![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কম্পিউটার গেম “গো’’খেলার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত প্রোগ্রাম আলফাগো গতমাসে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পেশাদার খেলোয়াড় লি সিডলকে পাঁচ টুর্নামেন্টের একটি খেলায় ৪-১ স্কোরে হারিয়ে দিয়ে এই খেলার অনুরাগীদের মধ্যে এক ধরণের ভীতি সঞ্চার করেছে।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এখন এই খবর কেন? আইবিএম কম্পিউটার ডিপ ব্লু দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান গ্যারি ক্যাসপারভকে হারিয়ে দিয়েছে সেই বিশ বছর আগেই, এবং আমরা সবাই জানি এই সময়ের মধ্যে কম্পিউটারের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ডিপ ব্লু জিতেছিল কম্পিউটারের কেবল গাণিতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে, একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের চেয়েও দাবার চালের ফলাফল গভীরভাবে হিসেব করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। গো খেলা হয় অনেক বড় বোর্ডে ( ৮×৮ বোর্ডে নয়, ১৯×১৯ বোর্ডে ), এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যতো পরমাণু রয়েছে, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক সম্ভাব্য চাল রয়েছে এই খেলায়। সুতরাং, এক্ষেত্রে কেবল গাণিতিক যুক্তির কাছে মানুষের স্বজ্ঞা পরাজিত হওয়ার কথা নয়।
আলফাগো বানানোই হয়েছে জেতানোর জন্যে – অন্যান্য প্রোগ্রামের সঙ্গে প্রচুর গেম খেলিয়ে এবং সেসব কৌশল গ্রহণ করে যেগুলো ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়েছে। বলতে পারেন বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় আলফাগো হয়ে উঠেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গো খেলোয়াড়, এবং মাত্র দুই বছরে যা অর্জন করেছে, প্রাকৃতিক চয়নপ্রক্রিয়ায় তা করতে আমাদের লেগে গেছে লক্ষ লক্ষ বছর।
মানবজাতির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অর্থবহতার ব্যাপারে গুগলের মূল শাখার নির্বাহী পরিচালক এবং আলফাগোর স্বত্বাধিকারী এরিক হিমড্ এর আগ্রহ লক্ষ্যনীয়। লি বনাম আলফাগোর ম্যাচটা শুরুর আগে দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, খেলার ফলাফল যা-ই হোক, জয় হবে মানুষেরই, কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষের ফলে প্রতিটি মানুষ আরো বুদ্ধিমান, সক্ষম আর “উন্নততর মানুষ“ হয়ে উঠবে।
আসলেই কি তা হবে? আলফাগো যখন জিতছিল, ওদিকে তখন ১৮-২৪ বছর বয়েসী মানুষের পাঠানো মেসেজের উত্তর দেওয়ার জন্য নির্মিত মাইক্রোসফটের টেইলর নামের চ্যাটবোট সফটওয়্যারটি যাচ্ছিল পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। কথা ছিল, নিজেকে “টে“ নামে ডাকা এই সফটওয়্যারটি মানুষের কাছ থেকে গৃহীত মেসেজ থেকে শিখতে পারবে এবং ক্রমে ক্রমে তার কথোপকথনের দক্ষতা বেড়ে যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ২৪ ঘন্টার মধ্যেই টে কে জাতি আর লিঙ্গবৈষম্যমূলক ধ্যান –ধারণা দেওয়া শুরু করে দিল মানুষ। এবং যখন এই সফটওয়্যারটা হিটলার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলতে লাগলো, গৃহীত আপত্তিকর মেসেজগুলোর বেশিরভাগই মুছে দিল মাইক্রোসফট।
আমি জানি না যেসব মানুষ টে কে জাতিবৈষম্যবাদী বানিয়েছিল তারা নিজেরাও জাতিবৈষম্যবাদী, নাকি তারা শুধু ভেবেছিল মাইক্রোসফটের এই নতুন খেলনাটা নিয়ে এভাবে খেলা একটা মজার ব্যাপার হবে। দু দিক থেকে দেখলেই, আলফাগোর জয় আর টেইলরের পরাজয় – এক ধরণের সতর্কতা সংকেত। নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন আর পরিষ্কার লক্ষ্য নিয়ে একটি গেম হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এক জিনিস, বাস্তব জগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লাগাম খুলে দেওয়া অন্য একটি ব্যাপার যেখানে পারিপার্শ্বিকতার অননুমেয়তা একটি সফটওয়্যারের ত্রুটি উন্মোচন করে ধ্বংসাত্মক ফল বয়ে আনতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিউচার অব হিউম্যানিটি ইন্সটিটিউটের পরিচালক নিক বোস্ট্রম তাঁর “Superintelligence” বইটিতে যুক্তি দেখিয়েছেন, টে‘র সুইচ যতো সহজে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, একটি বুদ্ধিমান যন্ত্রকে সবসময় ততো সহজে থামানো যাবে না।
