![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ম্যানচেস্টারের এক উজ্জ্বল সকাল। আলো ঝলমল করছে নীল আকাশ। আলো ঝলমল আকাশটা গাড়ির গ্লাস দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে শীতকাল ছিল। তার ছাপটা এখনও রয়ে গিয়েছে। চিরহরিৎ ওক গাছের পাতাগুলো কেমন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এখন সবুজ পাতায় পাতায় গাছটাকে কেমন শিল্পীর আঁকা ছবির মত মনে হয়। রাস্তার মাঝে মাঝে ২/১ টি কাঠের দোতলা বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়িগুলো দেখতে যেমন সুন্দর খরচটাও কম। মাঝে মাঝে সরকার থেকে যাদের আয় তুলনামূলক কম তাদের জন্য এই বাড়ি করে দেয়া হয়। একটু কৌশলী হলে আর প্যালেট বসানোর নিয়ম জানলে নিজেও বানান সম্ভব। পদ্ধতিটা বেশ মজার। মোটামুটি জ্যামিতিক নিয়ম মেনে প্যালেট বসাতে পারলেই কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কাঠের বাড়িগুলোর কথা মনে পড়তেই নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল দেবলিনার।দেবলিনা বিশ্বাস। সংক্ষেপে দেবু, বয়স ৫৫, যদিও বয়স দেখে বোঝা যায় না। ৩০/৩২ এর মত মনে হয়। তাদের গ্রামের বাড়িতে বড় বড় ঘরগুলোর মাথায় শালকাঠ ছিল। সে ছোটবেলায় অবাক হয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবত এত উপরে এই কাঠ গুলো কিভাবে ঝুলে আছে!! এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলত তার। নাহ স্মৃতিটাকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। বাইরের শক্ত খোলসটা ভেঙে মাঝে মাঝেই ভেতরের ভঙ্গুর, শীতের পাতার মত বিবর্ণ, মনের ভেতর ক্ষয়ে যাওয়া এক দেবলিনা বেড়িয়ে পড়ে। ম্যানচেস্টার শহরে নিজের ফ্ল্যাট, ভাল প্রফেশনাল জব থাকা সত্ত্বেও যে দেবলিনা একা, নিঃস্ব, রিক্ত আর অসহায়।
দেবলিনার বাড়ি বাংলাদেশে। খুলনার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। চার ভাইবোনের মধ্যে দেবলিনাই ছোট ছিল। সবার আদুরে আর মধ্যমণি। বড় ভাই আর তার পরে তিন বোন। বড়রা তেমনভাবে লেখাপড়া কেউ করেনি। তাই বাবার ইচ্ছা ছিল দেবলিনা অন্ততপক্ষে যেন অনার্সটা পাশ করে। কত বড় বাড়ির কর্তা তিনি। কিন্তু তার ছেলেমেয়ে কেউ তেমনভাবে পড়াশোনা করলনা, ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। সেই দেবলিনা হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যাবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। দেবলিনার এক বন্ধু, অমিত, ঢাকায় কোচিং করতে গিয়েছিল।ওই দেবলিনার ভর্তি ফরম পূরণ করেছিল আর বলেছিল তুই এসে পরীক্ষাটা দিস, দেখিস তোর হয়ে যাবে। কোন প্রস্তুতি ছিল না। কেবলমাত্র ঢাকা দেখার বায়না করে একপ্রকার জোর করেই বাবার সাথে এসে পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষা দিয়ে লালবাগ, আহসান মঞ্জিল ঘুরে পরদিনই বাড়িতে। না গিয়ে উপায় ছিল না। ওইগুলো দেখা তখন আকাশ ছোঁয়ার মত ছিল। পরীক্ষার ফল ও আর দেখেনি। ধরেই নিয়েছিল হবে না। নিত্যদিনের মত কাজকর্ম চলছিল। অমিতই বাবার ফোনে ফোন দিয়ে বলেছিল দেবু তোর হয়ে গিয়েছেরে। আর তোর? এই কথাটা জিজ্ঞেস করার পর অমিত বলেছিল সবার কি সব হয় রে? বলেই রেখে দিয়েছিল।
তারপর দোটানা, টানা হেঁচড়ার পর কি করে ভর্তি হয়েছিল সে অনেক কাহিনী। ভাগ্যের কি পরিহাস! যার কোন চিন্তাভাবনাতেই ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, সেই হয়ে গেল, আর যার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল সে হারিয়ে গেল। অথচ তার ঘাড়ে ভর দিয়েই দেবু চলে এলো এখানে। টিএসসি, কলাভবন, রাজু ভাস্কর্য কাঁপিয়ে বেড়ানো মেয়েটি আজকে বয়সের ভারে অনেকটাই ক্লান্ত।
