![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ যারা ভীষণ রহস্যময়। স্বয়ং শার্লক হোমস বা ফেলুদার পক্ষেও তাদের চরিত্রের রহস্য ভেদ করা কঠিন। চেহারা, আচরণ, বেশভূষা, লেখাপড়া, পাণ্ডিত্য দেখে তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত মন্তব্য করা যায় না-সে শয়তান না ভগবান। মাঝে মাঝে কথা শুনে আচরণ দেখে মনে হয়, তিনি স্বয়ং ভগবান। আবার একই ব্যক্তির কিছু কিছু আচরণ দেখলে ও উক্তি শুনলে মনে হয়, এ বুঝি শয়তানেরও বড় ভাই!
এসব রহস্যময় চরিত্রগুলো আমাদের সমাজের জন্য কতটা কল্যাণকর অথবা ক্ষতিকর, সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এই চরিত্রগুলো দুর্লভ। এ ধরনের বিশেষ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান। প্রতিভা আর যোগ্যতা ছাড়া কেউই ‘দুর্জ্ঞেয় বা ‘রহস্যময় হতে পারে না। যিনি একই সঙ্গে ‘দুর্জ্ঞেয় ‘রহস্যময় ‘শয়তান’ও ‘ভগবান এই বিচিত্ররূপে বিরাজমান, এমন যোগ্যতা স্বয়ং ভগবান ছাড়া আর কার আছে?
আমাদের চারদিকের চরিত্রগুলো বেশিরবাগই সহজ-সরল। হয় সাদা, নয়তো কালো। চোর না হলে সাধু। মুক্তিযোদ্ধা না হলে রাজাকার। এনজিওর পক্ষে, অথবা বিরুদ্ধে। ভাববাদী অথবা বস্তুবাদী। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী অথবা অবিশ্বাসী। মোল্লাতন্ত্রের পক্ষে অথবা বিরুদ্ধে। প্রতিক্রিয়াশীল অথবা প্রগতিপন্থী। ডান অথবা বাম। খচ্চর অথবা ঘোড়া। হাঁস অথবা সজারু। কিন্তু আমাদের চেনা জগতে এক ‘দুর্জ্ঞেয় চরিত্র সুকুমার রায়ের সেই ‘হাঁসজারু’হয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত চমৎকৃত করছেন। তিনি প্রগতির পক্ষেও কথা বলেন আবার প্রতিক্রিয়ার পক্ষেও ভূমিকা পালন করেন। যিনি মার্কসীয় দর্শনে আস্থাশীল হয়েও মোল্লাতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দেন। যিনি এনজিওর মালিক হয়েও এনজিও ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা পালন করেন। যিনি সব সময় স্টাবলিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলেন, আবার বেগম খালেদা জিয়ার (প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে) সফরসঙ্গী হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেন। অনেক বামপন্থী এখনও তাকে গুরু মানেন। একইসঙ্গে তিনি রাজাকারপন্থীদেরও তাত্ত্বিক গুরু। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সব পাতেই পরিবেশনযোগ্য এক অসাধারণ পাচন। তবে এই মহাপ্রতিভাবান বিরল ব্যক্তিটি জীবনের শেষভাগে এসে নিজের দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যময় চরিত্রটি আর ধরে রাখতে পারছেন না। মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার প্রশ্নে তিনি বিএনপিওয়ালাদের মতই শেষপর্যন্ত স্পষ্টভাবে রাজাকারপন্থী হয়ে গেছেন। রাজাকারদের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। রাজাকারদের ভাষায় কথা বলছেন। রাজাকাররা বর্তমানে যে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তার পক্ষে তিনি যাবতীয় জ্ঞান ও যুক্তি ঝেড়ে দিচ্ছেন। যাকে নিয়ে এত কথা, এত আলোচনা, এই মহামহিম পুরুষোত্তম ব্যক্তিটি হচ্ছেন, ফরহাদ মজহার। কবি, কলামিস্ট, এনজিও-মালিক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, গবেষক, গদ্যকার, ভাবশিল্পী, সমাজকর্মী, আধ্যাত্মবাদী, যুক্তিবাদী, কী নন তিনি? এমন বহুমাত্রিক প্রতিভা কলিকালে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। এই মহামানব, মহান দার্শনিক সম্প্রতি জঙ্গি-সন্ত্রাসী-জামায়াত-শিবিরের পক্ষে এবং গণজাগরণ মঞ্চ ও সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার বয়ান দিয়ে চলেছেন। তার বয়ান শুনলে মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল জিনিস হচ্ছে জামায়াত শিবির, আর সবচেয়ে খারাপ জিনিস হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ (এখানে বলে রাখা ভাল যে, আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমার কোনো মোহ নাই। তবে এই দলকে আমি বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে ভাল বলে মানি। প্রত্যাশার বেশিরভাগটা পূরণ করতে না পারলেও এই দলটি এখনও দশ ট্রাক অস্ত্র, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জঙ্গিকানেকশান, হত্যা-ক্যুসহ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেছে বলে আমার জানা নেই, সেই অর্থে অধিকতর গণতান্ত্রিক দল, মন্দের ভাল)।
যাহোক, আসলে আসলে প্রবৃত্তি বা স্বরূপকে কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায় না। একদিন না একদিন তা প্রকাশিত হবেই। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে রামকৃষ্ণপরমহংসদেবের একটি গল্প। একটি ছাগলের পালে দলছুট এক শূকরী ঢুকে পরেছিল। শূকরীটি ছিল গাভীন। ঘটনাচক্রে সেই শূকরীটির একটি বাচ্চা হলো এবং শূকরীটি মারা গেল। ছানাটি তখন সেই ছাগলের পালের সঙ্গে বড় হতে লাগল। তারাও ঘাস খায়, শূকর ছানাটিও ঘাস খায়। তারা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে শূকর ছানাটিও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। ক্রমে ছানাটি বড় হয়ে উঠল।
