নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছবি - rayhaber.com
১ম পর্বের লিংক - Click This Link
১ম পর্বের পর - কেন এত বিতর্ক ইস্তাম্বুল খাল নিয়ে
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান গত ২৬/০৬/২০২১ শনিবার উদ্বোধন করেছেন ইস্তাম্বুল খাল বা ক্যানাল ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের ব্রিজের কাজ।এই খাল নিয়ে তুরস্কের ভিতরে ও তুরস্কের বাইরেও চলছে তুমুল বিতর্ক।এখন আমরা দেখি এই খালের বিপক্ষের এবং পক্ষের যুক্তিগুলো কি বা কেন এই খাল নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা।
এই খাল খননের বিপক্ষে যারা রয়েছে তারা হলো- তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল, দ্বিতীয় বিরোধী দল, এরদোগান সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতওগ্লুর রাজনৈতিক দল, এরদোগান সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আলি বাবাজানের রাজনৈতিক দল, কুর্দি রাজনৈতিক দল, ইস্তাম্বুলের মেয়র এবং পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা। দেশের বাইরে থেকেও আছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।
আর পক্ষে আছেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান, তার সরকারের অংশীদার কট্টর জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি এবং তাকে সমর্থনকারী তার দেশের কোটি কোটি জনগণ।
ছবি - south asian news.com
প্রকল্পর পক্ষের এবং বিরোধী গ্রুপের যুক্তি গুলো হলো
১। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - এই খালের কোনো দরকার নেই। বসফরাস প্রণালি তো আছেই।
১। খালের পক্ষে যারা আছেন তাদের যুক্তি - বসফরাস প্রণালি হুমকির মুখে। বসফরাসের নিরপদ পারাপারের পরিমাণ বছরে পঁচিশ হাজার জাহাজ আর এখন এই প্রণালিটি ব্যবহার করে বছরে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার জাহাজ। এছাড়াও দৈনিক লাখ লাখ যাত্রী পার হয় এই প্রণালি দিয়ে। তাই কার্গো শিপের সঙ্গে সাধারণ যাত্রীবাহী লঞ্চের সংঘর্ষে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে এই বসফরাসের তথা ইস্তাম্বুলের।
বসফরাসে গত তিন বছরে ছোটবড় প্রায় পঞ্চাশটির মত দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে বসফরাস পার হওয়ার সময় একটি কার্গো শিপের স্টিয়ারিং সিস্টেম লক হয়ে গেলে জাহাজটি বসফরাসের তীরে ঐতিহাসিক হেকিমবাশি সালিহ এফেন্দি ম্যানশনটির সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে ম্যানশনটি ধ্বংস হয়ে যায়।এখন পর্যন্ত বসফরাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বৃহত্তম দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৯ সালে। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টা’ নামক একটি রোমানিয়ান অপরিশোধিত তেলের ট্যাঙ্কার ছিয়ানব্বই হাজার টন তেল নিয়ে একটা গ্রিক ফ্রেইটারের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সব তেল সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পরে। এক মাস ধরে জ্বলে সেই আগুন। ট্যাঙ্কারের ক্রু সদস্যদের মধ্যে ৪৩ জন মারা যায়। বসফরাস ভারী বায়ু এবং সমুদ্র দূষণ হয়। বায়ু দূষণের তীব্রতায় আকাশ কালো হয়ে থাকে মাসের পর মাস, বেশিরভাগ সামুদ্রিক প্রানি মারা যায়। পানির উপরিভাগে অপরিশোধিত তেলের আস্তর জমে যায়।দিন যত যাচ্ছে বসফরাসে এ ধরণের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরো বাড়ছে। কারণ মানুষ পারাপারের হার বাড়ছে।একারণেই সরকার দাবি করছে যে, বসফরাসের বিকল্প তৈরি করা জরুরি। কথায় যুক্তি আছে।
২। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - খাল খননের জন্য ১৫ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে।এখানে বিরোধীদের প্রশ্ন ৪৫ কিলোমিটার লম্বা, ৩০০ মিটার চওড়া এবং ২১ মিটার গভীর এই খাল খননে যে টাকা দরকার হবে তা আসবে কোত্থেকে? দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করলে কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে দেশ।
২। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি - তুরস্কের নিজস্ব অর্থায়নেই এই প্রকল্প করা সম্ভব। দেশের মধ্যে অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে যারা এই কাজ করতে আগ্রহী। আর বিদেশী বিনিয়োগ দেশে আসলে তো দেশেরই ভালো। জিম্মি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সারা দুনিয়ার সব দেশই তো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায়।
এ উত্তরেও বিরোধীরা সন্তুষ্ট না। এবার তারা সরাসরি হুমকি দিচ্ছে এই কাজের টেন্ডারে যেন কোনো কোম্পানি না আসে। তাদের সাফ কথা, কেউ যদি এই কাজের টেন্ডার নেয় তাহলে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে তাদের টেন্ডার বাতিল করে দেওয়া হবে এবং একটা টাকাও ফেরত দেয়া হবে না।এখানে বিরোধীদল ভুল করছে। প্রজেক্টের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে পারে, বিতর্কে জড়াতে পারে। কিন্তু টেন্ডারের অংশগ্রহণকারী কোম্পানিকে হুমকি দেওয়াটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারে পরে না। আর এতে এই প্রকল্পের গুনগত মানের কোনও উন্নতি হবে না বরং শুধু শুধু টেন্ডারে যে কোম্পানি ঢুকতে আগ্রহী তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে সরকারকে আরও বেশি লসে ফেলে দিবে।
৩। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - যদি এই টেন্ডার কোনও কোম্পানি পায় এবং কাজ শুরুও করে। তাহলেও এই কাজ করতে লাগবে সাত থেকে ১০ বছর। ওখান থেকে আসবে হাজার হাজার কোটি টন মাটি। এই মাটি ফেলতে ব্যবহার হবে হাজার হাজার ট্রাক। এই মাটি খনন তখন ব্যাপক বায়ু দূষণ করবে। এই বিশাল পরিমাণ মাটি তখন কোথায় ফেলবে। আর এই ট্রাকগুলো ইস্তাম্বুলের যাতায়াত ব্যবস্থাকে পুরো অচল করে দেবে।
৩। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি - বায়ু দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ট্রাকগুলো ইস্তাম্বুলের যাতায়াত ব্যবস্থাকে বাইপাস করে বিকল্প পথ ব্যবহার করবে। সেজন্য খাল খননের আগেই রাস্তাঘাট এবং ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে। আর এই বিশাল পরিমাণ মাটি এই খালের তীরবর্তী শহর গড়তে এবং কৃষ্ণ সাগরে মাটি ভরাট করে একটি পোর্ট নির্মাণ করা হবে।
৪। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - এই খাল খনন করলে মারমারা সাগরের জলজ প্রাণীগুলো হুমকির মুখে পড়বে। কারণ কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা সাগরের পানির তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক। আর পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততারও তারতম্য আছে। সুতরাং এই দুই সাগরের পানির মিশ্রণ ঘটলে ওই অঞ্চলের জলজ প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
৪। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি - এই যুক্তি ভিত্তিহীন। কারণ এই দুই সাগর তো ইতিমধ্যে বসফরাস প্রণালির মাধ্যমে যুক্ত। ইকোলজিকাল সমস্যা বা পানির তাপমাত্রার সমস্যা হলে তো অনেক আগেই মারমারা সাগরের সব প্রাণী মারা যাওয়ার কথা। যদিও এখন সামুদ্রিক শ্লেষ্মা বা মিউসিকাস এর আক্রমণে মারমারা সাগর ভয়ংকর হুমকির মুখে তবুও সরকারের কথায় যুক্তি আছে।
৫। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - এই খাল খনন করলে ইস্তাম্বুলে খাবার পানির সংকট হবে। কারণ এই খালের প্রস্তাবিত রুটের ওপর আছে অনেকগুলো জলধারা যা ইস্তাম্বুলের খাবার পানি সরবরাহ করে।
৫। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি - ইস্তাম্বুলে নিত্য ব্যবহার্য পানি সরবরাহের জন্য ১০টি জলধারা আছে। আর ওই খালের রুটের উপর পড়েছে দুটি জলধারা। একটি পুরপুরি এই খালের মধ্যে চলে যাবে আরেকটির আংশিক যাবে এই খালের মধ্যে। তাতে ইস্তাম্বুলের মোট দরকারির পানির শতকরা ৩ ভাগ নষ্ট হবে। তবে সরকার পানি সংরক্ষনের জন্য মেলেন ড্যাম নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সেটা এত বড় একটি পানি সংরক্ষণ প্রজেক্ট যে পুরো ইস্তাম্বুলের পানির চাহিদা মেটাতে এই একটি জলধারাই যথেষ্ট।
