নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ক্যপ্রিসিয়াস

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তাই স্বপ্ন দেখি বড় কিছু করার। অন্যের উপকার করতে ভাল লাগে তা যত নুন্যতমই হোক না কেন ।\n\nভাল লাগে বিধাতার গড়া অপরুপ সৌন্দর্যের মাঝে ঘুরে বেড়াতে।\n\nফেসবুকে এই আমি https://www.facebook.com/capricious.based

ক্যপ্রিসিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবন থেকে নেয়া- ৯ ( এক হাতেই ছক্কা! )

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:১৭





উত্তেজনায় ভরা ক্রিকেট ম্যাচ। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। মাঠের পিচে থাকা দলের কাপ্তানের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। আর বেশি সময় নেই। বাকি আছে ১০ বল। এর মধ্যে তুলতে হবে ১৪ রান। বোলারের একটি ফুলটস পেয়ে সজোরে ব্যাট চালাল কাপ্তান। ওভার বাউন্ডারি হয়ে বল চলে গেল সীমানার বাইরে। এভাবে শেষ ছয় বলে ১০ রান আর সঙ্গীর চার রানে জিতল দল। ম্যাচ শেষে জয়ের নায়ক ক্যাপ্টেনকে ঘিরে সতীর্থদের সে কী উচ্ছ্বাস। ভাবছেন, বাংলাদেশ দলের কোনো খেলার দৃশ্য? আর ক্যাপ্টেন মুশফিকুর রহিম? আদতে তা নয়। দলটি চট্টগ্রামের পশ্চিম মাদারবাড়ীর কামালগেট জুনিয়র বয়েজ। আর ক্যাপ্টেন ১৬ বছরের কিশোর মোহাম্মদ শরীফ। ১১ অক্টোবর কলেজিয়েট স্কুল মাঠে বসেছিল সীমিত ওভার (৮ ওভার) ক্রিকেটের এই আসর। প্রতি শুক্রবার কোনো না কোনো দলের সঙ্গে খেলা হয় তাদের। অবশ্য সব সময় বিজয়ের হাসি হাসে না শরীফের দল। মাঝে মাঝে ফিরতে হয় আক্ষেপ নিয়েই। চিন্তা থাকে পরের সপ্তাহে শুধরে নেওয়ার। কিন্তু কেন এই ক্রিকেটের আসর কিংবা ক্যাপ্টেন শরীফের কথা?

পাঠক, এই কিশোর অন্যদের চেয়ে আলাদা। ছয় বছর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই পা আর এক হাত হারিয়েছে। এর পরও সে দমে যায়নি। বিন্দুমাত্র কমেনি ক্রিকেটের প্রতি তার অমোঘ টান। এই এক হাতেই সব করে সে। বুঝিয়ে দিয়েছে, মনের জোর থাকলে সব সম্ভব। ব্যাটিং, বোলিং ও চমৎকার ফিল্ডিংয়ের জন্য তার অলরাউন্ডার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে। দলের অধিনায়ক হওয়ার পেছনেও কাজ করেছে তার ক্রীড়া নৈপুণ্য। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয়, প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ও সমীহের চোখে দেখে এই কিশোরকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেছে তার দল। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুটি টুর্নামেন্টে। দুটি টুর্নামেন্টেরই ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছে শরীফ।

শরীফ বলে, ‘দলের সবাই ভালো খেলে। আমার চেষ্টা থাকে যেন সবার ভালো খেলাটা দিয়েই দল জেতে।’ একেবারে পেশাদার ক্রিকেটারের মতো কথা! শরীফের খেলা দেখে আমাদেরও বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এও সম্ভব! শরীফ আমাদের শোনাল আরও অনেক কিছু। বলল, ‘আমার বাসা কাছেই। চলেন, বাসায় গিয়ে বসি।’ তার পিছু নিলাম। এক গলি পেরিয়েই চারতলা ভবনের দোতলায় ভাড়ার দুই কক্ষের ছোট্ট বাসা। দোতলার বাসায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল কারও সাহায্য ছাড়াই। বসার ঘরে আমাদের ঘিরে ধরল পরিবারের অন্য সদস্যরা। ছোট্ট ঘরটার শোকেসে সাজানো বিভিন্ন ট্রফি আর মেডেল। বিজয়ের স্মারকে যেন জ্বলজ্বল করছে শরীফের হাসিমাখা মুখ।