একদিন ওই ছাগরের পালে আরেকটি শূকর এসে উপস্থিত হল। ঘাসখেকো ছাগলমার্কা শূকরটিকে দেখে সে তো অবাক! তখন নবাগত শূকর সেই ছাগল স্বভাবের শূকরটিকে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে জলের কাছে নিয়ে গেল। বলল, দেখ, জলের ভেতরে তোর মুখ দেখ, ঠিক আমার মত। আর এই নে একটা কচু, এইটা খা। এই বলে সে জোর করে কচু খাওয়াতে লাগল। প্রথম দিকে আমতা আমতা ও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করার পর অবশেষে কচুর স্বাদে সে মোহিত হলো। নতুন শূকরটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে কচু খেতে লাগল। এবার নতুন শূকরটি বলল, এখন বুঝেছিস, আমিও যা, তুইও তা। সুতরাং দ্রুত পায়ে আমার সঙ্গে বনে চলে আয়।
হ্যাঁ, বর্তমানে অনেকেই নিজের ছাগশিশু পরিচয়কে আর আড়াল করতে পারছে না। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ সবাইকে নিজ নিজ প্রবৃত্তি বা স্বরূপের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখন হয় হাঁস হয়ে বাঁচতে হবে, না হয় সজারু, হাঁসজারু হয়ে ডুগডুগি বাজানোর দিন শেষ।
সভ্যতাবনিাশী অন্ধকারের কীটগুলোকে জামায়াত-বিএনপি ও তাদের দোসরা ছাড়া আর কেউ মহান না বললেও ফরহাদ মজহার বলেছেন। এর আগেও তিনি শায়ক আবদুর রহমান ও বাংলাভাইসহ জেএমবির কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সন্ত্রাসী বোমাবাজদের তুলনা করেছিলেন। এখন আবার তিনি জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ‘নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেনে। জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর-মানুষখুন, পুলিশের ওপর আক্রমন, আইন না মানা বা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডকে সাফাই গাওয়াকে আর যাই বলা যাক না কেন, সুস্থ নাগরিক চিন্তা বলা যায় না। এই নৈরাজ্যবাদী অবস্থান রাষ্ট্রে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। কেননা, কোনো অবস্থাতেই দস্যুতাকে কখনও প্রশয় দেওয়া উচিত নয়। বুনোষাঁড়কে বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ দিলে ফসল বলে কিছু থাকবে না। ষাঁড়ের অধিকারকে বড় করে না দেখে যুগে যুগে সব দেশে ফসলের অধিকারকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি দুষ্ট ষাঁড় যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মাথাব্যথার কারণ হয় তাহলে তাকে যেকোনো মূল্যে শায়েস্তা করাটাই ‘ন্যায়। স্বভাব বা আচরণগত কারণে কুকুরকে আমাদের সমাজের অনেকেই পছন্দ করেন না। কিন্তু তরপরও এক ধরনের উপেক্ষা দেখিয়ে এই জীবটিকে ওই অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা মেনে নেন। কিন্তু যখন সমাজে কোনো পাগলা কুকুরের অস্তিত্ব দেখা যায়, তখন কিন্তু কুকুরপ্রেমীরাও আর তাকে মেনে নেন না। কারণ তখন ওই পাগলা কুকুরটিকে হত্যা করাই হয়ে দাঁড়ায় সকলের অভিন্ন লক্ষ্য বা একমাত্র ব্রত। এর বাইরে যদি কেউ অবস্থান নেন তবে বুঝতে হবে তিনি কোনো কল্যাণ বা শুভবোধ দ্বারা চালিত হচ্ছেন না, তিনি পরিচালিত হচ্ছেন, মতলব দ্বারা।
পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ধর্মব্যবসায়ী, বোমাবাজ, খুনী সন্ত্রাসীদের সহিংস কর্মকাণ্ডকে যিনি জায়েজ করতে চান, গণজাগরণ মঞ্চের অহিংস আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাকে আমরা কোথায় স্থান দেব, তা ভেবে দেখা উচিত।
সরকার জামায়াত শিবির-বিএনপির আন্দোলনকে দমন করছে, কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকে নিরাপত্তা দিচ্ছে বলে ফরহাদ মজহার ও তাদের দোসরদের মনোবেদনার শেষ নেই। কিন্তু তারা একবারও বলছেন না যে, প্রথম হঠাৎ হেলমেট পড়ে জামাত শিবির কর্মীরা কাকরাইলে পুলিশের উপর ঝটিকা হামলা করে। এরপর পুলিশ হত্যা, চোখ উপড়ে ফেলা, মাথায় রড় ঢুকানো, হঠাৎ হঠাৎ ব্যাপক আক্রমন করে পুলিশ পিটানো, গাড়িতে আগুন দিয়ে জ্যান্ত যাত্রীদের পুড়িয়ে মারা, চলন্ত গাড়িতে বোমা মেরে যাত্রীদের ঝলসে দেওয়া, স্কুলগামী শিক্ষার্থীকে বোমার আঘাতে চোখ অন্ধ করে দেওয়া, স্কুলে ঢুকে ছোট ছোট বাচ্চাদের পেটানো-এগুলো বিরামহীনভাবে কারা করছে? এরপরও বলবেন, পুলিশ কেন জামায়াত দেখলেই গুলি করে? জামায়াতই তো পুলিশের সাথে যুদ্ধটা শুরু করেছিল। এখনও মসজিদের মাইক ব্যবহার করে পুলিশকে আক্রমন করার জন্য সাধারণ মানুষকে উস্কানি দিয়ে চলেছে। গত ষাট বছরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের নামে এমন নৃশংস সন্ত্রাস কখনও কেউ দেখেছে? এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ কী রবীন্দ্র সংগীত গাইবে? নাকি পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের ভাষায় বলবে, কাঁটা পেয়ে আমি ফুল করি দান যে মোরে করেছে পর, আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাধি তার ঘর?
