![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বর্তমান সরকারের শাসনামলে কারাভোগের সময় তার অভিজ্ঞতা গুলো প্রকাশ করেছেন আমার দেশ পত্রিকায়। কারাগারের ভিতর তার এই কঠিন অজ্ঞতা গুলো ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করা হল :
সাত নম্বর সেলের দুই নম্বর কুঠুরি থেকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা
মাহমুদুর রহমান
আজ জুলাইর প্রথম প্রভাত। ইংরেজি সন ২০১০। বাংলা তারিখ ১৭ আষাঢ় ১৪১৬। জীবন আর মৃত্যুর একেবারে সীমান্তে দাঁড়িয়ে তিরিশটি দিন পার করার পর প্রথমবারের মতো কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করছে। না, কোনো প্রাণঘাতী অসুস্থতায় আক্রান্ত হইনি। তবে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে কি-না, এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পর্যায় যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, সেটি এই একটি মাস প্রতিটি মুহূর্তে মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। মনের ভেতরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি সবিনয়ে সাঙ্গ করে রেখেছিলাম। যে অসহায় মা এবং স্ত্রীকে ঘরে রেখে গ্রেফতার হয়েছি, তাদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না এমন আশঙ্কায় হৃদয় ভেঙে-চুরে গেলেও অনেক চেষ্টায় বাইরে থেকে অবিচল থেকেছি। অবশ্য তাদের সঙ্গে মুক্তজীবনে কতদিন পর আবার দেখা হবে, সেটিও মহান আল্লাহতায়ালাই জানেন। আমাকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনে ক্ষমতাসীনদের বিদেশি মুরব্বি রাষ্ট্রগুলোর শতভাগ সমর্থন থাকলেও একেবারেই শেষ করে দেয়া নিয়ে সম্ভবত তাদের মধ্যে মতদ্বৈধ রয়েছে। সে কারণেই আমাকে হত্যার কাজটা শুরু করেও সমাপ্তি টানা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহ এখনও তাঁর এই অকিঞ্চিত্কর বান্দাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নেয়ার সময় নির্ধারণ করেননি।
লেখার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গত তিরিশ দিনে কলম একেবারেই স্পর্শ করিনি, তা নয়। ডাইরি লেখার অভ্যাস আমার কস্মিনকালে না থাকলেও গ্রেফতারের পর থেকেই সময়-সুযোগমত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ভবিষ্যতের রসদ হিসেবে টুকরো টুকরো কাগজে টুকে রাখতে ভুল হয়নি। রিমান্ড চলাকালে লেখা সম্ভব ছিল না। তবে, সেই বিভীষিকাময় স্থানগুলো থেকে কারাগারে ফেরামাত্র কোনোরকম বিশ্রাম না নিয়ে আগে লেখার টেবিলে কাজে বসে গেছি। কাজেই আজও লিখতে বসে পুঁজির অভাব হচ্ছে না। কিন্তু, সমস্যা অন্যত্র। আমি যে লিখতে জানি না, সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? প্রকৃতি যেমন আপন প্রয়োজনে শূন্যকে পূর্ণ করে, তেমন করেই তো এক-এগারোপরবর্তী এক বিশেষ সময়ের প্রয়োজন মেটাতেই আমি কলাম-লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলাম। তাগিদটা এসেছিল ভেতর থেকে। কিন্তু নাজিমউদ্দীন রোডের বন্দিশালার সাত নম্বর সেলে বসে কী লিখি? বন্দি জীবনের স্মৃতিচারণ আর পত্রিকার কলাম লেখার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। ব্যক্তিগতভাবে আত্মজীবনীমূলক লেখায় আমার কোনো উত্সাহ নেই। বাগাড়ম্বর করে নিজেকে মহত্ দেখানো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আত্মজীবনী তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তির মহান খণ্ডিত ও অনেকাংশে কাল্পনিক চিত্র হয়ে ওঠে। এর মধ্যেও ব্যতিক্রম হয়তো আছে। আমি কোনোক্রমেই সেই ব্যতিক্রমীদের মধ্যে পড়ি না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যথাসম্ভব
নিরাসক্তভাবে ঘটনা বর্ণনা করে যাব। এর মধ্যে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যে ছবি অবধারিতভাবে ফুটে উঠবে, তার ন্যায্যতা-অন্যায্যতার মূল্যায়ন করার দায়িত্ব আমার নয়। জীবিত থাকি আর না থাকি, যদি কোনোদিন এ লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁছায়, তাহলে সে কাজটি তারাই করবেন। এক মাস ধরে অনেক ভেবে যখন লেখকের ভূমিকাটি উপলব্ধিতে এসেছে, তারপরই কেবল লিখতে বসেছি। রিমান্ডের ফাঁকে ফাঁকে এই এক মাস বহিরাঙ্গে প্রশান্ত কিন্তু ভেতরে সর্বক্ষণ ছটফট করেছি। হাতে বন্ধ্যা কলম নিয়ে সাত নম্বর সেলের দুই নম্বর কুঠুরির লোহার মোটা মোটা শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখন আমি