নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শহুরে কাউয়া

আমি মনে হয় ভালই তারছিড়া।

শহুরে কাউয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

জিলাপী

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৪৯

রাস্তায় হাটুপানি। খুব সাবধানে একহাতে শাড়ী উঠিয়ে অন্যহাতে ছাতা সামলে বাস থেকে নেমে পরে সুমি। হাটুপানি হলেও শাড়ী অতদুর উঠানো যায়না। তাই শাড়ী ভিজিয়েই সামনে এগোয়। বাসস্টপ ভরা মানুষ। কেউ বাসের অপেক্ষায়, কেউ আশ্রয় নিয়েছে বৃষ্টির হাত থেকে। কিছু পরিত্যাক্ত মানুষ যারা এই সময় এখানে ঘুমানোর আয়োজন করে তারা গুটিয়ে আছে এককোনায়। রাত ৮ টা এমন কোন রাত নয়। কিন্তু বর্ষা নামলে অনেক রাত মনে হয়। দোকানদাররা শাটার অর্ধেক গুটিয়ে রেখেছে। তাই আলোয়ও কম। নিয়ন আলোতে ঝুম বৃষ্টিতে গলিটা অচেনা লাগে সুমির। মনে হয় কোন কালে এখানে ছিলনা ও। ভুল করে চলে এসেছে। অথচ এই বাসস্টপ থেকে আর দুটো বাড়ি পার হলেই সুমিদের ভাড়া বাড়ি। সেমি-পাকা তাই ভাড়া কম। টিনশেড। গরমে অনেক কষ্ট। তবু কিছু করার নেই। বাবার পেনসনের টাকা আর সুমির বেতন দিয়ে এর বেশী দেয়া সম্ভব না। বৃদ্ধা দাদী, মা, ছোট ৩টা ভাই বোন। তাও মামুন টিউশনীর কিছু টাকা দেয় বলে রক্ষা। নইলে আরো কষ্ট বাড়ত। মামুনের কাছে টাকা নিতে খুব খারাপ লাগে সুমির। মা কিভাবে যেন নেয়। দেখতে এত কুৎসিত লাগে বলার মত না। মাত্র কলেজে পরে একটা ছেলে। কলেজ শেষে দুটো টিউশনী করে। রোগা টিংটিঙে শরীর। ফেরে রাত করে। খেয়ে পড়তে বসে। আবার সকালে কলেজ। যাওয়ার আগে কেবল ভাত খায়, ডাল দিয়ে। মা মাঝে মাঝে ডিম দিতে পারে। তাও সপ্তাহে ১ বারের বেশী না। সুমির কান্না পেয়ে যায়। কত সাধ থাকে এই বয়সটায়। অথচ মামুন, মেনে নিয়েছে এটাই ওর নিয়তি।



আসলে সুমির বা ওর মার কিছু করার নেই। দাদীর অষুধের পেছনে মাসে যে খরচ যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর খুব সামান্যই পেয়েছে ওরা। তার উপর গোদের উপর বিষ ফোড়ার মত আছে সুমন। ওদের সবচেয়ে ছোট ভাই। মাত্র ১০ বছর বয়স। মানসিক প্রতিবন্ধি। পাড়ার লোক বলে পাগল। সমস্যা ছিল আগেই ধরতে পেরেছিল ওরা। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেমন যেন ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে ও। একমাত্র মা আর সুমিকে ভয় পায়। এমনিতে গায়ে গতরে বেড়ে উঠছে সুমন। সেদিন ঝুমির মাথা এমন করে দেয়ালে ঠুকে দিয়েছিল যে ৩টা স্টিচ দিতে হয়েছে। সুমি ওইদিন খুব মেরেছিল সুমনকে। মামুন এসে না ঠেকালে হয়ত মেরেই ফেলত। কত সহ্য হয় মানুষের ? আর পাড়ার লোকের অনুযোগের তো শেষ নেই।