আর গণজাগরণ মঞ্চের কারণে দেশে কয়টা সন্ত্রাস হয়েছে? গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কাউকে কী একটা ফুলের টোকাও দেওয়া হয়েছে? তাহলে কেন এই মঞ্চ নিয়ে এত গাত্রদাহ, এত কটাক্ষ?
আপনারা কি তেমন গ্যারান্টি দিতে পারবেন যে, জামায়াত-বিএনপির মিছিল-সমাবেশ থেকে একটা গাড়িও ভাঙচুর করা হবে না, একটা বোমাও আর ফাটানো হবে না? তাহলে দেখবেন পুলিশ হয়তো আবার আপনাদের ফুল দিয়ে বরণ করবে! কিন্তু তেমন গ্যারান্টি কি আপনারা কেউ দিতে পারবেন?
দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। এসব নীতিবাক্য আমরা বহু পড়েছি। এখন প্রতিনিয়ত অনুভব করছি। জামায়াত-বিএনপির যাবতীয় অপকর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পক্ষে একদল মানুষ এখন সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। তারা নানা অপযুক্তি কুযুক্তি খাড়া করছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ইতিহাসের অনেক মীমাংসিত বিষয় খণ্ডিত আকারে টেনে আনছেন। নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধামত কখনও আংশিক কখনও বিকৃত করে উপস্থাপন করছেন। নায়ককে ভিলেন এবং ভিলেনকে নায়ক বানানোর অপচেষ্টায় তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এই দলের শীর্ষে রয়েছেন ফরহাদ মজহার। আর তার ভাবশিষ্য হিসেবে এগিয়ে এসেছেন, ড. এমাজ উদ্দীন আহমদ, ড. মনিরুজ্জামান মিয়া, ড. আমেনা মহসীন, ড. দিলারা চৌধুরী, ড. মাহবুব উল্লাহ, মাহফুজ উল্লাহ, আমানুল্লাহ কবীর, শওকত মাহমুদ। হালের পিয়াস করিম ও আসিফ নজরুলও এই মতবাদের ধারক এবং প্রচারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এতগুলো নামজাদা লোক যখন দিনের পর দিন একই কায়দায় এক মুঠ মিথ্যের সঙ্গে এক চিমটি সত্য মিশিয়ে পরিবেশন করেন, তখন আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব সহজেই বিভ্রান্ত হন। আর বিভ্রান্তির হাত ধরে আসে নৈরাজ্য, হিংসা, বিদ্বেষ।
একজন ব্যক্তি যদি নানা ধরনের প্রলাপ বকেন, কুযুক্তি খাড়া করে মনগড়া সব তত্ত্ব আউরে যান, তা উপক্ষো করাটাই সবচেয়ে ভাল জবাব। কিন্তু সমস্যা হলো, চিন্তার দিক থেকে দেউলিয়া একদল লোক ওই প্রলাপ ও অপতত্ত্বকেই নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের বয়ান মনে করে প্রতিনিয়ত তা প্রচার করে যাচ্ছেন। জামায়াত-বিএনপি শিবিরের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে ফরহাদ মজহার এখন যা কিছু বলছেনে, যা কিছু লিখছেন, তা প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করার বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার এবং তার জামায়াত-বিএনপি সমর্থক ভাবশিষ্যরা এখন একই খণ্ডিত অথবা বিকৃত তথ্য বার বার উচ্চারণ করে গোয়েবলসীয় কায়দায় সত্যের বিপরীতে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন। বার বার শুনতে শুনতে এই সব অপযুক্তি দেশের অনেক মানুষ এখন বিশ্বাসও করছেন। এতে করে প্রতিষ্ঠিত সত্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে, চেনা নায়ক দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচিত হচ্ছে, আর ঘাতক বা দুর্বৃত্তরা মহতের আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এটা খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা। যেখানে ঘাতককে পীরের সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, সে বড় ভয়ঙ্কর সমাজ। এই ভয়ঙ্কর সমাজ নির্মাণের নীরব কারিগর হিসেবে আজ ফরহাদ মজহাররা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ফরহাদ মজহার সাহেব ইদানীং নানা লেখায় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিজের মনগড়া বয়ান দিয়ে চলেছেন। বলা চলে তিনি তার ব্যক্তিগত কিছু সিদ্ধান্ত পাঠকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। তার প্রধান কথা হলো, বাংলাদেশের সমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এবং এই বিভক্তি সৃষ্টির জন্য তিনি মূলত আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দায়ী করে চলেছেন। গত ২৮ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত 'সমাজে বিপজ্জনক বিভক্তি' শীর্ষক এক লেখায় একতরফা ব্যক্তিগত কিছু বিশ্বাস জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গিয়ে বলে থাকেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র-তারা আসলে আওয়ামী লীগের সংকীর্ণ দলীয় অবস্থানের পক্ষেই দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে কথা বলেন না। তার মতে, "বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে" সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র কায়েম-এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
ফরহাদ মজহার আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতিকে আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যাপার হিসেবে চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে তা দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আবার তিনি বোকার মত মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাকে স্বাধীনতার মূল চেতনা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। মুজিনগর সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সংবিধানের মূলস্তম্ভের বৈরীতা কোথায়? মুজিবনগর সরকার আর স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের মধ্যেই বা পার্থক্য কোথায়? উভয় সরকারই এদেশের মানুষের ম্যান্ডেট নিয়েই তাদের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করেছেন। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ-বিরোধী রাজাকার-আলবদরদের সমর্থন কখনই আওয়ামী লীগ বা মুজিবনগর সরকারের প্রতি ছিল না। মুজিবনগর সরকার বা স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এবং ইতিহাসের কাছে একটি মীমাংসীত বিষয়। যারা এটা নিয়ে আবার নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান, তাদের মতলববাজ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