কীভাবে কী হলো? শরীফের পাশে বসা মা বেবী খাতুন খুললেন স্মৃতির ঝাঁপি। শুরুতেই কথা হারিয়ে ফেললেন। চোখ বেয়ে টপ টপ করে নামছে পানি। বুকে চেপে থাকা কষ্টের পাথরে যেন ঘষা লাগল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শুরু করলেন। পাশে শরীফের মুখে তখনো মুচকি হাসি লেগে আছে। কিন্তু এই হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা দুঃখ চোখে পড়ে স্পষ্ট।



Untitled-9একটি ঘুড়ির জন্য...

২০০৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। শরীফ তখন সবে ১০-এ পা দিয়েছে। পড়ত মাদারবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে। ঘরের পাশের ভবনের চারতলার ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল এক বন্ধুর সঙ্গে। আশপাশের আরও কিছু ভবনে অন্যরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। কাটাকাটি চলছিল শরীফের সঙ্গে। একসময় শরীফের ঘুড়ি কাটা পড়ে আটকে যায় পাশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে। এত কিছু না ভেবে ঘুড়ি তুলে আনতে গেল সে। কিন্তু জানত না সেখানেই ওত পেতে আছে জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ। যেই তারে ঝুলে থাকা ঘুড়িতে হাত দিল, অমনি বিকট শব্দে আছড়ে পড়ল শরীফ। পড়েই অচেতন। নিথর দেহ। বন্ধু দ্রুত বাড়িতে খবর দিলে মা-বাবা এসে দেখেন কোনো নড়চড় নেই তার। সবাই বলল, মারা গেছে। কোনো কথায় কান না দিয়ে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন বাবা মোহাম্মদ আলম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করালে আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে তার। কিন্তু গুরুতর আঘাতের ব্যথায় কুঁকড়ে যায় ছোট্ট শরীরটা। পুড়ে যায় শরীরের বেশির ভাগ অংশ। এভাবে কাটে কয়েক দিন। অবস্থার কোনো উন্নতি না দেখে ছেলেকে বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করান আলম। কিন্তু চিকিৎসার খরচ জোগাতে অথই সাগরে পড়লেন। কারণ, আয় বলতে কেবল সবজি বিক্রির টাকা। নিজের জমাজাতি, স্ত্রীর গয়না যা ছিল, ছেলের জন্য উজাড় করে দিলেন সব। তার পরও কুলোয় না। হাত পাতলেন মাদারবাড়ীর স্থানীয় লোকজনের কাছেও। পাশে দাঁড়ালেন তাঁরা। সবার সাহায্যে চলতে থাকল চিকিৎসা। বিপত্তিটা বাধল মূল চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর। কারণ, তত দিনে হাত-পায়ের পুড়ে যাওয়া অংশে পচন ধরেছে। চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করে পচন ধরা অংশ বাদ দিলে আবার নতুন করে পচন শুরু হয়। এভাবে অস্ত্রোপচার হয় ছয়বার। শেষে দুই পায়ের হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ও ডান হাতের পুরোটাই কেটে বাদ দিতে হলো। হাসপাতালে থাকতে হয়েছে টানা আড়াই মাস। এখন আছে শুধু বাঁ হাতটা। এই এক হাতই শরীফের সম্বল।



Untitled-10বন্ধুরা দিল নতুন জীবন

ক্রিকেটের প্রতি শরীফের টানটা ছোটবেলা থেকেই। সারাক্ষণ ব্যাট-বল নিয়ে পড়ে থাকত। খেলনা বলতেও ওই দুটোই। ডানপিটে স্বভাবের জন্য বেশ খ্যাতি ছিল দুরন্ত শরীফের। মাঝে মাঝে ঘরের মেঝেকে পিচ বানিয়ে শুরু করে দিত খেলা। ছেলের এমন দুরন্তপনায় আশকারা দিতেন বেবী খাতুন। তবে শঙ্কা ছিল, কখন কী করে বসে। শেষে সেই শঙ্কাই জীবনের রং ফিকে করে দিল মায়ের। এখন সারাক্ষণ চিন্তা ছেলেকে নিয়ে। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে শরীফ মেজো।

