![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাহবুবুল আলমের জীবন সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত জন্ম ও বংশ: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ মাহবুবুল আলম, ১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারী, কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলাধীন হাইধন কান্দি গ্রামের সম্ভ্রান্ত মোল্লা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও স্বনামধন্য শিক্ষক সাহেব আলী মাস্টার, মা বিদুষী গৃহিনী রাবেয়া খাতুনের নয় সন্তানের মধ্যে মাহবুবুল আলম তাঁদের ষষ্ঠ সন্তান। শিক্ষা: স্থানীয় ইসলামাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, পাঁচ পুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, নিমসার জুনাব আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, তেজগাও কলেজ থেকে বি.এ ও এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। লেখালেখি: সত্তর দশকের গোড়ার দিকে তিনি সিলেট সমাচার, যুগভেরী, বাংলার বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকা সাময়িকীতে ছড়া, কবিতা গল্প ফিচার লিখে তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটান। সাথে সাথে সাহিত্যাঙ্গণের সম্পাদক হিসাবে মৌলভীবাজারের সমসাময়িক সাহিত্যানুরাগীদের মুখপাত্র সাহিত্যের কাগজ ‘প্রসূন’ সম্পাদনা করেন। একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে দেশের শিক্ষা বিস্তারেও তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, সেই লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন-সানমুন ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজ, হলিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মিশো মিউজিক কেয়ার প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা: ৩৮। উপন্যাস-৮, কাব্যগ্রন্থ-৯, ছড়ার বই-৩, কলাম সমগ্র-৫, নাটক-৭, গবেষনা-২, শিশুতোষ-২, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-২টা। পুরষ্কার: সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি কবিতাঙ্গন এ্যাওয়ার্ড (২০০৭), ড.মমিনুল হক একাডেমি ইউ.কে এ্যাওয়ার্ড (২০০৮) সংশপ্তক বঙ্গবীর ওসমানী পদক, অলইন্ডিয়া চিলরেন্ড লিটারারী ফউন্ডেশন ‘উৎপল হোমরায়’ স্মৃতি পুরস্কার-২০১২ ও ভারতের পূর্ব মেদিনীপুরের কবি ও কবিতা পত্রিকা সন্মাননা-২০১২, দুইবাংলা কবিতা উৎসব সন্মাননা-২০১৩, সাপ্তাহিক কালপুরুষ পত্রিকা সন্মাননা-২০১৩সহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
আজ ছুটি নিয়ে বিকেলের মধ্যেই অফিস থেকে বাসায় এসে পড়ে মেহমুদ। বাসায় পৌঁছে হাত-মুখ ধূয়ে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে। শীতের এই শেষ বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে সূর্যডুবা দেখছে সে। কতদিন যে হয়ে গেল সূর্য ডুবা দেখেনা তা এ মুহুর্তে মনে করতে পারছে না মেহমুদ। সূর্য বাহাদুর ডুবার আগে রঙের বর্ণময়কারুকাজে যে ভাবে পৃথিবীকে রাঙিয়ে যায় সে দৃশ্যটা কখনো মোহনীয় কখনো সহস্যময় করে তুলে পরিবেশকে। তাই যখনই সে সুযোগ পায় তখনই সূর্যডুবা দেখতে ভুল করে না কখনো। সেটা বাসা, খোলা প্রান্তর বা সমুদ্রেই হোক। এখন যেন কমলা রঙের হাওয়াই মিঠাইর মতো কুয়াশা ঢেকে দিচ্ছে দিগন্ত রেখা। আর এর ওপর সূর্যরশ্মি পড়ে কেমন ধূসর রঙ ধারণ করেছে।