দ্বিতীয় বর্ষেই অর্কের সাথে পরিচয়। তারপর শুরু হয়ে গেল তুমুল প্রেম। সব জায়গাতেই তাদের একসাথে দেখা যেত। দেবলিনার দুই বছরের বড় ছিল অর্ক। কিছু বিষয়ে মিল আবার অমিল। তুমুল তর্ক করত দুজনে। কিভাবে তাদের সম্পর্কটা বাড়িতে জেনে গেল। মা বাবা কোনভাবেই মেনে নিতে চাইনি। মেনে নেয়নি। অনেকভাবে বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। পারেনি। প্রেম জিনিসটা তাদের পরিবারে ছিল নিষিদ্ধ। এভাবে বাবা, মা, ভাই, বোনের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে লাগলো।
দেবলিনা তখন চতুর্থ বর্ষে। অর্ক বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড চলে আসে। এরপর দেবলিনার মাথায় চাপে সেও বৃত্তি নিয়ে বাইরে যাবে। অনেক কথা শুনতে হয়েছে তখন। মেয়ে খারাপ হয়ে গিয়েছে। কোথায় কোথায় যায় কে জানে। এরকম আরও অনেক অনেক কিছু। কিন্তু সে হার মানেনি। কানেই তুলেনি কিছু। মাস্টার্স শেষ হয়ে বৃত্তি হয়ে যাবার পরে বলেছিল বাড়িতে। আমি যাচ্ছি। আগামী মাসে ফ্লাইট। অর্কর সাহায্য ছিল অবশ্য অনেক। একা একা সে কখনোই এত কিছু করে উঠতে পারত না। মজার বিষয় হচ্ছে যারা আগে তার মা বাবার কানে বিষ ঢেলেছিল এবার তারাই মাথায় করে নেচেছিল।
এখানে এসে এক বছরের মাথায়ই বিয়েটা সেরে নেয় দুজনে। পড়াশোনা আর সংসার দুইই চলছিল সমানতালে। দুই বছরের মাথায় অর্ঘ্য। কি ব্যস্ত দিন ছিল তখন! ভাবলেই বুকটা হাহাকার করে উঠে। গাড়িতে এখন পুরনো সেই দিনের কথা গানটি বাজছে। সব কিছু কি সত্যি খুব বেশি পুরনো? এই সেদিনের মনে হচ্ছে। সত্যি সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায়। বাবা মার সাথে যোগাযোগটা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন বাবা-মা চলে গেল এক এক করে। বাবার মৃত্যুর সময় যেতে পর্যন্ত পারেনি দেশে। অর্কর সাথে তার রসায়নটা ভালোই ছিল সবসময়। ঝগড়া, খুনসুটি সবসময় চলত তাদের। ৫ বছর আগের এমনই এক রোদ্রজ্জল দিন। খুব ভাল করে দিনটা মনে আছে। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলনা। পার্কে হাঁটতে বেরিয়েছিল সেদিন দুজনে। হটাৎই অর্ক বুক ধরে বসে পড়লো। বলল খুব ব্যাথা করছেরে দেবু। এর পর কিছু বুঝতে না বুঝতেই সব শেষ। গাছের পাতা কি কেঁপেছিল? মনে হয় না। শুধু কেঁপে গিয়েছিল দেবুর বুকের ভেতর। ছেলের সামনে একফোঁটা চোখের জল পর্যন্ত ফেলেনি দেবু। ছোট থেকেই অনেক শক্ত এই সুনামটা রাখতে হবে কিনা তাই। শাঁখা সিন্দুরের ওপর খুব বেশি ভরসা তার কোনদিনই ছিলনা। কিন্তু সেদিন চিরজীবনের মত ছাড়তে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
এরপর কবে কিভাবে অর্ঘ্যও বড় হয়ে গেল। কাজের জন্য চলে গেল নিয়ইয়র্ক । ছয় সাত দিন পর পর একদিন কথা হয়। অনেক ব্যস্ত থাকে তো তাই মাকে ফোন দেবার সময় পায়না। এখন সঙ্গী বলতে একটা কুকুর। আর দেবু নিজেই নিজে তার সঙ্গী। ওহ, ম্যানচেস্টার শহরের মধ্যে এসে গিয়েছে। আর একটু পরেই বাসায় পৌঁছে যাবে। শুরু হবে একা থাকার লড়াই। নিরালায় বসে একটু স্মৃতি হাতড়ানোর সময়ও আর থাকবে না।
০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:৩৪
বর্ণা বলেছেন: ধন্যবাদ রইলো
২| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:২৮
বাকপ্রবাস বলেছেন: সুন্দর। খুুব ভাল লেখা।
০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:৩৬
বর্ণা বলেছেন: ধন্যবাদ বাকপ্রবাস ভাই
©somewhere in net ltd.
১|
৩১ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪০
ঋতো আহমেদ বলেছেন: প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য লিখা লিখেছেন। সুন্দর ভাষায় সাবলীল প্রকাশ। ভালো লাগলো