![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মার্চ মাস এলেই মনে পড়ে সেই বিভীষিকাময় কালো রাতের কথা। ২৫ মে মার্চ। বাঙালীর ইতিহাসে এক রক্তস্নাত কলঙ্কময় কালো অধ্যায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে আত্নত্যাগ, নাম না জানা বীর শহীদদের অমর গাথা, অসংখ্য মায়ের সন্তান হারানোর বেদনা। হুমায়ূন আজাদ যথার্থ বলেছিলেন, ' বাংলাদেশ অমরদের দেশ। এ-দেশের প্রতি বর্গমিটার মাটির নিচে পাঁচ জন করে অমর ঘুমিয়ে আছেন।' এমন আত্নত্যাগের ইতিহাস আর কোন জাতির আছে কিনা জানা নেই। তাই আমরা বাঙালী এক গর্বিত জাতি।
২৫ মার্চের রাতের সেই ক্ষতের কথা লিখে বা বর্ননা করে শেষ করার মতো নয়। তার পরেরও এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্থানে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যার ফলাফল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো। রীতিমতো অবিশ্বাস্য এক ফলাফল। পূর্ব পাকিস্থানের ১৬২ আসনের ভেতর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ পেল ১৬০ টি আসন। এবং সকল আসনের নির্বাচন শেষে দেখা গেল, মনোনীত মহিলা আসনসহ পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মাঝে পূর্ব পাকিস্থানে আওয়ামীলীগ ১৬৭ টি, পশ্চিম পাকিস্থানে জুলফিকার আলী ভুট্রোর দল অর্থাৎ পিপলস পার্টি ৮৮ টি আর অন্যান্য সব দল মিলে ৫৫ টি আসন পেয়েছে।
অর্থাৎ সোজা হিসেব দাড়ালো পাকিস্থানকে শাষন করবে পূর্ব পাকিস্থান নেতৃবৃন্দ। বঙ্গবন্ধু তো পরিষ্কার ভাবে বলেই দিলেন, তিনি ছয় দফার কথা বলে জনগনের ভোট পেয়েছেন সুতারাং শাসনতন্ত্র ও রচনা করবেন ছয় দফার ভিত্তিতেই।
আর তখনই পাকিস্থানের সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, আর যাই হোক না কেন কোনভাবেই শাষনভার বাঙালীদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না। এরই ভেতর দিয়েই জেনারেল ইয়াহিয়া তার অজান্তে'বাংলাদেশ' নামক এই রাষ্ট্রটির জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন।
জেনারেলদের এই ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিল সেনাশাসক আইয়ুব খানের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পশ্চিম পাকিস্থানের পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্রো। হঠাৎ করে জুলফিকার আলী ভুট্রো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে 'লারকানায়' পাখি শিকার করার আমন্ত্রন জানায়। আর এখানে যোগ দেয় পাকিস্থানের বাঘা বাঘা সব জেনারেল। বাঙালীদের হাতে যাতে কিছুতেই ক্ষমতা না যায় সেই ষড়যন্ত্রের নীলনকশাটা সম্ভবত এখানেই তৈরি হয়।
ভেতরে ভেতরের এসব কর্মকান্ডের পরিকল্পনা জেনারেল ইয়াহিয়া খান বুঝতে দিলেন না। কালক্ষেপন ও সকলের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখার জন্য তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারী ঢাকার জাতীয় পরিষদে অধিবেশনের কথা ঘোষনা করলেন। সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় সে দিনটির জন্য।
সেবার ১৯৭১ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী পালিত হলো অন্য এক উন্মাদনায়। শহীদ মিনারে সেদিন মানুষের ঢল নামে। এর ভেতর দিয়ে মানুষের বুকের মাঝে জন্ম নিতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন। অন্যদিকে বাঙালীর সেই উন্মাদনা দেখে সংখ্যালঘু দলের জুলফিকার আলী ভুট্রো, যার ক্ষমতা পাবার কথা নয়, সে তখন ক্ষমতার জন্য হয়ে উঠলো বেপরোয়া। জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন হবার কথা, তার ঠিক ২ দিন আগে অর্থাৎ ১ লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া তা স্থগিত করে দিলেন। পূর্ব পাকিস্থান বাসীর বুকের ভেতর যে বারুদ জমা ছিল তাতে যেন আগুন স্পর্শ করলো। সারাটা দেশে ঘটল এর ভয়াল বিষ্ফোরন। অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষনা যখন রেডিওতে প্রচার হচ্ছে তখন ঢাকা ষ্টেডিয়ামে চলছে পাকিস্থানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা। মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা ষ্টেডিয়াম যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিনত হয়ে ওঠল। স্কুল-কলেজ, দোকান-পাট, অফিস-আদালত সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমে আসতে লাগলো পথে। পুরো ঢাকা যেন পরিনত হলো মিছিলের নগরীতে। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকলো, 'জয় বাংলা', 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।'
