![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
"অন্ত্যজ বাঙালি আতরাফ মুসলমান" নামটা ব্লগার ইমন জুবায়েরের স্মরণে...
"সোনালি সোনালি চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!"
পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। অর্থ বুঝতে পারি নাই, চাইও নাই, ক্লাস সেভেনের ছাত্রের জন্য সেটা অস্বাভাবিকও না, স্রেফ চমকে গিয়েছিলাম।
আমি কোনো "সংস্কৃতিমনা" পরিবারে জন্মাই নাই। সত্য বটে আমার মা আমারে ছোটকালে আঙুলে ধরে প্রতিবছর একুশে বইমেলায় নিয়ে গ্যাছেন, এবং আমি গঠিত হয়েছি এমন এক পরিবেশে যেখানে বিদ্যাচর্চার ব্যাপারটা বেশ ভাল চোখেই দ্যাখা হয়; তথাপি সেই বিদ্যাচর্চা মূলত একাডেমিক বইপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এবং মাঝে মাঝে "রিলাক্সেশনের" জন্য বইমেলা-থেকে-কেনা দুই একটা "আউট বই" পড়া যেতে পারে, এমন একটা অলিখিত নিয়ম পরিবারে জারি ছিল সর্বদাই। গান শেখা, ছবি আঁকা, নাচ শেখাঃ মানে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ছেলেমেয়েদেরকে "পড়াশোনার পাশাপাশি" যে জাতীয় "সংস্কৃতিচর্চার" ভেতরে তাদের বাপ মা এক ধরণের জবরদস্তিমূলক প্রক্রিয়ায় ঢুকিয়ে দেন, উদ্দেশ্য থাকে ছেলে বা মেয়ে "কালচার্ড" হবে ও বিকাশ ঘটবে "সৃজনশীলতার", আমার ক্ষেত্রে সেসবের কোনোটাই করা হয় নাই। আমার বাপ মাও একটু সহজিয়া টাইপের মানুষ। "পোলা'রে জোর কইরা ক্রিয়েটিভ বানানের কি কাম?"-আমার ব্যাপারে এটাই সম্ভবত ছিল তাঁদের চিন্তা। আবার একাডেমিক পড়াশোনাতেও তেমন কোনো জোর করার মানুষ তারা ছিলেন না, একটা বয়স পর্যন্ত পড়া দেখিয়ে দিয়েছেন, ক্লাস সিক্সে ওঠার পর "প্রাইভেট টিউটর"-এর ছায়াতলে চলে গেছি, যদিও আমি কখনোই প্রাইভেট টিউটর-নির্দেশিত সহজ সরলে পথে চলতে চাই নাই, ছোটকাল থেকেই আমি ব্যাঁকা ত্যাঁড়া রাস্তা পছন্দ করি। [পাঠ্য বই আউট করতে করতে এবং আউট বই পাঠ করতে করতে, পরীক্ষায় সাধারণত মাঝারি মানের নাম্বার পেয়ে পেয়ে এবং উচ্চমাধ্যমিকের প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় আমার একমাত্র প্রিয় বিষয় পদার্থবিজ্ঞানে ১০০তে ১৩ পেয়ে, স্কুল ও কলেজ ডিঙিয়ে গেছি ক্যামনে ক্যামনে জানি। বিশ্ববিদ্যালয়েও ইন করেছি মুরুব্বিয়ানে কিরামের দোয়ায় সম্ভবত, আমার নেকঅভ্যাসটি এখনো পূর্ণমাত্রায় জারি আছে বিধায় ইদানিং একটু চিন্তিত; ইন তো করলাম, সহি সালামতে সার্টিফিকেট নিয়ে আউট হতে পারব তো ???!!! তবে, আশার কথা, অভ্যাস অপরিবর্তিত রয়েছে।]
সাহিত্য বলতে আমি যা বুঝতাম সেই সময়ে তা হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল জাতীয় কিছু লেখকের বই, আরো স্পেসিফিকভাবে বললে "গল্পের বই"উপন্যাস ছাড়া পড়তাম না কিছুই, কবিতা ল্যাখা দূরে থাক পড়ার ব্যাপারেও তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।
ঠিক সেই সময় আমার মাথাটার দখল নিয়ে নিলেন জীবনানন্দ দাশ !!!
