নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিক্ষার জন্য সীমানা ছাড়িয়ে

অপ্রাসঙ্গিক প্রখরতা

ভরকেন্দ্র

শিক্ষার জন্য সীমানা ছাড়িয়ে

ভরকেন্দ্র › বিস্তারিত পোস্টঃ

"চিকিৎসা নাকি ন্যায্য ব্যবসা"

১৪ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:২২

রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও হাসপাতাল-নার্সিংহোমে রোগী পাঠিয়ে তার বিনিময়ে টাকা বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়াটাকে বাংলাদেশী চিকিৎসকদের একাংশ অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। এটা অনৈতিক, ক্ষতিকারক। সাধারণ মানুষের ক্ষতি তো বটেই, চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাও কমছে।



এ অবস্থা আকাশ থেকে পড়েনি, চিকিৎসার বাজারের ক্রমপ্রসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তার সাংস্কৃতিক ও চরিত্রগত চাহিদা মেটাতে গিয়েই এটা ঘটছে। সমস্যার মূল এখানেই যে চিকিৎসাকে আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে একাকার করে দেখা হচ্ছে। যাঁরা রোগীকেন্দ্রিক কমিশনের ব্যবসায় মনপ্রাণ ঢেলেছেন তাঁরা মনে করছেন, এটা তাঁদের পাওনা, এর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই, কোনও সমস্যা নেই। কেউ কেউ তর্ক তুলছেন: জমিবাড়ির কেনাবেচায় যদি ‘বিনিময় মূল্য’ থাকতে পারে, চিকিৎসা কেনাবেচায় নয় কেন? কমিশন বা দালালি না বলে এঁরা এই বিনিময় মূল্যের নাম দিয়েছেন পরিষেবা মূল্য, রেফারাল চার্জ, এমনকী সাম্মানিক বৃত্তি।



বোঝা দরকার, ‘পণ্য’ হিসাবেও চিকিৎসার চরিত্র পাঁচটা ভোগ্যপণ্যের মতো হতে পারে না, কারণ চিকিৎসা কেনাবেচার মধ্যে থাকে একটা মানুষের শরীর, মন, জীবনমরণ। উৎকোচ, দালালি ইত্যাদি বিষয়গুলি এই পেশার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। চিকিৎসকরা অনেকেই নিশ্চয়ই এখনও সেটা জানেন, মানেন। সমাজে, যে কোনও ক্ষেত্রে, এমন মানুষেরা আছেন বলেই সমাজ প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে চলে। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশের কাছে এগুলো আর অন্যায় নয়, বরং প্রায় অধিকারে পরিণত। এবং এই অংশটা ক্রমশ বাড়ছে। কেবল সংখ্যায় নয়, দাপটেও। আগে তবু একটু গোপনে চলত, এখন সব একেবারে প্রকাশ্যে এসে গেছে। আগে যা ছিল ফিসফাস, কানাকানি, এখন তা কলরবে পরিণত। যাঁরা এই সব সুবিধে নেন, তাঁরা আজকাল অন্যদের দুর্বলচিত্ত মনে করেন, উঁচু গলায় বলেন, ‘ওর লোভ আছে, সাহস নেই।’



অন্য দিকে, যাঁরা নিজেদের বিকিয়ে দেননি, নিজের প্রতি, নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাঁরাও সাধারণত চুপচাপ থাকেন। ফলে দুর্জনের গলার জোর বাড়ে, দুষ্কর্মের পরিধিও প্রসারিত হয়। অন্তর্দৃষ্টিহীনতা এঁদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। এঁরা সচরাচর পথ চলা শুরু করেন গলিঘুঁজি থেকে। সামাজিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সাহস পেয়ে এঁরা ক্রমশ এসে পড়েন বড় রাস্তায়। লোভ আর লাভের পিঠে চড়ে রাজপথে দাপিয়ে বেড়ান। এঁদের স্বভাব ও চিন্তার অন্ধকার তখন অন্য সব আলোকে গ্রাস করতে থাকে, লোভের বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমাজে। এঁরা চোখ রাঙিয়ে বলতে শুরু করেন, তাঁরা যে পথে হাঁটছেন, সেটাই সাফল্যের পথ, বাকিদেরও কর্তব্য তাঁদের অনুসরণ, অনুকরণ। এই পথের আকর্ষণ স্বভাবতই বিপুল। অর্থ, স্বাচ্ছন্দ্য, সুযোগ, প্রতিপত্তি, এ-সবের এক আশ্চর্য মাদকতা থাকে।



পেশাগত পরিসরে এই ধরনের মাদকপ্রবাহ যখন তীব্রতা পায়, তখন তা ন্যায়-অন্যায়ের বেড়াজাল ভেঙে দেয় এবং বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে তরুণ পেশাজীবীদের একটা অংশকে, পিচ্ছিল পথে টেনে নেয় তাঁদের, তাঁরা শুরুতেই অন্যায়ের সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়েন, সারা জীবনের জন্য পথ হারান। চিকিৎসা পেশায় যুক্ত কিছু মানুষ এই অন্যায়কে ‘ন্যায্য ব্যবসা’ বলছেন, সেটা বড় কথা নয়, সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, তাঁরা সেটাকেই সমস্ত পেশার স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, প্রভাবিত করতে চাইছেন বৃহত্তর পরিমণ্ডলকে। তাই এ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন এখনই। উঁচু গলায়, বুক চিতিয়ে।



প্রশ্ন উঠবে, চিকিৎসকদের অন্যায়ের প্রতিবাদে সমাজ অতিরিক্ত মুখর হলে মানুষ সাধারণ ভাবে চিকিৎসার পেশাটাকেই অসৎ এবং অনৈতিক মানুষে ভরা বলে মনে করবেন না তো? এমনিতেই তো চতুর্দিকে ছুতো পেলেই ডাক্তার ধোলাইয়ের প্লাবন এখন, চিকিৎসককে গণশত্রু প্রতিপন্ন করার এক উন্মাদনার ক্ষেত্র তো মজুতই আছে। এটা সেই আগুনে ঘি ঢালবে না তো? উত্তর একটাই: না, তা হবে না। বরং মানুষ বুঝবেন সাদা আর কালোর তফাতটা। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন চিকিৎসার পেশায় যুক্ত সৎ, বিবেকবান মানুষরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন, অসৎ চিকিৎসকদের অন্যায় সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করেন, চিকিৎসা নামক ব্যবসার অন্ধকার দিকগুলি সম্বন্ধে মানুষকে ওয়াকিবহাল করবেন।



এবং সেটা করতে হবে একেবারে মূলে গিয়ে। চিকিৎসার ক্রমপ্রসরমাণ বাজারের মূল্য লক্ষ্যই হচ্ছে রোগের গান গাওয়া, সুস্থতার নয়। রোগ সম্পর্কে সচেতনতার নামে সমাজে রোগভীরুতার এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে সুস্থসবলরাও প্রতি মুহূর্তে ভাবেন তাঁরা অসুস্থ। যাঁদের রোগ নেই, তাঁদের রোগী উপাধিতে ভূষিত করা, যাঁদের সত্যি রোগ আছে তাঁদের অসুখের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া, যাঁরা সত্যিই অসুস্থ তাঁদের সুযোগ পেলেই ভেন্টিলেটরে চাপানো এ সবই হচ্ছে এই প্রাণহীন বাজারিভূত চিকিৎসার ইতিবৃত্ত। এখানে জীবন থাকে না, থাকে ‘কেস’।



চিকিৎসকরা ধনী হোন, কিন্তু সে জন্য যদি অস্বচ্ছ পথে মানুষের দুর্বলতম, অসহায়তম মুহূর্তগুলিকে বিকৃত ভাবে ব্যবহার করে হয়, সেটা অপরাধ। তা প্রতিরোধের জন্য কঠোর বিধি দরকার। দরকার সেই বিধির কঠোর প্রয়োগ, অন্তত দৃষ্টান্তমূলক। মেডিক্যাল কাউন্সিল আর চিকিৎসক সংগঠনগুলিরও বোঝা দরকার, এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলে তা তাঁদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়িয়ে তুলবে। আমার সন্তান বা আমার ভাই চুরি-ডাকাতি করলেও তার পাশে দাঁড়াতে হবে, তার অপরাধকে লঘু করে দেখাতে হবে, ‘আরও কত লোকে কত কী করে’ সেই গান গাইতে হবে, এটা ঠিক নয়। বেশ কিছু চিকিৎসক আছেন, যাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে মুখবন্ধ খামের হদিশ না পেলে হাঁসফাঁস করেন। তাঁদের কাছে নিবেদন, এ জীবন মোহময় হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত আনন্দের নয়, শ্রদ্ধার তো নয়ই।



পাশাপাশি, ‘কমিশন’-এর কুহু-ডাক যাঁদের হৃদয়ে ঢেউ তোলে না, তাঁরা আরও কথা বলুন। দেশে ন্যায়বিচারের পক্ষে মঞ্চগুলি ক্রমশ বলশালী হচ্ছে। অতএব দুর্জন-সবলদের পেশি প্রদর্শনে সন্ত্রস্ত থাকা এবং ‘আমি সুখে আছি, বাকিরা যেমনটাই থাকুক না কেন’ গোছের ভাবনা নিয়ে পথ চলাটা কালের প্রতি অবিচার। এ দেশে চিকিৎসা পেশার আকাশটা সব মিলিয়ে যথেষ্টই উজ্জ্বল, ঈশান কোণে যে মেঘ জমেছে তার দিকে নজর রাখা দরকার। প্রয়োজন সতর্ক থাকার।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.