গোধূলী বেলার সূর্যের আলো মেরমেরে মরামরা নিস্তেজ লাগছে এ মুহূর্তে । কেমন একটু শীত শীত লাগছে তার। হঠাৎ করেই যেনো ঠান্ডার একটা তীব্র কামড়ে তার শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। হাতমুখ ধোঁয়ার পর একটা টি-শার্ট ছাড়া গায়ে আর তেমন কোনো গরম কাপড় নেই। তবু ছাদে আরো কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকে মেহমুদ। বাসার ছাদের এক পাশে টবে মৌসুমী ফুলের একটি বাগান করেছে সে। দেশি-বিদেশি ফুলে ফুলে বেশ ভরে ওঠেছে বাগানটা। ফুল গাছগুলোতে নিজ হাতে ওয়াটারিয়ং ক্যান দিয়ে পানি দিয়ে অন্য পাশটাতে এসে দাঁড়ায়।
শহরের যে প্রান্তে তাদের বাড়িটি, তার ক্ষাণিকটা পাশ ঘেসেই বয়ে গেছে একটা নদী। শীত এলে অনেকটাই শুকিয়ে যায়। তখন এটিকে রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’র মতো মনে হয়। হাঁটু পানি ভেঙ্গে দূরগায়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা পারাপার হয়। যারা খেয়া পার হয়ে বা ঘুর পথে যেতে না চায়, তারা ক্ষানিকটা পানি ভেঙ্গে নদীটি পার হয়।
এখনো দিনের আলোটা একেবারে মিলিয়ে যায়নি। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আগ্রাসি অন্ধকার ঢেকে দেবে দৃষ্টিবদ্ধ সব কিছু। সেই সুযোগে বিক্ষিপ্ত ভাবনারা এসে জড়ো হয় তার মনের গহীন গহনে। কয়েকদিন ধরে ভীষন ব্যস্ততা গেছে তার। অফিসে কাজের খুব চাপ গেছে। আজ সেই চাপ কিছুটা কম থাকাতে একটু আগেবাগেই বাসায় চলে এসেছে।
অফিস ছুটি হয়ে গেলে সরাসরি বাসায় চলে আসে সে। বাইরে কোথাও কোনো আজেবাজে আড্ডায় যায়না। যাকে বলে একেবারে ঘরমুখো সুবোধ ছেলে। এই নিয়ে বন্ধুরা অনেক ঠাট্টা ইয়ার্কী করে তাকে। বন্ধুদের এসব ঠাট্টা ইয়ার্কীতে মোটেও কানে তোলেনা সে। তার ভাবনায় সারাক্ষণ একজনই। সে হলো মৌসুমী। যার জায়গায় মেহমুদ আজো কাউকে স্থান দিতে পারেনি।
মেহমুদ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে নদীটির দিকে। এতদিনের এই পরিচিত দৃশ্যটি আজ কেনো জানি তার কাছে অপরিতি বলে মনে হয়। শীতের তীব্রতা আরো ক্ষাণিকটা বেড়েছে। মেহমুদ নিচে নেমে, ঘরের ভেতর ঢুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ে মেরুন রঙের একটা গলা বন্ধ স্যুয়েটার জড়িয়ে আবার ছাদে এসে একটা বেতের গার্ডেন চেয়ার টেনে বসে। স্যুয়েটার গায়ে জড়ানোর পর শীতটা যেন এ মূহুর্তে উদাও হয়ে গেছে। এখান থেকেই দেখা যায় মৌসুমীদের বাড়ির লম্বা জোড়া তালগাছ। দেখা যায়, মসজিদের মিনারের চুড়া। দূর গাঁ মনে হলেও তেমন দূরে নয়।
মৌসুমীদের বাড়ির পাশেই মুন্সি কেরামত আলী ইউনিভারসিটি কলেজ। সেই কলেজ থেকেই মেহমুদ দর্শনে অনার্স ও মাস্টার্স করেছে। ঢাকা সিটি থেকে বাসে মাত্র ত্রিশ মিনিটের পথ রূপগঞ্জ। ঢাকা সিলেট হাইওয়ের অনতি দূরেই একদশক আগে গড়ে ওঠেছে একটি নতুন শহর। খুব দ্রুতই উন্নয়ন ঘটে এ শহরটি। সেখানে যেমন আছে ঢাকার আধুনিতকতার ছোঁয়া তেমনি আছে গ্রামীণও একটা পরিবেশ। তাই এ অঞলটাকে রাজধানীর বর্ধিতাংশও বলা যায়। তবে এখনো এখানে সুউচ্চ লালান কোঠা গড়ে ওঠেনি। তবে যে ভাবে রিয়েল স্টেট ও ডেভলাপার ব্যবসার নামে ভূমি দস্যুরা এ অঞ্চলেও তাদের থাবা বিস্তার করছে এ নদীটিও হয়তো একসময় দখল হয়ে যাবে। হাইরাইচজ বিল্ডিং-এ ঢেকে যাবে মৌসুমীদের বাড়িটিও। কিন্তু মৌসুমী হারিয়ে যাবে না। মেহমুদের মন থেকে। পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে এলে নিচে নিজের রুমে চলে আসে মেহমুদ। মা এসে চা দিয়ে যায়। চা শেষ করে মৌসুমীকে নিয়ে সে তার স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকে।