এর পর তিনি যোগ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়া এক জিনিস, আর রাষ্ট্র গঠন ভিন্ন বিষয়। আওয়ামী লীগ তার দলীয় কর্মসূচিকেই রাষ্ট্রের সংবিধানে পরিণত করল। "সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে" কী ধরনের কন্সটিটিউশান দরকার আমরা আলোচনার সুযোগ পর্যন্ত পাইনি। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর নতুন করে গণপরিষদ বা কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির প্রতিনিধি কারা হবেন এমন কোন নির্বাচন ডাকা হয়নি। বরং পাকিস্তানের সংবিধান লিখবার জন্য যারা পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত হয়েছিল, তারাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান লিখেছে। এই গোড়ার ইতিহাস না জানলে আমরা এখনকার রাজনৈতিক সংকটের চরিত্র বুঝতে পারবো না।
তিনি মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা-"বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে" সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র কায়েমকে ওহি মনে করেছেন। কিন্তু ৭২-এর সংবিধান প্রণেতাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে, কী ধরনের কন্সটিটিউশান দরকার আমরা আলোচনার সুযোগ পর্যন্ত পাইনি। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর নতুন করে গণপরিষদ বা কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির প্রতিনিধি কারা হবেন এমন কোন নির্বাচন ডাকা হয়নি। বরং পাকিস্তানের সংবিধান লিখবার জন্য যারা পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত হয়েছিল, তারাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান লিখেছে। হ্যাঁ, ঘটনা তো সত্য, তাতে সমস্যা কী হয়েছে? পাকিস্তানের সংবিধান লিখবার জন্য যারা পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত হয়েছিল, তাদের নেতৃত্বেই তো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, তাদের নেতৃত্বেই তো মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়েছে। এই নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা তো বাঙালি (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের) ভোটারদের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং এই নির্বাচনে দুটি ছাড়া সব আসনই তো আওয়ামী লীগের নেতারাই নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই জনপ্রতিনিধিরাই যখন সংবিধান রচনা করেছে, তখন তাদের গ্রহণেযাগ্যতা ও এখতেয়ার নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি, জেগেছে ফরহাদ মজহারের। আসলে সেই সময় যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এবং আওয়ামী লীগকে যারা মেনে নিতে পারেননি, তারা এই গণপরিষদ সদস্যদের সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। তাই তো চান্স পেলেই তারা এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। এটা কি তবে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে না পারার ক্ষোভ ও রোষজনিত আক্ষেপ? তা হলে, এই কূটপ্রশ্ন তোলা হবে কেন? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা তৈরি করেছে তা ভাল, আর তাদের সংবিধান তৈরি করার ব্যাপারটা খারাপ-এর মধ্যে যুক্তির জায়গাটা কোথায়?
মনে রাখা দরকার যে, কনস্টিটিউশন বা সংবিধান কোন শর্ত সাপেক্ষ বা চাওয়ার বিষয় নয়। স্বধীন রাষ্ট্র গঠনের পর সেই স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ আইন হিসেবে রচনা করা হয় সংবিধান। রাষ্ট্র যেমন কোন দল বা গোষ্ঠীর নয়; তেমনি সংবিধান ও কোনো দাল বা গোষ্টীর জন্য হয় না। রাষ্ট্র ও সংবিধান সকল জনগণের জন্য। ১৯৭১ সালে কি লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল তা ১৯৭২ সালের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বিধায়িত হয়েছে।
এই সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল- ‘গণতন্ত্র, ‘সমাজতন্ত্র, ‘জাতীয়তাবাদ’ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা। শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে পেছনের সারির একটি দেশ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভেতর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদ চরিত্রগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, তারপরও রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক রাখার জন্য আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।
বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ধারণা পশ্চিমের চেয়ে বহুলাংশে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশে এবং ভারতেও সেক্যুলারিজম বলতে বোঝায় রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছিন্নতা (Separation of state from religion), ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা নয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দিবার মতো ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে- আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি” (গণপরিষদের ভাষণ, ১২ অক্টোবর ১৯৭২)।
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মেরভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকে অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি এর দর্শনকে বাংলাদেশের মাটিতে যেভাবে সমাধিস্থ করেছে, পাকিস্তানি শাসকরা এবং তাদের এদেশীয় তল্পিবাহকরা কখনও তা মেনে নেয়নি। এ কারণেই তারা ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী চার শীর্ষ নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতাদের হত্যা না করলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলা সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীর দ্বারা সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও সমাজতন্ত্র মুছে ফেলে শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ এবং মুখবন্ধে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস...’ ইত্যাদি সংযোজন করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এই ইতিহাস ফরহাদ মজহাররা ভুলে যান, ভুলে থাকতে চান অথবা নিজেদের সুবিধামত তর্জমা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্ধ হলেই কী প্রলয় বন্ধ থাকে?
