| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সিদ্দীক চাচা অল্প বয়সে মারা যাওয়াতে উনার ফ্যামিলিটার পুরো দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া রাকিব চাচাকে। যদিও চাচা মারা যাওয়ার আগে মিরপুরে একটা ৪ তলা বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন তার ২কন্যা আর ঘরকুনো স্ত্রীর জন্য।
রাকিব চাচার তখন কান্নাকাটি অবস্হা । নিজের পড়াশুনা শেষ করবে নাকি বড় ভাইয়ের সংসার দেখবে ?? তাই ভাবির সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো সদ্য ১৮ বয়সে পা দেয়া বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়ে একটা শান্ত সুবোধ সৎ পাত্র নিয়ে আসলে সব কুলই রক্ষা হবে।
এমনি করেই খোজ পাওয়া গেল মিরপুর ১১ নাম্বারের বরিশাল শের-এ-বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে পাসকৃত অবিবাহিত ডাক্তারের । উনি ও খুব পছন্দ করেছেন মেয়েকে । ছেলের পক্ষ ছেকে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখছেন তার এক মামা । বিয়ের দিন-ক্ষন ও ঠিক হয়ে গেল । ২৬ জুন, ১৯৯৭ ।
সিদ্দীক চাচার ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে রাকিব চাচা আমার বাবার সাথেও বুদ্ধি পরামর্শ করে । ২৩ শে জুন বিকেল বেলায় আমাদের বাড়ির উঠানে বসে রাকিব চাচা আর আব্বা আলাপচারিত।
আব্বা : ছেলের ফ্যামিলি সম্বন্ধে ভালো ভাবে খোজ খবর নিয়েছো তো ?? বুঝইতো , বাপ মরা মেয়ে .. ভালো-মন্দের পুরো দায়িত্ব কিন্তু তোমাকেই নিতে হবে।
রাকিব চাচা :ছেলেতো দেখলাম ভালই । মেয়ের তুলনায় বয়স একটু বেশি কিন্তু বয়সি পাত্রই ভালো হবে ... মরা ভাইজানের পুরো সংসারটাতো তকেই দেখতে হবে। গাড়ি, বাড়ি নাই তাতে কি ডাক্তার ছেলে একদিন না একদিন এগুলো হবেই । ছেলেতো এম বি বি এস ডাক্তার । তাছাড়া বড় ভাইজানতো মাথা গোজার জায়গা করেই রেখে গেছেন , তো চিন্তার বেশি কিছু নাই ।
রাকিব চাচা বল্লো ঠিকই কিন্তু মনের কোনায় হয়তো কামড় একটা লাগলো । আমার দিকে তাকিয়ে বল্লো যাবি নাকি বরিশাল ???
আব্বার দিকে তাকিয়ে বল্লো ' ঘুরেই আসি বরিশাল কি বলেন ?'
আব্বা উপর নিচে মাথাটা দোলালো ।
১৫ মিনিটের নোটিশে আমরা সদরঘাটের উদ্দেশ্যে বাসা ছাড়লাম তার আগে পাত্রের মামার কাছ থেকে গ্রামের নামটা ও জোগাড় হলো । আমাদের যেতে হবে বরিশাল , ঝালকাঠি হয়ে পিরোজপুর।
সন্ধ্যার লন্চে চড়েই রাকিব চাচা কেবিন নিয়ে নিলো আর আমাকে দিলো পুর্ন স্বাধীনতা ' যা খুশি তা খেতে পারি আর যখন তখন ' ।
সারারাত নদীর হাওয়ায় আকাশের তারা গুনে সমস্ত লন্চের খাওয়া যায় এমন সব বস্তু চেখে দেখে ভোর বেলায় বরিশাল নামলাম ।
২৪ শে জুন বরিশাল মেডিকেল কলেজে আমাদের অভিযান পুপোপুরি ব্যার্থ হলো ....ডাঃ হাবিবুর রহমানের কোনো কলেজ-কুন্ডুলি উদ্ধারতো করতে পারলামই না উল্টা পিটুনি খাওয়ার ব্যবস্হা হয়েছিলো । অনেক কাহিনি করে হোটেলে ফিরে এসেছিলাম ।
পরের দিনের সিডিউল (গ্রামের বাড়ি ) ঠিক করে রাতটা হোটেলেই ঘুমালাম । ২৫ তারিখ ভোরে পিরোজপুর পাত্রের গ্রামের বাড়ির পথে নেমে যে রোড ম্যাপ পেলাম তাতে এক পুকুর পানির তৃষ্ণা পেয়ে গেলো । আমাদের যাত্রা হয়ে ছিলো বাস, টেম্পু, রিকসা অবশেষে আধা কিলোমিটার রাস্তা যা কোমর সমান কাদায় পুর্ন ।
অবশেষে ভুতের চেহারা নিয়ে গ্রামে উঠলাম এবং দেখা হয়ে গেলো এক টুপি মাথায় , পান্জাবি বগলে ছাতি ওয়ালা এক মুরুব্বির সাথে ।
ভুতের চেহারায় দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করলাম ---
স্লামালাইকুম , ' হাবিবুর রহমানের বাড়িটা কোনদিকে ??'
