![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের চলতি রাজনীতির নিরিখে নাগরিক আন্দোলন কথাটার অর্থ পরিষ্কার করার বিশেষ জরুরত আছে। নাগরিক আন্দোলন বলে নানা ধরনের নাগরিক কমিটি, সংগঠন আমাদের দেশে নতুন নয়। এবং এসব আন্দোলনের ভূমিকাও যে কমবেশি গণবিরোধী তাও এত দিনে জনগণের কাছে পরিষ্কার। এতদিন এই সব নাগরিক আন্দোলনের চরিত্রের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গণমানুষের স্বার্থের দিক থেকে দেখভার যে গাফিলতি ছিল তা আমাদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কেন? করেছে কারণ রাজনীতি বিজ্ঞানে ক্ষমতাশীল শ্রেণীদের মধ্যে দুইটা ক্লাসকে পাওয়ার এলিট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একটা হল পলিটিক্যাল এলিট আর একটা হল নন পলিটিক্যাল এলিট। এবং এই দুই ধারার এলিটরাই রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার প্রশ্নে সাধারণ বা গ্রামের কৃষক বা ভিন্ন চিন্তার বা মতাদর্শের নাগরিক অধিকারের বেলায় বেহুঁশ। ফান্ড বাগানো এনজিও কাজের কথা বলা হচ্ছে না। ফলে এত দিন নাগরিক আন্দোলনের নামে, সুশীল বা ইত্যাদি নামে আমরা যা দেখেছি তা চিন্তার দিক থেকে যেমন পশ্চাৎপদ, আচরণে প্রতিক্রিয়াশীল এবং চরিত্রের দিক থেকে গণবিরোধী।
এই তিতা অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন একটা ধর্মযুদ্ধে পরিণত হয়েছে তখনও এই সব তথাকথিত বিশিষ্ট (!) নাগরিক আন্দোলনের লোকজন (যার একটা বড় অংশ লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী নামে পরিচিত) সরাসরি জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গণহত্যায় মত উৎপাদনের মেশিন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে এই সব শিক্ষিত নামধারী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীরা। এতদিন আমরা নানাভাবে তাদের সাথে লড়েছি। শুরু থেকেই আমরা যারা গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি তাদেরকে সরলভাবে রাজাকার বা ফেসবুকিয় গালিগালাজ করে এইসব মূর্খরা ডিজিটাল ফ্যাসিবাদকে তাতিয়ে দিতে আরও তৎপর হয়েছে। এই ফ্যাসিজমের সামাজিক বিস্তারের নীলনকশার অংশ হিসেবে তারা মদদ দিয়েছে ইসলাম বিদ্বেষে। এবং আহত মুসলমানদের জাগরণ ও পাল্টা প্রতিরোধকে জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে জারি করা হয়েছে হিন্দুদের বাড়িতে, মন্দিরে আগুন দেবার রাজনীতি। এ সবই আপনারা জানেন। ফলে এত সব ঘটনার পরেও মধ্যবিত্ত যখন আওয়ামী খায়েশ আর বিচারের ফারাক বুঝতে পারে না তখন প্রস্তাব করে সংলাপের। বলাই বাহুল্য এখনকার রাজনীতির যে এজেন্ডা তাতে সংলাপ একদিকে আত্মঘাতী অন্য দিকে অকেজো দাওয়াই। কারণ সমাজে যে মতাদর্শের ভিন্নতা রাজনৈতিক লড়াই আকারে হাজির হয়েছে তাকে গণক্ষমতার ভিত গড়বার কাজে লাগানোর সম্ভাবনাকে সরাসরি কচুকাটা করে দিবে সংলাপের রাজনীতি। আবার সংলাপ কার্যকর করার জন্য যে জনসম্মতি তা গ্রামের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। মধ্যবিত্ত অতিরিক্ত আতঙ্কিত। ফলে সংলাপ নিয়া উচ্ছ্বাস তার সাজে, কিন্তু যে নিরীহ কৃষক জীবন দিচ্ছে, লড়ছে তার দিক থেকে এর দুই পয়সারও দাম নাই। অতএব যে সব ‘নাগরিক আন্দোলন’করনে ওয়ালারা এতদিন জনগণের রাজনৈতিক উত্থানের সম্ভাবনাকে কোন না কোন পাওয়ার এলিটদের কাছে তুলে দিয়েছে তারা জালেমদের দোসর ছাড়া আর কিছুই না। তারা গণশত্রু।
এবার আমরা যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার দিক থেকে বিষয়টিকে পরখ করে দেখি, আমাদের বিদ্যা চর্চার অন্যান্য মেলা অসুখের শিরোমণি হল পশ্চিমা বিদ্যাকে বিনাপর্যালোচনায় মেনে নেয়া। রাষ্ট্র ধারণার বেলায় এই রোগ সবচেয়ে প্রকোপভাবে লক্ষ করা যায়। আমরা যখনই জনগণের তরফে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লড়াইয়ে কথা বলি, এইসব মূর্খরা তখন জাতীয়তাবাদের কূটতর্ক শুরু করে। কে না জানে, ন্যাংটা পুঁজির কালে জাতীয়তাবাদ বিশুদ্ধ কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। রাষ্ট্রের গুরুত্ব কোনভাবেই জাতীয়তাবাদে নিহিত নাই। ৭১ সালেও আমরা কোন বিশেষ জাতীয়তাবাদ কায়েম করার জন্য রক্ত দেইনি। আমরা জালেমের বিরুদ্ধে লড়েছি। আওয়ামী লীগ এটাকে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদি লড়াই আকারে চাউর করেছে। এবং তারা এক কাল্পনিক জাতীয়তাবাদ রক্ষার নামে নিজ দেশের নাগরিকদের গুলি করে মারছে। জাতীয়তাবাদের একটি জটিল প্রপঞ্চ। সময়ে সে আলোচনা অন্যত্র করা যাবে। ন্যাশন এন্ড ন্যারেশন বই থেকে শুধু এক চিলতে আলো ফেলছি— বইটির ভূমিকাতে বলা হয়েছে—
`Nations, like narratives, lose their origins in the myths of time and only fully realize their horizons in the mind’s eye. Such an image of the nation-or narration- might seem impossibly romantic excessively metaphorical, but it is from those traditions of political thought and literary language that the nation emerges as a powerful idea in the west.’ (Nation and narration: Edited by Homi k. bhabha. 1990, Routledge, London)
হোমি ভাবা, ঠিকই ভাষা-সাহিত্য-জাত এই ধারার কল্পনাকৃত জাতীয়তাবাদ কে শক্তিশালী বলেছেন। এবং ধারাটা পশ্চিমা তাও বলেছেন। কিন্তু আমরা জানি এই ভাষিক জাতীয়তাবাদ কয়েকদিন আগেও আদালত দিয়া ‘মান’ ভাষা নামক একাট্টা ভাষার শাসন আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। রুখে দাঁড়িয়েছি। আজ সে পূর্ণ শক্তি নিয়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজমের বন্দুক উঁচায়া মানুষ মারছে। তার শক্তি জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে নিয়োজিত হয়েছে। এটা নিয়া বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে পাচ্ছি না। আমরা প্রসঙ্গে ফিরি।