ফরহাদ মজহার পার্বত্য চট্টগাম প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, বাঙালি যেভাবে পাকিস্তানিকে দেখে, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চোখে আমরাও সেই একই 'পাকিস্তানি', যারা গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অপরাধী। এই ইতিহাস আমরা চাপা দিয়ে রাখি। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢাকা যায় না।
এইটুকু বলেই তিনি ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যান। কথা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ চালিয়েছে কে? কার শাসনামলে এই নিপীড়ন ও জুলুম চালানো হয়? এই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য কারা দায়ী? বঙ্গবন্ধু সবাইকে ঢালাওভাবে বাঙ্গালি বলে পাহাড়িদের সমস্যাকে সংকটে পরিণত করেছেন এমন একটা দায় চাপিয়ে তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যান; কিন্তু জিয়া-এরশাদের ভূমিকা নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেন না।
বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অবশ্যই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু তিনি তো পাহাড়িদের সঙ্গে মনস্তাস্ত্বিক বিরোধে জড়িয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু এই বিরোধকে বিবাদে পরিণত করা (ফরহাদ মজহারের ভাষায় 'গৃহযুদ্ধ') এবং এই 'গৃহযুদ্ধ' বাধানোর কাজটা তো অত্যন্ত সততার সঙ্গে জিয়া-এরশাদরা এগিয়ে নিয়েছেন, বেগম জিয়াও আগুনে ঘি ঢেলেছেন, সে সব বিষয়ে ফরহাদ মজহার বাকরুদ্ধ, নীরব।
তিনি বলেছেন, যারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন, তারা বিরোধ বাঁধিয়ে দিয়েছেন ইসলামের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের।
ইসলামের সঙ্গে বিরোধ যারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন তারা বাধিয়েছেন, নাকি বাধিয়েছেন ফরহাদ মজহার এবং তার ভাবশিষ্য জামায়াত-বিএনপি-শিবিরের সন্ত্রাসীরা?
শাহবাগের আন্দোলনকারীরা বিধর্মী নাস্তিক-এই অপপ্রচার কে চালিয়েছে? 'এই সরকার ইসলামের পক্ষের লোককে পাখির মত গুলি করে আর বিধর্মী নাস্তিকদের পাহারা দেয়, বিরানি খাওয়ায়'-এমন সব মিথ্যাচার কার মুখ থেকে বের হয়েছে?
ফরহাদ মজহার নিজেই লিখেছেন, 'বিএনপি জামাতের নেতৃত্বাধীন জোটকে সভা-সমাবেশও করতে দেয়া হচ্ছে না। সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দেবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অফিসে হামলা করে বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের কিভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা সবাই দেখেছে।'
বিএনপি-জামায়াত জোট কি সত্যিই কোনো সভা-সমাবেশ করতে চাইছে? গত দেড়মাসের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, বিএনপি-জামায়াত জোট সভা-সমাবেশ-মিছিলের নামে, পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা-ককটেল বিস্ফোরণ, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, মানুষ হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কাজ করছে। বিএনপি-জামায়াত জোটকে এই অপকর্ম অবাধে করতে দেওয়াটাকে ফরহাদ মজহাররা যুক্তিযুক্ত মনে করেন? তারা কি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নতুন সংজ্ঞা বানাতে চান? নির্বিচারে সভা-সমাবেশ-মিছিলের নামে, পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা-ককটেল বিস্ফোরণ, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, মানুষ হত্যা করাটাই কি বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার? এই অধিকারের প্রয়োগ যথাযথভাবে করতে দেওয়াটাই সরকারের দায়িত্ব? গণতন্ত্র মানে কি যা খুশি তাই করা? বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ইচ্ছেমত বোমাবাজি করবেন, জানমালের ক্ষতি করবেন, সন্ত্রাস- নৈরাজ্য সৃষ্টি করবেন, আর সরকার এবং পুলিশ তাদের ধান-দুর্বা দিয়ে পুজা করবে-এমন ভাবাটা কী গণতন্ত্রসম্মত? পুলিশের ভূমিকা অবশ্যই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, নিশ্চয়ই তাদের বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু সম্প্রতি সংঘটিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের লক্ষ্যে পরিচালিত জামায়াত-বিএনপির তাণ্ডবকে কিছুতেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায় না। এই নৈরাজ্য, সন্ত্রাস আর তাণ্ডবকে যারা বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেন, তারা গণতন্ত্র ও দস্যুতার মধ্যে পার্থক্য বোঝেন বলে মনে হয় না। দস্যুতাকে সমর্থন করবার উদারতা আমাদের যেন না হয়।
