নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এবং সালাহি উদ্দিন গুম কাহিনী অতঃপর

চঞ্চল মাহবুব

মাহবুবুল আলমের জীবন সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত জন্ম ও বংশ: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ মাহবুবুল আলম, ১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারী, কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলাধীন হাইধন কান্দি গ্রামের সম্ভ্রান্ত মোল্লা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও স্বনামধন্য শিক্ষক সাহেব আলী মাস্টার, মা বিদুষী গৃহিনী রাবেয়া খাতুনের নয় সন্তানের মধ্যে মাহবুবুল আলম তাঁদের ষষ্ঠ সন্তান। শিক্ষা: স্থানীয় ইসলামাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, পাঁচ পুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, নিমসার জুনাব আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, তেজগাও কলেজ থেকে বি.এ ও এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। লেখালেখি: সত্তর দশকের গোড়ার দিকে তিনি সিলেট সমাচার, যুগভেরী, বাংলার বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকা সাময়িকীতে ছড়া, কবিতা গল্প ফিচার লিখে তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটান। সাথে সাথে সাহিত্যাঙ্গণের সম্পাদক হিসাবে মৌলভীবাজারের সমসাময়িক সাহিত্যানুরাগীদের মুখপাত্র সাহিত্যের কাগজ ‘প্রসূন’ সম্পাদনা করেন। একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে দেশের শিক্ষা বিস্তারেও তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, সেই লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন-সানমুন ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজ, হলিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মিশো মিউজিক কেয়ার প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা: ৩৮। উপন্যাস-৮, কাব্যগ্রন্থ-৯, ছড়ার বই-৩, কলাম সমগ্র-৫, নাটক-৭, গবেষনা-২, শিশুতোষ-২, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-২টা। পুরষ্কার: সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি কবিতাঙ্গন এ্যাওয়ার্ড (২০০৭), ড.মমিনুল হক একাডেমি ইউ.কে এ্যাওয়ার্ড (২০০৮) সংশপ্তক বঙ্গবীর ওসমানী পদক, অলইন্ডিয়া চিলরেন্ড লিটারারী ফউন্ডেশন ‘উৎপল হোমরায়’ স্মৃতি পুরস্কার-২০১২ ও ভারতের পূর্ব মেদিনীপুরের কবি ও কবিতা পত্রিকা সন্মাননা-২০১২, দুইবাংলা কবিতা উৎসব সন্মাননা-২০১৩, সাপ্তাহিক কালপুরুষ পত্রিকা সন্মাননা-২০১৩সহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

চঞ্চল মাহবুব › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প-অপেক্ষা

১৬ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:৩৬

অপেক্ষা

শতকষ্টের মাঝেও এখন আর একবিন্দু কাঁদতে পারেনা জরিনা। কাঁদতে কাঁদতে বোঝি তার চোখের সব অশ্রুই শুকিয়ে গেছে। এখন তার চোখে কোনো জল নেই, অশ্রুও নেই কোনো। চোখের ভেতর যেন এক ধূ-ধূ বালুচর। সমুদ্রের বেলাভূমিতে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা জরিনার বুকে যেন কষ্টের এক অথৈ সাগর।

একজন মানুষ আর কত কাঁদতে পারে? দিন সপ্তাহ মাস গড়িয়ে বছর হতে চললো। এতদিন কাঁদতে কাঁদতে মনের সব আবেগও বোঝি মরে গেছে তার। কেমন আবেগহীন এক পাথর মানুষের মতো নিশ্চল বসে আছে সে ঘরের অঙ্গিনায়।

এখান থেকে দেখা যায় গায়ের দীর্ঘ মেঠোপথ। ছুটি পেলে এ পথ দিয়েই বাড়ি আসতো মিজান। বাড়ি আসার কথা আগেই মোবাইল ফোনে জানাতো সে। আর জরিনা কাঙ্খিত দিনের অপেক্ষায় এখানটাই দাঁড়িয়ে বা বসে স্বামীর আসার অপেক্ষা পথ চেয়ে বসে থাকতো।

কিন্তু, কতদিন হয়ে গেল মানুষটা আর বাড়ি আসে না। আর কোনোদিন আসবে কিনা তাও জানে না জরিনা। চোখ শুকিয়ে গেলে মানুষের আবেগও কি মরে যায়? তা হলে এখন তার আর আবেগ নেই কেন? কি হয়েছে আবেগের; সেও কি মিজানের মতো নিঁেখাজের খাতায় চলে গেছে?