৬। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - এই খালের কারণে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। এতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য সংকট হবে দেশে।
৬। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি -৭ লাখ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে শুধু মাত্র ৩০০ মিটার প্রস্থের একটি খাল খননে খাদ্য সংকটে পড়বে কথাটা খুব যুক্তি সঙ্গত মনে হয়না।
৭। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - এই খালের কারণে ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্প ঝুঁকির পরিমাণ বাড়বে। কারণ ইস্তাম্বুল খুবই ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা; তাই এই খাল খননের কারণে ভূমিকম্প প্লেটের উপর অনেক বড় প্রভাব ফেলবে এবং অনেক বড় ভূমিকম্প নিয়ে আসবে।
৭। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি -এই খাল যে রুটে খনন করা হচ্ছে সেই রুটে কোন ভূমিকম্প প্লেট নেই। এই ব্যাপারে তুরস্কের প্রায় আড়াইশো বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং ৩৫টিরও বেশি সংস্থা একত্রে একটি রিপোর্ট বের করেছে। যে রিপোর্টেও এ ধরণের আশঙ্কাকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। আর ভূমিকম্প যে প্লেটের কারণে হয় তা থাকে ভূমির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার গভীরে। আর এই খালের গভীরতা মাত্র ২১ মিটার। অর্থাৎ এর গভীরতা একটি বিল্ডিং বা ব্রিজ করতে যতটুকু গভীরে যেতে হয় মাত্র ততটুকুই। তাই এই খাল খনন ভূমিকম্পের প্লেটে কোন ক্ষতি করবে না এবং ভূমিকম্পের প্রভাব ও বাড়াবে না।
৮। বিরোধী গ্রুপের যুক্তি - এই খাল খননের মাধ্যমে ইস্তাম্বুল এখন হয়ে যাবে একটি দ্বীপ। দুই দিকে দুই খাল মাঝখানে একটি দ্বীপ। এই দ্বীপে ভূমিকম্প বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে এই লাখ লাখ মানুষ দ্রুত কোথাও নিয়ে যাওয়াও কঠিন হবে।
৮। খালের পক্ষে বা সরকারি পক্ষের যুক্তি -ভূমিকম্পে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় অথবা খালি জায়গায় অবস্থান করে। ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে দৌড়ায় না। আর ওই দ্বীপটাই ইস্তাম্বুলের প্রাণকেন্দ্র তাই ওখানে দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
এখানে একটা বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আসলে দুই পক্ষের কথায়ই যুক্তি আছে। বিরোধীদেরকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার তারা প্রকল্পের এতগুলো খুঁটিনাটি বিষয় বের করে সরকারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন।অন্যদিকে, সরকারকেও ধন্যবাদ দেওয়া দরকার কারণ এতো বেশি লোক দিয়ে প্রকল্পের গবেষণা করিয়েছেন এবং সব বিষয় ভেবে খেঁটে খুঁটে তারপর প্রকল্পে নেমেছেন।তবে,
বিরোধীদের একটাই দোষ যে তারা টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিদেরকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। এটা বোধহয় ঠিকনা।
ছবি - ছবি - bbc.com
ইস্তাম্বুল খাল কি বিশ্ব রাজনীতির ক্রীড়ানকে বা খেলার সামগ্রীতে পরিণত হবে
শহর হিসেবে ইস্তান্বুলের ভূ-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এতটাই বেশি যে ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন একবার বলেছিলেন, "সারা বিশ্ব যদি একটি মাত্র ভূখণ্ড হতো তাহলে ইস্তান্বুল বা তৎকালীন কনস্টানটিনোপলিস হতো তার রাজধানী।"আর এই গুরুত্বের অনেকখানি তৈরি হয়েছে বসফরাস এবং দার্দানেলেস - এই দুটি প্রণালীর জন্য।সামরিক কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জলপথ এশীয় ও ইউরোপীয় তুরস্ককে পৃথক করেছে,এ গুলো হল - মার্মার সাগর, এবং বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেলেস প্রণালী। এই তিনটি জলপথ একত্রে কৃষ্ণ সাগর থেকে এজীয় সাগরে যাবার একমাত্র পথ তৈরি করেছে।