মেহমুদ যখন মাস্টার্স ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্র তখন তাদের কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পড়ে মেহমুদের ওপর। সে খুব ভালো আবৃত্তি করে। একজন আবৃত্তিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে কলেজে মেহমুদের খুব নামডাক। ছাত্র হিসাবে ছিল সে খুবই মেধাবী। অনার্সে সে সেকেন্ডক্লাস সেকেন্ড হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সে অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। তবে মেহমুদ প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে একটি প্রস্তাব তুলে ধরে বলে-
স্যার আমিতো অনুষ্ঠান পরিচালনা করবো ঠিক আছে; তবে উপস্থাপনায় একজন মেয়ে থাকলে উনুষ্ঠানের নান্দনিকতা ও ডিগ্নিটি আরো বাড়বে বলে আমার মনে হয়।
মেহমুদের কথা শুনে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন-
মেহমুদ এটা তোমার খুব ভালো প্রস্তাব। আমার কলেজে প্রায় হাজার খানেক মেয়ে আছে, সেখান থেকে তুমিই একজনকে খুঁজে বের করো। নিশ্চয়ই এদের মধ্যে কারো এ ধরণের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে পারে।
স্যারের নির্দেশ পেয়ে মেহমুদ বেশ কিছু মেয়েকে ডেকে এনে তাদের অডিশন নেয়। এর মধ্য থেকে বেছে নেয় সে মৌসুমীকে। ও দেখতে যেমন সুন্দরী, তার কন্ঠস্বরও তেমন মধুর। একটা স্কীপ্ট তৈরি করে দিয়ে একটা রিহ্যারসাল ও নিয়েছে। সেখনেও উৎরে গেছে মৌসুমী। তার উপস্থাপনার ধরণ, এক্সপ্রেশন খুুবই ইমপ্রেস করে মেহমুদকে। মৌসুমী যখন উপস্থাপনার ঢঙ-এ স্ক্রীপ্টটি পড়ছিল; সেময় মন্ত্রমুগ্ধের মতো মৌসুমীর দিকে তাকিয়েছিল মেহমুদ। মৌসুমীও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। যদিও মেহমুদ; কলেজের ভাষায় বড়ভাই সে হিসাবে আগে থেকে তাকে মান্য করলেও তার প্রতি একরকম দুর্বলই ছিল মৌসুমী। সে ছিল অনার্স থার্ড ইয়ার আর মেগমুদ মাস্টার্স ফাইন্যাল ইয়ারের। শুধু সে কেন কলেজের অনেক মেয়ে মেহমুদের সাথে একবার কথা বলতে পারলেই ধন্য মনে করতো। কেননা সে ছিল সবার প্রিয় মেহমুদ ভাই। যেমন ছাত্র, তেমন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিবেদিত এক ধরণের নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। আজ যেন ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’কথাটির মতো মৌসুমী মেহমুদের কাছাকাছি আসার সুযোগটি পেয়ে যায়। আর অন্য মেয়েরা মৌসুমীর প্রতি হিংসার আগুনে ˜গ্ধ হচ্ছিল পুড়ে পুড়ে। সেও রিহ্যারসালের সময় আড়চোখে মেমুদকে দেখেছে কয়েকবার। রিহ্যারসালের সময় প্রিন্সিপালসহ অধ্যাপক, সহঅধ্যাপক, প্রভাষকসহ সবাই মুগ্ধ হয়েছিল মৌসুমীর উপস্থাপনায়।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তো মেহমুদকে পিট চাপরে বলেই ফেললেন-
তুমি দেখছি এক জিনিয়াস মেয়েকে সিলেক্ট করছো হে মেহমুদ। একেই বলে ‘রতনে রতন চিনে’। ঠিক আছে চালিয়ে যাও। দু’দিন পরেই ফাইন্যাল অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের দিন মৌসুমী সুন্দর দুইটি টকটকে লাল গোলাপ রিবনে সুন্দর করে বেঁধে সবাই অনুষ্ঠানে আসার আগেই মেহমুদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল-
নিন! এটা আপনার জন্য।
মেহমুদ ফুল দুটি হাতে নিতে নিতে নিয়ে বলেছিল-
বাহ্! খুব সুন্দরতো। তো একটা কথা আছে।
মৌসুমী জানতে চায়-
কি কথা?