রাষ্ট্রের যদি কোন গুরুত্ব থেকে থাকে তবে তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয়তা সমস্যার নিরাকরণ ঘটানোর লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তা কার্যকর হয়। কথাটা খোলাসা করি, জাতীয়তা একটা কালচারাল পরিচয়। সমাজে নানা জাতি, গোত্র, ধর্ম আছে। থাকবে। রাষ্ট্রে সে হবে নাগরিক। ফলে এই রাষ্ট্রগঠনের জন্য যখন জনগনের লড়াই তুঙ্গে ওঠে তখন জাতীয়তার প্রশ্নে বিভাজন গণঐক্যে ফাটল ধরানো জনগণের সাথে সরাসরি বেইমানির সামিল। আর ঠিক এখানেই নাগরিক আন্দোলন জনগনের তরফে গণক্ষমতার উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। বলাই বাহুল্য এই আন্দোলনে জামাত-লীগ-বিএনপি হেফাজত-হিন্দু-পাহাড়ী সবাই সামিল হন। হতে হয়। এই যে সমাজের নানা মতের নানা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক রুচির মানুষ এতে সামিল হন তাদের মধ্যে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক দার্শনিকদের কাজ হল, প্রত্যেকের কমিউনাল ইন্টারেস্টকে ইনসাফের ভিত্তিতে সমাধানের জন্য আদর্শিক লড়াই অব্যাহত রাখা। এবং এই ইনসাফ রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা, তাকে হেফাজত করা নাগরিক মাত্রই দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, নাগরিক আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের গলদটা কোথায়? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘বিশিষ্ট’ নাগরিক, সুশীল নাগরিক বলে কোন ধারণা থাকতে পারে না। ফলে কোন গ্রুপ যদি নিজেদের পেশা, সংস্কৃতি বা অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে নিজেদের ‘বিশিষ্ট’ ডিকলার করে বৈষম্য বা জুলুমবাজ শাসন কাঠামোকে অক্ষত রেখে নাগরিক অধিকারের কথা বলে বুঝতে হবে এরা সরাসরি গণশত্রু। এই গণশত্রুরাই নাগরিক আন্দোলনের নামে পলিটিক্যাল এলিটদের স্বার্থ দেখভাল করে থাকে। এরাই দাতা গোষ্ঠির পেয়ারে আশেকিন। ফলে জুলুমের বিরুদ্ধে সমাজের সব শ্রেণীর স্বার্থকে ইনসাফের ভিত্তিতে সমাধানের বদলে, তারা স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান ও আইনের দোহাই দিয়ে থাকে। এরা জনগণ বলতে বুঝে শহুরে সমাজকে। ইতিহাস তাদের কাছে কিতাবি বয়ান ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের ভাড়াখাটা কেরানি টাইপের মাস্টাররাই এ সমস্ত ইতিহাস লিখে থাকে। ফলে এই ধরনের গণবিরোধী সিভিলদের মোকাবেলা করেই আমাদের জনগণের তরফে লড়াই-সংগ্রামের অভিমুখ ঠিক করতে হবে।
আমাদের সমাজে নাগরিক আন্দোলন বলে যা দেখি তা কোন ভাবেই নাগরিক আন্দোলন নয়। কিছু মাস্টার, টকশোর বক্তা, ক্যাডার সাংবাদিক এরা আর যাই হোন নাগরিক সাম্য বা অধিকারের জন্য লড়েন না। এটা এত দিনে পরিষ্কার। এরা একাট্টা ইতিহাসকে ধসিয়ে দেবার কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায়ও নিজেদের সামিল করেন না। গণতন্ত্রের কথা তারা মুখের বুলি আকারে বলেন বটে। গণক্ষমতার প্রশ্নকে ব্যবহারিক দিক থেকে আগলানো ছাড়া গণতন্ত্র কথাটা হাসিনার মুখে যে অর্থ তৈয়ার করে টকশোর বক্তার কথার অর্থেও তার কোনো হেরফের হয় না। অর্থাৎ এইসব টকশোজীবীরা গোষ্ঠিতন্ত্রের বাইরে আর কারো স্বার্থের দিকে নজর দিতে পারে না। এই অবস্থার মধ্যে আবার অতি বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যেহেতু রাষ্ট্র মানেই শাসন-শোষণ তাই তারা রাষ্ট্র চান না— বিপ্লব চান। এরা প্রকৃত অর্থেই আফিম খোর। মার্কসের নামে তারা একটা কিতাবি ধর্মতত্ত্বেরই চর্চা করে। তারা ক্ষমতার প্রশ্নকে দেখে পেটি-মোরালিটি দিয়া। এবং পরিণত হয় সরকারি বাম বা বেহুদা কলাম লেখকে। আপাতত তাদের নিয়া বেশি কথা খরচা না করলেও চলবে।
আমরা আলোচনা করছি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান ও গণক্ষমতার নিরিখে নাগরিক আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়া। বাংলাদেশের বিদ্যমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক দলগুলোর গণ-দুশমনি ও গণবিচ্ছিন্নতা স্পষ্ট। এ ভূ-খন্ডের মানুষ যে তাদের দিক থেকে কোন রাজনীতি শক্তি আজও গড়ে তুলতে পারেনি তার প্রমাণ হাতেনাতে পাচ্ছে বাংলাদেশ। এই অবস্থায় জনগণের জন্য ইনসাফ কায়েমের লড়াইয়ে যে রাজনৈতিক শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে নাগরিকদের ঐক্যের কোন বিকল্প নাই। নাগরিকদের নিজেদের রাজনৈতিক কর্তাসত্তার উম্মেষ ঘটানোর সংগ্রামেই কেবল এই জুলুমের অবসান হতে পারে। রাজনৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গা থেকে এই নাগরিক এখন আর কেবল পেশাজীবী মাত্র নয়। সে তার রাজনৈতিক সত্তা নিয়ে যেই মাত্র সমাজে হাজির হয়েছে, তখনই নিজেরে তার ইনসাফের প্রতীক হিসেবে জারী রাখা ফরজ হয়ে উঠেছে। ধর্ম, পেশা, সংস্কৃতির বিভেদকে নিরাকরণ করে রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নাগরিকতার কর্তব্য নিয়েই তাকে হাজির হতে হবে। এর সামনের অংশকে হতে হবে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের কণ্ঠস্বর। এই দিক থেকে বর্তমানে নাগরিক আন্দোলনের আর আগের অর্থটি রইল না। এর নতুন অর্থ তৈয়ার হল। এর উত্থানকে এক কথায় বলা যায় ‘সমবায়িক রাজনৈতিক কর্তাসত্ত্বা’।