নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার সব লেখা

ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী

চিকিৎসক এবং লেখক

ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

অবক্ষয়

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১০

‘স্যার, একটা কথা বলব? যদি কিছু মনে না করেন।‘

কথাটা যদিও চিকিৎসক জানেন, তারপর ও ভান দেখান কি বলবে আঁচ করতে পারছেন না।

এরপর আরও একটু হিন্টস যোগ হবে, ‘ব্যাপারটাকে স্যার অন্য ভাবে নিয়েন না।‘ অর্থাৎ ব্যাপারটায় একটা অনৈতিক ভাব আছে। সেটাকে উপেক্ষা করতে হবে।

এরপর বেশ বিনীত গলায় আসে আসল অনুরোধ কিংবা আরও ভালো করে বললে বলা যায় উৎকোচের প্রস্তাব।

‘স্যার, সিলেক্টেড কিছু ডক্টর দের জন্য কোম্পানি থেকে কিছু অফার থাকে। আপনি অনুমুতি দিলে স্যার, আপনার নাম পাঠাতে চাই।‘

খুব সোজা ভাষায়, মাসোহারা। কিংবা বার্ষিক উৎকোচ। যে শর্তটা উহ্য থাকে তা হচ্ছে, বিনিময়ে আমার কোম্পানির ঔষধ লিখতে হবে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে। এবং প্রায় প্রতিটি প্রেস্ক্রিপশানে।

এমনটা কি সচরাচর হয়? ব্যাপারটা এতো সোজা সাপটা না। এই প্রস্তাবটাই কিছুদিন আগে পর্যন্ত সেই ডাক্তারকে দেয়ার চিন্তা তাঁরা করে নি। কারণ এতদিন সেই ডাক্তার সাহেবের রুগীর সংখ্যা বেশ নগন্য ছিল। এতদিন তাই একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ ছিল তাঁকে ‘ভিজিট’ করা। ভিজিটের সময় কিছু ‘ফিজিশিয়ান’স স্যাম্পল’ ঔষধ দেয়া। ‘এইটা স্যার আমাদের কোম্পানির গেট আপ’। আর থাকতো এটা টোপ, ‘স্যার আপনার পার্সোনাল কোন ওষুধ লাগলে বলবেন’। অর্থাৎ তাঁর এবং তাঁর পরিবারের ব্যক্তিগত ওষুধ বিনে পয়সায় সরবরাহ করা হবে। বিনিময়ে ডাক্তার সাহেব কৃতজ্ঞতা বশে তাঁদের ওষুধ লিখবেন।

এতদিন সেই ডাক্তার সাহেবকে তাঁরা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কি জাতীয় ওষুধ লেখেন, চিকিৎসা কেমন, রুগী সুস্থ করবার ক্ষমতা কেমন। এতসব পরীক্ষায় পাশ করে ডাক্তার সাহেব তাঁদের ‘সিলেক্টেড’ লিস্টে উঠে এসেছেন। তাই এখন চেষ্টা ডাক্তার সাহেবকে হাতে করা, যেন এই বেশী সংখ্যক রুগীদের অধিকাংশের প্রেস্ক্রিপসানে তাঁদের কোম্পানির ওষুধ যায়।

চিকিৎসকদের নষ্ট করবার এই প্রচেষ্টা সম্ভবতঃ শুরু হয় ইন্টার্ন অবস্থা থেকে। উৎকোচ ব্যাপারটা সরাসরি না দিয়ে তখন দেয়া হত ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’। তখন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভিজিট করবার সময় যে ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’ ওষুধ দেয়া হত তাঁর অনেকটাই তাঁদের কাজে লাগতো না। হাসপাতালের আশে পাশের কোন ওষুধের দোকানদার একসময় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলতো, স্যার ঔসুধগুলো না লাগলে আমাকে দিয়েন স্যার। যা মার্কেট রেট তাঁর সিক্সটি পারসেন্ট দিব।‘ অনেক ওষুধ ই প্রয়োজন হয় না, তাই এই অফারটা তাঁর কাছে মন্দ লাগে না। রাজী হয়। মনে বাসা বাধতে শুরু করে লোভ। শুরু হয় তাঁর অবক্ষয়।

ইন্টার্নশিপ চলাকালীন সময়ে আরও কিছু টোপ চারপাশে ঘুরপাক করে। সুন্দর একটি কলম, সুন্দর প্যাড—‘স্যার এই সুন্দর জেল পেনটা খুব অল্প এসেছে, আপনার জন্য স্যার একটা স্পেশালি রেখে দিয়েছি।‘ বাকীটুকু বলতে হয় না। ডাক্তার সাহেব এরপর থেকে ওষুধ লিখলে সেই কোম্পানির ওষুধই লিখেন। এরপর সেই দুষ্ট চক্র থেকে, সেই চিকিৎসকের আর বের হওয়া হয় না।

