নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফাহীম সিদ্দীকী

ফাহীম সিদ্দীকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইলমে ফেকাহর সুচনাকালঃ প্রসঙ্গ ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)

২৫ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১০:৫৪

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

ইমাম আবু হানীফা হিজরী ৮০ সনে কুফার এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মড়্রহণ কবেন। তাঁর জৌত্র ইসমাঈলের জবানী- আমার পিতামহ ছিলেন নোমান ইবনে ছাবেত ইবনে নোমান ইবনে মুরযেবান। মুরযেবান ছিলেন পারস্য অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ভূম্যাতিপতি। তাঁর পুত্র যুতী যুদ্ধবন্দিরূপে কুফায় আসেন। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার হওয়ার পর তাঁর নামকরণ করা হয় নোমান। তিনি কূফার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত আলীর (রাঃ) খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর দোয়া লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যূতী বা নোমাদের পৌত্র আবু হানীফা রহঃ বিদ্যা ও মনীয়ার অকল্পনীয় গভীরতার ক্ষেত্রে শেরে-খোদা হযরত আলীর দোয়ার বরকত আমরা গর্বের সাথে স্মরণ করি। (খতীব বাগদাদী রচিত তারীখে বাগদাদ।)

অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায়, ইমাম ইবু হানীফার পিতামহ নোমান (যুতী) ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারনে পরিবার-পরিজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি তখন জন্মভূমি ত্যাগ করে ইসলামী খেলাফতের তদানিন্তন বাজধানী কুফায় চলে আসেন। এখানেই তিনি ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে স্হায়ী বসতি স্হাপন করেন। (ইমামে-আজমর, শিবলি নোমানী)।

নোমান (যুতী) হযরত আলীর রা. খেদমতে হাজিরা দিতেন। হযরত আলীর রা. সান্নিধ্যেই তাঁর দীনি শিক্ষা এবং আমলের প্রশিক্ষন লাভ করার সুযোগ ঘটেছিলো।

জন্মস্হান কুফাঃ

ইমাম আবু হানীফার জন্মভূমি কুফার তখন গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাগত শতাব্দির প্রখ্যাত হাদিস তত্ববিদ আল্লাম কাউসারী ‘ নসবুর-রায়া ‘ নামক গ্রন্হে লিখেছেন- দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা. কর্তৃক হিজরী ১৭ সনে কূফা নগরের ভিত্তি স্হাপন করা হয়। প্রধানতঃ মুজাহেদীনের একটি ছাউনী শহর রূপে প্রতিষ্ঠিত কূফায় বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবঅং বহু সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। এই শহরে বসতি স্হাপনকারী মুসলমানদের মধ্যে দীনি এলেম প্রচার এবং ফতোয়া প্রদান করার গুরু দায়িত্বে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে রা. সরকারিভাবে নিয়োগ দান করা হয়। হযরত ওমর রা. কূফবাসীগণের প্রতি প্রেরীত এক ফরমানে উল্লেখ করেছিলেন যে আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তির এখানেই (রাজধানীর মদিনায়) বিশেয় প্রয়োজন ছিল। তা সত্বেও তোমাদে প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে তাঁকে কূফায় পাঠানো হলো। বলাবাহুল্য যে, খলীফার এই ফরমানের দ্বারাই বোঝা যায় যে, আবদুল।লাহ ইবনে মসউদ রা. কত প্রাজ্ঞ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন একজন সাহাবী ছিলেন। ইবনে মাসউদ রা. তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমানের রা. খেলাফত আমলের শেষ সময় পর্যন্ত জনগণের মধ্যে কুরআন, হাদিস এবং ফেকাহর তালীম দিতে থাকেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই কূফায় অন্যুন চার হাজার বিশিষ্ট মুহাদ্দেসম মুফাছছেরও ফকীহর সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত আলী রা. যখন রাজধানী যখন রাজধানী স্হানান্তর করে কূফায় আসেন, তখন এখানকার জ্ঞান চর্চার পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কাঁর মন্তব্য ছিল- আল্লাহ পাক ইবনে মাসউদের রা. কল্যাণ করুন। তিনি এই শহরকে এলেমের নগরীতে পরিণত করে দিয়েছেন।

এমন আরো প্রাজ্ঞ সাহাবী কূফায় বসতি স্হাপন করেছিলেন যাঁদের অবদানে এ উম্মতের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেযোগ্য ছিলেন হযরত সয়ীদ ইবনে জুবায়ের রা.। কুফার কোন লোক যদি তফসীর শাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের নিকট কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করতে যেত, তখন তিনি বলতেন, তোমাদের শহরে সাঈদ আবনে জুবায়ের রা. এর ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তি থাকার পরও এখানে তুমি মাসআলা জিজ্ঞেস করতে এলে কেন?