নির্ভার। এবার শুরু হোক আমার কথকতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আমাকে জেলে পুরবেনই, সেটা আমার জানাই ছিল। ২০০৯-এর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে তার পুত্র এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের আনুষ্ঠানিক, সরকারি কাগজপত্র আমার দেশ-এর সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ হাতে পাওয়ার পর পুরো একটি দিন সেই সংবাদ ছাপানোর ঝুঁকি বিবেচনা করেছি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় পেশা বদল করে সম্পাদক হয়েছি। হয়তো সেজন্যই যে সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ, যার সমর্থনে কাগজপত্র রয়েছে, সেই সংবাদ চেপে রেখে নিজে বিপদমুক্ত থাকতে মন সায় দেয়নি। ঘটনার অবধারিত ধারাবাহিকতায় এই বছরের জানুয়ারি মাসে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের তাবত্ অংশে আনুষ্ঠানিক চিঠি যা সরকারি পরিভাষায় ডিও নামে অভিহিত, পাঠানো হয়। দেশের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এমন চিঠি দিতে পারে কি-না, সেই তাত্ত্বিক অথবা আইনি প্রশ্ন ফ্যাসিবাদকবলিত বাংলাদেশে উত্থাপন করা অর্থহীন। এই রাষ্ট্রে সরকার-পরম্পরায় ক্রসফায়ার পর্ব পেরিয়ে ষাট-সত্তর দশকের চিলি, আর্জেন্টিনার মতো আমরা এখন গুম-খুনের জমানায় প্রবেশ করেছি। জেলের এই তিরিশ দিনেই এ-জাতীয় অসংখ্য লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী জেনেছি, যেগুলো প্রসঙ্গক্রমে ক্রমান্বয়ে বর্ণনা করব। তার আগে আপন অভিজ্ঞতার গল্প। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডিও’র ব্যাপারে জেনে যাওয়ার পরই স্ত্রীকে বলেছিলাম, আমাকে হারানোর মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। মাকে বিশেষভাবে না বললেও ঘনায়মান বিপদের ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি একেবারে অন্ধকারে ছিলেন না। তবে গ্রেফতারের রাতের পূর্বপর্যন্ত সরাসরি কখনও আলাপ করিনি, মা আর ছেলের মধ্যে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা আর কি! জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেতাম প্রধানমন্ত্রী নাকি আমার গ্রেফতারে দেরির জন্য ভয়ানক ক্ষুব্ধ। ঘনঘন বিদেশযাত্রার আগে এবং প্রত্যাবর্তনের পরে এ বিষয়ে মনিটর করা তার রুটিনে পরিণত হয়েছিল। বশংবদ দুদক নির্দেশমত ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই আর ধৈর্য রাখতে পারছিলেন না। ঘটনার অন্ত টানতে তাই শেষপর্যন্ত এগিয়ে আসে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা—এনএসআই। ৩১ মে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় পরবর্তী দশ দিনের মধ্যে আমাকে গ্রেফতার এবং ‘আমার দেশ’ বন্ধ করা হবে। একজন সাংবাদিক জুনের এক তারিখ সকাল এগারোটার দিকে ফোনে আমাকে এই সংবাদ দেন। আমি তখন আর্টিজান সিরামিকের উত্তরা অফিসে নিজ কক্ষে বসে কাজ করছিলাম। আগেরদিন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সভাটির স্থান নিয়ে খানিকটা বিতর্ক রয়েছে। দু’টি সম্ভাব্য স্থানের কথা আমাকে জানানো হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কিংবা এনএসআই কার্যালয়ের মধ্যে যে কোনো একস্থানে চূড়ান্ত মিটিংটি অনুষ্ঠিত হয়। আমার স্ত্রী এবং আর্টিজান সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজার অফিসে আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত অবস্থাতেই আমার অপর সহকর্মী সাংবাদিক খবর দিলেন, সকাল ৯টায় হাসমত আলীকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা বাসা থেকে উঠিয়ে এনএসআই কার্যালয়ে নিয়ে গেছে। সংস্থাটির প্রভাবশালী এক পরিচালককে পুরো অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চাকা যে অতি দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে, সেটি বুঝতে অসুবিধা হলো না। স্ত্রী অফিসে এলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রেস ক্লাবের উদ্দেশে রওনা করলাম। বিদায়ের সময় আবেগতাড়িত হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না; বরং ঘটনার আকস্মিকতায় দু’জনাই হতবিহ্বল। এ দিনটি আসবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি! ঘর থেকে বার হয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রীর মাথায় হাত দিয়ে শেষবারের মতো দোয়া করাও হয়ে