ফরহাদ মজহার তার লেখায় বলেছেন, ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণার যে সংস্কৃতি গত ৪০ বছর চর্চা করা হয়েছে তার মূল্য দিতে হবে অনেক।
সত্যিই কি তাই? এদেশে ৪০ বছর ধরে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণার সংস্কৃতি ছড়ানো হয়েছে? কোথায়, কীভাবে এই সংস্কৃতি ছড়ানো হয়েছে ফরহাদ মজহার সাহেব কী দয়া করে তুলে ধরবেন? আসলে তিনি তা পারবেন না। এদেশে গত ৪০ বছর ধরে বরং এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ভাবধারার চর্চা হয়েছে। এবং এটা হয়েছে ফরহাদ মজহারের প্রিয় দোসরদের (জামায়াত-বিএনপি) মাধ্যমেই। তাই তো ফরহাদ মজহাররা সহজেই ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাচ্ছেন।
ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের মতো মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব আমরা ’৭১-এ দেখেছি, আবার দেখেছি ২০০১ থেকে ২০০৬-এ বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত-বিএনপি একই কৌশল অবলম্বন করেছে।
তবে এবার দেশের মুক্তমনা মানুষের ভরসা হচ্ছে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের মহাজাগরণ, যারা নিজেদের দাবি করেছে- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সন্তান। একুশ বছর আগে জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে যে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীপ্ত শাহবাগের মহাজাগরণের নায়করা তার নেতৃত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ছাত্র-জনতার এই মহাজাগরণ ঢাকার শাহবাগের চত্বর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই জাগরণ দেখে মতলববাজ ও ধর্মব্যবসায়ীরা বিচলিত হয়ে পড়েছে। তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এই জাগরণকে রুখে দেওয়ার জন্য। তাদের শক্তি ও বুদ্ধি যোগাচ্ছে ফরহাদ মজহারের মত জ্ঞানপাপীরা। এই জ্ঞানপাপীদের যুক্তিতে শাণিত হয়ে মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জামায়াত-বিএনপি গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের ‘শাহবাগী নাস্তিক, ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়ে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। যদিও তাতে শেষ রক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ফরহাদ মজহার ও তার দোসরদের রয়েছে একবুক জ্বালা, পাহাড় সমান ক্ষোভ। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনকারীদের শ্লোগান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, দাবি নিয়ে উস্মা দেখিয়েছেন, আইনসংশোধন করাটাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখছেন। যারা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ অগ্নিসংযোগসহ মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর সব অপরাধ করছে, তাদের ফাঁসি দাবি করে শাহবাগের আন্দোলনকারীরা যেন মহাঅপরাধ করেছে। ঘাতকদের বিচার চাওয়াটাই ফরহাদ মজহারের কাছে অন্যায়, আর ঘাতকদের মুক্তি পাওয়াটাই তার কাছে ন্যায়। এমন ন্যায়-অন্যায়ের জুলুম তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন অকাতরে। তিনি বলেছেন, শাহবাগে শুধু জবরদস্তির কথা, ফাঁসির দাবি উঠল। ন্যায়বিচার রইল উপেক্ষিত।... আদালতের কাজ হচ্ছে একটি ফাঁসির কাগজ শাহবাগীদের ধরিয়ে দেওয়া। এমন বেইনসাফির ফলে সমাজকে একত্রিত রাখবার কোন ন্যূনতম ভিত্তি আর থাকলো না।
এমন বেইনসাফি মন্তব্য ফরহাদ মজহার কীভাবে করতে পারলেন? শাহবাগের আন্দোলনকারীরা কি ফরহাদ মজহারের ফাঁসি চেয়েছে? ফাঁসি চেয়েছে কাদের মোল্লার, ফাঁসি চেয়েছে নিজামী, সাঈদীসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের, কোনো সাধারণ অপরাধের বিচার বা ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের তরুণরা প্রাণপাত করছে না। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাওয়া কি অন্যায়? আর ফাঁসি চাওয়ার 'বেইনসাফির' ফলে সমাজ ভেঙ্গে গেল? দুইভাগ হয়ে গেল?