এসব ভাবতে ভাবতেই জরিনার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানটি আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। নড়াচড়া করছে খুব। এরই মধ্যে দু’একবার লাথিও মেরেছে পেটের দেয়ালে। জরিনা তার স্ফিত পেটে হাত বুলিয়ে অনাগত সন্তানের স্পর্শ অনুভব করে। ভাবে-সন্তান পেটে আসার দিনটির কথা। ভাবতে ভাবতে এক সময় স্মৃতির তরঙ্গে তলিয়ে যায় জরিনা।

দুর্ঘটনা ঘটার মাস দুয়েক আগে বাড়ি এল মিজান। দু’দিন থেকে আবার চলে যায়। চলে যাবার রাতে বিছানায় শুয়ে জরিনার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে মিজান-
: বউ আমাদের বিবাহতো হয়ে গেল অনেক দিন। ঘরে এখন একটা নতুন মানুষের দরকার। তোমার কোলে একটা সন্তান আসলে খুব মানাইবো। লাল টুকটুকে বউ আমার। বলেই কেমন ক্ষেপাটে হয়ে ওঠে সে।
যে দু’দিন বাড়িতে ছিল সে দু’দিনই জরিনাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে মিজান। যেখানেই একা পেয়েছে, সেখানেই গায়ে হাত দিয়েছে। জরিনা স্বামীর এসব অসভ্যতা দেখে বারবার চোখ রাঙ্গিয়েছে স্বামীকে-
: এইসব কি করছেন আপনে! আব্বা-আম্মা আর বাড়ির কেহ দেইখ্যা ফ্যালাইলে লজ্জার শেষ থাকবোনি। এইবার বাড়ি আইস্যা আপনের অসভ্যতা খুব বাইরা গেছে। আপনে চইল্যা গেলে সেজান ও তার বউ আমারে খুব ক্ষ্যাপাইবো। আরেকবার এমন বেহায়াগিরি করলে বালা হইবনা কিন্তু কইয়া দিলাম।
জরিনা চোখ রাঙ্গিয়ে এসব বললে, মিজান তখন হাসতে হাসতে বলে-
: আমার বউরে আমি ধরব, চুমু খাব, আদর করবো আরও কত কিছু করবো; এখানে কার কি বলার আছে। আর তোমারও তো লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। তুমি আমার বিয়ে করা বউ। অন্য কোন মেয়ে মানুষের সাথেতো আমি আর অসভ্যতা করছি না। যা করছি আমার বউয়ের সাথেই করছি। কার কথায় আমার কি আসে যায়। আর মা-বাবার কথা বলছো; হেরা ও কি এই বয়সে কম? সারাক্ষণ ‘লাভ বার্ডের’ মতো জড়াজড়ি করে বসে থাকে। পান-সুপারী খায়, নানা কথা বলে। মা রে দেখবা কি সুন্দর করে বাবাকে তাল পাখার বাতাস করে। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পড়িয়ে দেয়। তুমি তো কোন দিন আমাকে একটুও বাতাস করলা না। বড় পাষাণ তুমি। অভিমান প্রকাশের মতো করে বলেছিল মিজান।
: হ দেখছি ত কি হইছে? এখন কি মায়ের মতো আপনের মাথার কাছে বইস্যা বাতাস কইরা দেওয়ন লাগবো নাকি? আমি এইসব পারুমনা। নিজের বাতাস নিজেই কইরা খান। জরিনা বলেছিল।
এসব কথা বলতে বলতে জোরে জরিনার নাক টেনে দেয় মিজান। তাতে মুহূতেই জরিনার নাকের ডগা লাল হয়ে যায়। তার পর হাত ঘোরাতে থাকে স্পর্শকাতর গোপন ঠিকানায়। মিজান জানতো কি করে জরিনার ভেতরের ঘুমন্ত বাঘটাকে জাগিয়ে তোলতে হয়। তা দেখে জরিনাকে আরো নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে মিজান বলে-
: না বউ, তোমাকে এসব করতে হবে না, এমনিই মজা করে বললাম আর কি। আমি বাড়ি আসলে তুমি কেবল সাইজ্জা-গুইজ্জা আমার চোখের সামনে বসে থাকলেই চলবে। বাতাস-টাতাস কিছুই করতে হবে না। তুমিই যে আমার শীতল বাতাস।
: আহ! কত্ত শখ। মানুষের বুঝি খাইয়া দাইয়া আর কাম নাই। ওনার সামনে সাইজ্জা-গুইজ্জা বইসা থাকলেই চলব। জরিনার এ কথায় কপট অভিমান করে মিজান বলে-
: তুমি আমাকে এ কথা বলতে পারলা বউ? তুমি জাননা, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি।
: হেইডাত জানি। জরিনা মুখচেপে হেসে বলে।
তা হলে তুমি এমন কর কেন? বলেই মিজান একটা মেকী গোমড়াভাব ধরে। এতটু পরেই গোমড়া ভাবটা ঝেরে ফেলে দিয়ে বলে-
: বউ একট কথা বলবো?
: বলেন, বলতে মানা করছে কে?
: না, বললে তুমি আবার বিশ্বাস করবে কিনা, তাই ভাবছি।
বিশ্বাস করার মতো কতা হইলে বিশ্বাস করুমনা ক্যান। কি এমন কতা যে আয়োজন কইরা আমারে জিগাইতে হইব। কি কতা কইবেন কইয়া ফেলান।
কথা শেষ হয় না, অমনি হেচকা টানে জরিনাকে জড়িয়ে ধরে মিজান। স্বামীর হাত থেকে ছাড়া পেতে বাইন মাছের মতো মোচরামুরচি করে জরিনা। কিন্তু মিজান জরিনাকে আরো নিবিড়ভাবে আকড়ে ধরে বলে-
: বউ যতই চেষ্টা কর আজ আমি তোমাকে ছাড়ব না। পারলে ছুটে যাও।
জরিনা ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুকেই নিজকে ছোটাতে পারেনা মিজানের শক্ত বাঁধন থেকে। এক সময় রণেভঙ্গ দিয়ে মিজানের ওপর হেলে পড়ে জরিনা। মিজানের গলার স্বরও খাঁদে নামতে নামতে কেমন ভিজে ওঠতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতেই মিজান বলে-
: বউ! আমাদের গার্মেন্টস-এ কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা কাজ করে কিন্তু তারা কেউই তোমার ধারে-কাছে যেতে পারবে না। তুমি হইলা পরী। একেবারে স্বর্গের হুরীদের মতো।
মিজানের এমনসব আবেগমথিত কথায় জরিনার কথাও কেমন জড়িয়ে যেতে থাকে। তার সারা শরীরের কেমন এক অচেনা জোয়ার নামে। অবস হয়ে যেতে থাকে সারা শরীর। জরিনার কথাও জড়িয়ে যেতে থাকে। তবু জরিনা বলে-
: হূর পরী কি, কোনদিন দেখছেন আপনে?
না দেখি নাই। তবে শুনেছি। দেখতে ওরা তোমার মতোই লাল টুকটুকে সুন্দরী। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, হরিণের মতো টানাটানা চোখ। হাসলেই হাসিতে মুক্তো ঝরে। তাদের দিকে একবার তাকালে তার চোখ ফেরানো যায় না। তোমারও তো তাই। মিথ্যা বললাম কোনো? বলেই মিজান জরিনাকে আরো আকড়ে ধরে। জরিনা আর কিছুই বলতে পারে না। চোখ বন্ধ করে আবেগে শুধু শিৎকার করে। কথা জড়িয়ে অস্পষ্ট হতে থাকে। এক সময় আর কিছুই বলতে পারে না সে।