এই যে, আমি তো একা। ফুল কেন দুটো? মেহমুদ হাসতে হাসতে বলেছিল। কথার পিঠে মৌসুমী ও কোনো রাখঢাক না রেখে বলেছিল
এ সব পুরুষদের বুঝে নিতে হয়।
ও তাই।
মেহমুদ যে একসাথে বাঁধা জোড়াফুল উপহার দেয়ার অর্থ বুঝেনি তা নয়। সে একটু মৌসুমীকে বাজিয়ে নিতেই কথাটা বলেছিল।
অনুষ্ঠান শেষে আরো নামডাক বাড়লো এ দুই জুঁটির।
মৌসুমীর অন্তরঙ্গ বন্ধুরা তো এ নিয়ে রঙ তামাশা করে বলতো-
মৌসুমী তোর ও যা কপাল। একেবারে কাতলাটাই হাসিল করে নিলি।
সেও বান্ধুবীদের কথার জবাব দিতো দুষ্টুমির সুরেই-
ধরলে পুটি-পাটি না, কাতলাই ধরতে হয়।
তখনও মোবাইল আজতের মতো এতো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। এখন যেমন স্কুল কলেজের ছেলেমেদের হাতে হাতে মোবাইল থাকবেই তখন তেমনটি ছিল না। তাই কলেজে এসেই তাদের দেখা হতো, মাঝে মাঝে কথা হতো, তা না হলে চোখে চোখে কথা বলা তো ছিল অনিবার্য। আর মাঝে মাঝে খুব সাবধানে চালাচালি করতো চিরকুট।
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই একজন থেকে অন্যের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। এম.এ পাশ করার সাথে সাথেই চাকুরী হয়ে যায় মেহমুদের। এর কিছুদিন পরেই মৌসুমীর বাবাও রূপগঞ্জ থেকে সেই বান্দরবানে বদলী হয়ে যায়। মৌসুমীরা রূপগঞ্জ থাকতে ছুটি-ছাটায় যাও দ’ুজনের কখনো সখনো দেখা হতো; তাও বন্ধ হয়ে গেল তাদের বদলীর কারণে।
তবে একদিন ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয় তাদের প্রতি। বছর তিনেক পরে মৌসুমীর বাবা অনেক চেষ্টা তদবীর করে, টাকা ঢেলে আবার সচিবালয়ে বদলী হয়ে আসে। বান্ধবীদের মাধ্যমে পাত্তা লাগিয়ে মৌসুমীই খুঁজে বের করে মেহমুদকে। সেশন জটের কারণে মৌসুমী অনার্স করে বেড়–তে বেড়–তে এই তিন বছর চলে যায়। সে এখন এমবিএ করছে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। মতিঝিলে হঠাৎ করেই একদিন মৌসুমী গিয়ে হাজির। তাকে দেখে মেহমুদ অনেকটা ভূত দেখার মতোই চমকে ওঠে বলে-
আরে তুমি! কোত্থেকে? কিভাবে? আর কার সাথেই বা এসেছো?
একসাথে অনকগুলো প্রশ্ন করে বসে সে।
মৌসুমী স্মিত হেসে বলে-
একটা একটা করে প্রশ্ন করেন। তারপর জবাব দিই।
আমি আপনাকে খুঁজে পেতে অমনি হাঁফিয়ে ওঠেছি।
ও স্যরি। বিনয়ের ভঙ্গিতে মেহমুদ বলে।
ওকে। নো এক্সকিউজ। আমি মজা করছিলাম। একগ্লাস পানি হবে?