এই কুফা শহরেই সর্বাপেক্ষা প্রজ্ঞাবান তাবেয়ী ইমাম শা’বী বসবাস করতেন। মা’বী সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের রা. মন্তব্য ছিল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় সবকটি যুদ্ধেই আমি শরীক ছিলাম। কিন্তু ইমাম শা’বী যুদ্ধগুলোর পুংখানুপুংকরূপে বর্ণনার ক্ষেত্রে যে নিপুনতার পরিচয় দেন, আমার ন্যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষেও সম্ভবতঃ সেরূপ নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।

কূফায় বসবাসকারী আর একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন ইবরাহীম নখয়ী রহ.। ইনি সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. এবং উম্মত-জননী হযরত আয়েশার রা. নিকট থেকেও হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লাম ইবনে আবদুল বার এর মন্তব্য হচ্ছে- ইবরাহীম নখয়ী তাঁর যুগের সকল আলেমের চাইতে উত্তম ছিলেন । হিপরী ৯৫ সনে ইবরাহীম নখয়ীর ইন্তেকালের পর আবু ইমরান তাঁর শষ্যদের সামনে এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে, তোমারা আজ এই যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফেকাহবিদকে সমাহিত করলে।

তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ইনি কি হাসান বসরী রহ. এর চাইতেও বড় আলেম ছিলেন? জবাব দিলেন নিঃসন্দেহে তিনি বসরা ‘কূফা’ শাম ও হেজাযের সকল আলেমের মধ্যে সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

কূফায় যে পনেরো শ সাহাবী বসতি স্হাপন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সত্তরজন ছিলেন বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী।

হযরত আলকামা রহ. ন্যায় জ্ঞানসাধক তাবেয়ীও কূফাতেই বসবাস করতেন। আল্লামা রমহরমুযী রহ. ক্বাবুসের এ মর্মের একটি বর্ণনা উদ্ধুত করেছেন যে – আমি আমর পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আপনি আলক্বামার নিকট মাসআলা- মাসায়েল জিজ্ঞেস করতে যান। তিনি তো হযরত ইবনে মাসউদের সাগরেদ। জবাবে তিনি বললেন- বৎস! আমি তাঁর নিকট হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনেক সাহাবীগণকেও বিভিন্ন মাসাআলা-মাসায়েল জানার উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতে দেথেছি।

প্রখ্যাত বিচারক কাজী শুরাইহ- এর কর্মস্হলও ছিলো কুফানগরী। হযরত আলী রা. বলতেন, শুরাইহ আরবের সর্বাপেক্ষা বিচক্ষন বিচারক। এ ছাড়াও এমন আরও ৩৩জন তাবেয়ী আলেমের কর্মস্হল ছিল এইকূফায় যাঁরা সাহাবয়ে কেরামের জমানাতেই ফতওয়া দানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এসব প্রাজ্ঞ সাহবী এবং তবেয়ীগণের নিকট যারা এলেম শিক্ষা করেছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল অগনিত। অত্যাচারী শাসনকর্তা হজ্জায আবনে ইউসুফের বিরুদ্ধে কূফার উপকন্ঠ ‘দাইরে- জামাজেম’ এ আবদুর রহমান ইবনে আশআস যখন যুদ্ধ ঘোষনা করেন, তখন তার সাথে কুরআন-হাদিস বিশেষজ্ঞ আলেমের সংখ্যাই ছিল চার হাজার। রামহরমুযীন ইমাম ইবনে সিরীনের পুত্র আনাসের বানী বর্ণনা করেন যে, আমি যখন কুফায় উপনীত হই তখন এই শহরে চার হাজার হাদীস বিশেষজ্ঞ এবং চারশতও বেশি ফেকাহবিদ আলেম বাস করতেন।