“আপা একটা মালা নিবেন?” সুমির ঘোর ভাঙ্গে। বৃষ্টি ধরে এসেছে। মানুষজন এই টিপ টিপ বৃষ্টি নিয়েই পথে নেমে পড়েছে। সুমির পাশে ভিজে চুপসে যাওয়া একটি বাচ্চা মেয়ে। ৮/১০ বছর বয়স হবে। হাতে নেতিয়ে পরা একটা টগর ফুলের মালা সাধছে সে সুমিকে। সুমির বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। মেয়েটা হয়ত ঝুমি হতে পারত। মেয়েটার মাথা একটু নেড়ে দিয়ে রাস্তায় রিকশা খোজে সুমি। এই পানিতে হেটে যাওয়া যাবে না। অনেকক্ষন খোজার পর একজন রিকশাওয়ালা সদয় হয়। সুমি সাবধানে রিকশায় ওঠে। ছাতা মুড়ে রাখে। ছেড়া চামড়ার ব্যাগের ভেতর একটা ঠোঙ্গার অস্তিত্ব আনন্দিত করে সুমিকে। জিলাপি খুব পছন্দ সুমনের। ওইদিন মার খাবার পর থেকে ওকে মা বেধে রাখে সবসময়। সুমিকে দেখলেই ভয়ে গোঙ্গায়। আজ ওকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে জিলাপি খাওয়াবে সুমি। সুমির চোখে পানি আসে। ও যে পাগল এটা তো ওর দোষ না। ও কি করে জানবে? ওর বাবা হুট করে মরে গেছে? কি করে বুঝবে বুড়ি দাদী-মা ভাই বোনদের টানতে গিয়ে সুমি লেখাপড়া ছেড়েছে। কি করে জানবে মামুন কত কষ্ট করে পড়ছে? ওর তো কোন দোষ নেই।



ভাবতে ভাবতে বাসার সামনে চলে আসে সুমি। বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। বাসার সামনে একটা ক্লুগার পার্ক করা। এতো দামী গাড়ি। বৃষ্টি না থাকলে মানুষ জমে যেত। রাত, তায় বৃষ্টি, তাই কেউ লক্ষ্য করেনি। কিন্তু কে এসেছে? সুমি ভাড়া মিটিয়ে বারান্দায় ওঠে। জুতা রেখে দরজায় টোকা দিতেই টের পায় দরজা খোলা। দরজা খুলেই জমে যায়। দু-রুমের বাসা। সামনের ঘরে মামুন-সুমন-দাদী থাকে। ভিতরের ঘরে মা-সুমি আর ঝুমি। পেছনের বারান্দায় রান্নাঘর। সামনের ঘরে সুমনের শেকল খুলে ওকে কোলে নিয়ে বসে আছে রুমি। সুমনের হাতে জিলাপির প্যাকেট। অনেক বড় দোকান থেকে আনা বোঝা যায়। রুমি মুখ তুলে তাকায়। মেকাপের আড়ালে রুমির চেহারার স্বাভাবিক কোন ছাপ নেই। এত মেকাপ করে রুমি কি বোঝাতে চাইছে? সুমির মাথায় ঢুকল না। ঘরের কোনায় ঝুমি বসে আছে মাথা নিচু করে। সুমি এসেছে টের পেয়ে ভেতর থেকে দাদীর তীক্ষ্ণ কন্ঠের চিৎকার ভেসে এলো “সুমি আইসোস? ওরে যাইতে ক। ওই মাগীরে যাইতে ক। বিদায় হইতে ক।” আরো গালিগালাজ ভেসে আসে। রুমির মুখ শক্ত। সুমি মায়ের গলা পায়। মা কাঁদছে। ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না। সুমি বুঝতে পারেনা কি করবে। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। সুমন খুব খুশী। সে জিলাপি খায় আর সুমিকে বলেঃ “আপ্পান দিলাবি” । ঝুমি ভেতরের ঘরে ঢুকে যায় মাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে বসে বোধহয়। কারণ সুমি দুটো গলার কান্নার আওয়াজ পায়। কি করবে সুমি ভেবে পায়না। রুমি এসেছে ১ বছর পর। রুমি – ওদের সবার বড়াপু। যে কিনা দুর্দান্ত রেজাল্ট করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকুরী পেয়েছিল। যে কিনা বাবার চোখের মনি ছিল। যে কিনা একাই সংসারের হাল ধরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যাকে বাবা বলত আমার ছেলের চেয়ে এই মেয়েই বড়। এই সেই রুমি যে কোম্পানীর বুড়ো বসের প্রেমে পড়ে গেল। বিয়ে করে ফেলল। শর্ত একটাই । এই সংসার ছাড়তে হবে। সব ছেড়ে রুমি এখন বিশাল বিজনেসম্যানের বউ। তার অনেক কোম্পানীর ডিরেক্টর। হাই সোসাইটি। হাই ক্লাস। ক্লুগার গাড়ি। সব মানিয়ে গেছে রুমির সাথে। পেছনে পড়ে গেছে এই ভাঙ্গা সংসারটি। রুমি চলে যাবার পরেই বাবা মারা গেল। প্রিয় সন্তানের বেইমানী হয়ত মেনে নিতে পারেননি। সুমিকে পড়া ছাড়তে হল। টিউশনী করে চলবে না তাই। মামুন টিউশনী নিল। দাদী ছেলের মৃত্যু শোকে প্যারালাইজড হয়ে গেল। আর মার হল ইনসমনিয়া। সারারাত সুমনের মাথার কাছে বসে থাকে মা। ভাবে এই ছেলের কি হবে? কে নেবে এর দায়িত্ব। মাঝে মাঝে ভীত চোখে চায় সুমির দিকে। সুমিও রুমির মত রুপবতি। যদি সুমিও একদিন চলে যায় তাহলে কি হবে? নিষ্ঠুরের মত মা এসব ভাবে। সুমি মাকে দোষী করেনা।