রাত পোহালেই মিজান ঢাকা চলে যায়। আর একটা দিন থাকতে চেয়েছিল মিজান। কিন্তু চাকুরীর কোন ক্ষতি হয়ে যায় বলেই মিজানকে আরও একদিন থেকে যেতে নিষেধ করেছে জরিনা। বউ পাগল লোকটা এমনিই বাড়ি এলে দু’কদিন বেশি বাড়ি থেকে যেতে চায়। এ নিয়ে দু’একবার চাকুরীও গেছে। আবার চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছে। বউয়ের না রাজিতেই মিজান আরও একদিন বাড়ি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাল্টায়। তবে যাওয়ার আগে বলে যায়-
বউ তোমাকে ছাড়া একা একা আর আমার থাকতে ভাল লাগে না। দু’এক মাসের মধ্যে তোমাকে আমি ঢাকা নিয়ে যাব। আর ভাল লাগে না। আর মাত্র কয়টা দিন অপেক্ষা কর। সামনে আমার প্রমোশন হবে। প্রমোশনটা হয়ে গেলেই পাঁচ ছয় হাজার টাকা বেতন বাড়বে। তখন ফ্যাক্টরীর কাছে সুন্দর দেখে একটা বাসা নেব। দুপুরে বাসায় আসবো। তোমার হাতের মজার মজার খাবার খাব। যখন তখন যত খুশি আদর করবো। তখন আর কে আটকায়। স্বামীর কথা শুনে জরিনার মন পাখিটা ভেতরে ভেতরে গান গেয়ে ওঠে। তবু এক অজানিত শঙ্কা পেয়ে বসে তাকে। সে বলে-
: আব্বা-আম্মা কি ঘর গেরন্থি ফালাইয়া আমারে ঢাকা যাইতে দিব। কথা কেড়ে নেয় মিজান-
: কেন দেবে না। নিশ্চয় দেবে। কিভাবে নিতে হয় সে ব্যবস্থা আমি করবো। বলবো মেচে খেতে খেতে আমার অসুখ বিসুখ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছি না। এ কথা বললে মা-বাবা আর অমত করবে না। তাছাড়া সেজান আর তার বউতো বাড়িতে আছেই। সেজানতো আর আমার মতো চাকুরী করে না। দেশেই থাকে ঘর-গেরহস্তি দেখে। বাজারে ব্যবসাও আছে একটা। তাই কোন সমস্যা হবে না। তুমি শুধু কিছু দিন অপেক্ষা কর। তারপর দেখবে আমি কি করি। আর তোমাকে নিয়ে গেলেতো বাড়িতে টাকা পয়সা পাঠানো বন্ধ করে দেব না। এখন যা দিচ্ছি পারলে এর চেয়ে দুই চার’শ টাকা আরো বেশি দেব। দেখবা সব ফক্ফকা।