কারণ কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী সবগুলো দেশকে নৌপথে বাইরের বিশ্বের যোগাযোগ করতে হলে বসফরাস ও দার্দানেলেস ছাড়া তাদের কোন গতি নেই। তুরস্ক ছাড়াও এই দেশগুলো হচ্ছে: রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং জর্জিয়া।বসফরাস প্রণালী সামরিক এবং বাণিজ্যিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথগুলোর অন্যতম। এই প্রণালী কে, কীভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তার জন্য রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যাকে মন্ট্রো চুক্তি বলা হয়।
ছবি - bbc.com
মন্ট্রো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী - শান্তির সময় যে কোন বাণিজ্যিক জাহাজ অবাধে ওই দুটি প্রণালী ব্যবহার করতে পারবে।
যুদ্ধজাহাজের ব্যাপারে শর্তাবলীতে বলা হয়েছে - কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী নয় এমন দেশের নয়টির বেশি যুদ্ধজাহাজ একসঙ্গে এই প্রণালী দুটি পার হতে পারবে না, এবং এগুলো ২১ দিনের বেশি কৃষ্ণ সাগরে অবস্থানও করতে পারবে না।এসব জাহাজ সম্মিলিতভাবে ১৫,০০০ টনের বেশি হবে না এবং কোন একটি জাহাজ ১০,০০০ টনের চেয়ে বেশি হতে পারবে না বলে শর্তাবলীতে আরও উল্লেখ করা হয়।কিন্তু কৃষ্ণ সাগরের দেশগুলোর রণতরী তুরস্ককে জানিয়ে প্রণালী দুটি ব্যবহার করতে পারবে।এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণ সাগর এলাকায় যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনা। কিন্তু এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর মতো পশ্চিমা দেশের সামরিক জোট দারুণ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের বিমানবাহী রণতরীগুলোর ওজন ছিল অনেক বেশি।
বর্তমানে বিশ্ব রাজনৈতিক ও ভূনিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে।এখন আমেরিকা যেমন সুপার পাওয়ার হিসাবে আর এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত অন্যদেশের উপর চাপিয়ে দিতে (যদিও চেষ্টার ত্রুটি করেনা) পারেনা তেমনি স্নায়ুযুদ্ধের পর সুপার পাওয়ার হিসাবে রাশিয়াও এখন আগের অবস্থানে নেই।মন্ট্রো চুক্তির প্রধান সুবিধাভোগী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানের রাশিয়ার) কৃষ্ণ সাগরে এখন আর একক প্রভুত্ব নেই।যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো এখন কৃষ্ণ সাগর ও বলকান অঞ্চলের ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী, বিশেষভাবে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া অঞ্চল দখলের পর।আর তাই তুরস্ক এখন মনে করছে এবং চাচছে,পরিবর্তীত বিশ্ব পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে নিজের সক্ষমতা বাড়াতে তথা তা থেকে নিজের দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করতে তথা দর কষাকষিতে নিজের সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিত করতে।আর তাই এ উচ্চাভিলাসী প্রকল্প নিয়ে এরদোগানের এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর বরিস টুকাস এক নিবন্ধে লিখেছেন, রাশিয়ার জন্য "ইউক্রেন হচ্ছে সামরিক উৎস, তুরস্ক হচ্ছে চাবিকাঠি এবং তুর্কী প্রণালীগুলো হচ্ছে নিয়ন্ত্রক পথ।"রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে, ন্যাটো জোটের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য ভূমধ্যসাগরের পূব দিকে (রাশিয়ার) একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করা।" আর সেটাই তুরস্কের জন্য তৈরি করেছে একটি অনন্য সুযোগ।এরদোগান সরকার মনে করছে, পশ্চিমা কিংবা পূর্বাঞ্চলীয় - কোন পক্ষেরই তল্পিবাহক না হয়ে তুরস্ক এখন নিজের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক খেলায় একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।সে জন্যেই তারা এমন একটি বিকল্প জলপথ তৈরি করতে চায় যা মন্ট্রো চুক্তির শর্তের জালে আবদ্ধ থাকবে না।
ছবি - abcgazetesi.com
আসলেই কি হুমকির মুখে পড়বে ইস্তান্বুলের পরিবেশ