কাহিনী হচ্ছে আমার মা তার বাপের ভাইয়ের কাছ থেকে প্রচুর বই পেয়েছিলেন। আমার সেই নানা বেশ ইন্টারেস্টিং মানুষ ছিলেন। চাকরিসূত্রে একবার পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে সেখানকার এক পাহাড়ি মেয়ের প্রেমে পড়েন। কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক বাধার কারণে বিয়ে না করতে পারায় মনের দুঃখে "আবিয়াইত্যা" থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেই সিদ্ধান্তে আমৃত্যু অটল থাকেন। তাঁর জীবন কেটে গ্যাছে বই পড়ে পড়ে, এবং সেই সব বই তাঁর মৃত্যুর পর অসিয়ত অনুসারে আমার মা পান। সেই বিপুল পরিমাণ বইয়ের একটা বড় অংশ বাসা বদল করতে করতে হারিয়ে গ্যাছে, এবং হারিয়ে যেতে যেতে এখনো কিছু বই টিকে আছে।
আমি সেই রাতটার কথা স্পষ্ট মনে করতে পারি। আমি, ক্লাস সেভেনে পড়া একটা ছেলে সাভার ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের, সাভারে আমাদের ভাড়া-বাসার তিন তলায় আমার রুমে বসে আছি, কি মনে করে য্যানো বুক শেলফটার দিকে আমি এগিয়ে গেলাম, যে কাজটা আমার করার কথা না সেই সময়ে আমার অভ্যাস অনুসারে, তারপর সবচেয়ে নিচের তাকের বইগুলো ঘাটতে লাগলাম উদাসীনভাবে, তারপর একটা ছোট বইয়ের ওপর আমার চোখ পড়ল। নামঃ বনলতা সেন, লেখকঃ জীবনানন্দ দাশ। নামটা খুব পরিচিত ছিল যেহেতু লেখক অত্যন্ত বিখ্যাত, জানতাম কবিতার বই, তবু ক্যানো জানি একটু ইচ্ছা হল উলটে পালটে দেখবার। প্রথম কবিতাটা পড়লাম, ভালই লাগল। তারপর দ্বিতীয় কবিতাটার শেষ দুই লাইন পড়ে পাগল হয়ে গেলাম !!! লাইন দুটি প্রবন্ধের শুরুতে লিখিত হয়েছে। পাগলের মত পড়তে লাগলাম বইয়ের অন্যান্য কবিতা।
এরপর প্রায় দুই বছর কেটে গ্যালো। আমিও তাঁর কবিতার মোহ প্রায় কাটিয়েই উঠেছিলাম। কিন্তু কাহিনী “শেষ হইয়াও হইল না শেষ”আমার ষোলতম জন্মদিনে “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” [আব্দুল মান্নান সৈয়দ নয়, হুমায়ুন কবির চৌধুরী সম্পাদিত] গিফট পেলাম আমাকে যে ভাইয়া প্রাইভেট পড়াতেন তাঁর কাছ থেকে। তিনি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন,
“তোমার চলার পথ আরো সহজ হোক এবং তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করে শুভ জন্মদিনে এই ছোট্ট উপহার। রাফিনকে-ফজলু , ১০-০৪-০৭”
শুরু হল পাগলামির দ্বিতীয় পর্ব।
আক্ষরিক অর্থে নাওয়া খাওয়া এক ব্যালা দুই ব্যালার জন্য বাদ দিয়ে, আমি কবিতা নাইতে ও খেতে লাগলাম জীবনানন্দ দাশের। মাথা আউলে গ্যাছে তখন পুরোপুরি। বালিশের পাশে জীবনানন্দ দাশ রেখে ঘুমাই। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা, আরিচা রোডের পাশের মানুষ হয়েও যে গাড়ির তলে পড়ি না সে কেবল আল্লাহর রহমত বা যানচালকদের সতর্কতা। আমি নিঃশব্দে খুন হতে থাকলাম জীবনানন্দ দাশ নামের মোহন ঘাতকটির হাতে, আমার নফসে ঢুকে যেতে লাগল তাঁর একটার পর একটা মাতাল লাইন।
এবার তার কবিতাবলি ও সেসব নিয়ে আমার জীবনযাপনের কিছু কথা কই।
ঝরা পালক [১৯২৭]
ঝরা পালকের যেসব কবিতা ভাল লেগেছিল [আমি ভাল লাগা কবিতাগুলোর শিরোনামে দাগ দিয়ে রাখি, অনেকের মতই] সেগুলো হলঃ নীলিমা, জীবন মরণ দুয়ারে আমার, নাবিক, একদিনে খুঁজেছিনু যারে-, অঁস্তচাদে, হিন্দু মুসলমান, পতিতা, সেদিন এ ধরণীর। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে জীবনানন্দ দাশের ওপর, আমার মনে হয়, অগ্রজ কবিদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বিশেষত, হিন্দু মুসলমান আর পতিতা কবিতা দুটি তো পুরোপুরি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মত লাগে। পতিতা পড়ে প্রথম কষ্ট লেগেছিলো যৌনকর্মীদের জন্য।
ধূসর পাণ্ডুলিপি [১৯৩৬]
এই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে এসে, আমার মনে হয়, আমরা যেই জীবনানন্দ দাশরে চিনি সে কবি হিসাবে জন্ম নিয়েছে। নির্জন সাক্ষর পড়ে আমার মাথা আবার আউলে যায় (কতবার যে আউলেছে! অনেকটা মার্ক টোয়েনের সিগারেট ছাড়ার মত। তিনি কতবার যে সিগারেট ছেড়েছেন! অনেকটা তেমন!!!)আমি ক্লাসরুমে বসে বসে খোয়াব দেখতে থাকি যে আমি হেমন্তের ঝড়ে ঝরে যাওয়া পথের পাতা আর আমার বুকে’র পরে শুয়ে আছে ক্লাসের সবচেয়ে রূপবতী মেয়েটি; তারপর সিরাজ স্যারের ঝাড়ি খেয়ে ফিরে আসি রাসায়নিক সমীকরণের কঠোর বাস্তবতায়।
সহজে সহজ ঢুকে যায় বুকের ভেতরে, “আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন/ প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে ” উঠতে থাকে, আমি দিনেদুপুরে ডুবে যাই পরস্পর-এর রূপকথায়। সারাজীবনের জন্য আমার প্রিয় হয়ে উঠলো নিম্নলিখিত লাইনগুলোঃ
"দেখা দিয়ে বলিলাম, ‘কে গো তুমি?’-বলিল সে ‘তোমার বকুল,
মনে আছে?-‘এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে’;-‘ভালোবাসো?’-হাসি পেল, হাসি!