সেই যাত্রায় মিজানের এমন ক্ষ্যাপা আচরণে জরিনার মনে ভয় ধরে গিয়েছিল; মানুষটা হঠাৎ করে এমন আচরণ করছে কেন। কিন্তু স্বামীর সাথে ঢাকা যাওয়ার কথা মনে হতেই সেই ভয় উবে যেত। ঢাকা যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভাবতো-এত সুখ কি তার কপালে সইবে? সে মনে মনে একটা সাজানো-গোছানো সুন্দর ঘরে স্বপ্ন দেখে। না দেখা ঢাকার রঙিন আলোয় স্বামীকে নিয়ে ঘোরে। সিনেমা দেখে। এসব ভাবনার মাঝেই ভাবে এত সুখ কি তার কপালে আছে? এসব ভাবতে ভাবতেই জরিনা হারিয়ে যায় স্মৃতির এক অরণ্যে।
দেড়বছর আগে তুমুল এক বৃষ্টির দিনে বিয়ে হয় জরিনা ও মিজানের। লেখাপড়া কম জানা মেয়ে হলেও জরিনা খুবই সুন্দরী। তাই মা-বাবাসহ পাড়া প্রতিবেশিরা তাকে জরিনা সুন্দরী বলেই ডাকতো। পরিবারের অবস্থা মোটামুটি ভাল তাদের। কিন্তু জরিনার মা তার পাঁচ বছর বয়সেই মারা গেলে তাদের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার-অমানিশা। এত অল্প বয়সে বউ মারা গেছে, তাই পবিরার ও আত্মীয়-স্বজনের চাপে জরিনার বাবাকে আবার বিয়ে করতে হয়। এরপর সে বড় হতে থাকে সৎ মায়ের সংসারে। গ্রাম বাংলার সৎ মায়েরদের যে গল্প সিনেমা নাটকে যায় সে রকমই ছিল জরিনা তার সৎ মায়ের সংসারে। এক বছর ভালই ছিল, কিন্তু বছর যেতে না যেতেই মায়ের গর্ভে নিজের বাচ্চা আসার পর থেকে জরিনার প্রতি সৎ মায়ের অবহেলার মাত্রা যেন ধীরে ধীরে আরো বাড়তে থাকে। এর পর পাঁচ বছরেই মায়ের ঘরে এলো পাঁচ সন্তান। দুই ভাই তিন বোন। তাদের কোলে করে রাখতে রাখতেই জরিনা লেখাপড়া লাটে ওঠে। মাঝে মাঝে স্কুলে আসা-যাওয়া করলেও লেখাপড়া যাকে বলে তার আর তা হয়ে ওঠেনি। মা তাকে স্কুলে যেতে বারণ করতো। সে স্কুলে চলে গেলে যে তার সন্তানদের দেখার আর মানুষ থাকে না। এভাবে কিছু দিন চললেও একদিন সত্যি সত্যি জরিনার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সংসারে দাদী যতদিন ছিল ততদিন ভালই ছিল জরিনা। তার প্রতি অবহেলা বা মারধর করলেই প্রতিবাদ করতেন দাদী। কিন্তু সে দাদীও একদিন টুপ করে মরে গেল। তখন আর জরিনার সমব্যাথী কেউ রইল না। মায়ের কাছে নালিশ শুনতে শুনতে বাবাটাও একদিন সত্যি সত্যি পর হয়ে গেল। এই করতে করতেই একদিন যৌবন এসে পা রাখলো জরিনার শরীরে।

এরপরই রূপে ও সৌন্দর্যে আমূল বদলে গেল জরিনা। তার দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। চারিদিক থেকে বিয়ের আলাপ আসতে লাগলো। কিন্তু মায়ের আপত্তির কারণে কোন সম্মন্ধই আর পাকা করতে পারে না জরিনার বাবা। মায়ের মতলব হলো জরিনা চলে গেলে তার এতজন সন্তানকে কে কোলে কাঁখে রাখবে। সে কারণেই বিয়েতে সৎ মায়ের কোনো গরজ নেই। বিয়ের আলাপ আসলেও বিয়ে হয়না পিছিয়ে যায়।

এক জৈষ্ঠ্য মাসে খালার বাড়ি বেড়াতে গেল জরিনা। খালাদের বাড়ির পাশের বাড়ির ছেলে মিজান। গার্মেন্টসে চাকুরী করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। জৈষ্ঠ্যের প্রচন্ড গরমে বাতাসের পরশ পেতে খালাতো বোন জুলেখার সাথে মিজানদের পুকুর পাড়ে এসে একটা ছোট গাছে ওঠে বসেছিল দুই বোন। তখন পুকুরের অন্যপাড়ে নিজের হাতে লাগানো নতুন গাছ-গাছলি দেখছিল মিজান। জুলেখা ও জরিনাকে দেখে এগিয়ে আসে মিজান। তাকে দেখে ওরা চলে যেতে চাইলে মিজান বাঁধা দিয়ে বলেছিল-
: কি ব্যাপার চলে যাও কেন। তোমাদেরকে দেখেইতো আমি এখানে এলাম। কি রে জুলেখা আমি কি চলে যাব।
বলেই মিজান অনেকটা বুভুক্ষের মতো তাকিয়েছিল জরিনার চোখের দিকে। সাতপাঁ না ভেবে সে ও কিছু সময় মিজানের চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছিল। যখন বুঝতে পারে এটা কি করছে সে, এক বেগানা পুরুষের দিকে নির্লজ্জের মতো এভাবে তাকিয়ে থাকাটা অন্য রকম অর্থ বোঝায়; তখনই সে চোখ নামি চলে যেতে উদ্যত হলে মিজান বলেছিল-
: ঠিক আছে জুলেখা তোদের যাওয়ার দরকার নাই, আমি চলে যাই।
মিজান চলে যেতে চাইলে জরিনা বলে-
আপনাদের পুকুর পাড় আপনে চইল্যা যাইবেন ক্যান, আমরাই চইল্যা যাই।
মিজান জরিনার এ কথার পিঠে বলেছিল-
: পুকুরটা কার এইটাতো কারো গায়ে লেখা নাই। দেখেন না পুকুরটা আমাদের হইলেও সারা গ্রামের মানুষ পুকুরে আইস্যা গোছল করে। তাই এই পুকুর বা পাড়ে সবারঐ গোসল কার বা ঘুরে বেড়ানোর অধিকার আছে। আর আপনারতো আছে আরো বেশি।
: ক্যান আমার অধিকার বেশি থাকবো ক্যান? জরিনা কথা শেষ করতে পারেনি, অমনি কথা কেড়ে নিয়ে মিজান বলেছিল-
: সুন্দরী মেয়েদের অধিকার সব কিছুতেই বেশি থাকে।
কথাটা শুনে জরিনা খুব ভাল লেগেছিল। কোনো কথা না বলে জুলেখার অলক্ষ্যে মিজানকে ভ্যাংচি কাটে জরিনা। বিয়ের পরে মিজান জুলেখাকে বলেছিল ওই ভ্যাংচি কাটাই নাকি তার জীবনটাকেই ওলট-পালট করে দিয়েছিল।

মিজানের সে দিনই ঢাকা চলে যাওয়ার কথা থাকলেও জরিনার কারণে অফিস কামাই করে আরো দু’দিন বাড়িতে থকে গিয়েছিল মিজান। এই দুই দিনে মিজান ও জরিনার মধ্যে একটা সম্পর্কের বীজ রোপীত হয়। কিন্তু সে বীজের অঙ্কুরোদগম হবে কি হবে কেউ বলতে পারে না। শেষ দিন জুলেখাকে বলে জরিনাকে তাদের বৈঠক ঘরে ডেকে এনেছিল মিজান। কিন্তু সেদিন মিজান তেমন কিছুই বলতে পারেনি। কিছুক্ষণ গল্প-সল্প করার পর মিজান একটি চিরকুট জরিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল-
এটাতে আমার মোবাইল নম্বর আছে, যদি কোনদিন এই দুই দিনের স্মৃতি মনে পড়ে তাইলে আমাকে একটা কল দিও। তাইলেই মনে করব আমার কথা মনে আছে।
চিরকুটটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে জরিনা বলেছিল-
: আমি আপনেরে ফোন করব কিভাবে। আমার কি মোবাইল আছে?
: আইজ কাইল ত নিজের মোবাইল থাকার দরকার পড়ে না বোকা মেয়ে। গ্রামে-গঞ্জে কত জায়গায় কত মোবাইল ফোনে কথা বলার দোকান বা বুথ আছে, সেখানে গিয়ে তুমি আমারে শুধু একটা কল করবা, পরে আমিই তোমারে ঘুরাব আবার।

মিজানের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তার কাছে বার বার কাবু হয়ে যাচ্ছিল জরিনা। শেষ দিন ও আরেকবার কাবু হলো। মিজানের এ কথা হ্যা না কিছুই উত্তর দিতে পারেনি জরি না। কেবর ফ্যাল ফ্যাল করে মিজানের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু এ চাহনীতে মিজান কি বোঝেছিল সেদিন জানতে পারেনি জরিনা। পরে জেনেছিল-এই ফ্যাল ফ্যাল করে চাহনীটাই নাকি ছিল জরিনার ভালবাসা প্রকাশের অন্যরকম ভাষা।

মিজান চলে যাওয়ার পর খালার বাড়িতে আর দু’দিনের বেশি থাকতে ইচ্ছে হয়নি জরিনার। ক্রমশ: তার মনের মধ্যে একটা অচেনা হাহাকার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই হাহাকারে তার ভেতরটা শূন্য থেকে শূন্য, ফাঁপা থেকে আরো ফাঁপা হযে যেতে থাকে। মিজান চলে গেলেও কি এক অদৃশ্য সুতোর টানে যেন বার বার এসেছে পুকুর পাড়ে। যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। কিন্তু জরিনা বুঝতে পারছে না এ জায়গাটা তাকে এত টানছে কেন? কেনই বা এখানটাতে দাঁড়ালে সে মিজানের গায়ের সেই পারফিউমের সেই গন্ধটা পায়। কেনই বা মিজান নামের সেই ছেলেটি তার মনের কোণে যখন-তখন এসে উঁকি দেয়।