না, পানি না। চল বাইরে যাই। সেখানে গিয়ে একসাথে বসি। এখানে দেখ না ফ্লোরের সবাই কেমন তোমাকে গিলছে। সবাই গিলে ফেললে, আমার ভাগে তো কিছুইথাকবে না।
ওকে। যাওয়া যায়। নামতে নামতে মৌসুমী বলে-
খুব তো বলছেন এখন। এই যে তিনটা বছর গেল। একবারের জন্যও তো এই মৌসুমীর খোঁজ করেননি। নিশ্চয় এতোদিনে মৌসুমীর শূন্যস্থান পূরণ করে বসে আছেন।
নামতে নামতেই একটা তোপখানার উদ্দেশ্যে রিক্সায় ওঠে। রিক্সায় বসতে বসতে মেহমুদ বলে-
সারা জীবন ও যদি তোমাকে খুঁজে না পেতাম। তাহলে সে শূন্যস্থানে কাউকে বসাতাম না।
আমাকে সামনে পেয়ে এসব ঢঙ।
বিশ্বাস করো। এই যে দিব্যি। সে মৌসুমীর মাথা ছুঁতে যায়।
আরে! পাগলের কান্ড দেখ! রাস্তাঘাটে এসব কি করছে। মৌসুমী বলে।
তবে যে, তুমি বললে,
বলবো না। আমিতো ভেবে বসে আছি হয়তো তুমি এতদিনে ঘরসংসার সাজিয়ে বসে আছো। তবে আমারও একটা প্রতিজ্ঞা ছিল যদি তোমাকে কোনোদিন না পাই তা হলে জীবনে আর বিয়ে করবো না।
দেখো দু’জনের কি মিল। আমিও তো তাই ভেবেছি। মৌসুমীর তিদে তাকিয়ে মেহমুদ বলে।
মৌসুমী তখন বলে চলেছে-
কিন্তু ঢাকা এসে তোমাদের এলাকায় গিয়ে বকুলকে খুঁজে বের করলাম। তার কাছ থেকেই তোমার খোঁজ খবর নিলাম। জনলাম তুমি বাড়ি থেকেই রোজ অফিস করো। বকুলকে ফোন করে কালেক্ট করলাম তোমার অফিসের ঠিকনা। আজ আজই এসে পাকরাও করলাম। তোপখানায় এসে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে ‘ধানসিঁড়িতে’ একটা কর্ণারের ক্যাবিনে এসে বসে দু’জন। তারপর খাওয়ার সাথে সাথে এতদিনে জমানো কথা। যেন শেষই হতে চায়না।
দু’জনের মধুর মিলনে প্রাণফিরে পায় আবার দু’জন। রাত জেগে জেগে চলে ডিজুস প্রেম। কিভাবে সংসার পাতবে। কেমন করে ঘর সাজাবে। এমনকি বাচ্চা-কাচ্চার প্রসংগ ও বাদ যায় না। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট ঘুরে ঘুরে চলে খাওয়া-দাওয়া আর জম্পেশ আড্ডা। আজও দুপুরে কস্তুরীতে দুপুরের খাবার খেয়েছে তারা।
তবে আজ তার মনটা বিক্ষিপ্ত হওয়ার একটা কারণও ঘটেছে। কয়েকদিন যাবত একটা আননোন নাম্বার থেকে প্রায়ই একটি মেয়ে ফোন করে। ফোন করে খুব মিষ্টি করে নানা ধরনের কথা বলে। কিন্তু মেয়েটি তার পরিচয় দিতে নারাজ। দু’দিন আগে অফিস চলা অবস্থায় কাজের খুব চাপের মাধ্যেও মেয়েটি ফোন করে বলে-
কেমন আছেন মেহমুদ সাহেব?
মেহমুদ কথাটার কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। এত ঝামেলার মধ্যে ফোন করাতে মনে মনে খুবই বিরক্ত হয় সে। কিন্তু হুট করে ফোনটাও ডিসকানেক্ট করে দিতে পারে না।
মেয়েটিই আবার বলে-
কী সাহেব একেবারে চুপ মেরে গেলেন যে, কোনো সমস্যা?