ইস্তান্বুল খাল খনন পরিকল্পনা নিয়ে তুরস্কের পরিবেশবাদীরা গোড়া থেকেই বেশ সন্দিহান ছিলেন, ছিলেন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার।আর এই সমালোচকদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত যিনি, তিনি হলেন একরাম ইমামোগলু - বিরোধীদলের হয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে পরাজিত করে যিনি এখন ইস্তান্বুলের মেয়র।তিনি বলেন,"এই সিমেন্ট প্রকল্পের কথা ভাবলে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না"।এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন , "এই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর প্রথম যে ভাবনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলবে তা হলো, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেঁচে থাকার অধিকার। অর্থের মূল্যে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে না।"
পরিবেশবিজ্ঞানীরা অভিযোগ করছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লেক দুরুসু ধ্বংস হয়ে যাবে। ইস্তান্বুলবাসীদের প্রয়োজনীয় পানীয় জলের এক পঞ্চমাংশ জোগান দেয় এই লেকটি। ধ্বংস হবে আশেপাশের জলাভূমি।এছাড়া কৃত্রিম খাল হলে ইস্তান্বুলের ভূগর্ভস্থ জলাধারে পানির উচ্চতা নেমে যাবে, এবং জলের লবণাক্ততা বেড়ে যাবে বলেও তারা মনে করছেন।
ছবি - hurriyetdailynews.com
এছাড়াও বিরোধীদলীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন যে সরকার এই প্রকল্পের ব্যাপারে মরীয়া, কারণ প্রকল্প সংক্রান্ত নানা স্বার্থের সঙ্গে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা - এমনকি এরদোগানের মেয়ের স্বামীও - জড়িত রয়েছেন।কিন্তু যতই সমালোচনা হোক না কেন, এরদোয়ান সরকারকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃশ্যত বদ্ধপরিকরই মনে হচ্ছে।সর্বশেষ এ কে পার্টির এক সভায় এরদোগান জানিয়েছেন, খুব শিগগীরই এই প্রকল্পের জন্য টেন্ডার ডাকা হবে, "কেউ (সমালোচকেরা) এটা পছন্দ করুক বা না-ই করুক।"
এই দুনিয়ার সবকিছুরই ভাল-খারাপ দুটি দিক আছে। আর প্রকতিরৃ স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে, এ প্রকল্পের ও ভাল-খারাপ দুটি দিক আমরা ভবিষ্যতে হয়ত দেখতে পাব এবং ভাল-খারাপের পরিমাণের উপর নির্ভর করে ইতিহাসে এ প্রকল্পের মূল্যায়ণ হবে । প্রকল্পের ভাল-খারাপের উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ণ হবে এরদোগানেরও ।তিনি ইতিহাসে জায়গা পেতে পারেন নব্য তুর্কী নায়ক হিসাবে অথবা হতে পারেন খলনায়ক ও। তবে এসব কিছু জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েক বছর বা যুগ।
সমাপ্ত
১১ ই জুলাই, ২০২১ দুপুর ১:৩৭
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: ধন্যবাদ সাড়ে চুয়াত্তর ভাই, আপনার মন্তব্যের জন্য।
আপনার মন্তব্য একদম সঠিক।তবে বিরোধীরা শুধু বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা করছে।বিরোধীদল ক্ষমতায় থাকলে তারাও এ প্রকল্পের ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থানই নিত।
আর একটা কথা, এ প্রকল্পের ব্যাপারে সরকার এবং বিরোধীপক্ষ উভয়েই এত গবেষনা ও যাচাই-বাছাই করেছে যে বর্তমান দুনিয়ায় কোন দেশের কোন প্রকল্প নিয়ে এত যাচাই-বাছাই-জনমত তৈরীর প্রচেষ্টা লক্ষনীয় হয়না।সেই হিসাবেও এ প্রকল্প বতর্মান সময়ে বা গুরুত্বে প্রথম শুধু তুর্কীতেই নয় তার বাইরেও।
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই জুলাই, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৯
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: আমার কাছে তো মনে হচ্ছে সরকারী দলের যুক্তিই বেশী গ্রহণযোগ্য। বিরোধী দল তো মনে হয় বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করছে। আমার ধারণা বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে এরা নিজেরাই এই প্রজেক্টে হাত দিত। বিরোধী দলের দূরদর্শিতার অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে।