাহমুদের সাথে, আমাদের আবার দেখা হবে।

মিরপুর, ঢাকা; ২৬/০২/২০২০

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ২:৩২

ইফতেখার ভূইয়া বলেছেন: প্রয়াত কবি আল-মাহমুদ স্যারের ব্যাপারে জেনে বেশ ভালো লাগলো। স্যারের বেশ কিছু কবিতা আমরা আমাদের সাইটে পাবলিশ করেছি ইতিমধ্যেই। সোনালী কাবিন সাম্প্রতিক কালে আমাদের হাতে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি স্যারের আরো বেশ কিছু কবিতা গল্প প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। সময় করে সাইটটি ভিজিট করলে খুশি হবো। ধন্যবাদ।

২| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ২:৪৮

সি পি জি বলেছেন: আচ্ছাআআআআ, আপনে তাইলে ছাগু? জামায়াতি দাঁড়ি দেইখা বুঝছিলাম না। এবার বুঝলাম। আপনে কি আগের মতই গেলমান পোষেন?

৩| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ২:৫০

সি পি জি বলেছেন:

২৮ শে অক্টোবর। :D B-))

৪| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: আল মাহমুদ এর লেখা আমার ভীষন পছন্দ।

বিশেষ করে তার- কাবিলের বোন এবং উপমহাদেশ উপন্যাসটি আমার খুব প্রিয়।

৫| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৪৯

নেওয়াজ আলি বলেছেন: সুচিন্তিতভাবে সুচারু মনোভাব প্রকাশ, ভালোই ।

৬| ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:০৮

সাইন বোর্ড বলেছেন: আপনার লেখা পড়ে কবি সম্পর্কে আরো কিছু জানা গেল ।

৭| ০৫ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:১৮

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: জাসদের পত্রিকার সম্পাদক হওয়াটা সম্ভবত ওনার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.