![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ছেলেটির সাথে আমার নামের কোন মিল নেই।এমনকি আমার লিখার সাথেও নেই।আমি আমার মত।আমার লিখারা তাদের মত..
মিসির আলী একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। সকাল থেকেই শুরু হয়েছে। মিসির আলী যে ঘরটিতে বসে আছেন তার জানালা দিয়ে বেশ কিছু দূরে কিছু গাছপালা দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে লম্বা মাথা নিয়ে একটা তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে সব গাছগুলোকে ছাড়িয়ে। ঝড়ের প্রচন্ড বাতাসে সেটা বাকা হয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষন পরপর। আবার বাতাস কমতেই কিছুটা সোজা হচ্ছে। কিছুক্ষন আগে তিনি একটি টিনও উড়তে দেখেছেন এই ঝড়ের মাঝে।
এত প্রচন্ড ঝড়ের মাঝেও মিসির আলী জানালা বন্ধ করছেন না। চুপচাপ জানালার পাশে ইজি চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোয়া বুকের ভেতর নিয়ে আবার ছেড়ে দিচ্ছেন। তাকিয়ে আছেন জানালার দিকে। ঝড়টার ভয়াবহতা দেখে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। ভয়াবহতা দেখার মাঝেও এক প্রকার আনন্দ আছে। কোথাও আগুন লাগলেও সেখানে অনেক মানুষ দৌড়ে যায়। দাঁড়িয়ে থেকে সে ভয়াবহতা উপভোগের জন্যে।
মিসির আলীর রুমটায় ইজি চেয়ার মোট দুটো। একটিতে তিনি নিজে বসেছেন। অন্যটিতে বসতে দিয়েছেন হিমুকে। মিসির আলী তাকিয়ে আছেন জানালার দিকে। আর হিমু তাকিয়ে আছে মিসির আলীর দিকে। মিসির আলী কি ভাবছেন সেটি বোঝার চেষ্টা করল সে। কিছুটা অনুমান করতে পারল তাকে। তার অনুমান বেশীরভাগ সময়েই ঠিক হয়। হিমু এবার মুখ খুললো..
: স্যার, একটা সিগারেট দিন।
- সিগারেট স্বাস্থের জন্যে ভাল নয়। খেও না।
: সিগারেট খাওয়া যায়না। পান করা যায়। তাই সিগারেট খাওয়াকে মানুষ শুদ্ধ ভাষায় ধুমপান বলে থাকে।
মিসির আলী এবার হিমুর দিকে তাকালেন। হিমুর সারা শরীর কাকভেজা। কাকভেজা অবস্থাতেই সে বসেছে চেয়ারে। তার হাতে একটি বই। খুব সম্ভবত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন বই। সে বইটিও ভেজা। গায়ে আগের মতই সে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে। টকটকে হলুদ রঙ খুব একটা বোঝা যাচ্ছেনা ভিজে যাবার কারনে।
পানির একটি অদ্ভুত ব্যাপার আছে। পানি দিয়ে ফুলকে তাজা রাখা যায়। কিন্তু সেই ফুল যদি কোন কাগজে আকা যায়, সেখানে ওই একই পানি কাগজের আকা উজ্জল ফুলটিকে কেমন যেন মলিন করে দেয়।কাপড় চোপড়ের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। হিমুর পাঞ্জাবীটাও তাই কেমন যেন মলিন দেখাচ্ছে।
নতুন একটা সিগারেট ধরালেন মিসির আলী। লম্বা একটা টান দিয়েই জানালার দিকে তাকালেন আবার। এইমাত্র একটি বড় আমগাছের বেশ বড় আকারের একটা ডাল ভেঙ্গে পড়ল ঝড়ের চোটে। সেটি দেখে তিনি কিছুটা ভ্রু কুচকালেন। ঝড়ের মাঝে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ার মত দৃশ্যে সাধারন মানুষেরা ভ্রু কুচকায়না। তবে অসাধারনরা হয়তোবা কুচকান। সামান্য জিনিসেই তারা বিরাট বড় কিছু ভাবতে চেষ্টা করেন। মিসির আলীও করছেন। তিনিও একজন অসাধারন মানুষ। ব্যাপারটি হিমুও লক্ষ্য করছিলো।
ভ্রু কুচকানো অবস্থাতেই মিসির আলী এবার সিগারেটটা এসট্রের উপড় রাখলেন। এবার হিমুর দিকে তাকালেন তিনি।
: কেমন আছ হিমু?
- ভাল।
: এসেছ কেন?
- এমনি।
: এমনি এমনি কেউ কখনো কোথাও যায়না, আসেও না। আর আমার কাছে কারন ছাড়া আসার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারনটা বল।
- কোন কারন নেই। এমনিই এসেছি। হিমুদের আসতে কোন কারন লাগেনা।
মিসির আলী আরেকটি সিগারেট ধরালেন। এবার তার ভ্রু কুচকানোর মাত্রাটা কিছুটা বাড়লো। তীক্ষ দৃষ্টিতে তিনি আবার তাকালেন হিমুর দিকে।
: তুমি খুব মানুসিক অশান্তিতে ভুগছো। আমি কি ঠিক বললাম?
- জানিনা।
: না জানারই কথা। যুক্তি তাই বলে। কারন ছাড়া মানুষ এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় তখনই যখন তার subconscious mind অস্থির থাকে। conscious mind সেটি ধরতে পারেনা। তুমিও পারছো না ।
- আপনার ঘরে কি টেলিফোন আছে?
: আছে। কিন্তু কেন?