দুর্ঘটনার পর খেলা বন্ধ হয়ে গেল। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাটত শরীফের। তবে এত কিছুর মধ্যে ক্রিকেট ছাড়েনি সে। টেলিভিশনে খেলা দেখত নিয়মিত। এভাবে পাঁচ-ছয় মাস কেটে যাওয়ার পর একদিন বন্ধুরা এসে তাকে মাঠে নিয়ে গেল। আবার ব্যাট হাতে নিল শরীফ। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে যেন জোর চলে এল। সেদিনের কাহিনি শুনুন শরীফের মুখেই: ‘ভেবেছিলাম পঙ্গুজীবন নিয়ে আর কী-ই বা করতে পারব। কিন্তু আমার বন্ধুরা সেই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। তারা আমাকে মাঠে ফিরিয়েছে। ব্যাট হাতে নিয়ে আমি নতুন জীবন পেয়েছি। প্রথম দিকে খেললে ব্যথা লাগত। কয়েক দিন পর সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমিও দলে ফিট হয়ে গেলাম। এখন ব্যাটিং, ফিল্ডিং ও বোলিং সব করি। শুধু ব্যাটিংয়ের সময় রানার লাগে। এ ছাড়া চলাফেরার সময়ও কারও সাহায্য লাগে না। বাবাকেও তাঁর কাজে সাহায্য করি।’



Untitled-11অলরাউন্ডার শরীফ

বাংলাদেশের কোনো ম্যাচ মানে শরীফের নাওয়া-খাওয়া বাদ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ আটকে থাকে টেলিভিশনের পর্দায়। দুর্ঘটনার আগে ও পরে এই এক জায়গায় শরীফের কোনো পরিবর্তন নেই। সাকিব আল হাসান তার প্রিয় তারকা। সাকিবের মতো অলরাউন্ডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেই ক্রিকেটের সঙ্গে বসতি গড়েছে। তবে ব্যাটিংয়ে আদর্শ তামিম ইকবাল। আর ফিল্ডিংটা নাসির হোসেনের মতো করতে চায়। এই তিনে মিলে পাড়ায়ও শরীফের খ্যাতি এখন অলরাউন্ডার হিসেবে। পা না থাকার দুঃখটা প্রায় সময় পোড়ায় শরীফকে। ‘দুই পা আর হাতটা থাকলে মনে হয় আরও ভালো করতে পারতাম। হয়তো একদিন জাতীয় দলেও জায়গা হতো। তার পরও আমি অনুশীলন করে স্থানীয় টুর্নামেন্টে নিয়মিত খেলব।’ বলল শরীফ।

এদিকে শরীফের পাশে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড (সিআরপি)। সংস্থাটির চট্টগ্রাম কার্যালয়ের একটি দল ইতিমধ্যে শরীফের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা কৃত্রিম পা ও হাত লাগিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কৃত্রিম পা আর হাত হলে আরও ভালো করে ক্রিকেট খেলবে বলে আশা শরীফেরও।

Untitled-13সিআরপির চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বিভাগীয় সমন্বয়ক সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘শরীফের শরীরের যে অবস্থা তাতে কৃত্রিম হাত ও পা লাগানো সম্ভব। এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও এক মাসের বেশি। এরপর সে কৃত্রিম অঙ্গের সাহায্যে হাঁটাচলা করতে পারবে। আমরা তাকে আমাদের প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলেও অন্তর্ভুক্ত করে নেব, যদি সে খেলতে চায়। এ ছাড়া সে যাতে স্বাবলম্বী হয়ে চলতে পারে, সে জন্য একটি দোকান করে দেওয়া হবে।’

তবে এখন খেলার পাশাপাশি লেখাপড়াও আবার শুরু করতে চায় শরীফ। আগামী জানুয়ারি থেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে সে। জীবনের ময়দানেও প্রকৃত অলরাউন্ডার হয়েই বাঁচতে চায় শরীফ।



লেখাটি প্রথম আলো থেকে নেয়া ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.