নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাত্তিনের যুদ্ধের কিছু কথা

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:৫৪


হাত্তিনের যুদ্ধ ১১৮৭ সালের ৪ঠা জুলাই শনিবার ক্রুসেডার জেরুজালেম রাজ্যে এবং আইয়ুবীয়দের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।
সালাদিনের অধীন মুসলিম সেনাবাহিনী ব্যাপক সংখ্যক ক্রুসেডার সেনাকে হত্যা করেন । জেরুজালেম পুনরায় অধিকার করেন এবং অন্যান্য কিছু ক্রুসেডারা অধিকৃত শহর দখল করে নেন । যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে মুসলিমরা আবার পবিত্র ভূমিতে প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন । খ্রিষ্টানদের এই পরাজয় তৃতীয় ক্রুসেডের সূচনা করে । হাত্তিনের যুদ্ধের দুই বছর পর এই ক্রুসেড শুরু হয়েছিল ।
যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান যা ছিল
সেই যুদ্ধ বর্তমান ইসরায়েলের টাইবেরিয়াস নামক স্থানের নিকটবর্তী স্থানে সংঘটিত হয় । হিত্তিন শহরের নিকটবর্তী সেই যুদ্ধক্ষেত্রে দুই চূড়া বিশিষ্ট একটি পাহাড় রয়েছে । এটি টাইবেরিয়াস এবং পশ্চিমে এক্রের পথের মধ্যবর্তী বিস্তৃত পর্বতমালার গিরিপথের পাশে অবস্থিত । দারবুল হাউয়ারনাহ রাস্তাটি রোমানরা তৈরী করেন । সেটি জর্ডান নদী, গেলিলি সাগর ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের মধ্য প্রধান পথ হিসেবে কাজ করে ।
১১৮৬ সালে জেরুজালেমের রাজা হলেন গাই অব লুসিগনান । তার স্ত্রী সিবিলার সন্তান পঞ্চম বল্ডউইনের মৃত্যুর পর স্ত্রীর পদাধিকার বলে তিনি ক্ষমতা পেলেন । সেসময় জেরুজালেম রাজ্য গাই সিবিলা ও রেইনল্ড অব শাটিলন সেসাথে গেরার্ড অব রিডফোর্ট এবং নাইটস টেম্পলারদের মত নতুন আগতদের মধ্যকার বিরোধে বিভক্ত ছিল । ত্রিপলির তৃতীয় রেইমন্ড যিনি শিশু রাজা পঞ্চম বল্ডউইনের অভিভাবক ছিলেন । তিনি এবং তার নেতৃত্বাধীন অভিজাতকরা গাইয়ের রাজা হওয়ার বিরোধীতা করতেন । রেইমন্ড অবস্থার কারণে বীতশ্রদ্ধ দেখতে পেলেন যে তার অনুসারী ব্যারনরা গাই ও সিবিলার প্রতি অনুগত রয়েছেন । তিনি তারপর বিপরীত দিকে জর্ডান নদী থেকে টাইবেরিয়াসের দিকে চলে যান । অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে রেইমন্ড এবং গাইয়ের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ চলছিল । গাই রেইমন্ডের স্ত্রী এসিভার মাধ্যমে টাইবেরিয়াস দুর্গ জয় করতে চাইছিলেন। রেইমন্ডের সমর্থক বেলিয়ান অব ইবেলিনের মধ্যস্ততায় যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে । ইতিমধ্যে জেরুজালেমকে ঘিরে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ১১৭০ এবং ১১৮০ এর দশকে সালাদিন কর্তৃক ঐক্যবদ্ধ হন । ১১৬৯ সালে সালাদিন মিশরের উজির নিযুক্ত হন এবং শীঘ্রই সুলতান হিসেবে দেশের শাসনভার লাভ করেন । ১১৭৪ সালে দামেস্কে তিনি তার শাসন জারি করলেন । ১১৭৬ সাল নাগাদ আলেপ্পো ও ১১৮৩ সাল নাগাদ মসুলে তার কর্তৃত্ব স্থাপিত হল । ফলে প্রথমবারের মত জেরুজালেম রাজ্য মুসলিম শাসিত অঞ্চল দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে ।
১১৭৭ সালে ক্রুসেডাররা সালাদিনকে মন্টগিসারডের যুদ্ধের পরাজিত করে এবং ১১৮০ এর দশকের প্রথমদিকে দুপক্ষের মধ্যে একটি সন্ধি ছিল । কিন্তু রেইনল্ড একটি মুসলিম ক্যারাভেনকে আক্রমণ করলে সন্ধি ভঙ্গ হয় । তাছাড়াও রেইনল্ড মক্কা আক্রমণের হুমকিও দেন । ১১৮৭ সালে এপ্রিলে রেইমন্ড সালাদিনের সাথে একটি চুক্তির বিষয়ে সম্মত হলেন । তাদের চুক্তির অংশ হিসেবে রেইমন্ড গ্যালিলিতে একটি পরিদর্শন দল আগমণের ব্যাপারে সুলতানকে অনুমতি দিলেন । একই সময় গাইয়ের পক্ষে বেলিয়ানের নেতৃত্বাধীন একটি দল উক্ত এলাকা দিয়ে অতিক্রম করছিল । রেইমন্ড বেলিয়ানকে উপদেশ দিলেন যাতে বেলিয়ান মুসলিম সেনারা চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আফুলা দুর্গে অবস্থান করেন । কিন্তু তার পরামর্শ উপেক্ষা করা হয় । ১ই মে ক্রিসনের যুদ্ধে আল আফদালের অধীন একটি ক্ষুদ্র দলকে পরাজিত করা হল । সালাদিনের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে সেনাসমাবেশ করা গাইয়ের সাথে রেইমন্ড তারপরে একমত হলেন ।