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ কায়েমের প্রত্যয়ে যখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ এক কাতারে দাঁড়ান তখন নাগরিক আন্দোলন কথাটার অর্থ আর আগের মত থাকে না। এটা আর কোন ভাবেই পশ্চিমা নাগরিক অধিকার (civil right) মার্কা কিছু থাকতে পারে না। থাকা সম্ভব না। পশ্চিমে সিভিল সোসাইটির মামলাটা বেশ পুরোনো। হবস, লক, হেগেল হয়ে মার্কস তো বটেই খ্যাতনামা চিন্তক গ্রfমসিও এটা নিয়া গুরুত্বের সাথে চিন্তা করেছেন। এদের মধ্যে গ্রfমসি এককাঠি এগিয়ে। তিনি হেজেমনি (Hegemony) তত্ত্ব দিয়া সিভিল সোসাইটির পলিটিক্যাল রোলকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। গণহত্যার মুখে এগুলা কিছুই এখন আমাদের কাজের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত না বলে আলোচনার প্রয়োজনে শুধু নোক্তা আকারে কয়েকটি কথা বলি— পশ্চিমে রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, সেখানে সমাজের মধ্যে ক্ষমতা পয়দা হওয়ার ফাংশনাল যে রোল তা আমাদের থেকে ঐতিহাসিক কারণেই ভিন্ন। আমরা একই পুঁজি তাড়িত আধুনিকতার কালের মধ্যে বাস করলেও ভিন্নতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্র গঠনের যে সঙ্কট হাজির হয়েছে, তাতে পশ্চিমা এ সব ডিসিপ্লিনারি বিদ্যার সরাসরি কাজে আসার সম্ভাবনা শূন্য। আমরা সেগুলা পড়ব, বুঝতে চাইব কিন্তু শেষ বিচারে নামতে হবে পথে। দাঁড়াতে হবে নির্যাতিত মানুষের শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েই। ফলে বইপূজারি বুদ্ধিজীবী থেকে সাবধান।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সবার প্রতি ইনসাফ নিশ্চিত করার জন্য সমাজে যখন সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি হাজির নাই তখন যার যার ভিন্নতা সত্বেও রাষ্ট্রের আত্মমর্যাদা বা সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লড়াইয়ে নাগরিক আন্দোলনের বিকল্প নাই। এ ক্ষেত্রে আমাদের জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী যে ধারাবাহিকতা আছে তা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে। এমনকি খোদ একাত্তর সালের পাবলিক স্পিরিটই আমাদের পাথেয় হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন ইতিহাসের নয়া উপলব্ধি। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং ইনসাফ বা সামাজিক ন্যায়বিচার করতে সক্ষম এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য। আমাদের লড়াইটা ছিল জুলুমের বিরুদ্ধে। আমরা বিশেষ কোন জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রে কায়েমের জন্য যুদ্ধ করিনি। তা না করলের অবশ্য আমাদের জাতীয় পরিচয় মুছে যায় না । যাবার নয়। ফলে এখন আমরা রাষ্ট্রের নামে দেখছি এক ফ্যাসিস্ট দানবকে। যে সামাজিক বিভাজনকে তাতিয়ে দিয়ে যুদ্ধাবস্থা জারি করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সমাজকে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তার নামে বিভক্ত করে শুরু করেছে গণহত্যা। উদ্দেশ্য হল সাংবাধিনাকি স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা নিজের গোষ্ঠির হাতে ধরে রাখা। এর সাথে আইয়ুবি আমলের কোনই পার্থক্য নাই। এই অবস্থার মধ্যে গণমানুষের ক্ষমতার দিক থেকে দরদী-দায়বদ্ধ কোন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক শক্তির অনুপস্থিতি বর্তমান অবস্থাকে অসহনীয় শুধু নয় লাশময় করে তুলেছে। এই অবস্থার উত্তরণের জন্য সামাজিক স্তরের বিভিন্ন পেশা, ধর্মের মানুষকেই তার রাজনৈতিক সত্তার উম্মেষ ঘটাতে হবে। তাকেই ইনসাফ কায়েমের লড়াইয়ে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
চলতি সঙ্কটে নাগরিক ঐক্যের জন্য জরুরি অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি—
শাহবাগ গলার ফাঁস
আমরা শাহবাগ নিয়ে শুরুর দিন থেকে যে অবস্থান (position) ব্যক্ত করেছি তা এখনও কার্যকর বলে মনে করি। ইতিমধ্যে শাহবাগকে নানাভাবে সমালোচনা করায় আমরা রাজাকার উপাধিও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এটা নিয়া আমাদের বিস্তর লেখা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। শাহবাগ যেভাবে সমাজে বিভক্তির আগুনকে উস্কে দিয়েছে তার পরিণতিতে তরুণরা আজ নিজেরাই বলির পাঠায় পরিণত হয়েছে। যে আবেগকে এত দিন তারুণ্য বলে পূজা দেয়া হয়েছে আজ তা উভয় তরফেই মরণ ফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলি, শাহবাগের ইভেন্ট ভেঙে দেওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা। কেন তারা হাসিনার উপস্থিতিতে একইসুরে কথা বললেন। কথাটি নির্মম শোনালেও বলতে বাধ্য হচ্ছি— হাসিনাকে টিকে থাকতে হলে শাহবাগিদের বিচার করতে হবে। অন্তত লোক দেখানো হলেও এর একটা উদ্যোগ তার নিতে হবে। ভোটের রাজনীতির দিক থেকে এ ছাড়া আর পথ নাই। ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আসিফ মহিউদ্দিনসহ আরও তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনায় মর্মাহত ব্লগাররা বলছেন, সরকার গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিয়েছে। ইসলাম বিদ্বেষের জের ধরে জল এত দূর গড়িয়েছে যে এই শাহবাগ এখন গলার ফাঁস হয়েছে। একটা প্রবাদ হাসিনার জন্য সত্য হয়ে ফিরল। অপরের জন্য গর্ত খুড়ে তিনি নিজেই এখন সেই গর্তে পড়েছেন। অন্যদিকে শাহবাগ নিজেই নাস্তিকতার তকমার সাথে এমন ভাবে একাকার হয়ে গেছে যে সে সামাজিক ভাবে গণমানুষের ঘৃণার কেন্দ্রে চলে এসেছে। বলাই বাহুল্য ব্লগার মাত্রই নাস্তিক নয়। বা নাস্তিক হলেও সমাজে তার নাগরিক অধিকার নিয়ে চলবার অধিকার আছে। কিন্তু এই নাস্তিকতা তো আর ব্যক্তিগত পছন্দের পর্যায়ে নাই। এটা ইসলামবিদ্বেষের যে নজির স্থাপন করেছে তার জন্য তথাকথিত প্রগতিধারী গোটা সমাজকেই মূল্য দিতে হচ্ছে। শাহবাগিদের যে শেখ হাসিনা এত দিন ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আগলে রেখে বিরানি সাপ্লাই করে আসছিলে আজ তিনি বলছেন, ‘এটা ঠিক নয়, আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাজনীতি করতে হয় বাস্তবতার নিরিখে।’
