নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন নিরীহ বাঙ্গালী নারী ছিলেন বেগম রোকেয়া

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০২


বেগম রোকেয়ার কথাঃ
আমরা দুর্ধ্বল নিরীহ বাঙ্গালী।এই বাঙ্গালী শব্দে কেমন সুমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ হয়। আহা! এই অমিয়াসিক্ত বাঙ্গালী কোন বিধাতা গড়িয়াছিলেন ? কুসুমের সৌকুমার্য্য, চন্দ্রের চদ্রিকা, মধুর মাধুরী, য়ূথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কামেলতা, সলিলের তরলতা,এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য্য এবং স্নিগ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত হইয়াছে।আমাদের নামটি যেমন শ্রুতিমধূর তদ্রুপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ এবং সরল।আমরা মূর্তিমতী কবিতা যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজী ধরনের একটি অট্টালিকা মনে করি, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা এবং বাঙ্গালী তাহাতে সাজসজ্জা যদি ভারতবর্ষকে একটা সারোবর মনে করি,তবে বাঙ্গালী তাহাতে পদ্মিনী, যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করি,তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা ! ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা! অতএব আমরা মূর্ত্তিমান কাব্য।আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি,পুঁইশাকের ডাঁটা, সজিনা এবং পুঁটি মাছের ঝোল,অতিশয় সরস। আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি, ঘৃত, দুগ্ধ, দধি, ছানা,নবনীত, ক্ষীর, সর, সন্দেশ এবং রসগেল্লা অতিশয় সুস্বাদু। আমাদের দেশের প্রধান ফল, আম এবং কাঁঠাল রসাল এবং মধুর।অতএব আমাদের খাদ্যসামগ্রী ত্রিগুণাত্মক সরস, সুস্বাদু, মধুর।

খাদ্যের গুণ অনুসারে শরীরের পুষ্টি হুয়।তাই সজিনা যেমন বীজবহুল, আমাদের দেহে তেমনই ভূঁড়িটি স্থূল।নবনীতে কামেলতা অধিক, তাই আমাদের স্বভাবের ভীরুতা অধিক। শারীরিক সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে অধিক বলা নিস্প্রয়োজন এখন পোষাক পরিচ্ছদের কথা বলি ।আমাদের বর অঙ্গ যেমন তৈলসিক্ত নবনিগঠিত সুকামেল, পরিধেয়ও তদ্রুপ অতি সূক্ষ শিমলার ধূতি এবং চাদর । ইহাতে বায়ুসঞ্চলনের কোন বাধা বিঘ্ন হয় না ! আমরা সময় সময় সভ্যতার অনুরোধে কোট শার্ট ব্যবহার করি বটে, কারণ পুরুষমানুষের সবই সহ্য হয় । কিন্তু আমাদের অর্দ্ধাঙ্গী-হেমাঙ্গী, কৃষ্ণাঙ্গিগণ তদনুকরণে ইংরাজললনাদের নির্লজ্জ পরিচ্ছদ,শেমিজ জ্যাকেট, ব্যবহার করেন না। তাহারা অতিশয় সুকুমারী ললিতা লজ্জাবতী লতিকা, তাই অতি মসৃণ এবং সূক্ষ হাওরার শাড়ী পরেন ! বাঙ্গালীর সকল বস্তুই সুন্দর, স্বচ্ছ ও সহজলব্ধ।বাঙ্গালীর গুণের কথা লিখিতে হইলে অনন্ত মসী, কাগজ এবং অক্লান্ত লেখকের প্রয়োজন । তবে সংক্ষেপে দুই চারিটা গুণের বর্ণনা করি।ধনবৃদ্ধির দুই উপায়, বাণিজ্য ও কৃষি।বাণিজ্য আমাদের প্রধান ব্যবসা।কিন্তু তাই বলিয়া আমরা ‘আরাব্যোউপন্যাসের’ সিন্দবাদের ন্যায় বাণিজ্যপোত অনিশ্চিত ফললাভের আশায় অনন্ত অপার সাগরে ভাসাইয়া দিয়া নৈরাশ্যের ঝঞ্জাবাতে ওতপ্রোত হই না।আমরা ইহাকে সহজ এবং স্বল্পায়াসসাধ্য করিয়া লইয়াছি।অর্থাৎ বাণিজ্য ব্যবসায়ে যে কঠিন পরিশ্রম আবশ্যক তাহা বর্জ্জন করিয়াছি । এ জন্য আমাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিষ নাই শুধু বিলাসদ্রব্য নানাবিধ কেশতৈল এবং নানাপ্রকার রোগবর্দ্ধক ঔষধ এবং রাঙা পিত্তলের অলঙ্কার, নকল হীরার আংটী, বোতাম ইত্যাদি বিক্রয়ার্থ মজুদ আছে।ঈদৃশ ব্যবসায়ে কায়িক পরিশ্রম নাই। আমরা খাঁটী সোনা রূপা বা হীরা জওয়াহেরাৎ রাখি না, কারণ টাকার অভাব।বিশেষতঃ আজি কালি কোন জিনিষটার নকল না হয় ?