বঙ্গবন্ধু ঢাকা সহ সারা দেশে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ফলে সারাদেশ এক প্রকার অচল হয়ে পড়লো। অবস্থা আয়ত্ত্বে আনতে কারফিউ দেয়া হলো। কারফিউ ভেঙ্গে ছাত্র-জনতা পথে নেমে এল। চারিদিকে মিছিল, স্স্নোগান আর বিক্ষোভ। সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা পড়ছে, তারপরেও কারো যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
২রা মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলা। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংহতি হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি নির্বাচিত করা হলো জাতীয় সংগীত হিসেবে।
জাতীয় সংগীত হিসেবে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি' গানটিকে যখন ঘোষনা করা হয় তখন বিষয়টি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সহ্য হয়নি। তাই তারা তাদের ১০ এপ্রিল সংখ্যায় 'ভারতের মায়াকান্না' উপম্পাদকীয়তে 'দূরবীন' হিন্দু মুসলিম জিগির তুলে জনগনকে বিভ্রান্ত করার লক্ষে লেখেঃ 'রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি হিন্দু। রবীন্দ্রনাথের পরিবার ছিল ব্রক্ষ্ণধর্মাবলম্বী। এরা মুসলমানদের মত একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী নয় এবং এ ধর্মে মৃত ব্যক্তিকে কবর দিয়ে সৎকার করা হয় না। তথাপিও দৈনিক সংগ্রাম হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে উষ্কে দেবার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। উপসম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়, গত কয়েক সপ্তাহ আগে জিন্নাহ হল যখন সূর্যসেন হলে পরিনত হলো এবং রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রস্তাবিত হলো তখন ভারতের হিন্দুরা তাদের সাফল্যে আনন্দে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে যখন তাদের আশা ভঙ্গ হলো এবং তাদের আশার প্রদীপ নিভে গেল তখন ভারতীয় হিন্দুদের স্বভাবতই বেসামাল হয়ে পড়ার কথা।'
পাঁচদিনের হরতালের পর ৭ ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষন দিতে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। লক্ষ লক্ষ মানুষ তার ভাষন শুনতে এল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেন সেদিন আক্ষরিক অর্থে জনসমূদ্র। এ ঐতিহাসিক ভাষনে বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' সেদিনের এমন ভাষন বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশী দেয়া হয়নি। এ ভাষন সেদিন দেশের সকল মানুষকে করেছিল ঐক্যবদ্ধ। অকাতরে প্রান দিয়ে দেশ স্বাধীন করার শক্তি যুগিয়েছিল।
এদিকে একদিকে চলছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন অন্যদিকে প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে পাকিস্তানি মিলিটারির গুলিতে শত শত মানুষ মারা পড়ছে। পাকিস্থানি মিলিটারির গতিবিধি থামানোর জন্যে ছাত্র-জনতা পথে পথে ব্যরিকেড গড়ে তুলছে। সারাদেশে তখন ঘরে ঘরে কালো পতাকার সাথে সাথে উড়ছে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। কোথাও কোথাও দেশের ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। ৯ মার্চ মাওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে পরিষ্কার ঘোষনা দিয়ে বললেন, পশ্চিম পাকিস্থানিরা যেন আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে। কারন পূর্ব পাকিস্থানের জনগন একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে।