বাড়িতে এসেও কিছুই ভাল লাগছিলনা জরিনা। ভেতরে ভেতরে কেমন এক অস্থিরতা কুহুককুন্ডলীর মতো ঘোরে। মা বকাঝকা করলে অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যায়। যে মেয়ে এতদিন অনেক মার ও বকাঝকা খেয়েও প্রতিবাদ করেনি সেই মেয়ে এখন মায়ের কথায় পাল্টা জবাব দেয়। কথা অমান্য করে। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি বাড়ে। বাপও মায়ের সাথে তাল মেলায়। অসহ্য হয়ে ওঠে জরিনার জীবন। এমন অবস্থায় আরো বেশি মনে পড়ে মিজানের কথা। দিনের ভাবনা, রাতের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে মিজান এসে হাজির হয় তার সামনে, কত কথা কত গান শুনিয়ে যায় স্বপ্নের রাজকুমার। লুকোচুরি খেলে যায় সারাবেলা। কখনো চমকে দিয়ে বলে-
: কিগো জরিনা সুন্দরী, কি করো! কি তোমার বৃত্তান্ত খবর।
জরিনা কিছু বলে না কেবল চুপ করে মিজানের কথা শোনে। আবার কখনো বলে-
: এই যে জরিনা বিবি! তুমি কি আমাকে ভালোবাস? আমি যে সেই দিন প্রথম দেখাতেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি গো সুন্দরী।
আবার বলে-
: তুমি আমায় ফোন দেওনা ক্যান, তোমারে মোবাইল নম্বর দিয়া আসলাম। আমি যে তোমার ফোনের অপেক্ষায় সব সময় মোবাইলের দিকে চাইয়া থাকি। জরিনা একা একা হাসে, বিরবির করে। বলে-আস্তা পাগল একটা।
জরিনার মনের এ অবস্থা চলে কয়েকদিন। সে আর নিজকে বশে রাখতে পারে না। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় মন।

একদিন ঠিকই কাউকে কিছু না বলে সাহস করে চলে যায় তাদের বাড়ির কাছেই বাজারে। বাড়ির এত কাছে এতবড় বাজার থাকলেও কোন দিন বাজারে ঢোকেনি জরিনা। হয়তো কোথাও আসা-যাওয়ার পথে দূর থেকে দেখেছে বাজারের দোকানপাট। এত বড় বাজারে মোবাইল কলের দোকান খুঁজে খুঁজে সে অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলে। কেউ নেই। গ্রামের বাজার। সকাল দশটার মধ্যে বাজার ভেঙে সুনসান হয়ে যায়। আবার বিকেল বেলায় বাজার জমে। এখন বাজারে দু’একটা দোকান খোলা। এ গলি ও গলি ঘুরে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায় ফোন কলের একটা দোকান। আশেপাশে কেউ আছে কিনা সন্তর্পনে পরখ করে নেয় জরিনা। শুধু দোকানী কিশোর ছেলেটা পাশের দোকানের ছেলেটার অলস খুনসুটি করছে। জরিনা ঢুকেই মিজানের মোবাইল নাম্বারের টোকাটা ছেলেটাকে দিয়ে বলে- এই নম্বরটায় লাগাওতো দেখি ভাই! ছেলেটা মোবাইলের কিপ্যাড টিপে সংযোগ স্থাপন করে জরিনার দিকে সেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে-
: নেন আফা; কথা কন।
ফোনের অপর প্রাপ্ত থেকে মিজানের কন্ঠস্বর শুনে জরিনা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে সহসাই কিছু বলতে পারে না। দোকানী ছেলেটি দাঁড়িয়ে বলে-আফা, কতা শেষ হইলে, লাল বোতামটা টিপ দিয়া বন্ধ কইরা দিয়েন, আমি একটু পাশের দোকান তাইক্যা আই। বলেই ছেলেটি বেরিয়ে যায়।
অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো হ্যালো করে মিজান। জুলেখা খালী চেয়াটায় বসতে বসতে বলে-
: হ্যালো, আমি... বলেই চুপ করে থাকে জরিনা। অপর প্রান্ত থেকে মিজান বলে-
: আরে- আমি কে?
: কনতো আমি কে। মিজানও হঠাৎ করে থেমে যায়। তার পর কেমন ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে-
: আরে না বললে, আমি জানবো কিভাবে আপনি কে। জরিনা আর ভনিতা না করেই বলে-
: আমি জরিনা।
: জরিনার কন্ঠ শোনে মিজানও যেন হঠাৎ করে কিছু বলতে পারেনা। কিন্তু মুহূর্তেই নিজকে গুছিয়ে নিতে সময় লাগে না চটপটে মিজানের। তার কন্ঠে তখন হাজারো বিস্ময়!
: আরে তুমি! আমিতো নিজেরেই বিশ্বাস করতে পারছিনা যে তুমি আমারে ফোন করছো। কার ফোন থাইক্যা ফোন করছো?
: বাজারের দোকান থাইক্যা। আপনে ভালা আছেন?
: আমি ভালা আছি, এখন তোমার খবর কও।
: আমার আবার কি খবর! আমার মতো মানুষের খবর থাকেনি কোনো। আমি হইলাম গিয়া গেরামের মূর্খসুর্খ মানুষ। খাই-দাই ঘুমাই এই আর কি। আপনের খবর কন, আপনের শরীল-মন ভালা?
: শরীল ভাল। কিন্তু মন ভাল ছিল না এই কয় দিন।
: ক্যান, মনের আবার কি হইল? কোন সমস্যা? জিজ্ঞেস করে জরিনা।
: না কোন সমস্যা না।
কথাটা বলেই মিজান থেমে যায় যায়। এ প্রান্ত থেকে জরিনা জিজ্ঞেস করে-
: কি হইছে? কতা কন না ক্যান?
: কিছুই হয় নাই। তবে সেই দিন তোমারে দেইখ্যা আসার পর থেকে মনটা কেমন জানি অস্থির অস্থির করে। কোন কিছুই ভাল লাগে না। চোখ বন্ধ করলেই কেবল তোমারে দেখি। কাজে-কর্মে মন বসেনা। আমি জানি কেমন হয়ে গেছি।
মিজানের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে হাসে জরিনা। এ হাসির শব্দ তার নিজের ভেতরই অনুরণিত হয়ে কেমন এক ভাললাগার শীতল ষ্পর্শ তার মন ছুঁয়ে যায়। এই ফাঁকেই মজান বলে-
তুমি ফোন রাখ। আমি ঘুরাই।
জরিনা বাধা দিয়ে বলে-
: না ঘুরাইবার দরকার নাই। কি কইতে চান কন।
বলতে বলতেই অপর প্রান্ত থেকে মিজান লাইন কেটে দেয়। জরিনা যখন ফোন নামাতে যাবে ঠিক তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। জরিনা গ্রামের মেয়ে হলেও বেশ বুঝতে পারে এটা মিজানেরই ফোন। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে মিজানের কন্ঠ ভেসে আসে-
: জরিনা। তুমি কি আছ? জরিনার মাথায় তখন দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়। সে গলার স্বর পাল্টে বলে-
: কে আপনে? এখানে জরিনা নামের কেউ নাই।
: কেন, এই মাত্র তো সে আমার সাথে কথা বলল।
: জ্বে। সে চইল্যা গেছে।
মিজানের মনে এক ধরনের হতাশা ভর করে। গলাটা কেমন শুকিয়ে যায়। কিন্তু এই প্রান্ত থেকে যে লাইন কাটে নাই তা মিজান এটা বুঝেও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে-
: ঠিক আছে। রাখি ভাই। আপনাকে বিরক্ত করলাম।
মিজানের ফোন রাখার কথা শুনেই জরিনা, মুহূর্তেই আবার গলার স্বর পাল্টে বলে-
: রাখবেন মাইনে। কি কইবেন কন।
জরিনার কন্ঠ শোনে যেন মিজানের মনে পুষ্পবৃষ্টি নামে। হাসতে হাসতে মিজান বলে-
: আরে দুষ্টু মেয়ে। তুমি আমাকে বোকা বানিয়ে ফেললে। আমিতো ধরতেই পারি নাই যে এটা তোমার স্বর পাল্টানো গলা। তুমিতো আমায় একেবারে ঘাবড়ে দিয়েছিলে।
মিজানের কথায় শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে হাসলেও অপর প্রান্ত থেকে মিজান জরিনার হাসির গমক শুনতে পায়। সে বলে-
আমাকে বোকা বানিয়ে খুব হাসা হচ্ছে না! যদি তোমাকে এখন কাছে পাইতাম...। বলেই মিজান থেমে যায়। জরিনা ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-
: কাছে পাইলে কি করতেন?
: লবণ-মরিচ দিয়া চিবাইয়া খাইতাম। মিজানের কথা শোনে জরিনা নিজে নিজেই ভেংচি কেটে বলে-
: আহারে! শখ কত। কেউ জাইনো তেনারা গাল পাইত্যা দিয়া বইস্যা থাকত। এভাবে আরো কিছু কথা বলার পর দোকানী ছেলেটি আসছে দেখে, জরিনা ফিসফিসিয়ে বলে-
এখন রাখি। দোকানের ছেলেটা আসতাছে। আরেক দিন ফোন দিমু। বলতে বলতেই জারিনা ফোন কেটে দেয়।

