নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নিরপেক্ষ নই, আমি ভাল'র দলে

গালিগালাজ ও ক্যাচালমুক্ত ব্লগ

চিরতার রস

ভাল'র সাথে থাকি। ভাল'র মাঝে বাঁচিতে চাই ফেসবুকে বন্ধু হতে চাইলে- www.facebook.com/chiroter.rosh

চিরতার রস › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা আবৃত্তির কবিতা সংকলন - পর্ব ২

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:১৯





যারা প্রথম পর্ব মিস করেছিলেন তাদের জন্য - বাংলা আবৃত্তির কবিতা সংকলন - সংগ্রহে রাখুন



ওটা কিছু নয় - নির্মলেন্দু গুণ



এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব? পাচ্ছো না?

একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব? পাচ্ছো না?

তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।

এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,

-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর

মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।

সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,

ওখানে কী খোঁজ তুমি? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ;

রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,

নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে, অইখানে

হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।

অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি;

অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।



মানুষ - নির্মলেন্দু গুণ



আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,

হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,

মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,

গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,

অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।

কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,

সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে

সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,

বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,

রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,

পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,

মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?

মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,

নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,

নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে

ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,

বাবা থাকতো, বোন থাকতো,

ভালোবাসার লোক থাকতো,

হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,

মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা

আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত

বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;

অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,

অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।



বাতাসে লাশের গন্ধ - রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ



আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই

আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি

ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে...

এ দেশ কি ভুলে গেছে সোই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে

মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ ।

এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধে ছিলো ।

জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার ,

আজ তারা আলোহিন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায় ।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জার আড়ষ্ট কুমারী জননী,

স্বাধীনতা-- একি হবে নষ্ট জন্ম ?

একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন ।

বাতাসে লাশের গন্ধ

নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংশের তুফান ।

মাটিতে রক্তের দাগ--

চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড় ।

এ চোখে ঘুম আসেনা । সারারাত আমার ঘুম আসে না-

তন্দ্রার ভেতর আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,

নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচালাশ

মুন্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর

ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে- আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি

ঘুমুতে পারিনা...

রক্তের কাফনে মোড়া - কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে

সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা ।

স্বাধীনতা, সে- আমার স্বজন- হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-

স্বাধীনতা- আমার প্রিয় মানুষের রক্তের কেনা অমূল্য ফসল ।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত পতাকা ।



তোমায় আমি – জীবনানন্দ দাশ



তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে

তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;

শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে

শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে

খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।

নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে

পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে

জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর

এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার

পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।

তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই

শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,

তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে

চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে

শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।

জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়

পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।

এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;

তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল

বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।



তুমি জেনেছিলে - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে

হাত ছুঁয়ে বলে বন্ধু

তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে

মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়

হাসি বিনিময় করে চলে যায়

উত্তরে দক্ষিণে

তুমি যেই এসে দাঁড়ালে-

কেউ চিনলো না কেউ দেখলে না

সবাই সবার অচেনা!



আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ

এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ

পরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা

আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা

করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে

থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে

হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,

মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি

অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-

(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়িরে ছেলে

সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক

ঘামে ছিল না এমন গন্ধক

যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার। নিখিলেশ, তুই একে

কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেকেরে

বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;

আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।

আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।

আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,

আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে

জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে

ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো

কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত

দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,

আমার ঘরের

দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের

হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে

দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে

হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার

একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়অর;