ওঠেনি। মনে হয়েছিল, গ্রেফতারের জন্য সরকার আরও কয়েকটা দিন সময় নিতেও পারে। উত্তরা থেকে প্রেস ক্লাব যাত্রাপথেই সর্বশেষ পরিস্থিতির ওপর বেসরকারি সংবাদ সংস্থা শীর্ষ নিউজকে টেলিফোনে সাক্ষাত্কার দিলাম। হাসমত আলীর নিরাপত্তা নিয়ে তখন আমার গভীর উত্কণ্ঠা। প্রেস ক্লাবে পৌঁছে সরাসরি গেলাম সভাপতি শওকত মাহমুদের কক্ষে। সেখান থেকেই আবারও অন্য বেসরকারি সংবাদ সংস্থা বিডি নিউজকেও সাক্ষাত্কার দিলাম। ততক্ষণে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শওকত মাহমুদের সৌজন্যে আহারপর্ব সাঙ্গ করলাম। সহকর্মী আবদাল, গনি এবং সাংবাদিক রওনাক আর শওকত মাহমুদ খাওয়ার সময় সঙ্গ দিয়েছিলেন স্মরণে আছে। বিকাল তিনটায় প্রেস ক্লাব থেকে আমার দেশ-এর উদ্দেশে যাত্রার আগেই সেখানে বিকাল পাঁচটার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনও সমাপ্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের লেবাসধারী সরকারের চরম স্বৈরাচারী আচরণের ইতিহাস জাতির জেনে রাখা দরকার।
আমার দেশ কার্যালয়ে আমার কক্ষে পৌঁছানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই টেলিফোন অপারেটর জানালো হাসমত আলী টেলিফোনে অপেক্ষমাণ। স্বস্তি এবং কৌতূহল নিয়ে ফোন ধরতেই ওপারে ভদ্রলোকের আতঙ্কমিশ্রিত গলার আওয়াজ পেলাম। তার বক্তব্যের সারাংশ হলো, সকাল ন’টায় সাদা পোশাকধারী লোকজন তাকে বাসা থেকে উঠিয়ে এনে এনএসআই কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, সেই বর্ণনা পরিষ্কারভাবে না দিয়ে তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধু বললেন, ওখানে মানুষ যায়! এই একটিমাত্র বাক্যে হয়তো তার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। হাসমত আলীর জবানিতেই জানলাম, বন্দিত্বের একপর্যায়ে তার কাছ থেকে দু’টি কাগজে জোর করে সই নেয়া হয়েছে। পরে এই দুই কাগজেরই একটি গেছে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে এবং অপরটি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাসমত আলী সরকারের নীলনকশার অংশীদার হতে সম্মত হওয়ার পরই দুপুর দুটোর দিকে এনএসআই অফিস থেকে ছাড়া পেয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন। শেখ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী তার পুলিশ যে ওইদিনই আমাকে গ্রেফতার করবে, এ নিয়ে আমার আর কোনো সংশয় থাকল না। ততক্ষণে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমার দেশ-এর খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। শীর্ষ নিউজ ডট কম তাদের ওয়েবসাইটে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দিচ্ছে। ফ্যাসিবাদী সরকার যে সর্বদা নির্জলা মিথ্যার ওপরই নির্ভর করে, তার প্রমাণ পেতেও দেরি হলো না। ‘অপারেশন আমার দেশ’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এনএসআই পরিচালক স্বগৃহ থেকে হাসমত আলীকে অপহরণ করার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছে বেমালুম অস্বীকার করলেন।
এদিকে উদ্বিগ্ন শুভানুধ্যায়ীরা ততক্ষণে ফোন করতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ আমার দেশ কার্যালয়ে এসেও পড়েছেন। সংবাদ সম্মেলন শুরু করার আগেই স্ত্রীকে ফোন করে সাড়ে তিন বছর ধরে আমার সঙ্গে জেলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ কাপড়-চোপড়ের ব্যাগটিকে পাঠাতে বলে একপ্রস্থ বিদায় নিলাম। ফোনের ওপারে কণ্ঠ রুদ্ধ হওয়ার আভাস পেলাম। তিনজন মাত্র মানুষের দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সংসার থেকে একজনের ঝরে যাওয়ার আশঙ্কাপূর্ব মানসিক প্রস্তুতি সত্ত্বেও তাকে ব্যাকুল করে তুলছিল। সারাদিনের তুমুল উত্তেজনার ফলে সেই মুহূর্তে আবেগশূন্য থাকতে পারলেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাত নম্বর সেলে বসে পাঠকদের গল্প বলার সময় কেবলই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে বারবার চশমার কাচ মুছেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কই? নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই আমি কর্মজীবনে নানামুখী সাফল্য পেলেও সমস্তটা জীবন ধরে আমার ছোট সংসারের মানুষগুলোকে বড় অবহেলা করার আক্ষেপ জীবনের পড়ন্ত বেলায় অসহনীয় বোধ হচ্ছে। তারাশঙ্করের মতো বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ভালবেসে মিটিল না সাধ, জীবন এত ছোট কেনে?’