মে মাসের শেষের দিকে সালাদিন তার জীবনের সর্ববৃহৎ সেনা সমন্বয়ে একটি সেনাদল গঠন করলেন । তাতে প্রায় ১২০০০সৈনিক সহ ও নিয়মিত অশ্বারোহীসহ মোট ৩০০০০ এর মত সৈনিক ছিল । জর্ডান নদী অতিক্রম করার পূর্বে ৩০শে জুন তিনি তেল আশতারায় তার বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করেন । প্রতিপক্ষ ক্রুসেডাররা জিপরিতে একত্রিত হয় । তাতে জেরুজালেম ও ত্রিপলি থেকে ১২০০ জন এবং এন্টিওক থেকে ৫০ জন নাইটসহ মোট ২০০০০ সৈনিক ছিল । সেটি সালাদিনের বাহিনীর তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও ক্রুসেডারদের তুলনায় অনেক বড় ছিল । রেইমন্ড এবং গাই ক্রুসেডার সেনা সহকারে এক্রেতে মিলিত হন । ইউরোপীয় সূত্রগুলোর মত অনুযায়ী নাইটদের পাশাপাশি সেখানে বড় ধরনের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী ও ১০০০০ এর মত পদাতিক সৈনিক ছিল । সম্পূরক হিসেবে ক্রসবোম্যানরাও উপস্থিত হয় এবং বেশ বড় সংখ্যক ভাড়াটে সৈনিকও ছিল । এক্রের বিশপ সেনাবাহিনীর সাথে থেকে ক্রস বহন করছিলেন । তিনি পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াসের স্থান নেন । ২রা জুলাই সালাদিন টাইবেরিয়াসে রেইমন্ডের একটি দুর্গ অবরোধে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দিলেন । সেসময় মূল মুসলিম সেনারা কাফ্র সাবতে অবস্থান করছিলেন । সালাদিন গাইকে সাফুরিয়ার ঝর্ণা থেকে সরাবার জন্য প্রলুব্ধ করতে চাইছিলেন । টাইবেরিয়াসের গেরসন সালাদিনকে অর্থ পরিশোধ করতে চেয়েছিল কিন্তু সালাদিন তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেন । ওইদিনই দুর্গের পতন হয় । একটি টাওয়ার খুড়ে ফেলা হয় এবং এটি ধ্বসে পড়ে সালাদিনের সৈনিকরা ভেতরে বাধাদানকারীদেরকে হত্যা এবং বন্দী করেন । রেইমন্ডের স্ত্রী এসিভা দুর্গের ভেতর আবদ্ধ হয়ে পড়েন । খনন আরম্ভ হলে সালাদিন খবর পান যে গাই ফ্রাঙ্ক সেনাবাহিনীকে পূর্বের দিকে নিয়ে আসছেন । ক্রুসেডাররা ফাঁদে পা দেন ।