কাজটা কি অনৈতিক? সমস্যাটা বেশ মজার। একজন চিকিৎসকে তো ওষুধ লিখতেই হবে। এবং কোন না কোন কোম্পানির ওষুধ। সেই ‘কোন’ টা ঠিক করবেন সেই ডাক্তার। কোন একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লেখা অন্যায় না। কেন লিখছেন তা জানবারও কোন উপায় নেই। কোম্পানি টিকে রিলায়েবল মনে করছেন, না উৎকোচের কারণে তা কেবল মাত্র তাঁর বিবেক জানে। এছাড়াও ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পরিচিত কেউ যদি কোম্পানিতে চাকরী করে কিংবা নেহাত ব্যবহার ভালো যেকোনো কারণেই একজন চিকিৎসক একটি কোম্পানিকে পছন্দ করতে পারেন।

আর উৎকোচ ব্যাপারটাকে যুক্তিসঙ্গত করার জন্য তাঁর কাছে বেশ কিছু যুক্তি আছে। ‘আমাকে তো কোন কোম্পানির ওষুধ লিখতেই হবে, এদের ওষুধ লিখলে অসুবিধা কি? কোন অন্যায় তো করছি না।‘ অন্যায়টা হয়তো এই মুহূর্তে খুব বেশী নাই, তবে অচিরেই শুরু হয়ে যাবে। অনুরোধ আসবে, ‘স্যার, আমাদের মাল্টিভিটামিন বেশ অনেকগুলো দোকানে জমে গেছে, সুযোগ হলে একটু লিখে দিয়েন।‘ এবার শুরু হবে অপ্রয়োজনে ওষুধ লেখা। এজন্যও যুক্তি আছে, ‘আমাদের যা নিউট্রিশান প্রয়োজন তাঁর সবটা আমরা ডেইলি খাবার থেকে পাই না, কিছু রান্নার কারণে নষ্ট হয়। তাই একটু একটা মালটিভিটামিন দিলে কিছু অভাব পূরণ হবে।‘

সুন্দর একটা কলম আর প্যাড দিয়ে শুরু হওয়া এই অবক্ষয় আর্থিক উৎকোচে এসে থামে। কখনও সরাসরি টাকা নেন কখনও বিদেশ ভ্রমণের স্পনসরশিপ নেন। কখনও সেমিনার অনুষ্ঠানের চাঁদা হিসেবে, কখনও বার্ষিক প্রতিবেদন কিংবা জার্নালের অ্যাড দিয়ে। চিকিৎসকের দাম নির্ভর করে তাঁর রুগীর সংখ্যার ওপর। অল্প হলে হয়তো মাসে একটি ৩০০ টাকার ফ্লেক্সি লোড আর বেশী হলে ইউরোপ আমেরিকা ভ্রমন করিয়ে আনা। গাড়ী গিফট কিংবা ফ্রি গাড়ী ব্যবহার করতে দেয়া কিংবা গাড়ী সার্ভিসিং করিয়ে দেয়া। এসি কিংবা ওয়াশিং মেশিন। কখনও দামী মেডিকেল বই।

বাহানা বিভিন্ন থাকে। কখনও ‘কোম্পানির পলিসি’ কখনও লোক দেখানো একটা লটারি করে ‘লটারীতে উঠেছে’ বলে। কখনও চিকিৎসক নিজেই প্রয়োজনের কথা জানান, কখনও অফার আসে। কখনও দাম দর হয়, ‘আমার এই ওষুধটা তাহলে স্যার অন্য কোন কোম্পানির লিখতে পারবেন না।‘ এরপর থেকে তিনি বাইরে পাহারায় থাকেন। কখনও মনে করিয়ে দেয়া ‘স্যার সাপোর্ট টা একটু কম পাচ্ছি।’

সঙ্গে থাকে নতুন টোপ, ‘সামনে বছর স্যার বাড়ানোর জন্য কোম্পানিকে বলেছি।‘

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ‘ফাটল-ঝাঁকি’ তত্ত্ব দিয়ে হয়তো মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিংএ ধস নামান যায় না, তবে বিবেকের এই ফাটল এ ঝাঁকি দিয়ে একজন চিকিৎসকের চরিত্রে অনায়াসেই ধ্বস নামান যায়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ‘ফাটল-ঝাঁকি’ তত্ত্ব দিয়ে হয়তো মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিংএ ধস নামান যায় না, তবে বিবেকের এই ফাটল এ ঝাঁকি দিয়ে একজন চিকিৎসকের চরিত্রে অনায়াসেই ধ্বস নামান যায়।

++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.