আর এই সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গনহত্যার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। বেলুচিস্তানের কসাই নামে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্থানের গভর্নর করে পাঠানো হল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোন বিচারপতি তাকে গভর্ণর হিসেবে শপথ করাতে রাজি হলো না। ইয়াহিয়া নিজে মার্চের ১৫ তারিখে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করে। আর এরই মাঝে প্রতিদিন বিমানে করে ঢাকায় আনা হতে থাকলো সৈন্য। যুদ্ধজাহাজে অস্ত্র এসে নোঙর করে চট্রগ্রাম বন্দরে। কিন্তু জনগনের বাধার কারনে সে অস্ত্র নামানো যাচ্ছিল না। ২১ মার্চ ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন ভুট্রো। সদলবলে সে ও ঢাকায় পৌছে আলোচনার ভান করতে থাকে।
এ সময়ে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালী সেনারা বিদ্রোহ করে বসল। তাদের থামানোর জন্য ঢাকা থেকে যে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় তাদের সাথে সাধারন জনগনের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রান হারায়। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসাতে সেদিন 'আমার সোনার বাংলা' গানের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো।
পরদিন ২৪ মার্চ। থমথমে একটা পরিবেশ সারা দেশজুড়ে। এই হত্যাযজ্ঞের যেন কোন সাক্ষি না থাকে সেজন্য সকল বিদেশী সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশী সাংবাদিকদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা নিবাসে। সেখান থেকে তাদের সোজা এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে বিশেষ প্লেনে তুলে দিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। কিন্তু মাত্র তিনজন বিদেশী সাংবাদিক গোপনে ঢাকায় লুকিয়ে থাকতে সক্ষম হন। তারা ছিলেন, আরণল্ড জেইথলিন, মিসেল লরেন্ট এবং সাইমন ড্রিং। তাদের মাধ্যমেই পরে বিশ্ববাসী ২৫ মার্চে রাতের পাকিস্থানি বর্বর বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা জানতে পারে।
২৫ মার্চ ১৯৭১।
সূর্য ডুবল। তখন পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। এর ঠিক এক মিনিট পর ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া চলে গেলেন সোজা এয়ারপোর্ট। তার আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সিরিজ বৈঠকগুলো ব্যর্থ হয়। তিনি বিমানে করাচী পাড়ি দিলেন। শান্তিুপূর্ন সমাধান যেখানে করা যেত সেই পথ এড়িয়ে ইয়াহিয়া বাঙালী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন।
নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা বর্তমান শেরাটন হোটেল ঘিরে ফেললো। সেখানকার সাংবাদিকরা যাতে বেরোতে না পারে তার জন্য জনৈক পাক ক্যাপ্টেন ডিসিপশনে কালো বোর্ডে চক দিয়ে লিখে দিল, বাইরে বেরুলেই গুলি। সাংবাদিকেরা বেরুতে না পেরে রেডিও ধরলেন। কোন কার্ফিউ এর ঘোষনা তার শুনতে পেলেন না। (পরে অবশ্য কারফিউ ঘোষনা হয়েছিল।) কিন্তু বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ ঠিকই পাওয়া গেল। সবাই ছুটে তখন ১২ তলায়। মেশিনগানের শব্দে কান পাতা দায়। ভুট্রোর দরজায় তারা দেখলেন কড়া পাহারা। ঘুম ভাঙ্গানো নিষেধ। ঢাকা-করাচী টেলিপ্রিন্টারের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা এখন বিচ্ছিন্ন। ওদিকে নরকের দরজা খুলে গেছে তারা কেউ তা জানতেও পারলেন না।
সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে ইয়াহিয়া খান চলে গেছে। আর তখন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকেরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা প্রতিন্ধক বসানো শুরু করে। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধক পাকিস্তনি সৈন্যদের চলাচলে তেমন কোন বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। যারা প্রতিবন্ধক স্থাপন করেছিল তারাই পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়।
যদিও হানাদার বাহিনীর অপারেশন শুরু হবার কথা ছিল রাত ১১ টায়। সৈন্যরা বের হয় সাড়ে ১১ টায়। কারন পাকিস্তানি ফিল্ড কমান্ডার চাইছিল না যে, বাঙালী সৈন্যরা প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোন সুযোগ পাক। নির্দিষ্ট লক্ষ অর্জনের জন্য সেনাদের ৬ ঘন্টা সময় বেধে দেয়া হয়েছিল। আক্রমন শুরু করার আগেই দ্রুততার সাথে ঢাকা শহরের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা তারা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