সুপারইন্টেলিজেন্সকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন বৈজ্ঞানিক সৃজনশীলতা, সাধারণ জ্ঞান এবং সামাজিক দক্ষতাসহ যে কোনো ক্ষেত্রে শেষ্ঠ মানবমস্তিষ্কের চেয়ে বুদ্ধিমান সত্তা হিসেবে। এমন একটি সিস্টেম আমাদের সেটাকে বন্ধ করে দেওয়ার সকল প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।
অতিমানবীয় বুদ্ধিমত্তার ধারণা কখনো বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে কেউ কেউ সন্দেহ পোষন করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছে বোস্ট্রম এবং ভিনসেন্ট মুলার জানতে চেয়েছেন কবে নাগাদ এরকম যন্ত্রের মানুষের সমান বুদ্ধিমান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অর্ধেক হতে পারে এবং কবে নাগাদ সে সম্ভাবনা হতে পারে নয় দশমাংশ। জানা গেছে, এই সম্ভাবনা অর্ধেক হতে পারে ২০৪০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে এবং ২০৭৫ সালের মধ্যে সেটা গিয়ে দাঁড়াবে নয় দশমাংশে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের প্রত্যাশা, মানব পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তা অর্জনের ৩০ বছরের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পৌঁছে যাবে সুপারইন্টেলিজেন্সের পর্যায়ে।
আমাদের উচিত হবে না এসব অনুমানকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে সাড়া পাওয়ার হার মাত্র ৩১%, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক গবেষকরা ঢাকঢোল পিটিয়ে তাঁদের কাজের বড় ফলাফলের কথা বলে এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
বিশেষত: বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলোর কারণে মনে হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুপারইন্টেলিজেন্সের পর্যায়ে পৌঁছতে অনেক দেরি, তাই এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু মানুষ সহ অন্য সব সংবেদনশীল সত্তার ( যন্ত্রপাতিরও, যদি সেসবের থাকে নিজস্ব স্বার্থ আর চেতনা ) স্বার্থ বিবেচনায় রেখে আমাদের ভাবতে শুরু করা দরকার কোন পথে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রণয়নের দিকে এগোতে পারি।
ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তায় চালকবিহীন গাড়ি চলছে, ফলে এ প্রশ্ন এখন তোলা যেতেই পারে যন্ত্রকে আমরা নৈতিক আচরণ করার জন্য প্রোগ্রাম করতে পারি কি না। এরকম গাড়ির উন্নয়ন ঘটলে জীবন রক্ষা করা যাবে, কারণ মানুষ চালকের চেয়ে এগুলো ভুল করবে কম। অবশ্য কখনো কখনো এই গাড়িগুলোকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে যেখানে একটি জীবন মেরে অন্যটিকে বাঁচাতে হবে। এসব গাড়িকে কি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা উচিত হবে, যাতে দৌড়ে রাস্তা পার হতে থাকা একটি শিশুকে বাঁচাতে হঠাৎ বাঁক নেয়, এমনকি যদি তার ফলে গাড়িতে থাকা যাত্রীদের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়? একটা কুকুরকে বাঁচাতে আকস্মিক বাঁক নেওয়া উচিত হবে কি? যখন একমাত্র ঝুঁকি হবে গাড়িটার ক্ষতি, যাত্রীদের নয়, তখন কি হবে?
চালকবিহীন গাড়ি সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলে তা থেকে সম্ভবত অনেক কিছুই শেখার থাকবে। কিন্তু চালকবিহীন গাড়ি অতিমানবীয় বুদ্ধিধর কিছু নয়। মআমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো যন্ত্রকে অনেকগুলো ব্যাপারে নৈতিকতা শেখানো একটা বড় কাজ।
বোস্ট্রম তাঁর Superintelligence বইটি শুরু করেছেন একটি নীতিগল্প দিয়ে। কিছু চড়ুই একবার ভাবলো, তাদের বাসা তৈরি আর বাচ্চা দেখাশোনার জন্যে একটা পেঁচাকে প্রশিক্ষণ দিলে বেশ হবে। তাই তারা পেঁচার ডিম খুঁজতে লাগলো। এক চড়ুই এতে আপত্তি জানিয়ে বললো, প্রথমে তাদের ভাবা উচিত কিভাবে একটা পেঁচাকে পোষ মানানো যায়, কিন্তু অন্যরা এই চমকপ্রদ প্রকল্পের ব্যাপারে অধৈর্য। একটা পেঁচাকে ঠিকঠাক লালন পালন করার পর তারা সেটাকে প্রশিক্ষণের ( যেমন চড়ুই না খাওয়ার প্রশিক্ষণ ) চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে।
যদি আমরা এমন পেঁচা গড়তে চাই যেটা হবে শুধু বুদ্ধিমান নয়, জ্ঞানীও, আসুন আমরা ওই অধৈর্য চড়ুইগুলোর মতো না হই।
( প্রজেক্ট সিন্ডিকেট এ প্রকাশিত পিটার সিঙ্গার এর প্রবন্ধের অনুবাদ)
©somewhere in net ltd.