ইমাম বুখারী রহ. এবং ইমাম আহমদ রহ. ইবনে হাম্বলের উস্তাদ আফফান ইবনে মুসলিম বলেন- আমি কুফায় চার মাস অবস্হান করেছি। তখন সেখানে হাদিসের এমন ব্যাপক চর্চা ছিল যে, ইচ্ছা করলে আমি অন্যুন এক লক্ষ হাদিস লিপিবদ্ধ করতে পারতাম। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ করার পর আর আমি অগ্রসর হইনি। এই পঞ্চাশ হাজার হাদিস এই শহরের সকল শ্রেণীর লোকজনের মধ্যে আলোচিত হতো। ইমাম বুখারী রহ. বলেন, হাদিস সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে আমি বারবার কুফা গিয়েছি। (ফতহুল বারী)

ইমাম তিরমিযী রহ. বহু স্হলে কূফাবাসীদের অভিমতের উল্লেখ করেছেন। এই কুফা নগরীতেই ইমাম আবু হানীফার রহ. জন্ম এবং এই শহরেই তিনি জ্ঞানার্জন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। ইমাম সাহেবের যুগে যেসব সাহাবী ওবং প্রজ্ঞ তবেয়ী জীবিত ছিলেন তিনিও তাদের সকলের নিকট থেকেই হাদিস সংগ্রহ ও আয়ত্ব করেছিলেন। অপরদিকে তাবেয়ীগণেরও অনেকেই আবু হানীফার নিকট থেকে হাদিস শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তাবেয়ী ছিলেন।

এই উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন সাহাবায়ে-কেরাম। সাহাবীদের পরবর্তী মর্তবা হচ্ছে তাবেয়ীগণের। সর্বসম্মতভাবে সাহাবীর সংজ্ঞা হলোঃ যাঁরা ঈমানের সাথে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন এবং ঈমান নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাবেয়ী হচ্ছেন, যাঁরা ঈমানের সাথে সাহবীগণের সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন। (নাখবাতুল-ফেকার)

সাহাবী এবং তবেয়ীগণের মর্যাদা নির্দেশ করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ঈমান আনার ব্যাপারে অগ্রবর্তিগণ, মুহাজের ও আনসারবৃন্দ এবং তাদের সৎকর্মের যারা অনুসরণ করেছেন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।

হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, অত্যন্ত সৌভাগ্রবান সেই সমস্ত লোক যারা আমার সাক্ষাত লাভ করেছে এবং আমার সাক্ষাত যারা পেয়েছে, তাদেরকে পেয়েছে।

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে- সর্বাপেক্ষা বরকতময় হচ্ছে আমার সময়কাল এবং তার পরবর্তী যুগ আর তার পরবর্তী যুগ।

ইমাম আবু হানীফার রহ. জন্ম ৮০ হিজরী সনে। সর্বাপেক্ষা বয়স্ক সাহাবী হযরত আবু তোফায়েল রা. ইন্তেকাল করেছেন ১১০ হিজরীতে। আবু হানীফার জন্মকাল থেকে নিয়ে একশত দশ হিজরী এই দীর্ঘ ত্রিশ বছর সময়কালের মধ্যে শতাধিক সাহাবী জীবিত ছিলেন। হাফেযুল হাদিস ইমাম মুযনীর রহ. বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন ৭২জন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। (মুজামুল মুসান্নেফীন)

হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. বলেন, তাবেয়ী হওয়ার জন্য সাহাবীগণের সাক্ষাত লাভই যথেষ্ট। কেননা, হাদীস শরীফে শুধুমাত্র দেখা’র কথা বলা হয়েছে। সে মতে যারা তাবেয়ী হওয়ার জন্য দীর্ঘ সাহচর্য এবং সাহাবীগণের নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করাকেও শর্ত নির্ধারণ করেন তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। (নুযহাতুননযর)