তো বাস্তবতার নিরিখ এখন তাকে হেফাজতে ইসলামীর কাছে নত করেছে। নত হতে বাধ্য করেছে। একেই বলে গনেশ উল্টানো। এখন শাহবাগীরাই কাঠগড়ায়। রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বেখেয়াল শাহবাগ শুরু থেকেই দেশকে আওয়ামী ফ্যাসিজম উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করেছে। আজও এই বেহুশ অবস্থা তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। আর কত সর্বনাশ হলে রাজনৈতিক হুঁশ হবে? এই বেহুঁশ অবস্থার গোড়াটাও আমাদের খুঁজে দেখতে হবে।
শাহবাগ কেন বুঝতে পারল না হাসিনা বিচার চায় নাকি বিচার নিয়া রাজনীতি করতে চায়। কেন এটা বুঝতে তার এত দেরি হল এই প্রশ্ন তুলে এখন আর ফায়দা নাই। হাসিনার গণতন্ত্রের মড়নকামড় এখন শাহবাগকে ছেড়ে দিবে এমটা মনে হয় না। এখন শাহবাগ নিয়ে শুরু হয়েছে হাসিনার ডাবলস্টান্ডার্ড বা দ্বিমুখী নীতি। একদিকে ভোটের রাজনীতির স্বার্থে মুসল্লিদের সন্তুষ্ট করার জন্য ব্লগার গ্রেফতার, সাইবার ট্রাইবুন্যাল ইত্যাদি গঠন করছে— অন্য দিকে লীগ তথা আওয়ামী-বামদের পাহারায় ইমরান চেতনার রাজনীতি ফেরি করছে। ইমরান বলছেন, শাহবাগ কারো রক্ত চোখকে ভয় পায় না। বাম-সেক্যুলার যে আওয়ামী এলায়েন্স তা রক্ষার জন্য ইমরান এখন সরকারবিরোধী হুঙ্কারও দিচ্ছে। এই হুঙ্কারের দম তিনি শুধু যে দেশের মধ্যে থেকেই পেয়েছেন এমন না— এর হাওয়া দেশের গন্ডির বাইরে থেকেও সাপ্লাই হচ্ছে। এটা নিয়া এর আগে লিখেছি (গণহত্যার রাজনীতি, ধর্মযুদ্ধে প্রবেশ : চিন্তা ডট কম ৫ মার্চ ২০১৩)।
আওয়ামী রাজনীতির হাত ধরে শাহবাগ এখন শাঁখের করাত। অন্যদিকে আমার তরুণ বন্ধুরা গ্রেফতারকৃত ব্লগারদের ছাড়িয়ে আনতে আন্দোলনে নামছেন। তাদের দাবি সরকার বাকস্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ করেছে। এই বাকস্বাধীনতাকামীরা এখনও হাসিনার রাজনীতি বুঝে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না। অবশ্য বুঝতে বুঝতে তারা জেলের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। আর এটা না বুঝতে পারার মেলা কারণের মধ্যে সামনের কাতারের কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নাই। তারা শাহরিয়ার কবির বা কালচারাল আওয়ামী-বাম আর হাসিনাকে একাকার করে দেখেছে। শাহরিয়ার তার কৈশোর থেকেই বাংলাদেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করে আসছেন। সে বেশ পুরান গণশত্রু। দীর্ঘদিন থেকেই সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের স্বার্থের বাইরে বিভিন্ন কাজ করে আসছে। তিনি শুধু নৌকাতে আশ্রয়-প্রশ্রয়ই নেননি— আওয়ামী লীগের মধ্যে শাহরিয়ার গং আরেকটা নৌকা হয়ে উঠছেন। শাহবাগিরা শাহরিয়ারের নৌকায় ভরসা করে বেশি বিপদে পড়েছেন। হেফাজতে ইসলামির কর্মসূচিকে সরকার গণতান্ত্রিক সাব্যস্ত করে তার জন্য নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। সাথে সাথে সহিংস হামলার ধুয়া তুলে আন্দোলনকারীদের সতর্কও করে দিয়েছেন। এর মধ্যে অতি আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামিকে যথারীতি মৌলবাদি জঙ্গি ঠাওরে ২৪ ঘন্টার হরতাল দিয়ে দিয়েছে। এরা এতই প্রগতিশীল যে শুক্রবারও হরতাল ডাকলেন। বাংলাদেশে ইতিহাসে গণবিরোধী প্রগতিশীলতার এক চূড়ান্ত নজির সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার জন্য বাংলার ধর্মপ্রাণ জনগণ আজীবন তাদের মনে রাখবেন।
শাহবাগিদের বোঝা উচিত আজ তাদের প্রধান শত্রু হেফাজতে ইসলাম নয়। তাদের প্রধান শত্রু চিন্তাশীলতার প্রশ্নে ‘মৌলবাদি’ এই সব বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা। এই মৌলবাদ পশ্চিমা প্রভাবিত ক্যালকেশিয়ান বাবু সংস্কৃতির কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত সরবরাহ হচ্ছে। এইটা এখন দিল্লির কূটনীতির পার্ট। এইসব তথাকথিত প্রগতিশীলরা আধুনিকতার বিকারের মধ্যে বাস করে, পুঁজির ভোগ লিপ্সায় আপাদমস্তক নিমজ্জিত থেকে জনগণ জনগণ বলে চিৎকার করে। শ্রেণীর দিক থেকে এরা সরাসরি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের শত্রুর হাতকেই শক্ত করে। প্রগতিশীলদের ডাকা এই হরতাল আওয়ামী কালচারাল ফ্যাসিস্ট চক্র পালন করার মধ্য দিয়ে তার ইসলাম বিদ্বেষকে সাংগঠনিক ভাবে জানান দিল। এর পরিণতি হাসিনা জানেন। কিন্তু জানেন না প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী মৌলবাদিরা। নিমূল কমিটি, সেক্টর ফেরাম (তারা অস্বীকার করেছেন), সাংস্কৃতিক জোট মিলে একটা সরকারি হরতালের ডাক দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে হরতালের মৌসুমে প্রবেশ করেছে, নাইলে কি আর সরকারি দলও হরতাল দেয়? এই কথাটা ঠাট্টা হিসেবে বলা যায়,কিন্তু এর রাজনৈতিক দিক টি হল, শাহরিয়ার গং রা বাধ্য হয়েছে এই কর্মসূচি দিতে। কেন না আজ এই দূরগর্তির মধ্যে হাসিনা কে ফেলার পেছনে শাহরিয়ার গং দের প্রেসক্রিপশন দায়ি। এখন কালচার দিয়া রাজনীতি ঠেকানোর শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে প্রগতান্ধরা। বলাই বাহুল্য রজনীতির কাছে কালচার বরাবরই অসহায়,তুচ্ছ। রাজনীতিই