২রা জুলাই ক্রুসেডারদের একটি যুদ্ধসভার ফলে গাইয়ের নিজের প্রতিরক্ষার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । ফ্রাঙ্কদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে এই সভার বিষয়ে তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট হলেও রেইমন্ড সালাদিনের ফাঁদ অনুযায়ী এক্রে থেকে টাইবেরিয়াসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ করেন বলে প্রতীয়মান হয় । অধিকন্তু গাইয়ের টাইবেরিয়াসের ব্যাপারে চিন্তিত হওয়া উচিত ছিল না । সেটি রেইমন্ডের ব্যক্তিগত অধিকারে ছিল এবং রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল । মতবিরোধের ফলে গেরার্ড এবং রেইনল্ড রেইমন্ডকে ভীরু বলে অভিযোগ করেন । ফলে গাই আক্রমণ করতে প্রভাবিত হন । তারপরই গাই সেনাবাহিনীকে সালাদিনের বিরুদ্ধে টাইবেরিয়াসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন । আর এটিই সালাদিনের পরিকল্পনা ছিল । এর মাধ্যমে ক্রুসেডারদেরকে তাদের দুর্গ অবরোধ না করে যুদ্ধক্ষেত্রেই পরাজিত করা সম্ভব ছিল । তাছাড়াও সালাদিন অনাকাঙ্খিতভাবে দ্রুজদের কাছ থেকে মিত্রতা লাভ করেন । জামাল আদদিন হাজির মাধ্যমে শারাহমুলে এই মিত্রতা স্থাপিত হয়েছিল । জামালের পিতা কারামা নূর উদ্দিন জেনগির পুরনো মিত্র ছিলেন । শারাহমুল শহর ক্রুসেডারদের কর্তৃক বেশ কয়েকবার হামলার স্বীকার হয়েছিল । জামাল আদদিন হাজির মতে তার বড় তিন ভাইকে হত্যা করেন ।
ক্রুসেডাররা সাফুরিয়া থেকে ৩রা জুলাই তাদের যাত্রা শুরু করেন । গাই সেনাদের মধ্যভাগ রেইমন্ড অগ্রভাগ এবং বেলিয়ান ও রেইনল্ড পেছনের দিক নিয়ন্ত্রণ করেন । মুসলিম সেনারা প্রায় সাথেসাথে ক্রুসেডারদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন ।
সেদিন দুপুর নাগাদ ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনী সাফুরিয়া থেকে ছয় মাইল দূরের গ্রাম তুরানের একটি জলধারায় পৌছায় । সালাদিনের মতে এখানে ফ্রাঙ্কিশ পদাতিকদের বাজপাখি এবং অশ্বারোহীদের ঈগলগুলো পানির পাশে উড়ছিল । টাইবেরিয়াস পর্যন্ত আরো ৯ মাইল ১৪ কিমি পথ বাকি ছিল । ফলে যাত্রার জন্য দিনের অর্ধেক সময় বাকি থাকায় এই পানির উৎস থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়া মানে সালাদিনের নিশ্চিত হামলার মুখোমুখি হতে হত । ১১৮২ সালে ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনী শত্রুদের বিরুদ্ধে এক দিনে ৮ মাইল ১৩ কিমি অগ্রসর হতে পারত এবং ১১৮৩ সালে পুরো দিনে ছয় মাইল ১০ কিমি অতিক্রমে সক্ষম হলেন । কিন্তু সালাদিনের লেখা অনুযায়ী গাইয়ের উদ্দেশ্যের বিপরীত হয়ে এমন কাজ করার জন্য শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করে । অর্থাৎ অজ্ঞাত কারণে গাই অনেক বিকেলে টাইবেরিয়াসের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেন ।