শায়খ আবুল হাসান হাফেজ ইবনে হাজারের উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন- আল্লামা এরাক্বীর অভিমত অনুযায়ী এটাই অধিকসংখ্যক আলেমের অভিমত এবং এটাই সর্বাধীক গ্রহণযোগ্য তথ্য। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য থেকে তাই প্রমাণিত হয়। সুতরাং হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. সন্দেহাতীত ভাবে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রমাণিত হল। কেননা, তিনি আনাস ইবনে মালেক রা. এবং অন্য আরো কয়েকজন সাহাবীকে দেখেছেন। যেসব লোক ইমাম আবু হানীফকে রহ. তাবেয়ীদের মর্যাদা দিতে চান না, এরা নির্বোধ এবং বিদ্বষপরায়ন। (প্রাগুক্ত)

হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. আরো লিখেছেন- ইমাম আবু হানীফা রহ. বহুসংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। কেননা, তিনি ৮০ হিজরী সনে কুফায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেসময় সেই শহরে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. জীবিত ছিলেন। তাঁর ইন্তেকাল ৮০ হিজরীর অনেক পরে হয়েছে। তেমনি বসরাতে আনাস ইবনে মালেক রা. ছিলেন। তাঁর ইন্তেকাল হিজরী নব্বই সনে পরে হয়েছে। সে মতে ইমাম আবু হানীফা রহ. নিঃসন্দেহে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। (তানসীকুন-নেজাম)

বুখারী শরীফের ব্যাখাগ্রন্হে ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. উপরোক্ত সিদ্ধান্তটি আলেমগণের সর্বসম্মত অভিমত বলে উল্লেখ করেছেন। হাফেজ যাহাবী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেককে রা. অনেকবার দেখেছেন। (খাইরাতুল-হেসান)

আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী রহ. মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গন্হে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন।

এঁরা হচ্ছেন-

১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী)

২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী)

৩) সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী)

৪) আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী)

৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী)

৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী)

৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)

ইবনে সাআদ লিখেছেন- সার্বিক বিচারেই ইমাম আবু হানীফা রহ. একজন তাবেয়ী ছিলেন। তাঁর সতীর্থ ফেকাহর ইমামগণের মধ্যে আর কারো এই মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য হয় নাই। (তানসীক্ব)

আল্লামা খাওয়ারেজমী রহ. বলেন- ওলামাগণের এ বিষয়ে ঐক্যমত রয়েছে যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের পবিত্র মুখ থেকে হাদিস শ্রবণ করে তা বর্ণনা করেছেন। তবে এরূপ হাদিসের সংখ্যা কত ছিল, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। (তানসীক্ব)

ইমাম আবু হানীফা রহ. কর্তৃক সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা কারো মতে ছয়, কারো মতে সাত এবং কারো মতে আটখানা। যেসব সাহাবী থেকে ইমাম সাহেব হাদিস বর্ণনা করেছিলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে – আনাস ইবনে মালেক রা., আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা., সহল আবনে সাআদ রা., আবু তোফয়ল রা., আমের ইবনে ওয়াছেলা রা., ওয়াছেলা ইবনে আশক্বা রা., মা’কাল ইবনে ইয়াসার রা., এবং জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. প্রমুখগণ।

হাদিস শাস্ত্রের ‘ আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান ( আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আবু হানীফা রহ. স্বয়ং একটি বর্ণনায় বলেন, আমার জন্ম হিজরী ৮০ সনে এবং ৯৬ সনে প্রথম হজে যাই। তখন আমার বয়স ষোল বছর। মসজিদুল-হারামে প্রবেশ করে দেখলাম, একটি বড় হালকায় বহু লোক সমবেত হয়ে রয়েছেন। আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের জমায়েত? তিনি বললেন, এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনুল হারেছের রা. পাঠদানের হালকা। এ কথা শুনে আমি সেদিকে অগ্রসর হলাম। তাঁকে বলতে শুনলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দীন সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করে, তার সকল প্রয়োজনের জিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হয়ে যান এবঙ তাকে এমন সব উৎস থেকে রিজিক পৌছাতে থাকেন, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। (মুসনাদে ইমাম আযম)

উল্লেখ্য যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেছের রা. ইন্তেকাল হয়েছে ৯৯ হিজরীতে। তখন ইমাম সাহেবের বয়স হয়েছিলো ১৯ বছর।

‘এলামুল-আখবার’ নামক গ্রন্হে বর্ণিত অন্য একখানা হাদিস ইমাম আবু হানীফা রহ. সরাসরি সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেকের রা. নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিসে বলা হয়েছে যে, এলেম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ।