হ্যা। সমস্যা আছে। এখন রাখি।
রাখবেন কেনো? আমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগে না।
না ভাল লাগে না। আর অপরিচিত কোনো মেয়ে মানুষের সাথে কথা বলা আমি মোটেই পছন্দ করি না। কথাটা শেষ করে নিজের কাছেই মেহমুদের কেমন চাছাছোলা মনে হয় উত্তরটা। কিন্তু মেয়েটিও নাছোর বান্দা। সে ঝটপট বলে-
পরিচয় নেই তো কি হয়েছে। আর পরিচয় দিয়ে দিলেই তো সব রহস্য শেষ। তাই আমি আপাতত পরিচয় দিতে মোটেই ইচ্ছুক নই। তবে ফোনে যেহেতু টুকটাক কথা হয়। পরিচয় তো একদিন হতেই পারে। নাকি পারেনা। এতো তাড়াহুড়োর কী আছে। মনে হয় একবারে তর সইছে না।
আরিফ অনেকটা রাগের সঙ্গেই বলে-
কিসের তর সইছেনা বলছেন?
এই যে পরিচিত হওয়ার।
না, মোটেই না। আপনার এ ধারণা ঠিক নয়।
আপনার কোনো বন্ধবী নেই?
বিরক্তির সুরে আরিফ বলে-
না, তা ও নেই।
আপনার মতো এতো হ্যান্ডসাম, তা ও আবার ভাল মাইনের সরকারী কর্তা তার বান্ধবী থাকবেনা। এক দু’জন প্রেমিকা থাকবে না এটা কি বিশ্বাস করা যায়?
বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার, যা সত্যি আমি তা ই বলছি।
তা হলে ভালোই হলো।
কেন ভালো হলো?
এই যে আমার ঝুলে পড়ার সুযোগ রইলো।
সে সিকেও ছিড়বেনা।
তা হলে কার ভাগ্যে ওই সিকে ছিড়বে।
তাও কী আপনাকে বলতে হবে।
না, তা বলছি না।
তো আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?
না জানতে চাচ্ছিলাম আপনার সাথে যে মেয়েটি এখন জুটেছে তার সাথে সম্পর্ক টিকবে তো। নাকি তাকে বাদ দিয়ে আবার অন্যজনকে বলবেল-‘সখি ভালোবাসা কারে কয়।’
আচাছা আপনি কে বলুনতো। এভাবে একজনকে ফোন করে ডিষ্টার্ব করারই বা হেতু কি।
না, আমি আপনার এক শুভাকাঙ্খি; তাই জানতে ইচ্ছে করছে প্রেম-টেম কেমন চলছে।
এ’সব খেজুরে আলাপ আমার মোটেই পছন্দ নয়। কোথাকার কে। যতসব ফালতু। মোবাইলে যে কত উটকো কল আসে। মোবাইল ডিসকানেক্ট করে দেয় মেহমুদ।
মোবাইলটা পকেটে রাখতে না রাখতেই; আবার কল। সেই একই নাম্বার। অনেকক্ষণ ধরে রিং বাজছে। মেহমুদ ধরছে না। কিন্তু মেয়েটি অনবরত কল করেই যাচ্ছে। শেষে বাধ্য হয়ে ফোন অন করে। ফোন অন করতেই মেয়েটির কন্ঠস্বর শোনা যায়Ñ
আপনি কিন্তু আমাকে খুব অপমান করলেন সাহেব। এতো দেমাগ ভালো নয়। শুধু একটা কথা বলার জন্য কলব্যাক করেছি। এই নাম্বারটা সেইভ করে রাখবেন। যে দিন মন ভালো থাকে সেদিন ফোন করবেন। গভীর রাতে ফোন করলে ভাল হয়। আমি হলাম রাত জাগা পাখি। সারারাত জেগে থাকি।
এতক্ষনে মেহমুদ বলে-
ও তাই বলেন, আপনি বুঝি রাত জেগে জেগে মানুষকে এ ভাবে টিজিং করেন, তাই না।
হ্যা করি। তবে ইভ নয়। এ্যাডাম টিজিং করি। দেশে যে ভাবে ইভ টিজিং বেড়ে গেছে, তার প্রতিশোধ হিসাবেই আমি সারারাত জেগে ছেলেদেরকে টিজ করি। কি বলেন, আইডিয়াটা মজার না। তো আজ রাখলাম। ফোন করবেন কিন্তু, আপেক্ষায় থাকবো। ঠিক রাত একটায়। বাই...