ইচ্ছে ছিল না জানাবার

এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে

এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্ড়ে

টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়

আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়

কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে

বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে

তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার

নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য

পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।



ব্যর্থ প্রেম - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়

আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি

দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত

ছড়িয়ে যায়

আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক

অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে

হেঁটে যাই

সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না

আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই

রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট

অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে

খসে পড়ে

আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ

ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে

মনে হয় খুব আপন

আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা

প্যান্ট শার্ট পরে

আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে

আমি নিজেই আদর করি

খুব গোপনে

আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ

আমার সর্বাঙ্গে কোথাও

একটুও ময়লা নেই

অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার

মাথার পেছনে

আর কেউ দেখুক বা না দেখুক

আমি ঠিক টের পাই

অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য

আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও

আঘাত না লাগে

আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।



উত্তরাধিকার - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ

তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর

ফুসফুস-ভরা হাসি

দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হ’য়ে শুয়ে থাকা

এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভ’রে নাও আমার অবেলা

আমার দুঃখবিহীন দুঃখ ক্রোধ শিহরণ

নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছুল আভরণ

জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানালার পাশে

বালিকার প্রতি বারবার ভুল

পরুষ বাক্য, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, ছুরির ঝলক

অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মত আর যা-কিছুর

বুক চিরে দেখা

আত্মহনন, শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত

একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী —

এ-সবই আমার পুরোনো পোষাক, বড় প্রিয় ছিল, এখন শরীরে

আঁট হয়ে বসে, মানায় না আর

তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও

অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার

তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়।



কেউ কথা রাখেনি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি

ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল

শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে

তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী

আর এলোনা

পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর

তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো

সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর

খেলা করে!

নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ

ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়

তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো

লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা

ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি

ভিতরে রাস-উৎসব

অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা

কত রকম আমোদে হেসেছে

আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!

বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…

বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই

সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব

আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,

যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে

সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!

ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি

দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়

বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম

তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ

এখনো সে যে-কোনো নারী।

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!



চিঠি দিও -মহাদেব সাহা



করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও

আঙ্গুলের মিহিন সেলাই



ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,

এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো

অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।



চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...

বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!



আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,

আসবেন অচেনা রাজার লোক

তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....

এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...



করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি

দিও খামে

কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস

একটি ফুলের ছোট নাম,



টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে

সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প

খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো



করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !



একবার তুমি - শক্তি চট্টোপাধ্যায়



একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো--

দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে

পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল

নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।



বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে

যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা

বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।



বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল

চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক - ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল-

অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।



মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে

আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো

রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে

একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো ।



শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?

তারি রথ নিত্য উধাও।

জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন

চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।

ওগো বন্ধু,

সেই ধাবমান কাল

জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল

তুলে নিল দ্রুতরথে

দু'সাহসী ভ্রমনের পথে

তোমা হতে বহু দূরে।

মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে

পার হয়ে আসিলাম

আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরানো নাম।

ফিরিবার পথ নাহি;

দূর হতে যদি দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।

কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে

বসন্তবাতাসে

অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,

ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,

সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে

তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে

হয়তো দিবে সে জ্যোতি,

হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।

তবু সে তো স্বপ্ন নয়,

সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় -

সে আমার প্রেম।

তারে আমি রাখিয়া এলাম

অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।

পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে

কালের যাত্রায়।

হে বন্ধু বিদায়।

তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।

মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি

যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি

হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-

পূজার সে খেলা

ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;

তৃষার্ত আবেগবেগে

ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।

তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে

যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত'ষায়

তার সাথে দিব না মিশায়ে

যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।

আজও তুমি নিজে

হয়তো বা করিবে বচন

মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন

ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।

হে বন্ধু বিদায়।

মোর লাগি করিয় না শোক-

আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।

মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,

শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।

উ'কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে

সে ধন্য করিবে আমাকে।

শুক্লপখক হতে আনি

রজনী গন্ধার বৃন্তখানি

যে পারে সাজাতে

অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে

সে আমারে দেখিবারে পায়

অসীম ক্ষমায়

ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,

এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।

তোমারে যা দিয়েছিনু তার

পেয়েছ নিশেষ অধিকার।

হেথা মোর তিলে তিলে দান,

করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান

হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,

ওগো নিরূপম,

হে ঐশ্বর্যবান

তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,

গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।



সে - জীবনানন্দ দাস

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;

বলেছিলো: 'এ নদীর জল

তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:

সব ক্লান্তি রক্তের থেকে

স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;

এই নদী তুমি।'



'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'

মাছরাঙাদের বললাম;

গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।

আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;

জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে

কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।



সময়ের অবিরল শাদা আর কালো

বনানীর বুক থেকে এসে

মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে

ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো

ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি

না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।



আমাকে একটি কথা দাও - জীবনানন্দ দাস



আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো

সহজ মহৎ বিশাল,

গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে

মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,

আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।

সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:

সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন

সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে

অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।



সুচেতনা - জীবনানন্দ দাস



সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত

ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।

কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;

সেই শস্য অগণন মানুষের শব;

শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়

আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ

মূক করে রাখে; তবু চারিদকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।

সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;

সে অনেক শতাব্দীর মানষীর কাজ:

এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–

প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ

আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে

গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।

মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসছি,

না এলেই ভালো হত অনুভব করে;

এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি

শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;

দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।



একটি পতাকা পেলে- হেলাল হাফিজ



কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা



কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস

ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।



কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে

ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।



কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,

বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।



কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,

সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ

সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।



নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়-হেলাল হাফিজ



এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

মিছিলের সব হাত

কন্ঠ

পা এক নয় ।



সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,

কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।

কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার

শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে

অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে

অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,

কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে

কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।



যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান

তাই হয়ে যান

উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।



এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।



অভিশাপ-নজরুল ইসলাম



যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,

অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -

বুঝবে সেদিন বুঝবে!

ছবি আমার বুকে বেঁধে

পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে

ফিরবে মরু কানন গিরি,

সাগর আকাশ বাতাস চিরি'

যেদিন আমায় খুঁজবে -

বুঝবে সেদিন বুঝবে!



স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,

কাহার যেন চেনা-ছোওয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে, -

জাগবে হঠাৎ চমকে!

ভাববে বুঝি আমিই এসে

ব'সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,

ধরতে গিয়ে দেখবে যখন

শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!

বেদনাতে চোখ বুজবে -

বুঝবে সেদিন বুঝবে!



গাইতে ব'সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,

ব'লবে সবাই - "সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?"

আসবে ভেঙে কান্না!

প'ড়বে মনে আমার সোহাগ,

কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!

প'ড়বে মনে অনেক ফাঁকি

অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি

ঘন ঘন মুছবে -

বুঝবে সেদিন বুঝবে!



আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ'রবে তোমার অঙ্গন,

তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ -

কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!

শিউলি ঢাকা মোর সমাধি

প'ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি'!

বুকের মালা ক'রবে জ্বালা

চোখের জলে সেদিন বালা

মুখের হাসি ঘুচবে -

বুঝবে সেদিন বুঝবে!



প্রণয়ের প্রথম চুম্বন-কায়কোবাদ



মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

যবে তুমি মুক্ত কেশে

ফুলরাণী বেশে এসে,

করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?



প্রথম চুম্বন!

মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!

কত প্রেম কত আশা,

কত স্নেহ ভালবাসা,

বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!



হায় সে চুম্বনে

কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!

কত হাসি, কত ব্যথা,

আকুলতা, ব্যাকুলতা,

প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!



সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,

অতৃপ্ত হৃদয় মূলে

ভীষণ ঝটিকা তুলে,

উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!



স্বাধীনতা তুমি-শামসুর রাহমান



স্বাধীনতা তুমি

রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।

স্বাধীনতা তুমি

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো

মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-

স্বাধীনতা তুমি

শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা

স্বাধীনতা তুমি

পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।

স্বাধীনতা তুমি

ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।

স্বাধীনতা তুমি

রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।

স্বাধীনতা তুমি

মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।

স্বাধীনতা তুমি

অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।

স্বাধীনতা তুমি

বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর

শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।

স্বাধীনতা তুমি

চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।

স্বাধীনতা তুমি

কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।

স্বাধীনতা তুমি

শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক

স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।

স্বাধীনতা তুমি

উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।

স্বাধীনতা তুমি

বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।

স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।

স্বাধীনতা তুমি

গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,

হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।

স্বাধীনতা তুমি

খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,

খুকীর অমন তুলতুলে গালে

রৌদ্রের খেলা।

স্বাধীনতা তুমি

বাগানের ঘর, কোকিলের গান,

বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,

যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।



তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা-শামসুর রাহমান



তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,

তোমাকে পাওয়ার জন্যে

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?



তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,

সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো

দানবের মত চিৎকার করতে করতে

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

ছাত্রাবাস বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।

তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।

তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার

ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।



তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে

আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো

উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের

দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নডছে চুল।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে

মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে

নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।



স্বাধীনতা, তোমার জন্যে

হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে

বসে আছে পথের ধারে।

তোমার জন্যে,

সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,

কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,

মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,

গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে

রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস

এখন পোকার দখলে

আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো

সেই তেজী তরুণ যার পদভারে

একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –

সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।



পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত

ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,

মতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক

এই বাংলায়

তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।



প্রস্থান - হেলাল হাফিজ



এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷

এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা

খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত

ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷

আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷

গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?

আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,

নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে

পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?

এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,

এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!



ইচ্ছে ছিলো - হেলাল হাফিজ



ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে

শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।

ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো

সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা

পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।

ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে

রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,

জন্মাবধি আমার শীতল চোখ

তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।

ইচ্ছে ছিল রাজা হবো

তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,

আজ দেখি রাজ্য আছে

রাজা আছে

ইচ্ছে আছে,

শুধু তুমি অন্য ঘরে।

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৪২

মামুন রশিদ বলেছেন: কবিতা প্রেমীদের জন্য চমৎকার সংকলন । মাঝে মাঝে এসে পড়ে যাব :)

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:২০

চিরতার রস বলেছেন: আমিও কবিতাগুলো সংগ্রহ করে রাখার জন্যই পোস্টটা দিলাম। অনেক সময় বিভিন্ন যায়গায় খোজাখুঁজি করতে হয়। তাই সব ভাললাগার কবিতাগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসলাম :)

২| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:১৪

এহসান সাবির বলেছেন: দারুন পোস্ট!!!
+++++

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:২১

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ সাবির ভাই। আপ্নেও কি নীলফামারী গেছিলেন ?

৩| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:৫৩

স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:
দারূন একটা পোষ্ট দিয়েছেন মশাই,
প্রায় সবগুলোর আবৃত্তি শুনেছি..।

এর মধ্যেঃ

* কেউ কথা রাখেনি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
* শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
* নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়-হেলাল হাফিজ
* স্বাধীনতা তুমি-শামসুর রাহমান
* ইচ্ছে ছিলো - হেলাল হাফিজ

কবিতাগুলো বেশি প্রিয় তাই
সংগ্রহে নিলাম ।

অনেক ধন্যবাদ ।

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:১১

চিরতার রস বলেছেন: থ্যাংকু গ্রানমা :)

আইচ্ছা "মশাই" শব্দটি কি বুড়োদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না ? :-* আমি শিওর না। B:-/

৪| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:২৬

স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:
বুড়ো বললে কি খুব কষ্ট নাকি..?

এটা সাহিত্যরস, বুঝলেন না ব্রাদার !
ভালো থাকুন ।

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৩১

চিরতার রস বলেছেন: ছেলে মানুষ কক্ষনো বুড়ো হতে চায় না। :#) ছেলেরা সারাজীবন সবুজ B-))

৫| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৮

সায়েদা সোহেলী বলেছেন: । রাখলাম :)

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:১৮

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ তো দিলেন না B-)) B-)) B-)) আপ্নে এত্তোগুলা পঁচা :-P

৬| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৩২

লেখোয়াড় বলেছেন:
+++++++++++++++
টাইপ করেছেন না কপি?

ভাল কাজ।

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৩

চিরতার রস বলেছেন: কিছু কবিতা নেটে পেয়েছিলাম, তাই কষ্ট কম হয়েছিল। :) অনেকগুলি বই দেখে টাইপ করতে হয়েছে। :(

৭| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:২৮

লাবনী আক্তার বলেছেন: একদম প্রিয়েতে। :D


আমার কিছু প্রিয় কবিতা আছে এখানে। অনেক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:২৭

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ লাবনীপু ;)

সবগুলি কবিতাই আমার প্রিয়।

৮| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৪৮

স্বপ্নবাজ অভি বলেছেন: সুন্দর আয়োজনঃ)

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৯

চিরতার রস বলেছেন: কবিরা মইরা গেলে লিজেন্ড হয়। তোমার মরণের পরে তোমার কবিতা দিয়াও পোলাপান ব্লগ সংকলন করবো B-)) B-)) B-))

৯| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৪২

যুগল শব্দ বলেছেন:
ভালো কবিতা,
রেখে দিলাম !

১০| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪৩

দেওয়ান তাহমিদ বলেছেন: দুজন মেয়ে আবৃত্তি করবে, এমন কিছু কবিতার নাম বলতে পারেন?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.