এরপর থেকে দু’জনের মধ্যে ফোন আলাপ জমতে জমতেই, মিজান তার বাবাকে দিয়ে জরিনার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। জরিনার বাবাও এমন চাকুরীজীবী ছেলে পেয়ে সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। কোন এক শুভ দিনে মিজান জরিনাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেয়। এরপর বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জরিনার জীবনে ঘটে যায় মহাপ্রলয়।

মিজান চলে যাওয়ার মাস খানেক পরই জরিনার চলাফেরা খাওয়া-দাওয়ায় দিন দিন পরিবর্তন হতে লাগলো। ফোনে মিজান এ সংবাদটি পেয়ে জরিনার জন্য নানা উপহার নিয়ে বাড়ি চলে এসেছিল। সে বাবা হতে চলেছে এ সংবাদ পাবার পর খুশিতে যেন সে হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছিল। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহেই মিজান বাড়ি চলে আসতো। কিন্তু দুর্ঘটনার আগের দুই সপ্তাহ কাজের চাপে মিজান বাড়িতে আসতে পারেনি। তবে ফোনে জানিয়েছিল বাসা ভাড়া নেয়ার খবরটি। এরপরই একফালি রঙিন স্বপ্ন জরিনার মনের আকাশে জমাট বাঁধতে শুরু করলো। ঘটনার আগের রাতেও মিজান বউয়ের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইল ফোনে আলাপ করেছে। সংলাপে সংলাপে সাজিয়েছে একটা সুন্দর সংসার। মিজানের শেষ কথা ছিল-
: বউ আর কয়টা দিন ধৈর্য ধর, সামনে শুধু তোমার সুখের দিন। আমাদের প্রমোশনের লিস্ট এমডি স্যারের টেবিলে গেছে। স্যারের দস্তখত হয়ে গেলেই আমাকে আর পায় কে। তখন আমি হয়ে যাব কোয়ালিটি কন্ট্রোলার। আমাদের ফ্যাক্টরীর পাশেই একটা বাসা দেখেছি। দুই রুমের বাসা। এটাচ বাথ, দক্ষিণে একটি বড় বারেন্দা। সেখানে বসলেই দেখা যায় সামনে বিশাল বিস্তৃত খোলা প্রান্তর। সেই খোলা মাঠের সব বাতাস যেন এসে ঢুকে ঘরটাতে। আর চাঁদনী রাতে এখানে বসে দু’জন জোসনায় সাঁতার কেটে কেটে হারিয়ে যাব কোন এক স্বপ্নের রাজ্যে। স্বামীর এমন স্বপ্নিল কথা শুনে জরিনা আর কিছু বলতে পারেনি। সে শুধু হু বলে মিজানের কথায় সায় দিয়েছিল।