ফোনটা কেটে যেতেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মেহমুদ। স্বগতোক্তির মতো করে সে বলে-
নিশ্চয় কোনো বড়লোকের বখে যাওয়া সন্তান। সিট।
আজও গভীর রাতে মেয়েটি ফোন করে। প্রতিদিনই মেয়েটি রাতবিরাতে মেহমুদকে ফোন করে করে তার রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। সে মনে মনে ভাবে, মৌসুমীর সাথে ব্যাপারটি শেয়ার করলে কেমন হয়। কিন্তু নিজে নিজেই মত পাল্টায়। মেয়ে মানুষ কিসে আবার কি ভেবে বসে। আবার ভাবে, নাকি থানাকে এনফর্ম করবে। শেষে সিদ্ধান্ত নেয় এ নামারটি ব্লাকলিষ্ট করে রাখবে।
পরের দিন মৌসুমী ও মেহমুদ আবার এক রেষ্টুরেন্টে যায় দুপুরের খাবার খেতে। অর্ডার দেয়ার পর দু’জনে যখন গল্পে মত্ত তখনি সেই নাম্বাটি থেকে আবার কল আসে। কিন্তু মেহমুদ কল রিসিভ না করে কেটে দেয়। আবার কল করে। মেহমুদ বিরক্তির সুরে বলে-
যতসব আজে বাজে কল।
মৌসুমী মৃদু হেসে বলে নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের ফোন?
আরে বল না। একটা কোথাকার কোন মেয়ে ফোন করে করে আমার জীবনটা বিষিয়ে তুলেছে।
নিশ্চয়ই মেয়েটি তোমার লাই না পেলে তা করতো না।
তুমি বিশ্বাস করো। আমি জীবনে এ মেয়েকে দেখিইনি। লাই দেয়া তো দূরের কথা। ভাবছি থানায় জিডি করবো। সে বলে কিনা। এটা নাকি তার ইভ টিজিং এর প্রতিবাতে এ্যাডাম টিজ্। আরে ফাজিল মেয়ে তুই এ্যাডাম টিজ না যা খুশি টিজ কর। আমার ঘাড়ে এসে চেপেছিস কেন। মেহমুদ একটু থামে স্মিত হাসি মুখে মৌসুমী চেয়ে থাকে মেহমুদের দিকে। মেহমুদ আবার বলে-
শুনেছো ফাজিল মেয়ের কথা। সে নাকি এ্যাডাম টিজ করে। মেহমুদের চেহারাটা তখন কেমন বাংলা পাঁচ এর মতো দেখায়। তার এ অবস্থা দেখে মৌসুমী হাসতে হাসতে পারলে টেবিলে লুটিয়ে পড়ে।
মেহমুদ বিব্রত হওয়ার ঢঙ-এ বলে এখনি এ ফাজিল মেয়ের নাম্বর ব্লাকলিষ্ট করছি।
মৌসুমী বাঁধা দেয়। ব্লাকলিষ্ট করার দরকার কি। তোমার সাড়া না পেলেই তো সে আর এ্যডাম টিজ করতে পারবে না। আবার হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে আসে মৌসুমীর। মেহমুদ তখন নাম্বারটি ব্লাকলিষ্টেড করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। মৌসুমী মেহমুদের হাত থেকে তার হেন্ডসেটটি কেড়ে নিয়ে তার হেন্ডসেটটি বের করে মুচকী হেসে সে সেট থেকে কল দেয়। মেহমুদ দেখে সেই একই নাম্বার। সে উচ্চস্বরে মৌসুমীর গাল টিপে ধরে বলে-
আরে দুষ্ট মেয়ে তুমি টেবিলের নিচে হাত রেখে তুমি এখন কল করছো। তা হলে তুমিই এতদিন ধরে আমাকে জ্বালাচ্ছো। দেখ দেখাচ্ছি মজা।
মৌসুমী হাতজোড় করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে-
স্যরি। আমিই অন্য একটা নাম্বরের সেট থেকে তোমাকে পরখ করে দেখছিলাম। আমার নাগর কি আমাকে ভুলে অন্য কারো সাথে প্রেমটেম করে কিনা।
হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মেহমুদের চেহারা।
মেহমুদের যেন এ মুহুর্তে ঘামদিয়ে জ্বর ছাড়ে। সে উ-উ-ফ্ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়ে মৌসুমীর বুকে।
©somewhere in net ltd.