কালচার পয়দা করে। পরে সেই কালচার জন্ম রাজনীতিকে পরিপুষ্ঠ করে। যেমন আওয়ামী লীগকে পরিপুষ্ট করে সাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল কালচার। তরুণরা আজ এই কালচারাল ফ্যাসিজমের খপ্পরে পড়েছেন। তারুণ্য কথাটাকে তারা নিজেদের ক্ষুদ্র শ্রণীর এজমালী সম্পত্তি ভেবে ভুল করেছেন। মালটিন্যাশনাল কম্পোনির কেরানি বা চাকর-বাকর হওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষার নামে যে সাংস্কৃতিক হিংসা তারা অর্জন করেছেন তা আজ গণহত্যায় মদদ চিচ্ছে। কেএফি ও ডিজুস মার্কা ভোগবাদি আধুনিক বিকারগ্রস্ত জেনারেশন কোন ভাবেই বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে না। শিক্ষার অহমিকা/হিংসা আজ তাকে পতনের দ্বার প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এখন তারা সামাজিক ভাবে যেমন কলঙ্কিত। হাসিনার রাজনীতিরও কাঁচামাল।
আমরা মনে করি, গণক্ষমতার উত্থানের যে নাগরিক আন্দোলন, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যে লড়াই তাতে সামিল হয়েই তরুণরা তাদের তারুণ্যের মর্যাদা রাখবেন। বুদ্ধিমানরাই নিজেদের শুধরে নেন।
হেফাজতের তাৎপর্য
এত দিন যারা বুঝে না বুঝে বুশ-হাসিনার ডামাঢোলে পড়ে মুসলমান, ইসলাম, টুপি, দাড়ি ইত্যাদিকে ঢালাও ভাবে জঙ্গি, জঙ্গি বলে চিৎকার করেছেন আজ তার পাল্টা জবাব আকারেই শাহবাগি আর নাস্তিক একাকার হয়ে গেছে। শাহবাগি আধুনিক চেতনা এত দিন ইসলাম প্রশ্নে জ্ঞানগত ভাবে যে বেইনসাফির চর্চা করে আসছে তারই বিষবাষ্প এখন শাহবাগকে অঙ্গার করে দিচ্ছে। তাদের জন্য মাকস এর কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে ফলেছে।
history repeats itself, the first as tragedy, then as farce...
[Ref: The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte./ K Marx]
অন্য দিকে আস্তিকতা-নাস্তিকতার তর্কটা যে কোন বিবেচনাতেই কূটতর্ক। ইসলামও এই ব্যাপারে কোন বেইনসাফি বরদাশত করে না। অন্য দিকে দর্শনের দিক থেকে আস্তিক-নাস্তিক তর্কটা ইতরোচিত। এটা নিয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে।
জুলুমের বিরুদ্ধে যে নাগরিক আন্দোলনের জরুরত বাংলাদেশ হাজির হয়েছে তার পথ ধরেই এক মাত্র আমরা বিবাদ এবং বিভক্তির অবসান ঘটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। এ ছাড়া শাহবাগিদের আর কোন পথ খোলা নাই। শাহবাগ (তথা প্রগতিশীল সেক্যুলার চেতনা) যেমন ইসলাম সম্পর্কে এত দিন বেখবর থেকে মুসলমানদের জঙ্গি, মৌলবাদি সাব্যস্ত করে সামাজিকভাবে বৈষম্যকে তাজা করেছে। এখন শাহবাগিদেরকে নাস্তিক সাব্যস্ত করে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হুমকিতে ফেলা হয়েছে। আমাদের প্রগতিশীল বন্ধুরা রাতে ঘুমাতে পাছেন না। পুরো পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হয়েছেন। এই নিরাপত্তাহীনতার কারণ সরকারের গ্রেফতার আতঙ্ক। এই সংঙ্কট কালে তাদের আবেগি ভুলের জন্য আমরা জালেমি ক্ষমতার চালের কাছে তাদের বলি হতে দিতে পারি না। আমরা বারবার বলে এসেছি, সমাজে আস্তিক নাস্তিক, হিন্দু, মুসলামান, পাহাড়ি ইত্যাদি নানা পরিচয় থাকতে পারে। থাকে। এবং তাদের প্রত্যেকের স্বার্থেও দেখভাল করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র যেমন বিশেষ কোন জাতীয়চেতনাকে অন্য গোষ্ঠির চেতনার মুখোমুখি দাঁড় করাবে না । তেমনি আস্তিকতার চেতনাকে নাস্তিকতার চেতনার বিপরীতে দাঁড় করানোর কূট চালও আমাদের রুখে দিতে হবে।
গণবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদি শাহবাগ এখন বাকস্বাধীনতার ধোয়া তুলে মানববন্ধন করছে, হারমোনিয়ামের সুর তুলে প্রতিবাদী গানবাজনা করছে। সরকারের কাছে গ্রেফতারকৃত ব্লগারদের মুক্তির আবদার করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বর্তমান পরিস্থিতি আস্তিকতা-নাস্তিকতার ইস্যু নয়। ইস্যুটা হল ইসলামবিদ্বেষ। শাহবাগি কতিপয় ব্লগার যেভাবে নবীর নামে পর্নোগ্রাফিক মানের কুরুচি লিখেছে তা দেখলে শুধু মুসলমানরাই নয়, এদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান এবং নাস্তিকতার মতাদর্শে বিশ্বাসী যে কোনো ইতিহাসজ্ঞান সম্পন্ন বিবেকবান সুরুচি সম্পন্ন মানুষই মর্মাহত হবেন। এরা শুধু ইসলামের মহান নবীর প্রতিই ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেননি, হিন্দু ধর্মের অবতার শ্রীকৃষ্ণকে নিয়েও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছেন। এটি আস্তিক-নাস্তিক বা অন্য ধর্মমতের যে কোন বিবেকবান মানুষের কাছেই ঘৃণ্য অপরাধ। কোন স্বাভাবিক মানুষ এটা বরদাশত করবে না।
অতএব এখন আমাদের খেয়ার রাখতে হবে নাস্তিকতার জিকির তুলে যেন এখন বিরোধীমতকে দমনপীড়ন করা না হয়। কেউ নাস্তিক এই কারণে সে অপরাধী হতে পারে না। আমাদের সম্মানিত আলেম-উলামারও কেউ ব্যক্তিগত ভাবে নাস্তিক বলেই তার শাস্তির দাবি করেননি। নাস্তিকতা এখন আর ব্যাক্তিগত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেক্যুলার বনাম ইসলাম যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিষয়টা দাঁড়িয়েছে সমাজ বনাম জালেম রাষ্ট্রের লড়াই। আপনারা জানেন, কয়েক বছর ধরেই তথাকাথিত সোসাল মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধোয়া তুলে ফাঁসির প্রোপাগান্ডার নামে ব্লগাররা যে ধরনের পর্নগ্রাফিক ভাষা চর্চার উৎসবে মেতে উঠেছিলেন এখন তা সর্বনাশা রূপ নিয়েছে। নাস্তিকতার নামে নির্জলা ধর্ম বিদ্বেষকে বাকস্বাধীনতার নামে চর্চা করেছেন। আর সরকারও এ সবের ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী বাসনা ছিল, এসব আধুনিক পর্নগ্রাফারদের মধ্যে জাতীয়তাবাদি উম্মাদনা তৈরি করা। এই মর্দানি আর ধর্মবিদ্বেষকেই তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে চর্চা করে আসছিল। আমার কথার সত্যতার জন্য এই সব বিকৃত রুচির অনলাইন তারকাদের ভাষা ও ভঙ্গির দিকে খেয়াল করলেই প্রমাণ মিলবে। এসব ব্লগারদের কয়েকজনের ছ্দ্মনাম দেখুন— আল্লামা শয়তান, পাপী ০০৭, ভণ্ডপীর, জুম্মন কসাই ইত্যাদি। এই সব ইউরোসেন্ট্রিক আধুনিকতার বিকারে আক্রান্ত তরুণরা আর নিরীহ ব্যাক্তিগত নাস্তিক মাত্র নয়। তাদের এই ব্যাক্তিগত নাস্তিকতা মিলেছে ফ্যাসিবাদের সাথে। তারা সম্মিলিত ভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে সমাজকে সহিংস করে তুলেছে। যে ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা তাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পেশ করেছে, তাতে সেই সব কুৎসিত রুচির ব্লগারদের আপত্তিকর মন্তব্যগুলোর প্রিন্ট কপিও তাঁনারা জমা দিয়েছেন। তারা দাবি জানিয়েছেন, মুসলমানরা নিজের জীবন, বাবা-মা অর্থ-সম্পদ ইত্যাদিও চেয়ে আল্লাহ ও তার রাসূল (স.) কে বেশি ভালবাসেন। তাদের বিশ্বাস কে অন্যায়ভাবে আঘাত করা হয়েছে। তারা এর বিচার চান। সেক্যুলার নামধারি গণশত্রু যে সকল বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যালঘুর উপর আঘাত করা হলেই সাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ তুলেন এখন তারা নীরব। হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হলেও যেমন আমার নাগরিক অধিকার হরণ হয় তেমনি নবীকে নিয়ে কুৎসা রটালেও আমার নাগরিক অধিকার হরণ হয়। ফলে নাস্তিক কথাটা রেটরিক অর্থে সামনে চলে আসলেও আমাদের আলেম সমাজ ইনসাফের ব্যাপারেও সচেতন। ফলে এই রেটরিক শাহবাগকে ঘরে-বাইরে আজ অপদস্ত করছে। এবং এই অবস্থার সুযোগ তৈরি হতে পেরেছে ইসলাম বিষয়ে তাদের সাংস্কৃতিক বৈষম্য দৃষ্টির কারণে। এদের মধ্যে যারা পড়াশোনা জানা তারাও কখনও ইসলাম নিয়ে আন্তরিক বোঝাপড়ার চেষ্টা করেননি।
আমরা যখন ইসলাম নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি, ইসলাম নিয়ে বোঝাপড়ার জরুরতের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছি আমাদের মৌলবাদি,জামাতি বলে অপদস্ত করা হয়েছে। এই শিক্ষিত নামধারি মূর্খদের জন্যই আজ আগুন এতদূর ছড়াতে পেরেছে। ভিন্ন চিন্তাকে সম্মান না দিয়ে, তাকে বুঝবার চেষ্টা না করে, তার প্রতিহিংসা ছড়িছে বা অস্ত্র দিয়ে তাকে দমন করবার চেষ্টা কোন কালেই শুভ পরিণাম বয়ে আনে না। মহানবী (স.) বলেছেন— ‘যে সংখ্যালঘুকে আঘাত করল, সে যেন আমাকেই আঘাত করল।’ ইসলাম ভিন্ন মতের প্রতি যে গণতান্ত্রিক আচরণ শিক্ষা দিয়েছে তা তাঁরা শুধু প্রচারই করেন না নিজেরা আমলও করেন। ফলে নাগরিক হিসেবে কেউ নাস্তিক হলেই তাকে যেন আমরা অপরাধী গণ্য না করি। এ ব্যাপারে জ্ঞানী ওলামা সমাজই অগ্রণী ভূমিকা নিবেন।
শেখ হাসিনার উপর মানুষের আস্থা নাই। ফলে সে গায়ে পড়ে হঠাৎ ইসলাম দরদি সেজে কিছু ব্লগারদের ধরে শাস্তি দিয়ে দিলে তো আর ইনসাফ হবে না। অন্যদিকে সামাজিক ভাবে আমরা ইসলাম নিয়ে চর্চাকে যদি গুরুত্ব দিয়ে নিতে না পারি তা হলে পশ্চিমা ও তাদের দেশি দালালদের খপ্পরে পরে আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তারক্তি থামাতে পারব না। মধ্যবিত্তকে তার সাংস্কৃতিক অহম ঝেড়ে কৃষক-মুসলমানের চেতনাকে বুঝতে হবে। কলকাতার সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের বয়ানের মুসলমান আর বাংলার মুসলমান এক না। তাকে আধুনিক জ্ঞানের অহমিকায় পশ্চাৎপদ মনে করার মাশুল কিন্তু সুধে-আসলে দিতে হবে। কারণ এই মুসলমান জুলুমের বিরুদ্ধে যুগে যুগে লড়ে এসেছে। তার মুসলমান পরিচয় যতখানি তার কাছে ধর্মীয় সামাজিক ভাবে ঠিক তত খানি তার আত্মমর্যাদার চিহ্নও। কারণ সে উচা-জাতের দেমাগি জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা তথা মুসলমান আত্মপরিচয় তৈরি করেছে।
হেফাজতে ইসলাম ইসলামের এই ঐতিহাসিক ভূমিকা ভুলে যায়নি। ইনসাফের প্রশ্ন তুলে হেফাজতে ইসলামের অন্যতম নেতা, মাওলানা আশরাফ বলেন, আমরা জামাতের পক্ষে নই, মজলুমের পক্ষে। সরকার বিনা বিচারে পাখির মত গুলি করে মানুষ মারছে এতে আমরা বাধ্য হয়েই মজলুমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি’ ( সূত্র : আরটিএনএন ডট নেট, ৩ এপ্রিল)। অন্য দিকে তারা যে কোন মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে পক্ষেও শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তাদের শর্ত বিচারে যেন ইনসাফ লঙ্ঘন না হয়। এটা বাংলাদেশের প্রত্যেক বিবেকবান মানুষেরও চাওয়া। ফলে মুসলমানকে পশ্চিমা চশমায় না দেখে আমাদের নিজেদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্যেই তাকে দেখতে, চিনতে হবে। তার সামাজিক স্তরের মুসলমান পরিচয়কে যেমন দেখভাল করতে হবে অন্য দিকে সমাজের অন্য মতাবলম্বীদের সাথে সামাজিক সৌহার্দ্য কিভাবে বজায় থাকবে তারও বিধিব্যবস্থা করতে হবে।
পবিত্র কুরআনে যুদ্ধ সম্পর্কে যতগুলো আয়াত আছে তার মধ্যে প্রথমে নাজিল হয়েছে ‘সুরা হজ্জ’-এর ৬ নাম্বার আয়াতটি। এখানে বলা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা লড়াই করবে! তাদের বিরুদ্ধে একারণে লড়াই করবে না যে তাদের কাছে উর্বর ভূ-খন্ড আছে, কিংবা বড় রকমের বাণিজ্যিক এলাকা আছে,কিংবা তারা ভিন্ন ধর্মের অনুসারি। বরং বলা হয়েছে,তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে কারণ তারা অত্যাচারি। এবং এদের বিরুদ্ধে কেবল নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্যই যুদ্ধ করতে বলা হয়নি বরং অন্যান্য মজলুমের সাহায্য সমর্থনের কথাও বলা হয়েছে।