যখন সালাদিন টাইবেরিয়াস দখল করার পর ফিরে আসেন এবং ফ্রাঙ্কিশরা তুরান ত্যাগ করেন মুসলিমরা হামলা করা শুরু করেন । সালাদিন তার সেনাবাহিনীর দুইটি অংশকে ফ্রাঙ্কিশদের বিরুদ্ধে পাঠান এবং তুরানের জলধারা দখল করে নেন । ফলে ফ্রাঙ্কিশদের পিছু হটার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় । এই পরিকল্পনা সালাদিনকে বিজয় দান করেন । ক্রুসেডারদের পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে । ক্রুসেডাররা সালাদিনের সাথে সরাসরি লড়তে পারবে না এমন বিশ্বাস নিয়ে রেইমন্ড গাইকে বাহিনীর বাম এবং অগ্রভাগ ৬ মাইল ৯.৭ কিমি দূরের হাত্তিনের জলধারার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন । সেখান থেকে তারা পরেরদিনই টাইবেরিয়াসের দিকে যাত্রা করতে পারবে । আসন্ন আক্রমণে ফ্রাঙ্কিশদের পশ্চাতভাগ নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণের কারণে অচলাবস্থায় ছিল । সেসময় সমগ্র বাহিনী মেসকানা গ্রামের নিকট উচ্চভূমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েন । ক্রুসেডাররা মুসলিম পরিবেষ্টিত অবস্থায় ক্যাম্প করতে বাধ্য হন । ফলে তাদের কাছে কোনো পানি ছিল না এবং রসদ ও নতুন সৈন্য আগমনের সুযোগও হারায় । গাইয়ের আশা ছিল যে তার লোকেরা পরেরদিন সকালে হাত্তিনের জলধারায় পৌছতে পারবেন । যখন ক্রুসেডাররা পানির জন্য পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিল সেসময় উটের ক্যারাভেন মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্য টাইবেরিয়াস হ্রদ বর্তমানে গেলিলি সাগর বলে পরিচিত টা থেকে ছাগলের চামড়ার ব্যাগে পানি বয়ে নিয়ে আসছিল । বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ ফ্রাঙ্কিশ সেনাবাহিনীর অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণনা করে লিখে গেছেন । ৪ঠা জুলাইয়ের সকালে ক্রুসেডাররা তাদেরকে সমস্যায় ফেলার জন্য সালাদিনের বাহিনীর সৃষ্ট আগুনের ধোয়ার কারণে কিছু দেখতে পারছিল না । এর মাধ্যমে মুসলিম সেনাবাহিনীর একাংশের কমান্ডার প্রতিপক্ষের উপর ৪০০ তীর ছুড়ে মারেন । গেরার্ড এবং রেইনল্ড গাইকে যুদ্ধের জন্য সেনাবিন্যাস ও হামলার পরামর্শ দিলেন । গাইয়ের ভাই আমালরিক এই কাজ সম্পন্ন করেন । রেইমন্ড প্রথম ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন । তার সাথে এন্টিওকের তৃতীয় বোহেমন্ডের পুত্র রেইমন্ড অব এন্টিওক ছিলেন । অন্যদিকে বেলিয়ান ও এডেসার তৃতীয় জোসেলিন পশ্চাতভাগ বিন্যাস করেন । এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার সময় রেইমন্ডের পাঁচজন নাইট সালাদিনের কাছে ক্রুসেডার শিবিরের দুর্বল অবস্থার কথা ফাঁস করে দিলেন ।
পিপাসার্ত এবং মনোবল ভেঙ্গে পড়া ক্রুসেডাররা শিবির গুটিয়ে নেন ও হাত্তিনের জলধারার দিকে নিজেদের গন্তব্য ঘুরিয়ে নেন । কিন্তু তাদের এই পদক্ষেপে সালাদিনের সেনারা বাধা দেয় । তার ফলে সামনে আগানোর বা পিছিয়ে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় । কাউন্ট রেইমন্ড টাইবেরিয়াস হ্রদের দিকে হামলা ভেঙ্গে দেওয়ার দুটি প্রচেষ্টা চালানো হয় । দ্বিতীয়বার তিনি তার মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন । রেইমন্ড পালানোর পর গাইয়ের অবস্থান তখন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে । অধিকাংশ ক্রুসেডার পদাতিক সৈনিক ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানোর জন্য দলত্যাগ করেন । গাই মুসলিম অশ্বারোহীদের গতিরোধ করার জন্য তাবু স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পদাতিকদের সুরক্ষা ছাড়া নাইটদের ঘোড়াগুলো মুসলিম তীরন্দাজদের কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং অশ্বারোহীদেরকে পায়ে ভর দিয়ে লড়াই করতে হয়েছিল । তারপর তারা দুজনই পিছু হটেন । তখন ক্রুসেডাররা ঘেরাও হয়ে পড়েন । তিনটি বেপরোয়া হামলা ছাড়া তারা সালাদিনের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ফলে পরাজিত হন ।