বিকেল পাঁচটার সংবাদ সম্মেলনে আমার দেশ নিয়ে প্রশাসনের বেআইনি কার্যকলাপের বিবরণী সপ্রমাণ তুলে ধরলাম। প্রাসঙ্গিক সব কাগজপত্রের অনুলিপি তুলে দিলাম সংবাদমাধ্যমের উপস্থিত সহকর্মীদের হাতে। উপস্থিত সাংবাদিকরা সহজেই বুঝতে পারলেন তথ্য মন্ত্রণালয় আমাকে প্রকাশক হিসেবে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিলেও ঢাকা জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে অসত্ উদ্দেশ্যে সামান্য দাফতরিক একটি রুটিন কাজ মাসের পর মাস ফেলে রেখেছেন। এই গর্হিত অপরাধের জন্য জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে এখন আমাকে জেলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। বলে রাখা দরকার, সংবাদ সম্মেলন চলাকালীনই আমার দেশ কার্যালয় যে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার মালিকানাধীন ইমারতে অবস্থিত, তার নিচতলায় সাদা পোশাকে অসংখ্য পুলিশ অবস্থান নিতে শুরু করেছে। তখন পর্যন্ত ঢাকার জেলা প্রশাসক পত্রিকার ডিক্লারেশনও বাতিল করেননি কিংবা শিল্পাঞ্চল থানায় আমার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়নি। অথচ সর্বশেষ ব্যবস্থায় শত শত পুলিশ আসতে শুরু করেছে। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে অফিস কক্ষে ফিরে এলাম। আমার দেশ পত্রিকা অফিস ততক্ষণে অন্যান্য সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকর্মীতে ভরে গেছে। নিজের ঘরে ফিরেই শুনলাম, আমার গাড়িসহ এগারোতলা ইমারতের নিচতলা পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। শুরু হলো দীর্ঘ অবরোধ। বাংলাদেশে সম্পাদক গ্রেফতারের পরম্পরা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমান চালু করেছিলেন। কবি আল মাহমুদ, এনায়েতুল্লাহ খান, আবদুস সালাম, ইরফানুল বারী প্রমুখ গ্রেফতার হয়েছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে। পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক এরশাদ গ্রেফতার করেছিলেন আতাউস সামাদকে এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে তোয়াব খান ও বোরহান আহমেদও গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু প্লাটুনের পর প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ পাঠিয়ে একটি পত্রিকা অফিসকে এমন করে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেনি কোনো সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলগত মিত্র এবং পূর্বসূরি জেনারেল মইনের প্রচ্ছন্ন সামরিক সরকারের পাইক-বরকন্দাজদের বুটের আঘাত অবশ্য অনেক পত্রিকা অফিসকেই এক-এগারোপরবর্তী সময়ে সইতে হয়েছে। আজ যারা আমার দেশ বলাত্কারের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করছেন, তাদের অনেককেই চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মহাজোটের আন্দোলনের ফসল সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযানের অংশ হিসেবে। এদের দুর্বল স্মৃতিশক্তি দেখে করুণা হয়। যা-ই হোক, কী ঘটতে চলেছে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আমরা প্রতি সন্ধ্যার মতো পত্রিকার মেকআপের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। রাত আটটার দিকে নিচ থেকে সংবাদ পেলাম, গাড়ির পর গাড়ি দাঙ্গা পুলিশ এসে চত্বর ভরে ফেলেছে। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগল। অবরোধকারী পুলিশ সাংবাদিকদেরও আর এগারোতলায় উঠতে দিচ্ছিল না। এদিকে টেলিভিশন চ্যানেলে তখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে কাজে লেগে গেলাম যাতে যত দ্রুত সম্ভব সেলোফেন ছাপাখানায় পাঠানো সম্ভব হয়। ধারণা করছিলাম, যে কোনো সময় সেখানেও পুলিশ পৌঁছে যাবে। রাত দশটার মধ্যেই প্রথম সংস্করণের সেলোফেন পাঠিয়েও দেয়া গেল। সোয়া দশটায় খবর পেলাম ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। আনন্দিত হয়ে ভাবলাম, অন্তত পরদিনের সংবাদপত্র পাঠকদের হাতে দিতে পারব। পৌনে এগারোটায় প্রেস মহাব্যবস্থাপক আহমদ হোসেন মানিক ফোন করে জানালেন, কয়েকশ’ পুলিশ প্রেস ঘিরে ফেলেছে। প্রায় একই সময় প্রধান কার্যালয়ের নিচতলা থেকে খবর এলো দাঙ্গা পুলিশ সিঁড়ি বেয়ে এগারোতলার উদ্দেশে উঠতে শুরু করেছে। কম্পিউটার বিভাগকে তাত্ক্ষণিক নির্দেশ দিলাম সংবাদপত্রের সফট কপি ওয়েবে তুলে দেয়ার জন্য, যাতে বিশ্ববাসী তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের চরম ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। এর মধ্যেই অগ্রজপ্রতিম ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আসন্ন গ্রেফতারের সংবাদ দিয়ে আইনি লড়াইয়ে তার সহযোগিতা চাইলাম। তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার সাধ্যমত চেষ্টা চালানোর দৃঢ় সঙ্কল্পের আশ্বাসটুকুই কেবল দিতে পারলেন। বাংলাদেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এই আইনজীবীকে দীর্ঘদিন ধরে চেনার সুযোগ হয়েছে। এদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে তার সহানুভূতি সেক্যুলারদের প্রতিই অধিকতর মনে হয়েছে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সামরিক সংযোগের বিষয়টি তিনি কখনোই সর্বান্তঃকরণে অনুমোদন করেননি। অবশ্য জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের অসাধারণ সত্ ব্যক্তিচরিত্রের প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেন। তার তুলনামূলক পছন্দের দলের এই অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারবিরোধী আচরণ তাকে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত করেছে বলেই মনে হলো। এক-এগারোর অপশাসনের দুই বছরে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে দু’জনা দিনের পর দিন আলাপ-আলোচনা করেছি। তার পুরানা পল্টনের চেম্বারে বসে থাকার সময় আজকের ক্ষমতাবানদের আত্মীয়-স্বজনের কত অশ্রুজলের সাক্ষী আমি নিজে। (চলবে)
ভোরের আজানের ধ্বনি আমাকে সেই ভরসাই দিয়ে গেল
মাহমুদুর রহমান
পুলিশ হেফাজতে আমার নির্যাতন এখন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম চেষ্টায় রিমান্ডে নিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বার যে তারা ব্যর্থ হবে না, সে ব্যাপারে আমি এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছি। কতখানি নির্যাতন সইতে পারব, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য.....