- রুপাকে একটা ফোন করব।
: আচ্ছা। করো ফোন।
মিসির আলী হিমুকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। বেশ গোছানো ঘর। একটি সিঙ্গেল বেডের পাশে একটি ছোট্ট টুলের মত টেবিল। তার উপড়ে টেলিফোনটা রাখা। একটি ছোট্ট বুকশেলফও আছে ঘরটিতে। সব মিলিয়ে ছিমছাম ঘর। হিমু টেলিফোনটা হাতে নেয়ার আগেই হঠাত সেটি বেজে উঠলো। যদিও এটা মিসির আলীর কোন ফোন হতে পারে, তবু হিমু ফোনের রিসিভারটি তুলে কানে ধরল।
- হ্যালো
: আপনি এখন মিসির আলীর বাসায় তাইনা? (মেয়েকন্ঠ)
- হ্যা।
: বলেন তো কি করে জানলাম? (অনেক হাসিখুশি তার কন্ঠস্বর)
- জানিনা
: আপনি কি জানেন তাহলে?
- অনুমান হচ্ছিলো তুমি এ মূহুর্তে ফোন দিতে পারো। এটা জানতাম বোধহয়।
: আপনি শুধু এটুকুই জানেন। কিন্তু আমি অনেক কিছু জানি। আপনি এখন পুরো ঝড়ে ভিজে এসেছেন মিসির আলী সাহেবের বাসায়। তাইনা?
- হুম।
: আমিও আজকে প্রচন্ড ভিজেছি। এখনও ভিজছি। ভেজার মাঝে ভাবলাম আপনাকে একটি ফোন দেই। খুব আনন্দ হচ্ছে আমার! আপনার ভাল লাগছে না?
- বৃষ্টিতে ভেজা আর বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া দুটো আলাদা জিনিস। বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ায় আনন্দ আছে। কিন্তু ভিজে যাওয়ায় আনন্দ নেই। আমি আজ ভিজে গিয়েছি।
: কিন্তু আমার আজকে ভিজতে যাওয়াটা একটু আলাদা।
- আলাদা কেন?
: আমি নীল শাড়ী পড়ে বৃষ্টিতে ভিজছি তাই ।
হিমু কিছুক্ষন চুপ হয়ে রইলো। রুপা একটু পর সে নিরবতা ভাংলো। এবারে তার কন্ঠটা আর আগের মত হাসিখুশি মতন শোনালোনা। অনেকটা শীতল আর মিনতিমাখা কন্ঠের মতন শোনালো।
: আজকে আমাদের ছাদে আসবেন? একসাথে ভিজি?
- না।
রুপার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এবার তার কন্ঠে মিনতির ভারটা আরো জোড়ালো হল।
: আপনার জন্যে একটা পাঞ্জাবী এনেছি। আব্বুকে অনেক বলে কিনিয়েছি। এবারের ঈদে আপনাকে গিফট করব। আব্বু একেবারেই কিনে দিতে চায়নি প্রথম।জেদ করে তিন চারদিন না খেয়ে যখন আমার অবস্থা খারাপের দিকে, তখন আব্বু এই পাঞ্জাবীটা নিয়ে এসেছেন।
- কাজটা ভাল করনি।
: আসবেন না আপনি আজ?
- না।
: একটা ছবি একেছি আজ। রঙ পেন্সিল ছিলোনা বাসায়।নরমাল পেন্সিল দিয়ে আকিয়েছি কিছুটা। পুরোপুরি আপনার মত হয়নি যদিও। তবু আপনাকে দেখানোর খুব ইচ্ছা আমার।
- এগুলো কেন করছ রুপা?
: এমনি।
- মানুষ কোন কারন ছাড়া কিছু কখনো করে না। কারন ছাড়া মানুষ কিছু করে তখনই যখন তার subconscious mind অস্থির থাকে। conscious mind সেটি ধরতে পারেনা। তুমিও পারছো না ।
: এত কঠিন কঠিন কথা আজকে মিসির আলী স্যার আপনাকে শিখিয়েছে তাই না?
- হুম।
: আমি এতো কঠিন কথা বুঝিনা। আমি কেন এগুলো করি তাও বুঝিনা। আমার বোঝার দরকারও নেই। আপনি আসবেন কিনা বলুন।
- আমি আসতে আসতে ঝড় থেমে যাবে রুপা। আজ ভেজা হবে না আর।
রুপা এবার ফোন রেখে দিলো। হিমু লোকটার প্রতি সে প্রচন্ড বিরক্ত। মেয়েরা সবকিছুই সহ্য করতে পারে, কিন্তু অবজ্ঞাটা সহ্য করতে পারেনা। এটা তাদের অনেক বড় একটি আত্মসম্মানের জায়গা। রুপার কাছে খুব অপমানিত মনে হচ্ছে নিজেকে। সে ছাদে গিয়ে কাদছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাদছে। বৃষ্টির মাঝে কান্না করার একটি সুবিধা রয়েছে। চোখের পানিটুকু বৃষ্টির পানির সাথে মিলিয়ে যায়। কাদছে কি না কাদছে সেটি বোঝা যায় না খুব একটা।
হিমুও বেড়িয়ে এসেছে মিসির আলীর বাসা থেকে। আবারো তার শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজতে শুরু করেছে।কিছুটা অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করছে তার।কারন এবারে সে ভিজে যাচ্ছে না, সে ভিজতে এসেছে।
মিসির আলী আরেকটি সিগারেট ধরালেন। ধোয়ার মাঝে দেখা ঝাপসা জানালার মধ্য দিয়ে হিমুর চলে যাওয়া দেখছেন তিনি.. হয়তোবা আবারো কোন একদিন আসবে সে।আসার কারন জিজ্ঞেস করলে হয়তো সেদিনও সে বলবে "এমনি এসেছি" .......
©somewhere in net ltd.