মধ্যরাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গনহত্যার নায়ক ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাক বর্বর বাহিনী নিরস্ত্র নরনারীর উপর ঝাপিয়ে পড়লো আদিম হিংস্রতায়। রাতের স্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ল জল্লাদ বাহিনীর রাইফেল, কামান মর্টারের হিংস্র গর্জনে। হাহাকার, আর্তচিৎকার ক্রন্দনে '৭১ এর ২৫ মার্চ রাত হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। সয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের নল ক্রমাগত উদ্গীরন করছিল মৃত্যু। পাক সেনাবাহিনীর জেনারেল ফজলে মুকিম খানের বিবৃতি থেকে নিরীহ নিরস্ত্র নর-নারীদের ওপর কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল তার একটা ধারনা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, 'প্রয়োজনের খাতিরে পাকিস্থান সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহ দমন করার জন্য মর্টার, রিকয়েলস রাইফেল, মেশিনগান, এমনকি ট্যাঙ্ক ও ব্যবহার করতে হয়েছিল। সে রাতে মারনাস্ত্রসমূহের শব্দ থেকে মনে হচ্ছিল সমস্ত ঢাকা শহরই একটি রণক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মার্কিন ট্যাঙ্ক আর সাথে সেনা বোঝাই লরি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে পড়লো। ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চললো তাদের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড। প্রতিটি রুমে রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ ছাত্রকে।
হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা কিছ সময়ের জন্য বাচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোড়ার কাজ করতে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুড়তে। তাদেরই দিয়ে একে একে সহপাঠিদের লাশ টানিয়ে এনে মাটি চাপা দিয়েছিল পাক সেনারা এবং কাজ শেষে তাদের লাইনে দাড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়।
সে রাতে জগন্নাথ ও ইকবাল হল ছাড়াও রোকেয়া হলে শকুনীর দল একে একে দানবের মতো তাদের থাবায় তছনছ করেছিল। ওদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ও। ড. গোবিন্দচন্দ্র ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাম অধ্যাপক সন্তোষ ভট্রাচার্য, ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক জি সি দেব, অধ্যাপক ফজলুর রহমান, অধ্যাপক মুক্তাদির সহ বিভিন্ন বিভাগের ১০ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করা হয়। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন।
রোকেয়া হল আক্রান্ত হলে হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী লাফিয়ে পড়ে পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে। ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুনের হাত থেকে বাচতে হলের বাইরে আসা শুরু করা মাত্র পাকবাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রক কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ ছাত্রীকে সে সময় হত্যা করা হয়।
পশুরা হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াও করেছিল শহরের সব জায়গায়। পাক বাহিনীরা তাদের যাবার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। চারিদিকে রক্ত আর লাশের স্তুপ তখন।
সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দফতরে পাকসেনারা সাড়াশি অভিযান চালায়। এর মুখে বাঙালী পুলিশরা আত্নসমর্পনের বদলে রাইফেল তুলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দানবদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে তাদের সকল প্রতিরোধ গুড়িয়ে যায়। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুন দিয়ে একপ্রকার ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দপ্তর। দানবেরা ১১'শ পুলিশের রক্ত ঝরিয়েও ক্ষান্ত হয়নি। গুড়িয়ে দেয় পুরো ব্যারাক। জ্বালিয়ে দেয় সবকিছূ।