‘ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’ ”
বোধ পড়ে আমি যেতে লাগলাম আলো অন্ধকারে, শিখলাম কি করে সকল লোকের মাঝে বসে একলা হতে হয়, জানলাম ভালবেসে-অবহেলা করে-ঘৃণা করে দেখব আমি মেয়েমানুষেরে, আমাকে সে ভালবাসবে, কাছে আসবে, উপেক্ষা করবে, ঘৃণা করে চলে যাবে যখন তাকে ডাকব বারবার। অবসরের গান সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা, এই কবিতার কয়েকটি লাইনের অর্থ আমি তখন বুঝতাম না (পাঠ্যবইয়ের রহমতে আমরা জানতাম ও এখনো লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে জানছে জীবনানন্দ দাশ নাকি একজন “রোমান্টিক” ও “প্রকৃতিবাদী” কবি !!!), কিন্তু এখন বুঝি, লাইনগুলো হলঃ
“আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের রং
দামামা থামায়ে ফেল,- পেঁচার পাখার মত অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য
আর সাম্রাজ্যের সং!”
ক্যাম্পে কবিতায় পড়ে শিউরে উঠেছিলাম, কবি, হোক না হরিণের ক্ষেত্রে, সুন্দরী গাছের নিচে জোছনায় বোনের কাছে আসা বলতে কি বুঝিয়েছেন??? আজও সেই শিহরণ যায় নাই...
১৩৩৩ পড়ার পর কতবার আমার চোখে আকাশ এলোমেলো হয়ে গ্যাছে !!!
[চলবে]
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৩:৫৯
ইরফানুর রহমান রাফিন বলেছেন: সাথে থাইকেন, খুব দ্রুত দ্বিতীয় পর্ব লেখা শুরু করার আশা রাখি...
২| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৬:২৪
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: জীবনানন্দ দাশের বই প্রথম পাই বাবার কাছে ,ক্লাস সেভেন এ , রূপসী বাংলা , খুবই সাদামাটা জলপাই রঙের খসখসে কাগুজে মলাটের বই ।
কবিতাগুলো পড়ে আমি অবাক হই ! ভাষা হারিয়ে ফেলি । সেই থেকে উনি আমার সবচে' প্রিয় কবি । ওনার লেখায় বুনো ঘ্রাণ স্বাদ পাই । প্রকৃতির খুব কাছ থেকে যেন জীবনটাকে দেখতে পাই
পোষ্টে + রইল ভালো থাকবেন
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:০৫
ইরফানুর রহমান রাফিন বলেছেন: আপনার মন্তব্যের ধরণটা কাব্যিক, ভাল লাগল।
৩| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:২১
শহিদুল ইসলাম বলেছেন: আহ ! জীবনবাবু ! প্রিয় কবি
অনেক সুন্দর লিখেছেন ।
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:০৪
ইরফানুর রহমান রাফিন বলেছেন: ধন্যবাদ। আশা করি দ্বিতীয় পর্বও পড়বেন।
৪| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:০৫
হোরাস বলেছেন: ইরফানুর রহমান রাফিন জীবনানন্দের ভক্ত জানতাম না, আমিও তার ব্যপক ভক্ত। তুমি অতিস্বত্বর দেখা দাও ক্যাম্পাসে।
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৪৭
ইরফানুর রহমান রাফিন বলেছেন: ভাই, দ্যাখা দিলাম।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৩:৪৯
জালিস মাহমুদ বলেছেন: চলুক সাথে আছি ..........
চুল তার কবেকার অন্ধকার :!> :!> :!> :!>