(গতকালের পর)
আমাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে এগোতে চেষ্টা করছে। ভেতর থেকেই শুনতে পাচ্ছি অনেকের কণ্ঠে ‘মাহমুদ ভাই’ ডাক এবং পুলিশের মুহুর্মুহু হুইসেলের আওয়াজ। সিএমএম আদালতের সামনের রাস্তায় অপেক্ষমাণ আইনজীবী, সাংবাদিক, প্রকৌশলী এবং সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের মুখে আমাকে কোর্টে নেয়া সম্ভব হলো না। অবস্থা বেগতিক হয়ে ওঠায় শেষ পর্যন্ত শত শত পুলিশের প্রহরায় প্রিজন ভ্যান ঢুকে গেল কোর্ট গারদ চত্বরে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমে ভ্যানের মধ্যেই সেদ্ধ হচ্ছি। আশপাশের বিল্ডিং-এ ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকরা ততক্ষণে অবস্থান নিয়েছেন। আইও আহাদ ভ্যানের তালা খুলে একজন কনস্টেবলসহ প্রবেশ করল। দু’জনার হাতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হেলমেট। যুগপত্ বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাতেই পুলিশের গত্বাঁধা বুলি আউড়ে জানাল, আমার নিরাপত্তার জন্যই নাকি এই চরম অবমাননাকর আয়োজন। যেন আমি ভয়ঙ্কর কোনো সন্ত্রাসী। হয় আমাকে মেরে ফেলা কিংবা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যান থেকে বাইরে পা দিলেই অস্ত্র হাতে হাজার হাজার সন্ত্রাসী ঝাঁপিয়ে পড়বে! এক-এগারোর সময়ে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে এই আদালতেই হেলমেট, জ্যাকেট পরিয়ে আনার দৃশ্য মনে পড়ে গেল। জেএমবি এবং হুজির লোকজনকেও একইভাবে আদালতে হাজির করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। বুঝতে অসুবিধে হলো না, মিডিয়া-সার্কাসের মাধ্যমে চরিত্রহননের চেনা কৌশল আমার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হতে যাচ্ছে। আমাকে পুরোপুরি চিনতে বর্তমান প্রশাসনের তখনও বাকি ছিল।
আমি বেঁকে বসলাম। আমার সাফ কথা, হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানোর আগে প্রিজন ভ্যানের ভেতরেই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। আইও আবদুল আহাদ আমাকে বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। তার কাছ থেকে শুনলাম, আমার নাকি অনেক শত্রু, জ্যাকেট আর হেলমেট কেবল আমার অমূল্য প্রাণ রক্ষার জন্যই ‘সদাশয় সরকার’ বিশেষভাবে ব্যবস্থা করেছে। আমি অটল রইলাম। দল বেঁধে আসা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানারকম হুমকিতেও কাজ হলো না। আমার অনমনীয়তার কাছে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের লেবাসধারী মহাজোট সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। তখনও বাইরে পুলিশের সঙ্গে আইনজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবীসহ প্রতিবাদী জনতার ধাক্কাধাক্কি চলছে। আরও ঘণ্টাখানিক অপেক্ষার পর অনেক কসরত করে প্রিজন ভ্যান কোর্টের একেবারে দোরগোড়ায় নেয়া হলো। চারদিকে স্লোগান এবং শত শত পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে হেলমেট, জ্যাকেট ছাড়াই মাটিতে পা দিলাম। এর মধ্যেই অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার দুটো ওকালতনামায় আমার সই নিয়ে গেছেন। তখনই প্রথম বুঝেছি, সরকার নতুন একটি মামলা অন্তত দায়ের করেছে। তবে কী প্রকৃতির মামলা, সেটি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগে টের পাইনি। অসংখ্য পুলিশ এবং জনতার ভিড় ঠেলে দুর্বল শরীরে সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হলেও পিঠ সোজা রেখেই আদালতে পৌঁছে সোজা কাঠগড়ায় উঠলাম। সানাউল্লাহ মিঞা, মাসুদ তালুকদার, খোরশেদ আলমসহ অনেক আইনজীবী আমার জন্যে দাঁড়ালেন। সরকারও তার পিপিবাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছে। এজলাসে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যুক্তি-তর্ক শুরু হলো। হাসমত আলীর দায়ের করা জামিনযোগ্য, বানোয়াট মামলায় সহজেই জামিন পেয়ে গেলাম। তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় মামলা। এই মামলায় বাদী তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পূর্বরাতে আমার দেশ কার্যালয় থেকে আমাকে গ্রেফতারের সময় পুলিশকে নাকি আমারই নির্দেশে কর্তব্য-কর্মে বাধা দেয়া হয়েছে। কেবল মামলা দায়ের নয়, পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডও প্রার্থনা করল। এবার সত্যিই ধাক্কা খেলাম। মইন ও তার মার্কিন এবং ভারতীয় প্রভুর বিরুদ্ধে কলম ধরার দিন থেকেই জেলখানায় আসার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের একজন সম্পাদককে কোনো সরকার নির্যাতন করার অভিপ্রায়ে বানোয়াট মামলায় রিমান্ডে নিতে পারে—এমন চিন্তা কখনও মাথায় আসেনি। মনে পড়লো, পত্রিকার দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনেই আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের মানবাধিকার প্রশ্নে আমার অনমনীয় অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সেই থেকে ক্রসফায়ার, রিমান্ডে নির্যাতন, গুম-খুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে আমরা জনমত গঠনের অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে গেছি। গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হবে, এটা মানতে পারিনি কোনোদিন। আজ আমিই রিমান্ডের শিকার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। উপস্থিত সবাইকে কিছুটা অবাক করেই তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট সরকারপক্ষের রিমান্ডের আবেদন খারিজ করে তিন দিনের মধ্যে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের রায় শোনানো মাত্র প্রসিকিউশনের এক আইনজীবীকে উচ্চস্বরে ম্যাজিস্ট্রেটকে রাজাকার বলে গাল দিতে শুনলাম। উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্কের পুরোটা সময় ধরে একই ব্যক্তি আমাকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন ধরনের খিস্তি-খেউড় ও অঙ্গভঙ্গি করে যাচ্ছিল। অনেক গালাগালের মধ্যে টাউট শব্দটা বেশ পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় মামলায় জামিন অবশ্য হলো না। এক-এগারোর অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরার দিন থেকে জেলে যাওয়ার যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, আজ সেটাই ঘটতে চলেছে। থানার হাজত ইতোমধ্যে দেখা হয়েছে, এবার প্রকৃত জেল দেখতে চলেছি। রিমান্ড আটকাতে পেরে আমার পক্ষের আইনজীবী ও আদালতে উপস্থিত পেশাজীবী নেতারা এক ধরনের স্বস্তিসহ আমাকে বিদায় জানালেন। তাদের অভিব্যক্তিতে মনে হলো, স্বল্প সময়ের জন্য আমি যেন কোথাও বেড়াতে চলেছি। এদিকে আমার মন তখন বলছে, এক দীর্ঘ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এই যাত্রা। রিমান্ড চাওয়ার মাধ্যমে সরকারের হীন চক্রান্ত প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে আমার নির্যাতন এখন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম চেষ্টায় রিমান্ডে নিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার বিফল হলেও দ্বিতীয়বার যে তারা ব্যর্থ হবে না, সে ব্যাপারে আমি এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছি। কতখানি নির্যাতন সইতে পারব, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য। হাসিমুখেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। আজ অন্তত গত রাতের মতো গন্তব্য নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তায় ভুগছি না। প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যয়নকালে পুরনো ঢাকা থেকে বহুদিন নাজিমউদ্দীন রোডের জেলখানার উঁচু প্রাচীরের পাশ দিয়ে রিকশা করে বুয়েটে গেছি। সেই উঁচু প্রাচীরের ভেতরের পৃথিবীর বাসিন্দা হব আজ থেকে। ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে তার প্রয়োজনীয় ভিসা দিয়েছেন।
জুন মাসের ২ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আমাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি থামল কারাগারের প্রধান ফটকের গা ঘেঁষে। ব্যাগ হাতে নেমে বিশাল প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পেছনে পড়ে রইল আমার ৫৭ বছরের মুক্ত জীবন। ভেতরে আলো-আঁধারি। পার হয়ে আসা দীর্ঘ সময়ের চিহ্ন কারা অফিসের চারদিকে। কোন দিকে যাব বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়ালাম। একজন কারারক্ষী ইশারা করল ডান দিকের গলিপথের দিকে। বেশ খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই সেখানে একজন জেল কর্মকর্তার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো, তিনি আমার পরিচয় জানেন। সামনের চেয়ারে বসতে বলে সেই ডেপুটি জেলার নিজের কাজে মন দিলেন। আধঘণ্টাখানিক পর মাথা তুলে জানালেন, আমার ডিভিশন প্রাপ্তির কোনো আদেশ নাকি তারা পাননি। কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গেই মনে করিয়ে দিলেন পরের দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় রোববারের আগে আদালতের সেই আদেশ জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাত্ অন্তত তিন দিন আমাকে আম-কয়েদিদের সঙ্গে কাটাতে হবে। জেল কোড অনুযায়ী সচিব পর্যায় পর্যন্ত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এবং জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকের ক্ষেত্রে ডিভিশন পাওয়ার জন্যে আদালতের নির্দেশের প্রয়োজন পড়ে না। এটা প্রটোকল অনুযায়ী তাদের প্রাপ্যের মধ্যেই পড়ে। জেল কোডের প্রশ্ন তুলতেই ভদ্রলোক অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জানালেন, কোর্টের আদেশ ছাড়া আমাকে ডিভিশন দেয়া হলে তার বিপদে পড়ার সমূহ আশঙ্কা। চাকরি তো যাবেই, তার সঙ্গে উপরি হিসেবে আনুষঙ্গিক বিপদ। তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম, সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। এবার একটু বিব্রত হয়েই তিনি জানতে চাইলেন, আমি শুকনো খাবার, বোতলের পানি ইত্যাদি সঙ্গে এনেছি কিনা। নেতিবাচক জবাব শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললেন, মুশকিলে ফেললেন; এত রাতে খাবেন কী? এক রাত উপোস করতে কিংবা পিপাসার্ত থাকতে আপত্তি নেই শুনে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে তার বোধহয় কিছুটা সন্দেহ হলো। খানিকটা চুপ থেকে আড়ষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি যদি আমাকে এক প্যাকেট বিস্কুট এবং এক বোতল পানি দেন, আমি গ্রহণ করব কিনা। কোনো কথা না বলে কৃতজ্ঞচিত্তে কেবল ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাতে পেরেছিলাম। আমাদের আলাপচারিতার মাঝখানেই হৃষ্টপুষ্ট ও অতিশয় উদ্ধত এক কারারক্ষী উপস্থিত হয়ে প্রচণ্ড রুক্ষভাবে সঙ্গের ব্যাগে কী আছে জানতে চাইলে বৃথা বাক্যব্যয় না করে ব্যাগটি তার দিকে এগিয়ে দিলাম। ব্যাগের সব বস্তু মাটিতে নিক্ষেপ করা হলো। আপত্তিকর কিছু না পেয়ে লোকটির বিরক্তির পারদ কয়েকগুণ চড়ে গেল। এরপর আমার পরিধেয় বস্ত্র এবং আবৃত শরীর তার মনোযোগের বস্তুতে পরিণত হলো। অন্তর্বাসের ভেতরে লুকিয়ে মোবাইল ফোন এনেছি কিনা, জিজ্ঞাসা করেই অশালীনভাবে আমার ওপর-নিচ পরীক্ষা করা হলো। আল্লাহর কাছে তখন শুধু সবর করার শক্তি চাচ্ছি। ব্যাগের দ্রব্যাদি অবহেলায় মাটিতে ফেলে রেখেই কারারক্ষী চলে গেলে নিজেই সবকিছু কুড়িয়ে আবার ব্যাগে ভরলাম। জেল কর্মকর্তাটি লজ্জিত মুখে কেবল বলতে পারলেন, আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আজ হয়তো এখানে একটা চরম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেত। আমি যথাসম্ভব নির্বিকারভাবে বললাম, যতদূর জানি ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামির শরীর স্পর্শ করতে পারেন কেবল জেলার নিজে। একজন কারারক্ষী আপনার সামনে এই আচরণের স্পর্ধা কেমন করে পেল? এই প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে ভদ্রলোক অপর একজন রক্ষীকে ডেকে আমাকে আমদানিতে নিয়ে যেতে বললেন। ব্যাগ হাতে যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়ালাম। দ্বিতীয় একটি বিশাল দরজা পেরিয়ে এবার কারাগারের মূল অংশে প্রবেশ করলাম। রাত তখন ৯টার কাছাকাছি। দু’দিনের ধকল এবং খানিক আগের অপমানে জেলের চারপাশ দেখার উত্সাহ তখন শূন্যে। কোনো কথা না বলে রোবটের মতো সঙ্গের রক্ষীটিকে অনুসরণ করে আমদানিতে পৌঁছানোর আগেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মনে করলাম সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সব গ্লানি ধুয়ে দেয়ার জন্যই তার রহমতের দ্বার আমার জন্য খুলে দিলেন। আল্লাহ্র কাছে শোকর জানিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। আমদানিতে পৌঁছে দেখলাম, বেশ দীর্ঘ টানা একটি একতলা বিল্ডিং। সেখানকার প্রথম ঘরটি সুবেদারদের অফিস কক্ষ। বড় জেলগুলোয় দু’জন সুবেদার সচরাচর দায়িত্বে থাকেন। সুবেদার ফয়েজ এবং সুবেদার ফজলু দু’জনই উপস্থিত ছিলেন। জেলের প্রধান অফিসে যে ব্যবহার জেলে প্রবেশের পর পেয়ে এসেছি, তার তুলনায় এখানকার ব্যবহার যথেষ্ট ভদ্রজনোচিত। রাতে আমাকে যে অনাহারে থাকতে হবে, সেই সংবাদ দেখলাম এরই মধ্যে আমদানিতে পৌঁছে গেছে। সুবেদার ফয়েজ একটি ত্রিকোণাকৃতির বড় পাউরুটি দেখিয়ে জানালেন, সেটিই জেলখানার বেকারিতে তৈরি বিখ্যাত পেজগি রুটি। সেই রুটি এবং জেলেরই কোনো এক ভাণ্ডার থেকে জোগাড় করা দুই বোতল পানি দিয়ে রাতের আহারের ব্যবস্থা হলো। বৃষ্টি একটু ধরে এলে বিশাল দুই ছাতা সঙ্গে সুবেদার ফয়েজ আমাকে নিয়ে এগোলেন ঢাকা জেলে আমার বাসস্থানের দিকে। তখনও জানি না জেল