কিন্তু সেই স্বপ্নটা জমাট বাঁধার আগে এক ফুৎকারেই জরিনার সব সাজানো স্বপ্ন ভেঙেচুড়ে খান খান হয়ে গেল। ঘটনার দিন বিনা মেঘে বর্জ্রপাতের মতো সেই দুঃসংবাদটি এলো। জরিনা তখন রান্না ঘরে ছিল। টেলিভিশনে খবরটা দেখেই সেজান হন্তদন্ত হয়ে হয়ে রান্না ঘরে ছুটে গিয়ে হাফাতে হাফাতে বলে-
: ভাবী হুনছেন, যেই বিল্ডিং-এ ভাইয়ের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী সেই রানা প্লাজার বিল্ডিংটা ভাইঙ্গ্যা মাটির সাথে মিইশ্যা গেছে। কত লোক যে মারা গেছে কেউ কইতে পারতাছে না। টিভিতে সব দেখাইতেছে, আসেন, দেইখ্যা যান আইস্যা।

সেজানের কথা শুনে জরিনার পৃথিবীটা হঠাৎ করেই যেন উল্টে গেল। চোখের দৃষ্টি ঝাপ্সা থেকে ঝাপ্সা হয়ে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যেতে থাকে। তবু জরিনা সর্বশক্তি দিয়ে নিজকে টেনে নিয়ে আসে বড় ঘরের ভেতরে। সব চ্যানেলেই রানা প্লাজা ধ্বংসের চিত্র ও প্রতিবেদন দেখাচ্ছে। সেখানে মানুষের কান্না আর আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠছে। বিশেষ বুলেটিনে বলছে-তিনতলা পর্যন্ত রানা প্লাজা মাটির মধ্যে দেবে গেছে। মিজানতো তিনতলাতেই কাজ করতো। তবে কি...। জরিনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। মাথাঘুরে সে মাটিতে পড়ে যায়। ঘরের ভেতর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সবার চিৎকার ও কান্নাকাটি শুনে আসপাশের বাসিন্দা ও প্রতিবেশিরা এসে হাজির হয়। তখন কা’কে আর কে শান্তনা দেবে।

জরিনা শরীরের এ অবস্থা নিয়েও স্বামীর অবস্থা জানতে ঢাকা চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাড়ির কেউ তাকে যেতে দেয়নি। সেজান চলে গিয়েছিল ভাইয়ের খোঁজে। ভাইকে ধ্বংসস্তুপের মাঝে খোঁজতে খোঁজতে সেজানও নিজের অজান্তেই হয়ে ওঠে একজন উদ্ধারকর্মী। প্রথম দিকে কারো হাত, পা, মাথা ঘুড়িয়ে যাওয়া আহত মানুষ উদ্ধার হলেও দিন যত বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল ততই দীর্ঘ হতে থাকে। এসব দেখে দেখে প্রথম প্রথম মুর্ছা গেলেও জরিনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি তার মিজান মরতে পারে। সে আশায় বুক বেধেছিল। হয়তো ধ্বংসস্তুপের কোথাও না কোথাও মিজান বেঁচে আছে। উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হওয়ার ঠিক আগে আগে রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করতে দেখে জরিনা, মিজানের মা-বাবা পরিবারের সবাই মনে আশা জেগেছিল তাদের মিজানও হয়তো এভাবেই রেশমার মতো একদিন অক্ষত দেহে উদ্ধার হবে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন আর আশা আর পূরণ হয়নি। একদিন সত্যি সত্যি জরিনাকে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তায় ডুবিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণার সাথে সাথে জরিনা ও তার পরিবারের সকল আশা-আকাঙ্খা ধূলোয় মিশে গেল। সেজান, ভাই হারানোর বেদনায় একজন পাথর মানুষ হয়ে ফিরে এলো বাড়ি।

তারপরও জরিনা আশা ছাড়েনা। তার বিশ্বাস মিজান একদিন ফিরে আসবেই। তার ভেতরে স্বপ্নের বীজ বপন করে দিয়ে মিজান কিছুতেই এভাবে চলে যেতে পারে না। সে অপেক্ষায় জরিনা তার ভেতরের মিজানের স্বপ্নকে তিল তিল করে বড় করে তুলছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.