এটা ঠিক যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফরহাদ মজহার এবং তার ভাবশিষ্যরা অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপিওয়ালারা একদিকে চলে গেছেন। তারা কিছুতেই এই বিচারকে মেনে নিতে পারছেন না। মেনে নিতে পারছে না শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে। তাইতো তারা আজ গণজগরণ মঞ্চ আর সরকারের বিরুদ্ধে এমন হিংস্র হয়ে উঠেছে। অথচ তারা যদি এই যুদ্ধাপরাধের বিচারকে মেনে নিত, জাতীয় স্বার্থে কয়েকজন ঘাতকের শাস্তি কবুল করত তাহলে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ-বিভক্তি কিছুই হত না। কাজেই বর্তমান বিভক্তির জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তাহলে সবার আগে দায়ী ফরহাদ মজহার নিজে। এবং তার মতবাদে দীক্ষিত ব্যক্তিরা। তারাই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, ঘাতকের পক্ষে সাফাই গেয়ে সাধারণ মানুষের একটা অংশকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
নিজের অভিজ্ঞান অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বাতুলতা থেকে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ইতোমধ্যেই তারা (সরকার) 'সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি' গঠন করেছে। এর পাল্টা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে 'কমিটি ফর পাবলিক সেইফটি' বা 'জননিরাপত্তা কমিটি' গঠন করা হয়েছে। সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ নির্মূলের নীতি বাস্তবায়ন। 'জননিরাপত্তা কমিটি' গঠনের উদ্দেশ্য জনগণের জানমাল রক্ষা।
তিনি কোথায় সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি দেখলেন, এবং কোথায় জননিরাপত্তা কমিটি দেখলেন ঈশ্বর জানেন। আমরা প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর মুখ থেকে এ ধরনের কমিটি গঠনের ব্যাপারে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুনেছি। এই বক্তব্যকে ধরেই তিনি উপসংহারে পৌঁছে গেছেন। এবং সহজেই তার রাজনৈতিক সমর্থন প্রকাশ করেছেন। তিনি তার দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝেছেন যে, সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ নির্মূলের নীতি বাস্তবায়ন। আর জননিরাপত্তা কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য জনগণের জানমাল রক্ষা। তিনি যাদের দেখতে পারেন না, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে 'ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ নির্মূলের নীতি বাস্তবায়ন', আর তার প্রাণের আদর্শের সংগঠনের কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য 'জনগণের জানমাল রক্ষা।'
বাঃ ফরহাদ মজহার সাহেব বাঃ! বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের 'জানমাল' গত দুইমাস ধরে যেভাবে 'রক্ষা' করছে, তাতে আপনার কাছে মাপ চাই, জনগণের জানমালের হেফাজত আপনাদের করতে হবে না, বরং আপনারা আপনাদের খাসলতের হেফাজত করুন।
যে কোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজস্ব মেধাশক্তি ও হৃদয়বৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন এটাই শ্রদ্ধেয় এবং সৎ ও বিবেকবান ব্যক্তির নিকট প্রত্যাশিত; দলসম্পৃক্তির বাইরে, নির্দলীয় মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে দেশ ও দশের ভিতরে নিঃশর্তে, নিঃসঙ্কোচে, নির্ভয়ে, মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার দেওয়ার লক্ষেই মানবসভ্যতা শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আবিষ্কার করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার নামে, ন্যায়ের নামে, ন্যায়বিচারের নামে দস্যুতাকে আমরা যেন প্রশ্রয় না দিই।
ফরহাদ মজহার এবং তার সহগামীরা বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতাকে অত্যন্ত কৌশলে ইসলাম ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা একদিকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যখন যাকে খুশি নাস্তিক, বিধর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। অন্যদিকে নানা রবম গুজব আর কুৎসা রটনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে গণজাগরণ মঞ্চ ও প্রগতিশীল ধারার মানুষজন সম্পর্কে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। এটা দেশের রাজনীতির জন্য খুবই খারাপ কথা।
ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ও ধর্ম ব্যবসায়ী এক নয়। আমাদের দেশে ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদর হীন স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। এই ধর্মব্যবসায়ী জঙ্গিরা জয়ী হলে জয়ী হলে সভ্যতার অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হবে। একধর্ম-একগোষ্ঠীর এক সমাজ কায়েম হবে। যে সমাজে কোনো বৈচিত্র্য থাকবে না। এমন একটি আজব ও অবাস্তব সমাজ গঠনের জন্য ফরহাদ মজহাররা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মনে রাখা দরকার যে বর্তমান মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জিতেছিল। এটি পূরণ করতে বা অন্য কোনো কারণেই হোক তারা ট্রাইব্যুনাল তৈরি করেছে। এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। যারা এসব করছে তারা জামায়াতের সমর্থক। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তারা চিঠি লিখেছেন, বলেছেন এ ট্রাইব্যুনাল বৈধ নয়।
যদিও জামায়াতের এ দাবি অসার। বৈধ বলতে আমরা আইনের পরিভাষায় যা বুঝি এটাও সেরকম বৈধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক মান বলে একটা কথা আমরা বাজারে শুনি। কিন্তু এটা তো বাংলাদেশি ট্রাইব্যুনাল। কথাটা হলো, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল; ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ক্রাইমস, তা নয়। ইন্টারন্যাশনাল শব্দটা এখানে ক্রাইমের বিশেষণ। এক দেশে যুদ্ধের সময় অন্য দেশের নাগরিক যে অপরাধ করে-এ জাতীয় অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে, এ ট্রাইব্যুনাল তার বিচার করছে না। এ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশি বিচারকদের দ্বারা গঠিত। এর বিষয়বস্তু কিন্তু সাধারণ ফৌজদারি অপরাধ নয়। ইন্টারন্যাশনাল শব্দটি একটি ভদ্রশব্দ। আর ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল জনবোধ্য শব্দ। আর আমরা মুখে মুখে জনবোধ্য কথাটাই বলি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশে যে অপরাধ হয়েছিল তা বিচারের জন্য এ দেশের একটি বৈধ সরকার এটি গঠন করেছে।
এখন যে কোনো ট্রাইব্যুনালেরই সমালোচনা করা যাবে। যাবে না কেন? নুরেমবার্গ, টোকিও ট্রাইব্যুনালেরও সমালোচনা করা যাবে। সমালোচনা এক কথা আর নাকচ বা নিকুচি করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালকে নাকচ করে দেওয়ার জন্য একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। এটা করছে জামায়াতিরা। আর সমর্থন যোগাচ্ছে বিএনপি এবং জামায়াত-বিএনপির তাত্ত্বিকগুরু ফরহাদ মজহাররা।
এই হচ্ছে বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপট। কিন্তু ফরহাদ মজহার ও তার দোসররা উলটো বুঝছেন, উল্টো বোঝাচ্ছেন। ফরহাদ মজহাররা কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরুতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। জামায়াতিরাও বিষয়টাকে সেভাবে পাত্তা দেয়নি। তারা হয়তো ভেবেছিল, ট্রাইব্যুনাল তাদের কিছুই করতে পারেব না বা করবে না। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে সত্যি সত্যি রায় ঘোষণা করায় তাদের টনক নড়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এটা মানতে হবে যে, যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বৈধ, এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনের উদ্যোগে গঠিত। আর এতে বাংলাদেশের জনসাধারণের সমর্থন আছে। যদি না থাকতো, তাহলে এ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকার নির্বাচনে জিততে পারতো না। বিচার প্রক্রিয়ায় ক্রুটি থাকলে তা সংশোধনে উচ্চ আদালতে আপিলের ব্যবস্থাও তো আছে। জামায়াতিরা আইনের পথেও রয়েছে। তাহলে কেন এই রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা? দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা? আর ফরহাদ মজহারই বা কেন এই রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতাকে এমন সমর্থন যোগাচ্ছেন? এর পেছনে কী অন্য কোনো কোনো গোপন বিষয় বা নগদনারায়ণের যোগ আছে?