একই সুত্রে হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে ইমাম আবু হানীফা রহ. কর্তৃক বর্ণিত অন্য আর একখানা হাদিস হচ্ছে- পাখীরা আল্লাহর উপর যতটুকু ভরসা করে জীবন ধারন করে কোন বান্দা যদি ততটুকু ভরসা করতে শেখে তবে আল্লাহ পাক তাকেও অনুরূপ রিজিক দান করবেন। পাখীরা সকাল বেলায় খালি পেটে বের হয়ে যায়, সন্ধায় পেট ভরে বাসায় ফিরে আসে।

ইমাম সাহেব আর একখানা হাদিস সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদিস খানা হচ্ছে- যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ পাক তার জন্য বেহেশতে গৃহ নির্মাণ করবেন।

শেষোক্ত হাদিসখানাকে ইমাম জালালুদ্দিন সিয়ুতী রহ. মোতাওয়াতের হাদিস রূপে অভিহিত করেছেন।

মোল্লা আলী কারী রহ. বরেন, এই হাদিসটির অন্যুন পঞ্চাশটি সনদ আমি সংগ্রহ করেছি। তম্মধ্যে ইমাম আবু হানীফার রহ. মাধ্যমে বর্ণিত সনদিই সর্বোত্তম।

ইমাম সাহেবের শিক্ষা জীবনঃ

সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্হিতি ইমাম আবু হানীফা রহ. যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন আলমে আসলামের খেলাফতের মনসদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান। ইরাকের শাসন কর্তৃত্ব ছিল হাজ্জান ইবনে ইউসুফের হাতে। সাহাবী এবং যুগশ্রষ্ঠ জ্ঞানীগুনিগণের শহর কুফা ছিল তার রাজধানী। হাজ্জাজকে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে জালেম প্রশাসকরূপে আখ্যায়িত করা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীসহ অগণিত সংখ্যক জ্ঞানী গুনীকে তার জুলুম অত্যাচরের কবলে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলতেন, পূর্ববর্তী উম্মতগণের সকল জালেমকে এক পাল্লায় এবং আমাদের হাজ্জাজকে যদি আর এক পাল্লায় তোলা হয় তবে নিঃসন্দেহে হাজ্জাজের জুলুমের পাল্লা অনেক ভারি হবে।

ইবরাহীম নখয়ীর রহ. ন্যায় সাধক ব্যক্তি হাজ্জাজের মৃত্যুসংবাদ শুনে সেজদায় পড়ে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে আল্লাহর শুকুর আদায় করেছিলেন। জুলুম-অত্যাচরের বিভীষিকাময় পরিস্হিতিতে আলেম-সাধক এবং দীনদার শ্রেণীর লোকেরা অনেকটা নিষ্ক্রীয়তা এবং নির্জনবাস বেছে নিয়েছিলেন। যারাই একটু সাহসের সাথে অগ্রসর হয়েছেন, তাদের কেউ এই জালেমের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাননি।

খলীফা আবদুল মালেকের ইন্তেকাল হয় হিজরী ৮৬ সনে। দুর্দন্তপ্রতাপ এই খলিফার শাসনামলে ইসলামী খেলাফতের সীমান্ত পূর্বে কাবুল-কান্দাহার এবং সিন্ধু-পান্জাব পর্যন্ত এবং পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু এলমে-দীনের বড় বড় কেন্দ্রগুলি ছিল স্তব্ধ। আলেমগণ নিজেদের নির্জন হুজরায় বরে দীনি এলেমের চর্চা নামেমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সত্য, কিন্তু বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এলেমের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

হিজরী ৯৫ সনে হাজ্জাজ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। পরবর্তী বছর আব্দুল মালেকের পুত্র ওলীদেরও মৃত্যু হয়। ওলীদের মৃত্যুর পর সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। ইতিহাসবিদগণের বিবেচনায় সুলায়মান ছিলেন উমাইয়া বংশীয় খলীফাদণের মধ্যে অন্যতম সেরা সৎ শাসক। হিজরী প্রথম শতাব্দির মুজাদ্দেদ রূপে পরিচিত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. নিযুক্ত হন তার প্রধান উপদেস্টারূপে। মত্র পৌনে তিন বৎসর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার পর যখন তার ইন্তেকাল হয়, তখন খলিফার অসিয়্যত অনুযায়ী ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হন। (হিজরী ৯৯ সন)

ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. স্বয়ং একজন সাধক প্রকৃতির আলেম ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও যত্নে সে যুগের বিশিষ্ট আলেমগণ হাদিস, তফসীর ও ফেকাহশাস্ত্রের চর্চায় ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম বুখারী লিখেছেন, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. আবু বকর ইবনে হাদম এর বরাবরে লিখিত এক পত্রে এ মর্মে আদেশ প্রদান করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস সুমূহ যত্নের সাথে সংগ্রহ ও তা লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্হা কর। আমার আশঙ্কা হয় (বিরাজমান অবস্হায়) এলেম চর্চা এবং আলেমগণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে না যায়! (সহীহ আল বুখারী)

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী বহ. বলেন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উপরোক্ত মর্মের আদেশনামাটি সে যুগের সব বিশিষ্ট আলেমের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হিজরী ১০০ সন থেকে হাদিস সংকলনের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়। তা না হলে আজ আমাদের নিকট হাদিসের যে বিরাট ভান্ডার মজুদ আছে, তা হয়ত থাকতো না। (ওমদাতুল-ক্বারী, ১ম খন্ড)

ওলীদের যখন মৃত্যু হয় (হিজরী ৯৬) তখন আবু হানীফা রহ. ষোল বছরের তরুণ। এ পর্যন্ত তাঁর লেখাপড়া পারিবারিক পরিবেশেই সীমিত ছিল। সে বছরই পিতার সাথে হজ্বে গমন করে মসজিদুল-হারামের দরছের হালকায় বসে আল্লাহর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীর জবানী হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমে এলমে-হাদিসের সাথে তাঁর সরাসরি পরিচিতি ঘটে। প্রথম যৌবনের সীমিত কিছুদিন ছাড়া ইমাম আবু হানীফার জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্তটি ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে কন্টকিত। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতেই উমাইয়া শাসনের পতন এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের উত্থান ঘটে। আব্বাসীয়দের দাবী ছিল খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন ব্যবস্হা পূনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শাসন ক্ষমতায় আহলে-বাইতের প্রাধান্য স্হাপন। যে কারণে সমসাময়িক বিশিষ্ট আলেম ওলামাগণের পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফাও রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটানোর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শরীক হয়েছিলেন।

সেই বিস্ফোরণমূথী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই ইমাম আবু হনীফা কুরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবীগণের জীবনপদ্ধতি মন্হন করে এলমে-ফেকাহ বা বিধান শাস্ত্র রচনা করে গেছেন। সর্বকালের মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞান সম্মত বিধিবিধান সম্বলিত এগরো লক্ষাধীক মাসআলা সংকলিত করে গেছেন তিনি। তাঁর সংকলিত মৌলিক মাসআলা-মাসায়েলের সুত্রগুলির মধ্যে এমন একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সমর্থনে কুরআন, হাদিস বা সাহাবীগণের আছার এর সমর্থন নাই। এর দ্বারাই অনুমিত হয় যে, তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটুকু বিস্তৃত ছিল।

ইমাম আবু হানীফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় প্রষ্ঠপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। তাঁর অন্যতম বিশিষ্ট সাগরেদ ইমাম মুহম্মদকে তিনি বাল্যকাল থেকেই লালন-পালন করে প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত শিখরে পৌছে দিয়েছিলেন। তাঁর অর্থ সাহায্যে লালিত এবং জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন শাখায় সুপ্রতিষ্ঠিত মনীষীবর্গের তালিকা অনেক দীর্ঘ।

কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ওবাং বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শা’বীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শা’বী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি! তুমি কোথায় যাওয়া-আসা কর?

ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শা’বী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে?