সুমিকে ঠেলে ঘরে ঢোকে মামুন। ভিজে চুপসে গেছে। রুমিকে দেখেই মুহুর্ত থেমে যায়। তারপর খিচিয়ে ওঠে।

- তুই? তুই এখানে কেন এসেছিস?

রুমি নিশ্চুপ।

- বের হ। বের হ। হেহ আবার দরদ দেখাতে এসেছে। জিলাপি এনেছে। ফেল ওগুলো সুমন।

- না – সুমন চেচিয়ে ওঠে।

মামুন হ্যাঁচকা টানে সুমনকে সরিয়ে নেয় রুমির কোল থেকে। রুমি মাথা নিচু করে ফেলে। সুমন জিলাপি নিয়ে টানা টানি করে। মামুন কষে চড় মারে সুমনের গালে। সব জিলাপি ছিটকে পড়ে যায়। সুমন চেঁচায়। মার কান্নার আওয়াজ বাড়ে। দাদী অভিশাপ দেয়। সুমি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। রুমি একবার সুমির দিকে তাকায়। সুমি চোখ ফিরিয়ে নেয়। মামুন রক্তচোখে আবার বলে

- তুই যাবি। নাকি টেনে হিঁচড়ে বের করে দেব?

রুমি উঠে দাঁড়ায়। এক পলক মামুনকে দেখে বের হয়ে যায়।



রাত বেড়েছে। বৃষ্টি একটুও থামেনি। মামুন-ঝুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদীর নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সুমনের মাথার কাছে মা থম মেরে বসে আছে। সুমি জিলাপির ঠোঙ্গা নিয়ে এগিয়ে যায়। সুমনের আজ অনেক আনন্দের দিন হোক।

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৫৪

আমি সুফিয়ান বলেছেন: আরেকটু বড় করতেন, ভালো লিখেছেন +++

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৫৯

শহুরে কাউয়া বলেছেন: ধইন্যা

২| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:১৯

আফসিন তৃষা বলেছেন: যতবার এরকম একটা রাত নিয়ে লেখা হয়েছে প্রতিদিন তার চেয়ে অনেক বেশিবার এরকম নাটক মঞ্চস্থ হয় এই শহরে, দেশে। তাই আপন লাগে লেখাগুলো। আপনারটাও আপন লেগেছে। সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। শুভকামনা :)

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৪:০৩

শহুরে কাউয়া বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপু

৩| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৪:২৫

শায়মা বলেছেন: অনেক সুন্দর লেখা তবে অনেক কষ্টের!:(

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০০

শহুরে কাউয়া বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:২০

দিকভ্রান্ত*পথিক বলেছেন: লেখা অনেক অনেক ভালো লেগেছে, নিয়মিত লিখুন নইলে মিস করবো :) :)

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৯

শহুরে কাউয়া বলেছেন: তুমি বলছো আর আমি লিখব না এটা কি হয় লিও? ;-পি

৫| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৩:১০

প্রিন্স হেক্টর বলেছেন: বাহ! বেশ বালো পল্প রিখেন তো আপনি!

+ দিতেই হল

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৮

শহুরে কাউয়া বলেছেন: ধন্যবাদ

৬| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:৫৮

সকাল রয় বলেছেন:
চমৎঁকার

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০১

শহুরে কাউয়া বলেছেন: রয় যকন বলচ, তকন লিকেই যাব মাইরি

৭| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:০৭

অপ্রচলিত বলেছেন: অসাধারণ একটি জীবনের গল্প লিখেছেন। খুব খুব ভালো লাগলো।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++

শব্দচয়ন চমৎকার হয়েছে, বাস্তবতার প্রতিফলন ছিল গল্পে। সব মিলিয়ে এক কথায় দুর্দান্ত হয়েছে।

অনুসরণে নিলাম। ভালো থাকুন নিরন্তর।

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:২২

শহুরে কাউয়া বলেছেন: ধইন্যা

৮| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩০

ভিটামিন সি বলেছেন: আমাদের গল্পবাজ অপু'র মতোই লিখেছেন। আরেক গল্পবাজ হেক্টু মিয়া প্রশংসা করেছে। গল্প ভালোই হয়েছে। সেইরাম....

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৮

শহুরে কাউয়া বলেছেন: ধইন্যা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.