![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অতি তুচ্ছ, সাধারণ একজন মানুষ।
বুকটা ধড়ফড় করছে জামালের। অস্ত্র সে আজই প্রথম ধরেছে তা নয়। তবে আজ সে যে অপারেশনে যাচ্ছে তা মোটামুটি অসম্ভবই বলা চলে। শহীদ ভাইয়ের কথায় এমনটাই আভাস পাওয়া গেল। শহীদ ভাই তাদের এই মুক্তি ক্যাম্পের লিডার। তাদের এই ক্যাম্পের নাম "জয়-বাংলা" ক্যাম্প।
.
যুদ্ধে যাবে বলে জামাল যেদিন বাড়ি থেকে বের হল সেদিনও বুঝতে পারেনি সে কোথায় যাচ্ছে। তার বন্ধু লিটন ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, "জামাল যুদ্ধে যাবি? আমি বড় ভাইয়ের সাথে যাচ্ছি। পাকসেনাদের মেরে সাফ করে ফেলব।"
জামাল সেদিন কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। তবে আশঙ্কা ছিল বাবা-মা রাজি হবেন কিনা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মায়ের ঘরে যেতেই সে দেখে শহীদ ভাই কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। শহীদ ভাইকে দেখে সেদিন কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেছিল তার শরীরে। মা একপাশে বসে নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন। বাবা-মা সেদিন তাকে আটকায়নি। শহীদ ভাইয়ের সাথে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে জামাল "জয়-বাংলা" ক্যাম্পে।
.
সকালের নাস্তার পর শহীদ ভাই সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আজকের অপারেশনের খুঁটিনাটি।
"শোন ভাইয়েরা, আজকে আমরা যেই অপারেশনে যামু এইটা একটা বিরাট অপারেশন। আমাদের আজকের হামলা হইব পাকসেনাদের অস্ত্রের ঘাঁটিতে। যেহেতু অস্ত্র তাই সেগুলা পাহাড়ায় থাকবে সব বাঘা বাঘা পাক সৈন্যরা। তবে ভয় পাইলে চলব না। দ্যাশের জন্য আমরা নিজের জান দিতেও প্রস্তুত আছি কি কও সবাই? "
সবাই একযোগে চিৎকার করে উঠল, "হ আছি!"
.
বিকালে সবাই যখন প্রস্তুত হচ্ছিল অপারেশনে যাওয়ার জন্য জামাল তখন পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বোর্ড স্ট্যান্ড করার পর বাবা বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, "এভাবেই আমাদের মুখ চিরকাল উজ্জ্বল করে যেও!"
বাবা সেদিন তাকে একটা কলম উপহার দিয়েছিলেন। ফাউন্টেইন পেন। জামালের অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সেদিন জামাল কেঁদে ফেলেছিল। বেশি আনন্দে মানুষ কাঁদে বিষয়টা সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করে সে।
.
আজ সেই হাতে অস্ত্র নিয়ে জামাল দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চলেছে। আজকের অপারেশন সাকসেসফুল হলে তা হবে পশ্চিম পাকিস্তান বধের একটা বিরাট ধাপ।
.
সন্ধ্যার পর তারা প্রবেশ করে পাক সেনাদের অস্ত্রের ঘাঁটিতে। শহীদ ভাইয়ের নেতৃত্ব সবাই তিনটে ভাগে ভাগ হয়ে যায়। জামাল, শহীদ ভাই, লিটন ছাড়াও আরও ছয়জন নিয়ে তাদের ভাগ। জামাল একবার লিটনের দিকে তাকায়। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে বেচারার।
একবার স্কুলে পড়া না পারায় মাস্টারের বেতের বাড়ি হজম করতে হয় তাকে। সাংঘাতিক কেঁদেছিল লিটন সেদিন। তার সেদিনের অবস্থা মনে পড়ে যাওয়ায় মনে মনে হাসি পায় জামালের।
.
শহীদ ভাই সবাইকে নিয়ে খুব সাবধানে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
"লিটন আর জামাল তোমরা এইখানে দাঁড়াইবা। এক চুলও নড়বা না। যদি দরকার লাগে আমি তোমাগরে ডাকমু।"
শহীদ ভাই বাকিদের নিয়ে ভেতরে চলে যান।
.
শহীদ ভাই মোটাসোটা ধরণের মানুষ। তিনি যে এত পরিশ্রম করতে পারেন তা জামালের ধারণাতেও ছিল না। আজ সময়ের প্রয়োজনে তিনিও দেশের জন্য প্রাণপন লড়ে যাচ্ছেন। তিনি একা হাতে কত অপারেশন যে জিতিয়েছেন তার কোন হিসেব নেই। তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথাটা নুইয়ে আসছিল জামালের।
.
খানিকক্ষণ বাদে ভেতর থেকে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। জামাল আর লিটন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারা মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ভেতর থেকে চেনা স্বরে একটা আর্তনাদ ভেসে আসে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে জামালের। লিটন আগেই দৌড়ে গেছে। সেও তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে।
একটা লাশের গায়ে পা বেঁধে পড়ে যায় জামাল। উঠতে গিয়ে মুখটা চিনতে পারে সে।
"শহীদ ভাই!" - চিৎকার করে উঠে জামাল।
ততক্ষণে বিজয়োল্লাস ভেসে আসছে ভেতর থেকে। "জয়য়য়য়য়য়য় বাংলা.........."
.
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিজয়মিছিলে যাচ্ছে লিটন আর জামাল। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে অবশেষে জয় এসেছে। লাখো শহীদের ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন আজ তারা। এই শহীদদের অবদান ভোলার মত নয়। জামালের কষ্ট হয় এই ভেবে যে, শহীদ ভাইদের মত আরো যারা দেশের জন্য নিজের প্রাণকে উৎসর্গ করলেন তারা এই বিজয় দেখে যেতে পারলেন না। কিংবা হয়তো কে জানে তারা উপর থেকে দেখে মুচকি হাসছেন কিনা।
জামালের চোখ থেকে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এ অশ্রু কষ্টের না, এ অশ্রু আনন্দ অশ্রু!
©somewhere in net ltd.