আমাদের জ্ঞানী ওলামায়ে কেরামরা ইসলামের ইনসাফের ব্যাপরে বরাবরই সচেতন। ভিন্ন মত অন্য ধর্ম বা জাতীর ‘হক’-কেও হেফাজত করা হেফাজতে ইসলামের শুধু রাজনৈতিক-সামাজিক দায়িত্ব নয়— ঈমানী দায়িত্বও বটে। কঠিন নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই নাগরিক আন্দোলনের ইনসাফ কায়েমের লড়াই অভিষ্ট্য লক্ষে ধাবিত হতে পারবে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, হিন্দু, মুসলামান, পাহাড়ি কেউ কারো কাছে শত্রু নই। আমাদের সবার শত্রু জালেম শাসক, জালিমি আইন বা ব্যবস্থার পৃষ্টপোষকরা। আমাদের সবার ‘হক’ প্রতিষ্ঠার জন্যই আজ এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। আর ঠিক এখানেই নিহিত আছে হেফাজতের তাৎপর্য। কাজেই হেফাজতের ১৩ দফার সাথে যে কেউ এক মত নাও হতে পারে। কিন্তু তাদের অধিকার এর প্রশ্নে কারো কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। অধিকারের দিকে নজর রেখেই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
অন্য দিকে বিশ্ব-রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দানে ইসলামের যেরূপ পুজিবাদি-সাম্রাজ্যিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছে তাকেও চিনতে হবে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষিতেই। হেফাজতে ইসলাম বা মুসলমান মাত্রই অবগত আছেন, পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামকে নিয়ে সন্ত্রাসী প্রপাগান্ডা জারি আছে। এর হাত ধরে সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ধবাজরা নিরীহ মানুষের জীবনে বোমা বৃষ্টি বর্ষণ করে। ফলে আমাদের সম্মিলিত নাগরিক আন্দোলনের ব্যাপারে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকে হিসেবে রাখতে হবে। কেউ যেন আর জঙ্গি জিকির তুলে ঐক্যে ফাটল ধরাতে না পারে এই দিকটা সম্মানিত আলেম সমাজ খেয়ালে রাখছেন। তাদেরকে নিজেদের অধিকার যেমন প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে হবে— অন্যের অধিকারের হেফাজতকারীর ভূমিকাও নিতে হবে। মনে রাখতে হবে শত্রু আমাদের ঘরে-বাইরে নানা বয়ানে প্রস্তুত। অন্যদিকে তথাকথিত শিক্ষিত নামধারি আধুনিকতার বিকারের শিকার মানুষদের ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আমরা যেন ঘরে ঘরে আগুন না জ্বালি। খুব সাবধান হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে হেফাজতে ইসলাম তার নিজ ধর্মকে হেফাজতের অঙ্গিকার নিয়ে লড়তে পারে। সে জালিমের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াইয়েও বীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধা করবে না। ইতিমধ্যে পুলিশলীগ ২০০ লোককে গুলি করে মেরেছে। সেই জনরোষে পড়ে মার খাচ্ছে পুলিশও। আর তা নিয়ে শুরু হয়েছে মিডিয়া ট্রায়াল। অবশ্য মিডিয়ার কথা এখন আর মানুষ কৌতুক ছাড়া সিরিয়াসলি নেয় না। কিন্তু আমাদের এটাও খেয়াল করতে হবে যে, এই পুলিশ যে কোনভাবেই এই নিপীড়ন চালতে রাজি নয়। ইতিমধ্যে প্রশাসনের সাথে সরকারের দ্বন্দ্বে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে সব তরফের নাগরিক আজ নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হয়েছে। হাসিনার নিমূর্লের বাসনাকে ইসলামফেবিয়ার প্রভাবে যারা এখন সমর্থন করে যাচ্ছেন তারা জানেন না জামাতকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়। শুধু জামাত কেন যে কোন মতাদর্শকে মোকাবেলা করার যে জ্ঞানগত চর্চা আমাদের করবার কথা ছিল তা না করে আজ তারা নিজ দেশের নাগরিককে হত্যা করে বিনাশ করে দিতে চাচ্ছেন। ভাবছেন জামাত মরছে, মানুষ নয়! এত সীমার কিভাবে হলাম আমরা। জামাত লীগ বা বিএনপি করলেই কি গুলি করে মারা জায়েজ হয়ে যায়? আজ বিভক্তির দেয়াল শুধু সামাজিকভাবেই খাড়া হয়নি, রাজনৈতিক ভাবেই শুধু গণহত্যা চালানো হয়নি— রাজনৈতিক বিভক্তি যেন আমাদের মানবিক বা বিবেকের সব বিবেচনাও ধসিয়ে দিয়েছে। এটা আর বাড়তে দেয়া যাবে না। আজ নাগরিক আন্দোলনের যে জরুরত হাজির হয়েছে তাতে কোন বিভেদের খপ্পরে আমরা পড়তে পারব না। পরতে পারি না। জামাতি-হেফাজতি- লীগ-বিএনপি এ সব জিকির তুলে আর আমাদের দমানো যাবে না। সামাজিক বিভেদের নিরাকরণ ঘটিয়ে ইনসাফ কায়েমের লড়াইয়ে প্রতিটি বিবেকবান মানুষই নিজেদের সামিল করার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ কে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ইনসাফের রাষ্ট্র আকারে গড়ে তুলতে লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
সেনা নিয়া সুশীল ফোবিয়া
সামাজিক বিভাজন, সরকারি গণহত্যা তার বিপরীতে পাল্টা হত্যা— প্রতিরোধ পুলিশের অসহায় অবস্থান, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুলিশকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার— এসব ঘটনা সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ নামক ভূ-অংশটিতে রাষ্ট্র অর্থে এখন কারো হাতেই কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। কারণ, গ্রামে যেভাবে পুলিশলীগদের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদি হয়ে উঠছে। এবং সরকারী নির্দেশে গণহত্যা জারি রয়েছে তাতে পাল্টাশক্তি রাষ্ট্রর ক্ষমতাকে এরমধ্যেই ধসিয়ে দিয়েছে। এসব প্রতিরোধকে, জামাত বলে মিডিয়ার এখন আর প্রচার করবারও দরকার নেই। কারণ জামাতই এই দাবিকে মিথ্যা দাবি বলে জানিয়েছে। আবার মধ্যবিত্তকে পুলিশ মারার দৃশ্য যেভাবে সাপ্লাই করা হচ্ছে এতে মিডিয়ার এক চোখা নীতিও চোখে পড়ে। নির্বিচার গুলি গণহত্যাকে মিডিয়া পাশকাটায়। কারণ জামাত-শিবির মরলে তো তার চেতনার জন্য নগদ লাভ। ফলে এই একচোখা মিডিয়া দিয়া আমরা যদি কোন পরিষ্কার ধারণায় পৌঁছাইতে চাই তা কোন ভাবেই সম্ভব না। অন্য দিকে গ্রামে পুলিশের প্রতি যে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে তা গণহত্যার প্রতিক্রিয়াতেই। এখন সরকার পুলিশ দ্বন্দ্ব এত স্পষ্ট যে রাষ্ট্রের ক্ষমতাই আর ফাংশন করছে না।
ফলে এখন অনিবার্য ভাবে দেশে সেনাবাহিনীর কথা আলোচনার এজেন্ডার মধ্যে চলে এসেছে। কারণ গৃহযুদ্ধ এত ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে যে মধ্যবিত্ত খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এই আতঙ্ককে রাজনৈতিক ভাবে ক্যাপচার করার জন্য বেগম জিয়া জুতসই তালে সেনা প্রসঙ্গ এনেছেন। কিন্তু এতে তিনি কোন ফায়দা পাবেন বলে মনে হয় না। কারণ সেনা বলে দেশপ্রেমিক গণমানুষের স্বার্থ রক্ষাকারী কোন ফোর্সকে বাংলাদেশের জনগন এখনও দেখেনি। আগামি দিনে যে এর ব্যতিক্রম হতে পারেবে না তা কিন্তু বলা যায় না। আমাদের বুঝতে হবে একাট্টা সেনা বিরোধিতার রাজনীতি আরও পশ্চাদপদ। এরও কোন মানে হয় না।
বর্তমানে (১-৪ এপ্রিল) আমাদের সেনা প্রধান ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। আপনাদের মনে পড়তে পারে মইন কে এই ভারত ১/১১ এর সময় লালগালিচা দিয়েছিল, সাথে দিয়েছিল ঘোড়া। তো এখনকার সেনাদের যদি আবার সেই ঘোড়া রোগ দেখা দেয় তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষ চায় সব পেশা ও নেশার মানুষদের নিয়া একটা ইনসাফের রাষ্ট্র। আমরাই আমাদের মোড়ল। এই দিক থেকেই নাগরিক আন্দোলনের তাৎপর্যে বেহুদা সেনা এলার্জির কোন মানে হয় না। অন্যদিকে সেনাবাহিনীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যে তারা কি সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েমে নিয়োজিত হবে? জনগণের বুকের উপর বুট জুতা দিয়া পাড়া দিবে নাকি জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেও যে একজন নাগরিক— শুধু সেনা মাত্র নয়— এই পরীক্ষা দিবে? যারা সেনা নিয়া অতঙ্কিত তারা ভোটাভুটির মাধ্যমে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রই কায়েম করতে চান। বর্তমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যে সেনাকে যারা মনে করেন পেটুয়া বাহিনী হিসেবে কাজে লাগাবে এবং বিরোধী পক্ষকে র্নিমূল শেষে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তারা ‘জালেম’। তাদের বিরুদ্ধে জনবিস্ফোরণ শুরু হয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতায় নাগরিক আন্দোলনের যে জরুরত হাজির হয়েছে তার তাৎপর্য আমাদের আমলে নিতে হবে।
অন্যদিকে এই সুযোগে রাজনীতিশূন্য বিরোধী দল ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। তারই অন্তবর্তীকালীন ঠেকনা হিসেবে তারা সেনাদরদী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের এযাবৎ কালের তাবত শাসক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে। সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করেছে, তাকে স্বার্থবাদি পেশাজীবী শ্রেণীতে পরিণত করেছে। কেউ গণতান্ত্রি সামরিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেনি। যার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি বিডিআর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। অতএব এই শাসকরাই যখন সেনা নিয়া গদগদ হয় তখন সতর্কতা দরকার । সেনাবাহিনীকে বুঝতে হবে ৪২ বছরেও আমাদের কোন সামরিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রকে খোড়া রেখে, তাদেরকে ইউএন মিশনের ভাড়া খাটার গোলামে পরিণত করা হয়েছে। তাদেরকে নাগরিক বোধহীন হাটুরে বুদ্ধির চাকরীজীবী করা হয়েছে। বাংলাদেশ আজ ঘরে-বাইরে নতজানু। এর দায় কার? সেনাবাহিনীকে তার ভূমিকার বিষয়ে জনগণের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া উপায় নাই। এই লড়াইয়ে সেনাকে এলিটিজম ছেড়ে নাগরিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হবে। । ফলে সেনা, আম-বাম-জামাত-লিগ-হেফাজত-জাতীয়তাবাদি ইত্যাদি সহ সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় নানা পরিচয়ের যে বিভাজনের ফাঁপরে পড়ে বাংলাদেশ আজ জ্বলন্ত কড়াই হয়েছে, তাকে মুছে ফেলে গণঐক্যের ভিত্তিতে লড়াইয়ের বিকল্প নাই।
আমাদের সামাজিক বিভাজন, আত্মপরিচয়ের ভিন্নতা, নানা ধর্মমতের সহাবস্থানের যে ঐতিহ্য আছে তাতে ফ্যাসিজমের থাবা পরেছে। আরবান বুদ্ধিজীবীরা যতই সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িকতা জিকির তুলুক তাদের জিকির যে ধর্মযুদ্ধের আমন্ত্রণ তা ইতিমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন। তারাই সম্প্রদায়-এর চেতনাকে রাজনীতির হাতিয়ার বানায়। রাষ্ট্রে টেনে আনে সাম্প্রদায়িকতা। পরে এই জুলুম চাপিয়ে দেয় সমাজের নানা শ্রেণীর উপর। অন্য দিকে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের সামাজিক জীবনে এই বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই করেই সমাজকে গতিশীল রেখেছে। ফলে নাগরিক আন্দোলনের দিক থেকে আমাদের সামাজিক ভিন্নতা কোন সমস্যা নয় বরং সম্ভাবনা। আমরা যদি খেয়াল রাখি জগতের প্রতি ইনসাফ করাই মানুষের কর্তব্য। এবং নিজেরা যেন সেই কর্তব্য পালনে তৎপর হই। ঐক্যবদ্ধ তৎপরতাই জন্ম দিতে পারে নতুন সম্ভবনা।
(ডেইলি টাইমস ২৪ ডটকম)
©somewhere in net ltd.