কর্তৃপক্ষ আমার জন্য কী ধরনের জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে কাদাপানি পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই শুনলাম, আমরা সাত নম্বর সেলে যাচ্ছি। এর আগে শুনেছিলাম আমার মতো হাজতিদের ডিভিশন না দেয়া হলে হাসপাতালে রাখা হয়। আমি সম্ভবত জেল কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় সেই পর্যায়ভুক্তও নই। সুবেদার ফয়েজ জানালেন, সাত নম্বর সেলের দুই নম্বর কুঠুরি হবে আমার আবাসস্থল। সেখানে তিনজন আসামি ছিল যাদের এক ঘণ্টার নোটিশে পাশের তিন এবং চার নম্বর কুঠুরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে আমাকে জায়গা করে দেয়ার জন্য। তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আজ রাতের মতো আগের স্থলেই থাকবে। সুবেদার ফয়েজ আমাকে আপাতত মানিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানালে নিঃশব্দে হাসা ছাড়া আর জবাব খুঁজে পাইনি।
সেলে পৌঁছে তালা খোলা হলে অপর্যাপ্ত আলোর মধ্যেই ভেতরে ঢুকে হাতের ব্যাগটি রাখলাম। সুবেদারকে আগেই গোসলের ব্যবস্থার অনুরোধ করেছিলাম। সেলের বারান্দার ঠিক নিচেই ড্রামে পানি তোলা ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে রাতের মতো নিজের সেলে ঢুকলাম। বাইরে থেকে প্রহরী তালা লাগিয়ে দিল। অর্থাত্ জেলের পরিভাষায় আমার লক-আপ সম্পন্ন হলো। পেজগি রুটির একাংশ ছিঁড়ে রাতের আহারের পাট সাঙ্গ করলাম। অন্য আসামির ব্যবহার করা মাটিতে বালিশ ছাড়া কম্বলের বিছানায় পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই অনুভব করলাম, জেলজীবন সত্যিই শুরু হলো। স্ত্রীকে কতদিন রসিকতা করে বলেছি, অনেক কিছু দেখা হলেও জেলখানাটা এখনও দেখা হয়নি। প্রতিবারই রাগতকণ্ঠে পারভীন (স্ত্রীর ডাক নাম) বলতো, বাজে কথা বলো না তো, আল্লাহ কখন কোন কথা কবুল করেন, কে জানে! শুয়ে তো পড়লাম, কিন্তু নিদ্রাদেবী অধরা। সেই শৈশব থেকে ফেলে আসা জীবনের কত কথা মনে হতে লাগল। কোথায় যেন পড়েছিলাম, স্মৃতি সততই দুঃখের। দুঃখ তো দুঃখই। কিন্তু সুখের কথা মনে হলেও যে চোখ ভিজে আসে, সেই নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম অন্ধকার সেলের নোংরা মেঝেতে শুয়ে। কখন ঘুমিয়েছি জানি না। তবে ঘুম ভাঙল আজানের সুমধুর আওয়াজে। বিগত প্রায় কুড়ি বছর ধরে গুলশানে থাকি। সেখানে কষ্ট করে, কান পেতে আজানের শব্দ শুনতে হয়।
পুরনো ঢাকার চিত্র একেবারে আলাদা। চকবাজারের চারপাশের মসজিদগুলো থেকে আজানের সুরেলা ধ্বনি ভেসে আসছে। হঠাত্ মনে হলো যেন শৈশবে ফিরে গেছি। গেণ্ডারিয়ায় ধূপখোলা মাঠের পাশে থাকতাম। ওখানকার এক মসজিদের মুয়াজ্জিনের অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ ছিল। মাঝে মাঝে আমার নানা ভোরবেলায় ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন সেই আজান শোনার জন্য। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম রাত কাটানোর পর মনে হলো, আমি যে এখনও আল্লাহর
১৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ২:৩০
মাহমুদ ইমতিআজ বলেছেন: যদি তাই না হতেন, তাহলে তাকে নিয়ে এত নাটক করার কারন কি বলতে পারেন।
২| ১৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ২:০৩
আেনায়ার এইচ ভূইয়া বলেছেন: তিনি জেল জীবনের যে কাহিনী লিখেছেন বা লিখবেন তা কোন বিস্ময়কর ঘটনা নয়। প্রতিটি জেলবন্দীর জীবনে এগুলোই ঘটে।
১৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ২:৩১
মাহমুদ ইমতিআজ বলেছেন: মনে হয় কোথাও ভুল করছেন।
৩| ১৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ২:০৭
েতজপাতা বলেছেন: বুঝলাম মাহ্মুদুর রকমান বিশাল নেতা হইছেন।। কিন্তু আপনের লগে উনার রিলেশন কি?? উনার বিগত দিনের ইতিহাস লিখে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া গেলে বলেন... আমিও ইনকাম করতে চাই।।
এইটা নিয়া তো আগেই পোষ্ট হইসে।। কপি পেষ্ট মারেন নাকি??
১৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ২:৩৩
মাহমুদ ইমতিআজ বলেছেন: ঠিক সেই রকম না। সত্য গুলা তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র।
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই মে, ২০১১ দুপুর ১:৫৭
আেনায়ার এইচ ভূইয়া বলেছেন: ক্ষমতাসীনরা তাদের স্বার্থে জনাব মাহমুদুর রহমানকে আটক করেছিলেন। কিন্তু তাকে মেরে ফেলা হেবে না বাঁচিয়ে রাখা হবে এই চিন্তায় তারা গলদঘর্ম ছিলেন এতটা গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তি তিনি ছিলেন না।