মুরুব্বি তার হাতের ছাতিটা উঠিয়ে একদিক দেখিয়ে দিলো ।
কিন্তু হাবিব তো বাড়িতে নাই । আপনারা কারা ????
আমি মোরশেদ উনি রাকিব, উনি হাবিব ভাইয়ের সাথে বরিশালে মেডিকেলে পড়তো (আমার কৌশুলী উত্তর)।
বরিশাল মেডিকেল??? মুরুব্বি এক মুহুর্ত যেনো কি ভাবলেন।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম 'আমি কিন্তু ডাঃ হাবিবুর রহমানের কথা বলছি '
মুরব্বির উত্তর 'হ্যা , আমি ও ডাঃ হাবিবুর রহমানের কথাই বলছি '....
হঠাৎ মুরুব্বি ব্যাস্ত হয়ে বললেন ' যাই আমার আবার কাচারিতে উকিলের সাথে দেখা করতে হবে' এই বলে উনি এক কোমর কাদায় নেমে গেলেন ।
কিছুটা হতভম্ব হয়ে সামনে এগুতেই দেখা আমাদের মতোন কাদা মেখে ভুত সাজা এক গ্রাম্য যুবকের সাথে । সম্ভবত আমাদের কথাই শুনছিলো ।
যুবক : আপনারা কি ডাক্তার সাবের বাড়িতে যাইবেন ??
আমি : হ্যা , চিনেন নাকি উনাকে ???
যুবক : চিনি , কিন্তু উনিতো বাড়িতে নাই।
আমি : (অবাক হওয়ার ভান করে ) বাড়িতে নাই ?? তাহলে কোথায় ।
যুবক : চলেন আগে বাড়িতে নিয়ে যাই , যাইতে যাইতে কইতাছি। আর যে মুরুব্বির সাথে কথা বললেন উনিতো ডাক্তার সাবের বড় ভাই , উনি কিছু বলে নাই ??
আমি : না , কিছুইতো বললো না । (এবার আমাদের সত্যিই অবাক হওয়ার পালা)
আমার মাথায় তখন ২০০ কিলোমিটার বেগের ঝড় 'আসলে কি হতে যাচ্ছে ???'
হাটতে হাটতে যুবক আবার কথা শুরু করলো ।
'২ বছর আগে সেই যে ডাক্তার সাব গ্রাম ছাড়লো আজ পর্যন্ত কোনো খবর নাই ....... এদিকে তার ছোটো মেয়েটার বয়স এখন ৩ বড় মেয়েটাও স্কুলে যায় ক্লাস টুতে পড়ে । বুঝেনইতো গ্রামগন্জের ব্যাপার কতোদিন আর এইভাবে স্বামীর অপেক্ষায় ঘরে বইসা থাকে ??'