আরেকটি কথা, হত্যা-খুন কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও উল্লেখ করা দরকার যে, বর্তমান সরকারের আমলেই 'পাখির মত' মানুষ মারা হচ্ছে না। 'পাখির মত মানুষ হত্যা' অতীতেও হয়েছে। এর আগে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায়্য দাবি আদায় করতে গিয়ে বিএনপি শাসনামলে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। অথচ সেই সব হত্যাকাণ্ড বিষয়ে আমাদের বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বুদ্ধিজীবীরা নীরব। এই একচোখা ব্যক্তিরা কখনও বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম দেখে না। ২০০৬ সালে বেগম জিয়ার শাসনামলে বেশ কয়েক দফা গুলিবর্ষণের কারণে বহু লোক নিহত এবং আহত হয়েছিলেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর গুলিতে সরকারি হিসাব মতেই ১৭ জন নিহত হয়েছিলেন।...দেশের বিভিন্ন স্থানে সারের জন্য ১৮ জন নিরীহ কৃষককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ কোম্পানি এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে কয়লা খনি এলাকা ফুলবাড়ীতে জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় গুলি করে ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।.
ওই একই বছর...গাজীপুরে গার্মেন্ট শ্রমিক বিক্ষোভের সময় গুলি করে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে হত্যা এবং আহত করা হয়েছিল।
এ হত্যাকাণ্ডগুলোর কথা বিএনপি-জামায়াতের নেতারা এবং তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীরা বেমালুম চেপে যান।
কাজেই ফরহাদ মজহারের মত দলকানা বুদ্ধিজীবীর বিভ্রান্তিকর মত ও বক্তব্যের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৩৫
চিররঞ্জন সরকার বলেছেন: ভাই, আপনি খুব ভাল বুঝদার। আপনি মুক্তিযোদ্ধাও না রাজাকারও না, আপনি হলেন পয়গম্বর। লেখক যেহেতু আওয়ামীভক্ত (!) কাজেই আপনি আওয়ামী বিরোধী হয়েই থাকুন।
ঈশ্বর আপনাকে শান্তিতে রাখুন।
২| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৪:০৩
তিক্তভাষী বলেছেন: লেখাটা পড়ে একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেলো।
এক কর্মচারী বলছে-আমার বসের কোন সময় জ্ঞান নাই।
শ্রোতা-কেন?
কর্মচারী- না মানে, আমি যেদিন আগে যাই দেখি বস আসেনি। আবার যেদিন আমার দেরী হয়, দেখি ব্যাটা এসে বসে আছে।
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৩৮
চিররঞ্জন সরকার বলেছেন: গল্পটা খুবই মজার এবং লাগসই। আপনারা আছেন বলে দুনিয়ায় এখনও রস আছে। রসিক ভাই, আপনি চালিয়ে যান।
৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৬
সাফায়াত কাদির বলেছেন: আফনে এইডা কি কন?
চোররে চোর ডাকব না তো কি ডাকব খালু?
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৩৯
চিররঞ্জন সরকার বলেছেন: হ্যা ভাই, যা দিনকাল পড়েছে, তাতে চোরকেই খালু বলতে হবে।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৪
কাঙ্গাল মুরশিদ বলেছেন: "আমাদের চারদিকের চরিত্রগুলো বেশিরবাগই সহজ-সরল। হয় সাদা, নয়তো কালো। চোর না হলে সাধু। মুক্তিযোদ্ধা না হলে রাজাকার।"
এর পর আর পড়া গেল না - মুক্তিযোদ্ধা না হলেই রাজাকার? কঠীন আওয়ামী ব্রেনওয়াশড ছাড়া এই মনোভাব বেশী মানুষের মাঝে আছে কি?
বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। একই ভাবে লেখক যখন এই মানের আওয়ামীভক্ত তখন বাকি লেখায় কী থাকবে সেটা বোঝার জন্য কস্ট করে পড়ার কোন দরকার আছে কি??