যদিও এ হত্যাকান্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল - জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এতে ৬০০-৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। পুরো বাংলাদেশে হিন্দু এলাকাগুলো বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঢাকা মধ্যরাতের আগেই পুরোপুরি জ্বলছিল। বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরনের ঠান্ডামাথার হত্যাকান্ডের কথা অস্বীকার করেছে তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান বাহিনী ব্যাপক ধরনের শক্তি প্রয়োগ করেছিল। জগন্নাথ হল ও অন্যান্য হলগুলোতে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের নিষ্ঠুরতম দৃশ্য ভিডিওটেপে ধারন করেন তদানিন্তন বুয়েট প্রফেসর নুরুল উলা। বিদেশ থেকে সদ্য আনা ক্যামেরাতে তিনি যে ভিডিও চিত্র ধারন করেছিলেন তার কিছু অংশ NBC News এর সংবাদ চিত্রে স্থান পায়। যা এই লিংকটিতে গিয়ে দেখা যাবে।
ওদিকে টিক্কা খান পকিস্থানি সৈন্যদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বেতারে ২৫ মার্চের এই তান্ডবলীলা পরিচালনা করছিলেন। সেই বেতারের কথোপকথন কয়েকজন দুঃসাহসী বাঙালি রেকর্ড করে। তার কিছু অংশ ছিল এমন-
"কন্ট্রোলঃ হ্যালো ৯৯-লাইনে থাকো... নতুন কোন খবর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও যুদ্ধ চলছে। ওভার।
থেকে ৭৭: ৮৮-ও কাছ থেকে শেষ খবর... সে বেশ এগোচ্ছে। কিন্তু সেখানে বহুবাড়ি রয়েছে। ফলে তাকে একটা একটা করে ধূলিসাৎ করতে হচ্ছে... ওভার।
প্রতি ৭৭: তাকে বলো যে, তার বড় ভাইরা (আর্টিলারি বাহিনী) সত্বরই তার কাছে যাবে, সুতরাং বাড়িগুলো ধূলিসাৎ করার জন্য তাদের ব্যবহার করা যাবে। আমার মনে হয় লিয়াকত ও ইকবাল (লিয়াকত ও ইকবাল হল) এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি কি ঠিক বলেছি? ওভার।
থেকে ৭৭: কাজ শেষ করার রিপোর্ট এখনও পাইনি, তবে এ দুটোর ব্যাপারে তারা খুবই খুশি। ওভার।
থেকে কন্ট্রোলঃ খুবই খুশির খবর। ওভার।
প্রতি ৭৭: দ্বিতীয়ত রাস্তার সেই সব বাধা সম্পর্কে ঘোষনা করতেই হবে। রাস্তায় বাধা তৈরি করতে কাউকে দেখা গেলে তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হবে। ১ নং, ২ নং কোন এলাকায় রোড বন্ধক তৈরি করলে সেই এলাকার অধিবাসীদের শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের দায়ী করা হবে এবং ধ্বংস করে দেওয়া হবে... ওভার।
প্রতি ৮৮: তোমাদের ইমাম (কমান্ডিং অফিসার) কি বলেছে যে, তোমরা কাজ শেষ করতে প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টা সময় নেবে? ওভার।
থেকে ৮৮: ইমাম এখন ২৬ নম্বরের সঙ্গে। যদি তোমাদের আর কোন প্রকার সাহায্য লাগে তাহলে তাকে তোমরা জানাতে পার। বাক্সারদের (বাড়ি ধূলিসাৎ করার স্কোয়াড) সম্পর্কে রলছি, তারা তাদের ঘাঁটি থেকে যাত্রা করেছে এবং সকাল হওয়ার আগেই তোমাদের সামনের বাধা ধূলিসাৎ করার কাজে দ্রুত তারা তোমাদের সাহায্য করতে পারবে। ওভার।"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত লেখক রবার্ট পেইন তার চাঞ্চল্যকর 'ম্যাসাকার' পুস্তকে লিখেছেন, মাঝরাত নাগাদ তিনি বুঝতে পারলেন যে, ঘটনাপ্রবাহের দ্রুত পারিবর্তন হচ্ছে। তার টেলিফোন অবিরাম বেজে চলছে, কামানের গোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে আর দূর থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। তখনও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, কিন্তু তিনি জানতেন যে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল এর ব্যারাকগুলো এবং রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রান্ত হয়েছে। এর একমাত্র অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর ঘাটিগুলো নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর। তাই সে রাতেই তিনি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্বত্র বেতার যোগে পাঠাবার জন্য তিনি টেলিফোনে নিম্নোক্ত বানীটি সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে জনৈক বন্ধুকে ডিকটেশন দিলেন। যা চট্রগামে আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম এম এ হান্নানের কাছে যথাসময়ে পৌছেছিল।
"The Pakistani Army has attacked police lies at Rajarbagh and East Pakistan Rifles Headquarters at Pilkhana at midnight. Gather strength to resist and prepare for a War of Independence”
MASSACRE by Robert Payne (page 24) : The Macmillan Company New York.
অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করা। কেউ একজন ফোনে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দেন যে, শহরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তিনি যেন বাড়ি ছেড়ে আত্নগোপন করেন। তবে তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমি যদি আত্নগোপন করি তবে তারা আমার সন্ধানে নেমে সারা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে। আসলে তিনি আগেই এ ধরনের হামলার আশংকা করেছিলেন এবং কয়েকজন কাজের লোক ও দেহরক্ষী বাদে অন্যদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায।
মুজিবের এক প্রতিবেশী পরে জানান, রাত ১ টা ১০ মিনিটে একটি ট্যাঙ্ক, একটি সাজোয়া গাড়ি এবং ট্রাক বোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে মুজিবের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই চেচিয়ে বলেন, শেখ আপনি বাইরে আসুন। ব্যালকনিতে বেরিয়ে মুজিব বলেন, হ্যা আমি প্রস্তুত, এতো গোলাগুলির দরকার ছিল না। আমাকে ফোন দিলে আমি নিজেই হাজির হতাম।
এরপর অফিসারটি বাড়ির বাগানে ঢুকে বললেন, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। তিনজন কাজের লোক, একজন সহকারি আর দেহরক্ষীসহ মুজিবকে তারা নিয়ে গেল।
পরদিন ২৬ মার্চ কারখানায় নিত্যদিনের মতো সেদিন সাইরেন বাজলো না। এমনকি সরকারী ভবনগুলো পর্যন্ত খুলল না। ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদের অফিস তখনও পুড়ছে। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতিতে কোন সংবাদপত্র বের হতে পারলো না। এমনকি কোন সরকারী সংবাদ পত্র ও না। কিন্তু অস্বাভাবিকতার মাঝেও একটি পত্রিকা বের হলো, সেটি দৈনিক সংগ্রাম। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র আখতার ফারুক সম্পাদিত পত্রিকাতে গত রাতের নারকীয় হত্যাকান্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, লুটপাট কোন কিছুর খবরই ছাপা হলো না পক্ষান্তরে ঘাতক জান্তার বিভিন্ন কঠোর নির্দেশ ও প্রেসনোটে ঠাসা ছিল সেদিনের সংখ্যাটি।
তারপর সুদীর্ঘ ৯ মাস, সম্মিলিত একটি জাতি সামরিকভাবে প্রায় অজ্ঞ হয়েও তৎকালীন বিশ্বের সেরা এক বাহিনীর অধিকারী একটি দেশকে লজ্জায় ডুবিয়ে ঠিকই লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনলো। আমরা হলাম স্বাধীন। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা মাটি আর কত শত সহস্র মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে ভূমিষ্ঠ হলো লাল সবুজের বাংলাদেশ। আমার প্রিয় জন্মভূমি। পূর্ব পাকিস্তান নাম রাষ্ট্রটি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য। জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
২৫ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১২:০৬
ashumon79 বলেছেন: মনসুর ভাই, অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ৭:০০
মনসুর-উল-হাকিম বলেছেন: মাশাআল্লাহ, সুন্দর লিখেছেন| শুভেচ্ছান্তে ধন্যবাদ।
দেশের এই সময়ে আমরা যেন সৎ দেশ প্রেমিকের পরিচয় দিতে পারি, আল্লাহুম্মা আমীন।