নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দিন দিন বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে বর্তমানে প্রচলিত ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র পতনের প্রায় দ্বারপ্রান্তে। দিনে দিনে এর ব্যর্থতার ফুটো বড় হয়ে যাচ্ছে। একটা দালান ঘর যখন পুরনো হয়ে যায় তখন প্রথমে এর রং নষ্ট হয়। পরে ধীরে ধীরে এর পলেস্তারা খসে পড়ে। এর পর এক সময় এর খুঁটি ও দেয়াল ও ছাদ এর ভিত্তির উপর ধসে পড়ে ভিত্তিকে আড়ালে ফেলে দেয়। বর্তমানে এই ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থাগুলোর জৌলুস হারিয়ে গেছে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। অশান্তির আগুনে পুড়ছে প্রাচ্য থেকে প্রাতীচ্য। কায়েমী স্বার্থবাদীরা চাইছে এর পলেস্তারা আবার মেরামত করতে। তাদের প্রচার-প্রচারণাগুলো লক্ষ্য করলে সহজেই এই বিষয়টি অনুভব করা যায়। তাদের প্রচারণার মরিয়া ভাষাগুলো এরকম যে-এখনো মানুষ গণতন্ত্রকেই চায়, গণতন্ত্রই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে বলে সবাই বিশ্বাস করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা তাদের বিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ। অর্থাৎ তারা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে যে এ ব্যবস্থা আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু তারা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে যে উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো তাদেরই সৃষ্ট ব্যবস্থার ফল । তাই তারা শুকনো বালি দিয়ে পলেস্তারা মেরামত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আত্মাহীন একটা সভ্যতা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। কারণ মানুষের শুধু দেহই নয়, এর আত্মাও আছে। দেহ আর আত্মার চাহিদা পূরণ করেই মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। কিন্তু স্্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করা এই সভ্যতা মানুষকে আত্মাহীন, দেহসর্বস্ব ও যান্ত্রিক করে দিয়েছে। তাদের জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা আর ভোগ করা।
যার কারণে আজকের এই সভ্যতায় এত অন্যায়, এত বৈষম্য, এত কান্না, এত হাহাকার। অনেকে আপত্তি করতে পারেন যে গণতন্ত্র তো কারো ধর্ম পালনে বাঁধা দিচ্ছে না। বরং যথা সম্ভব নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবার ধর্ম পালনের জন্য সুযোগ নিশ্চিত করে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম পালন করে উন্নতি করার জন্য রাস্তা খোলা রেখেছে। কথা সত্য। কিন্তু আমাদের নজরে যে বিষয়টি আসছে না তা হচ্ছে গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থাগুলো ধর্মকে শুধুমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। তাই জাতীয় বা সমষ্টিগত জীবনে এর কোন নিদের্শনা ও কার্যকারিতা নেই। সমষ্টিগত জীবনে ধর্মের যে অংশটুকু আচরিত হয় সেগুলো নেহায়েতই লোক দেখানো এবং অনুষ্ঠানসর্বস্ব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে- আমাদের দেশসহ সারা দুনিয়ায় ধর্মীয় রাজনীতির পক্ষে বিপক্ষে দুইটি ধারা বিদ্যমান। একটি পক্ষ চায় ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুযায়ী রাষ্ট্র শাসিত হোক আর অন্যটা চায় ধর্মহীন রাষ্ট্র। এই ধারণাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক জগতের মূল সংঘাত। সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ থাকবে কি থাকবে না, আল্লাহর উপর আস্থা কথাটি থাকবে কি থাকবে না তার দ্বন্দ্ব। কিন্তু সংবিধানে এই বিষয়গুলো থাকা আর না থাকায় কিন্তু আসলে কিছ্ইু যায় আসে না। কারণ, এসব বিষয় মেনে নিলেও সংবিধানের পরবর্তী কার্যক্রমগুলো কিন্তু স্রষ্টাকে সার্বভৌমত্বের মালিক হিসেবে মেনে নিয়ে সামনে এগোয় নি।
এগিয়েছে জনগণকে সার্বভৌমত্বের মালিক হিসেবে মেনে নিয়ে। সংবিধানে এই বিপরীতমুখী বিষয়গুলো থাকাটা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। এটা এক ধরনের প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। বিসমিল্লাহ থাকুক আর না থাকুক, আল্লাহর উপর আস্থা থাকুক আর না থাকুক- জাতীয় জীবনে এর প্রয়োগ কিন্তু একই। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ নীতির উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। সমষ্টিগত জীবন ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে এবং ব্যক্তি জীবনের সীমিত গণ্ডিতে ধর্ম পালন হওয়ায় ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেয়ে গেছে। আগেই বলেছি মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়। প্রত্যেক জিনিসের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক দুইটি দিক প্রয়োজন হয়। যেমন দেহ-আত্মা, ইহকাল-পরকাল, দিন-রাত, আলো-অন্ধকার ইত্যাদি। ঠিক মানুষের ক্ষেত্রে ও দুটো ভাগ রয়েছে। দেহ এবং আত্মা। এর একটিকে বাদ দিলে অন্যটি অচল হয়ে যায় কিংবা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কিংবা কখনো কখনো কোন একটা অংশকে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয় তখন অন্য অংশটি দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয় তাই দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা স্রষ্টাহীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রসহ অন্যান্য জীবনব্যবস্থাগুলো জাতীয় জীবনে প্রয়োগের ফলে আত্মিক দিক দিয়ে মানুষ অধ:পতনের সর্বনিু পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ, সমষ্টিগত জীবনে যে বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয় তার প্রভাবে ব্যক্তি জীবন ভিন্ন থাকলেও তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটা খুবই স্বাভাবিক নিয়ম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে আমাদের দেশের জাতীয় খেলা হচ্ছে হা-ডু-ডু। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন এবং গুরুত্ব দেওয়া হয় ক্রিকেটকে। যার দরুন আজ আমাদের নতুন প্রজন্ম হা-ডু-ডু খেলতে আগ্রহী নয়। সবাই এখন ব্যাট, বল নিয়ে ক্রিকেট খেলায় নেমে পড়ে।
অনুরূপ সমষ্টিগত জীবনে স্রষ্টার অস্তিত্বকে, আদেশকে অবজ্ঞা করায় মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকেও ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। আর এ থেকেই আত্মিক শূন্যতার সৃষ্টি। যার কারণে আমাদের মধ্যে হতাশা ও বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়েছে; নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, অপরের সম্পদ লুটে নেওয়া, চুরি করা, ঘুষ খাওয়া, হত্যা, ধর্ষণ ধাই ধাই করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে মাঠ ঘাটের মানুষ আজ সামাজিক অবস্থার ক্রমাবনতির ফলে এই অবস্থার পরিবর্তন কামনা করছে। লোমহর্ষক খুন, নৃশৃংস আচরণ দেখে আমাদের লোম শিউরে উঠছে। আমরা ভাবতে শুরু করেছি যে আমাদের আত্মিক অবনতির দরুন এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেই আত্মিক শূন্যতা পূরণে আমরা কি করতে পারি সে ব্যাপারে আমাদের কোন ধারণাই নেই। আমরা অন্ধকারে হাবু-ডুবু খাচ্ছি। ধারণা এই জন্যই নেই কারণ আমরা আমাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখি না। আমরা জানি না কোথা হতে আমাদের আগমন এবং কোথায় আমাদের প্রত্তাবর্তন। জীবনের সঠিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের উচিত জীবনের এই দিক সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা রাখা।
উদাহরণস্বরূপ ধরুন একটা পশুর জীবনকে। তার কোন অতীত নিয়ে ভাবতে হয় না, ভবিষ্যত নিয়েও ভাবতে হয় না তার। তার সামনে শুধুই বর্তমান। তার কোন কাজের জন্য জবাবদিহিতা নেই। সুতরাং তার বর্তমানই হবে একমাত্র চিন্তার বিষয়। কিন্তু মানুষের জীবন তা নয়। পশুর সাথে মানুষের বিরাট একটা পার্থক্য এই যে মানুষের দেহের সাথে আত্মা ও আছে। এই আত্মার শক্তি যদি শেষ হয়ে যায় কিংবা দুর্বল হয়ে যায় তখন মানুষ পশুর পর্যায়ে নেমে যায়, দৈহিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে ন্যায় অন্যায়ের ব্যবধান ভুলে যায়। যে যত আত্মাহীন হয় সে তত পশুর কাছাকাছি চলে যায়। আর ঐ মানুষটিই যখন তার আত্মাকে যতবেশি শক্তিশালী করতে পারে সে ততবেশি মানবীয়তার চূড়ায় উঠতে পারে। এভাবে উঠতে উঠতে মানুষ এক সময় মহামানবও হতে পারে।
বর্তমান সভ্যতার সামষ্টিক জীবন থেকে মানুষের এই আত্মিক দিকটি উঠে যাওয়ায় মানুষ অনেকটা সেই পশুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যার বহিঃপ্রকাশ আজকের সমাজের এই অধঃপতন, অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার অশান্তিময় নরকের মত দুনিয়া। যেহেতু আমাদের আত্মিক শক্তি নেই সেহেতু আমরা পরকাল নিয়ে মোটেও চিন্তা করি না। তাই আমাদের জবাবদিহিতারও প্রশ্ন আসে না। অর্থাৎ পশুর মত। কিন্তু চাহিদায়, জ্ঞানে, কৌশলে, শারীরিক দক্ষতায় আমরা পশুর চেয়ে অনেক অগ্রগামী। তাই আমাদের জৈবিক সত্ত্বার চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমরা পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র, কৌশলী ও নৃশৃংস হয়ে উঠি। এসব দেখে যদি কোন পশুর বোধ শক্তি থাকত তাহলে তারাও আমাদের আচরণ দেখে হতবাক হোত।
যাহোক, যা বলছিলাম- আসা যাক আত্মিক শূন্যতা পূরণে মানুষের হাহাকারের কথায়। দিকনির্দেশনাবিহীন এই মানুষগুলো বর্তমানে আত্মিক শূন্যতা পূরণে নানা ধরনের পথ বেছে নিচ্ছে। পাশ্চাত্য অনেক আগেই তাদের জাতীয় জীবন থেকে স্রষ্টার অস্তিত্বকে বাতিল করার পর নিজেদের হাতে তৈরি জীবনব্যবস্থার বিষময় ফল ভোগ করতে শুরু করেছে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এখন তারা আবার বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকছে। চার্চে গিয়ে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। এমনকি বিমান বন্দরসহ বিভিন্ন জনসমাগমপূর্ণ স্থানে তারা ধ্যান করার মত নিরিবিলি কক্ষের ব্যবস্থা করছে। অনেকে নিজেদের অর্থকরি বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করছেন। দরিদ্রদের জন্য স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল তৈরি করছেন। কেউ কেউ ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে সাধু সন্ন্যাসীদের পিছে পিছে ঘুরছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। কারণ ঐ একই। সমষ্টিগত জীবনের নীতির চাপে তাদের এসব ব্যক্তিগত উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
সত্যিকার অর্থে আত্মিক শূন্যতা পূরণের জন্য তাদের এই উপলব্ধিতে আসতে হবে যে মানুষ দুনিয়াতে এসেছে সাময়িক সময়ের জন্য। তাদের আসল বাসস্থান জান্নাত। তারা দুনিয়াতে এসেছে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে, তাঁরই প্রতিনিধি হয়ে তাঁরই দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে দুনিয়া পরিচালনা করে শান্তি বজায় রাখার জন্য। এখানে তারা যদি শান্তিতে থাকে তবে এই শান্তিকে বাড়িয়ে আল্লাহ তাদের আবার জান্নাতে ফিরিয়ে নেবেন। দুনিয়া পরকালের শস্যক্ষেত্র। এখানে সে যা রোপণ করবে তার ফল ভোগ করবে পরকালে। পরকাল দুনিয়ার ছায়ার মত। এখানে যদি তারা শান্তিতে থাকে তাহলে একটি ছায়া যেমন বস্তুর সাথে নড়াচড়া করে তেমনি দুনিয়ার আলোকে তাদের পরকালের অবস্থা নির্ধারিত হবে। সুতরাং এই সত্যকে এড়িয়ে মানুষ কোনভাবেই তার দুনিয়াকে সুন্দর করতে পারবে না। মানুষকে ফিরে আসতে হবে আদি পরিচয়ে, সঠিক পরিচয়ে। বর্জন করতে হবে আত্মাহীন জীবনধারাকে। তবেই সম্ভব আত্মিক শূন্যতা পূরণ এবং এ অশান্তিময় অবস্থা থেকে মুক্তি।
©somewhere in net ltd.