যখনই কেহ একটু যত্ন পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক দীর্ঘকেশী তৈল প্রস্তুত করেন, অমনই আমরা তদনুকরণে হ্রস্বকেশী তৈল আবিষ্কার করি।যদি কেহ কৃষ্ণকেশী তৈল বিক্রয় করেন, তবে আমরা শুভ্রকেশী বাহির করি। কুন্তলীনের সঙ্গে কেশলীন বিক্রয় হয়। বাজারে মস্তিষ্ক সিগ্ধকারী ঔষধ আছে, মস্তিষ্ক উষ্ণকারী দ্রব্যও আছে । এক কথায় বলি, যত প্রকারের নকল এবং নিষ্প্রয়োজনীয় জিনিষ হইতে পারে, সবই আছে । আমরা ধান্য তণ্ডুলের ব্যবসা করি না, কারণ তাহাতে পরিশ্রম আবশ্যক।আমাদের অন্যতম ব্যবসা পাশ বিক্রয়। এই পাশ বিক্রেতার নাম বরএবং ক্রেতাকে শ্বশুর বলে । এক একটি পাশের মূল্য কত জান ? অর্দ্ধেক রাজত্ব এবং এক রাজকুমারী। এম, এ , পাশ অমূল্যরত্ন, ইহা যে সে ক্রেতার ক্রেয় নহে ৷ নিতান্ত সস্তা দরে বিক্রয় হইলে, মূল্যএক রাজকুমারী এবং সমুদয় রাজত্ব।আমরা অলস, তরলমতি, শ্রমকাতর, কামেলাঙ্গ বাঙ্গালী কিনা তাই ভাবিয়া দেখিয়াছি, সশরীরে পরিশ্রম করিয়া মুদ্রালাভ করা অপেক্ষা শ্বশুরের যথাসর্ব্বস্ব লুন্ঠন করা সহজ!এখন কৃষিকার্য্যের কথা বলি।কৃষি দ্বারা অন্নবৃদ্ধি হইতে পারে ৷ কিন্তু আমরা ভাবিয়া দেখিয়াছি কৃষিবিভাগের কার্য্য করা অপেক্ষা মস্তিষ্ক উর্ব্বর করা সহজ। অর্থাৎ কর্কশ উর্ব্বর ভূমি কর্ষণ করিয়া ধান্য উৎপাদন করা অপেক্ষা মুখস্থ বিদ্যার জোরে অর্থ উৎপাদন করা সহজ। এবং কৃষিককার্য্যে পারদর্শিতা প্রদর্শন করা অপেক্ষা M R. A. C. পাশ করা সহজ! আইনচর্চ্চা করা অপেক্ষা কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চ্চা করা কঠিন।অথবা রৌদ্রের সময় ছত্র হস্তে কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শন জন্য ইতস্ততঃ ভ্রমণ করা অপেক্ষা টানাপাখার তলে আরাম কেদারায় বসিয়া দুর্ভিক্ষ সমাচার পাঠ করা সহজ। তাই আমরা অন্নোৎপাদনের চেষ্টা না করিয়া অর্থ উৎপাদনে সচেষ্ট আছি।আমাদের অর্থের অভাব নাই, সুতরাং অন্নকষ্টও হইবে না! দরিদ্র হতভাগা সব অন্নাভাবে মরে মরুক তাতে আমাদের কি ?