সালাদিনের ১৭ বছর বয়সী এক পুত্র আল আফদান এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী । মুসলিম লেখক ইবনে আল আসিরের লেখায়ও এটির উদ্ধৃতি রয়েছে । যখন ফ্রাঙ্কদের রাজা গাই তার দল নিয়ে পাহাড়ের উপর ছিলেন তারা মুখোমুখি অবস্থান করা মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি ভয়ংকর হামলা চালায় যাতে তারা তাদেরকে আমার পিতার সালাদিন কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন । আমি তার দিকে তাকালাম এবং তিনি বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং তার গাত্রবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে গেল । তিনি তার দাড়ি ধরলেন ও অগ্রসর হলে চিৎকার দিয়ে বললেন শয়তানদেরকে ফেলে দাও । মুসলিমরা এগিয়ে যায় লড়াইয়ে পুনরায় অংশ নেয় এবং পাহাড়ে চড়ে । যখন আমি দেখলাম যে মুসলিমদের পশ্চাদ্ধাবনে ফ্রাঙ্করা পিছিয়ে যাচ্ছে আমি আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলেন । এই বলে আমরা তাদের পরাজিত করেছি । কিন্তু ফ্রাঙ্করা এগিয়ে আসে প্রথমবারের মত হামলা চালায় এবং মুসলিমদের তার বাবার কাছে ফেরত পাঠায়। তিনি আবার প্রথমবারের মত করেন এবং মুসলিমরা ফ্রাঙ্কদের দিকে আবার ফিরে যায় এবং তাদেরকে পাহাড় থেকে পিছু হটায় । সে আবার চিৎকার দিয়ে উঠে আমরা তাদের পরাজিত করেছি । কিন্তু তার বাবা তার পাশে ঘুরেন এবং বলেন শান্ত হও যতক্ষণ না ওই তাবুটি গাইয়ের ধ্বংস না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা তাদেরকে হারায়নি । তিনি একথা বলার পর তাবুটি ধ্বংস হয় । সুলতান ঘোড়া থেকে নামেন সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে সিজদায় নত হন এবং আনন্দে কেঁদে ফেলেন ।

যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা সংক্ষেপে
মুসলিম সেনারা রাজা গাইয়ের রাজকীয় তাবু দখল করেন । সেইসাথে যুদ্ধে এক্রের বিশপ নিহত হলে তার ট্রু ক্রসও দখল করেন । গাই তার ভাই দ্বিতীয় আমালরিক রেইনল্ড অব শাটিলন, মন্টফেরাটের উইলিয়াম, গেরার্ড দ্য রিডফোর্ট, টোরনের হামফ্রে, জাবালার হাফ, বোট্রনের পিলভেইন, জিবেলেতের হাফ এবং অন্য আরো অনেকেই বন্দী হন । সম্ভবত ৩০০০জন খ্রিষ্টান সৈনিক পালাতে সক্ষম হয়েছিল । একজন বেনামী লেখকের লেখা De Expugnatione Terrae Sanctae per Saladinum Libellus অনুযায়ী রেইমন্ড, জোসেলিন, বেলিয়ান এবং রেজিনাল্ড অব সিডন যুদ্ধের মধ্যবর্তী অবস্থায় পালিয়ে যান । কিন্তু সেটি অন্যান্য সূত্রগুলো দ্বারা সমর্থিত নয় এবং এতে লেখকের শত্রু মনোভাব প্রকাশিত হয় । ক্লান্ত বন্দীদেরকে সালাদিনের তাবুতে আনা হয় । সালাদিনের ঔদার্যের নিদর্শন হিসেবে গাইকে বরফ পানির একটি পানপাত্র দেওয়া হয় । গাই এই পাত্র তার সঙ্গী রেইনল্ডের দিকে দিলে সালাদিন তাকে এটি পান করার অনুমতি দেন কিন্তু কিছুক্ষণ পর বলেন যে তিনি রেইনল্ডকে পানি প্রদান করেননি এবং এর কারণে মুসলিম রীতি অনুযায়ী আতিথেয়তায় আবদ্ধ না । যখন সালাদিন রেইনল্ডকে শপথ ভঙ্গকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন রেইনল্ড উত্তর দিলেন রাজারা সবসময় এভাবেই কাজ করে । আমি এর বেশি কিছু করিনি । সালাদিন এরপর নিজের তরবারী দিয়ে রেইনল্ডের শিরচ্ছেদ । গাই রেইনল্ডের পরিণতি দেখে হাটুর উপর ভর দিয়ে বসে পড়েন । কিন্তু সালাদিন তাকে উঠতে বলার পর বলেন রাজা কখনো অন্য রাজাকে হত্যা করে না কিন্তু ওই লোকটা সব সীমা অতিক্রম করেছিল এবং তাই আমি তার সাথে এই আচরণ করেছি । এই লোকটিকে তার অপরাধপ্রবণতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মরতে হয়েছে । ট্রু ক্রসকে বর্শার সাথে বাধে দামেস্কে পাঠিয়ে দেওয়া হলো । সালাদিনের সেনাবাহিনীর কিছু লোক সেসময় ফ্রাঙ্কিশ বন্দীদেরকে দাস হিসেবে নিয়ে সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন ।

৫ই জুলাই রোববার সালাদিন টাইবেরিয়াসের দিকে ছয় মাইল ১০ কিমি যাত্রা করেন এবং সেখানে কাউন্টেস এসিভা দুর্গের নিয়ন্ত্রণ সমর্পণ করেন । তাকে তার পরিবার অনুসারী ও সহায় সম্মদসহ ত্রিপলি যেতে অনুমতি দেওয়া হয় । রেইমন্ড অব ত্রিপলি যুদ্ধ থেকে পালানোর পর ১১৮৭ সালে প্লুরেসিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের দন্ড শিরচ্ছেদের মাধ্যমে কার্যকর করা হয় । বন্দী অনেক ক্রুসেডার নিজেদের টেম্পলার নাইট হওয়ার মিথ্যা দাবি করেন যাতে সালাদিনের লোকেরা তাদেরকেও শিরচ্ছেদ করেন । নাইটস হসপিটালার সেইন্ট নিকাসিয়াসকে খ্রিষ্টান শহীদ হিসেবে সম্মান করা হয় । বলা হয় যে তিনিও নিহতদের মধ্যে একজন । সালাদিন তাদের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন তিনি তাদের কারাগারে রাখার পরিবর্তে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন । তার সাথে পন্ডিত সুফি ও নির্দিষ্ট সংখ্যক ধর্মপ্রাণ এবং কঠোর সাধনা করা লোক ছিল যারা প্রত্যেকে বন্দীদের একজন করে হত্যার অনুমতি চাইছিল এবং তলোয়ার নিয়ে জামার হাত গুটে নেয় । সালাদিন উচ্ছ্বসিতভাবে তার উঁচু আসনে বসে ছিলেন অবিশ্বাসীরা তাদের নিরাশা প্রদর্শন করে । ইমাদ আদদিন আল ইস্ফাহানি সালাদিনের সচিব হন । গাইকে দামেস্কে বন্দী হিসেবে নেওয়া হয় । পরে তিনি মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পান ।
২০০০০জন সৈনিক নিয়ে মাঠে নামার কারণে ক্রুসেডারদের দুর্গ এবং আবাসথলগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে । হাত্তিনে বড় ধরনের পরাজয় সালাদিনের বিপক্ষে লড়াইয়ের জন্য স্বল্পসংখ্যক রিজার্ভ সৈনিকের উপস্থিতি প্রমাণ করেন । এই পরাজয়ের ফলাফল হিসেবে সালাদিনের সেনারা ক্রুসেডারদের এলাকা দখলে নিয়ে নেন । মধ্য সেপ্টেম্বর নাগাদ সালাদিন এক্রে, নাবলুস, জাফা, টোরন, সিডন, বৈরুত এবং আসকেলন দখল করে নেন । সৌভাগ্যবশত কনরাড অব মন্টফেরাটের আগমনের কারণে টায়ার রক্ষা পান । রাণী সিবিলা, পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াস ও বেলিয়ান জেরুজালেম প্রতিরক্ষা করতে থাকেন । ২রা অক্টোবর বেলিয়ান সালাদিনের সাথে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন
এরনলের বিবরণ অনুযায়ী পরাজয়ের খবর শোনার পর পোপ তৃতীয় আরবান শোকে মৃত্যুবরণ করেন । টায়ারের আর্চবিশপ জোসিয়াস এবং অন্যান্য তীর্থযাত্রী ও ভ্রমণকারীদের কর্তৃক হাত্তিনের পরাজয়ের খবর ইউরোপ পৌছায় । নতুন ক্রুসেডের জন্য অবিলম্বে পরিকল্পনা তৈরী হয় । পোপ অষ্টম গ্রেগরি অডিটা ট্রিমেন্ডি জারি করেন এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে সালাদিন টিথে নামক ফান্ডে অর্থ সংগ্রহ শুরু হয় । তৃতীয় ক্রুসেড ১১৮৯ এর আগ পর্যন্ত শুরু হয়নি । তাতে ফিলিপ অগাস্টাস, রিচার্ড লায়নহার্ট এবং ফ্রেডেরিক বারবারোসা পৃথক পৃথকভাবে নেতৃত্বে দেন ।

ছবিতথ্যসূত্র গুগল এবং বিভিন্ন ওয়েব পেজ থেকে ।



মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৩৭

মোঃ শিলন রেজা বলেছেন: অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান পেলাম। আপনার লেখাতে খুব সহজেই ইতিহাস টা জেনে গেলাম। ইতিহাস আমার খুব ভাল লাগে। মুঘল দের ইতিহাস গুলা নিয়ে যদি এমন কিছু পোস্ট করতেন তাহলে পড়ে উপকৃত হতাম।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৫৬

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই অবশ্যয়ই আপনার কথা রাখার চেষ্টা করবো । শুভেচ্ছা থাকলো ।

২| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:০৩

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: চমৎকার পোস্ট! ভালো লাগা রেখে গেলাম ।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৯

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

৩| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৬

আধার রাতের মুসাফির বলেছেন: চমৎকার পোস্ট! ভালো লাগা রেখে গেলাম ।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪১

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

৪| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫২

আহলান বলেছেন: পড়লুম ....

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪৩

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ।

৫| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:০৯

ধমনী বলেছেন: আপনি কি শান্তি ও সংঘর্ষ বিষয়ে পড়েন?

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪৬

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আমি সব বিষয়ে লেখাপড়া করি । আপনাকে ধন্যবাদ ।

৬| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:৩৯

বাংলার ফেসবুক বলেছেন: ২রা জুলাই ক্রুসেডারদের একটি যুদ্ধসভার ফলে গাইয়ের নিজের প্রতিরক্ষার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । ফ্রাঙ্কদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে এই সভার বিষয়ে তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট হলেও রেইমন্ড সালাদিনের ফাঁদ অনুযায়ী এক্রে থেকে টাইবেরিয়াসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ করেন বলে প্রতীয়মান হয় ।

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১৮

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ ।

৭| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২১

অগ্নি সারথি বলেছেন: হুম। জানা ছিল না অনেক কিছুই।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৩

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: জানার জন্য ধন্যবাদ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.