'আমরা আসলে হাবিব ভাইয়ের নিরুদ্দেশ হবার খবরটা জানতাম না'..(আসলে বুঝতে চাইছি পরে কি হবে? )
অন্যদিকে হবু পাত্রের থলের বিড়ালগুলো দেখে তপ্ত কড়াইয়ের মতোন লাল হচ্ছে রাকিব চাচার মুখ ।
অবশেষে আমরা ডাঃ বাড়িতে পৌছালাম ।
খুবই জীর্ন-শীর্ন একটা গ্রাম্য বাড়ি । সর্বত্রই অভাবের চিহ্ন ।
'ডাঃ সাবের কি মর্জি হইলো এই ভাবে আর চলে না ' যুবক আবার বলতে শুরু করলো । 'তাই ঢাকা গেলো বেশি বেশি টাকা কামানোর জন্য । কিন্তু সেই যে গেলো আর কোনো খবরই নাই ।'
এরই মাঝে রাকিব চাচা ডাঃ সাহেবের ছোট মেয়েকে কোলে নেয়ার ছলে দুইবার শোবার ঘরে ঢুকে গেলো ।
আমি প্রশ্ন করলাম ' হাবিব ভাইয়ের ডাক্তারি প্রাকটিস কেমন ছিলো ?'
যুবক : গ্রামে ডাক্তারি কইরা আর কতো কামানো যায় । যা আয় তাই ব্যয় । পাশের বাজারেই ডাক্তারি করতো সাথে ঔষুধ ও বেঁচতো । চলেন আপনেগোরে বাজারে নিয়া যাই ।
বাজারে ঢুকতেই সবচাইতে ভাঙাচোড়া যে সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো তা দেখে রাকিব চাচা আর দাড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না ।
আলকাৎরা লেপা কাঠের উপর সাদা রঙে লেখা ডাঃ হাবিবুর রহমান (আর এম পি )
আমি শুধু রাকিব চাচার হাতটা ধরে রেখে শক্তি দিতে চাচ্ছিলাম ।
যুবককে অবাক করে দিয়ে বাজার থেকেই সোজা কাদাময় রাস্তায় নেমে পড়লাম । এরপর রিক্সা , টেম্পু বাস ঠেলে যখন বরিশাল পৌছালাম ততক্ষনে ঢাকার শেষ লন্চটা ও ছেড়ে গিয়েছে ।রাকিব চাচা ঢুকলো টেলিফোনের দোকানে , ঢাকাতে বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু বল্লো '' আমি না আসা পর্যন্ত কাবিনটা স্হগিত রাখো ''।
তারপর সেই রাতেই মাইক্রোবাস ভাড়া করে পরদিন সকাল ১১ টায় আমরা ঢাকায় পৌছি । অগ্নিভরা চোখ করে আমাকে আমার বাসার সামনে নেমে যেতে বললেন .... ইচ্ছা ছিলো শেষটা নিজের চোখে দেখার কিন্তু চাচার রক্তচক্ষু দেখে আর সাহস হলো না ।
পরে শুনেছিলাম রাকিব চাচা তার কিছু বন্ধুকে নিয়ে কাবিনের আসরেই ডাঃ (!) হাবিবকে ধোলাই করেছিলো । তারপর এলাকার মুরুব্বিদের সামণে মুচলেকা দিয়ে ডাঃ পাত্র ছাড়া পায় । তাতে লেখা ছিলো সে এম বি বি এস পাসের ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে এতোদিন প্রাকটিস করেছে, প্রতারনা করে বিয়ে করার চেষ্টা করেছে সর্বপরি সে তার সন্তানদের কাছে ফিরে যাবে ।
বাড়তি ঝামেলার হবে ভেবে আর থানা পুলিশ করা হয় নাই ।
আমি জানিনা ডাঃ হাবিব তার চরিত্র বদলাতে পেরেছিলেন কিনা ... তাও জানিনা সে তার পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন কিনা ।
কিন্তু ব্লগার বন্ধু সবার কাছে অনুরোধ থাকবে , বিয়ের আগেই ভালো ভাবে পাত্র, পাত্রীর সব কিছু স্বশরীরে জেনে নেয়া ভালো । শুধুমাত্র বাইরের চাকচিক্য দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া কখনো ঠিক হবে না । ছোট্ট একটি ভুলের জন্য হয়তো দুটো জিবনই তছনছ হবে.... ভবিষ্যতের কোনো সিদ্ধান্তই যা সমাধান করতে পারবে না ।
উৎসর্গ : বিয়ের বাজারে প্রতারিত ভাই অথবা বোনদের ... যারা প্রতারিতের দগদগে ঘা অন্তরে পুষে বেড়াচ্ছেন ।
©somewhere in net ltd.