আমরা আরো অনেক প্রকার সহজ কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকি।যথা :
১। রাজ্য স্থাপন করা অপেক্ষা “রাজা” উপাধ লাভ সহজ।
২। শিল্পকার্য্যে পারদর্শী হওয়া অপেক্ষা B. Sc. এবং D. Sc. পাশ করা সহজ।
৩।অল্প বিস্তর অর্থব্যয়ে দেশে কোন মহৎ কার্য্য দ্বারা খ্যাতি লাভ করা অপেক্ষা “খাঁ বাহাদুর” বা “রায় বাহাদুর” উপাধিলাভের জন্য অর্থ ব্যয় করা সহজ।
৪। প্রতিবেশী দরিদ্রদের শোক দুঃখে ব্যথিত হওয়া অপেক্ষা বিদেশীয় বড় লোকদের মৃত্যুদুঃখে “ শোক সভার” সভ্য হওয়া সহজ।
৫। দেশের দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য পরিশ্রম করা অপেক্ষা আমেরিকার নিকট ভিহ্মা গ্রহণ করা সহজ।
৬। স্বাস্থ্যরক্ষায় যত্নবান হওয়া অপেক্ষা স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া ঔষধ ও ডাক্তায়ের হস্তে জীবন সমর্পণ করা সহজ।
৭। স্বাস্থ্যের উন্নতি দ্বারা মুখশ্ৰীর প্রফুল্লতা ও সৌন্দর্য্য বর্দ্ধন করা (অর্থাৎ healthy & cheerful হওয়া) অপেক্ষা (শুষ্কগণ্ডে!) কালিডোর, মিল্ক অভ রোজ ও ভিনােলিয়া পাউডার (Kalydore, milk of rose ও Vinolia powder) মাখিয়া সুন্দর হইতে চেষ্টা করা সহজ।
৮। কাহারও নিকট প্রহারলাভ করিয়া তৎক্ষণাৎ বাহু বলে প্ৰতিশোধ লওয়া অপেক্ষা মানহানির মোকদ্দমা করা সহজ ইত্যাদি।
তারপর আমরা মূর্তিমান আলস্য-আমাদের গৃহিণীগণ এ বিষয়ে অগ্রণী। কেহ কেহ শ্ৰীমতীদিগকে স্বহস্তে রন্ধন করিতে অনুরোধ করিয়া থাকেন ৷ কিন্তু বলি, আমরা যদি রৌদ্রতাপ সহ্য করিতে না পারি, তবে আমাদের অর্দ্ধাঙ্গীগণ কিরূপে অগ্নির উত্তাপ সহিবেন?
আমরা কােমলাঙ্গ-তাঁহারা কোমলাঙ্গী ; আমরা পাঠক, তাঁহারা পাঠিকা ;আমরা লেখক, তাঁহারা লেখিকা। অতএব আমরা পাচক না হইলে তাঁহারা পাচিকা হইবেন কেন? সুতরাং যে লক্ষ্ণীছাড়া দিব্যাঙ্গনাদিগকে রন্ধন করিতে বলে, তাঁহার ত্রিবিধ দন্ড হওয়া উচিত। যথা তাহাকে (১) তুষানলে দগ্ধ কর, অতঃপর (২) জবেহ কর, তারপর (৩ ) ফাঁসী দাও!
আমরা সকলেই কবি আমাদের কাব্যে বীররস অপেক্ষা করুণরস বেশী। আমাদের এখানে লেখক অপেক্ষা লেখিকার সংখ্যা বেশী l তাই কবিতার স্রোতে বিনা কারণে অশ্রুপ্ৰবাহ বেশী বহিয়া থাকে। আমরা পদ্য লিখিতে বসিলে কােন্ বিষয়টা বাদ দিই ? ভগ্ন শূর্প জীর্ণ কাঁথা পুরাতন চটীজুতা কিছুই পরিত্যজ্য নহে।
আমরা আবার কত নূতন শব্দের সৃষ্টি করিয়াছি,যথা:অতি শুভ্রনীলাম্বর,সাশ্রুসজলনয়ন, ইত্যাদি। শ্রীমতীদের করুণ বিলাপ প্রলাপপূর্ণ পদ্যের অশ্রুজলের বন্যায় বঙ্গদেশ ধীরে ধীরে ডুবিয়া য৷ইতেছে ! সুতরাং দেখিতেছেন, আমরা সকলেই করি।
আর আত্মপ্ৰশংসা কত করিব? এখন উপসংহার করি।

১। নায়িকা বলিয়া আমি ব্যাকরণের নিয়মভঙ্গ করি নাই।কারণ অনেকে বাঙ্গালী পুরুষকে বেচারী বলে। উর্দু ভাষায় পুরুষকে বেচারা এবং স্ত্রীলােককে বেচারী বলে।যদি আমরা বেচারী হইতে পারি, তবে পদ্মিনী,নায়িকা এবং পুরুষিকা হইলে দোষ কি ? (পৃ:২২)
২।গত ১৩১০ সালে নিরীহ বাঙ্গালী লিখিত হইয়াছে ৷ সুখের বিষয় বর্তমান সালে আর বাঙ্গালী পুরুষিকা নহেন। এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে এমন শুভ পরিবর্তন হইবে, ইহা কে জানিত? জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ, এখন আমরা সাহসী বাঙ্গালী।

লেখার মূল উৎসঃ নিরীহ বাঙ্গালী, মতিচূরঃ প্রথম খন্ড, রোকেয়া রচনাবলী, প্রথম খন্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৬, পৃঃ ২২-২৫

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৬

চাঁদগাজী বলেছেন:


উনি বাংগালীর ইতিহাসে উজ্বল তারকা, আমাদের ইয়াবা জেনারশনের চোখ পড়েননি উনি, মনে হয়।

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:২২

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৩৮

ধ্রুবক আলো বলেছেন: বেগম রোকেয়া, উনাকে নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ, অভিনন্দন +

এই মহিয়সী নারীর কথা অনেক নারীই ঠিক মত জানেনা। চাঁদগাজী ভাইয়ের কথার সাথে একমত, ভালো বলেছেন।

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:২২

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.