আবু হানীফা রহ. সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়।

কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শা’বী আবু হানীফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম সাহেব বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু জোহরা)

এ সময় আবু হানীফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর কাল ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন। ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ইমাম সাহেবের শিক্ষা জীবনঃ(বাকী অংশ)

আবু হানীফা নিজমুখে বর্ণনা করেন, কিছুদিন এদিকে সেদিক কিছু লেখাপড় শিক্ষা করার পর একবার আমি বসরায় যাই। সেখানকার জ্ঞানীগুনীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পর বুঝতে পারলাম যে, কুল-কিনারাহীন জ্ঞান সাগরের অনেক কিছুই আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তারপরই আমি মনে মনে সংকল্প গ্রহণ করি যে, যতদিন বেঁচে থাকব, ইমাম হাম্মাদের সাহচর্য ত্যাগ করব না এবং এরপর দীর্ঘ আঠারো বছর তাঁর সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য থেকে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হই। (আবু জোহরা)

৯৬ হিজরীতে সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক খেলাফতের দায়িত্বগ্রহণ করার পর যখন দীনি এলেম চর্চার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই ইমাম আবু হানীফা নিয়মিত এলেম চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তখনকার দিনে কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি এলমে কালাম বা আকায়েদ শাস্ত্র নামের আর একটি বিষয় দীনি এলেমের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাহাবায়ে-কেরামের জামানা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা ও গুনাবলী (যাত ও সিফাত), পবিত্র কুরআনের আয়াত ইত্যাদিতে কোন প্রকার দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। ইহুদি তাত্ত্বিক আবদুল্লাহ ইবনে সাবার দৌরাত্ম, হযরত আলীর রা. এবং হযরত মোয়াবিয়ার রা. মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ, প্রাচীন ইরানী সভ্যতার সাথে ইসলামের সংমিশ্রণ প্রভৃতি কারণে মোতাযেলী, খারেজী, শিয়া প্রভৃতি বিভ্রান্তিকর মতবাদের সৃষ্টি হয়। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর চেতনায় এমন একটি স্হায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় নানা প্রকার বিভ্রান্তিকর মতবাদ অনুকূল পরিবেশ লাভ করে। ইমাম আবু হানীফার শিক্ষা জীবনের সূচানায় বিভিন্নমুখী মতবাদের মোকানেলায় এলমে-কালাম বা আকায়েদ শাস্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইয়হইয়্যা ইবনে শাইবানের বক্তব্য অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. তাঁর এলমেকালাম চর্চায় ইতিহাস সম্পর্কে বলেন, আমি বেশ বিছুকাল এলমে কালাম চর্চায় নিয়োজিত থাকি। বিভিন্ন জটিল বিষয়ে বিতর্কে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি বহুবার বসরা সফর করি। কেননা, তখনকার বসরা ছিল বিভিন্নমুখী দর্শনিক আলোচনার পীঠস্হান। এ উদ্দেশ্যে কোন কোন সময় মাসের পর মাস আমাকে বসরায় অবস্হান করতে হয়। (আবু জোহরা)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অনুমিত হয় যে, ৯৬ হিজরী থেকে শুরু করে ১০২ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদের শিক্ষায়তনে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত অনুমান সাত বছর কাল ইমাম আবু হানীফা রহ. একান্তভাবে এলমে-কালামের চর্চায় ও অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

আকায়েদ সম্পর্কিত দার্মনিক আলোচনার ক্ষেত্রে ত্যাগ করে এলমে ফেকাহর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন, একদিন আমি দোকানে বসা ছিলাম। জনৈকা স্ত্রীলোক এসে তালাক সম্পর্কিত একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে তাকে অনতিদূরে অবস্হিত ইমাম হাম্মাদের দরসগাহে যেতে বললাম। আর বিশেষভাবে বলেদিলাম যে, ইমাম সাহেব তোমার এ সমস্যার কি সমাধান দেয় আমাকেও তা বলে যেও।

ইমাম সাহেব বলেন, সেদিন থেকেই আমার অন্তরে এলমে-ফেকাহ শিক্ষা করার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।

ইমাম হাম্মাদ এবং তাঁর শিক্ষায়তনঃ

হাম্মদ ইবনে আবূ সুলায়মান ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে একজন বিজ্ঞ আলেম। কুফার এক সম্ভ্রান্ত বিত্তবান পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তখনকার যুগে এলমে-ফেকাহর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দি ব্যক্তিত্ব। সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেকের রা. নিকট হাদিস শিক্ষা এবং তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর উস্তাদ ছিলেন প্রাজ্ঞ তাবেয়ী ইবরাহীম নখয়ী রহ.

আবুল শায়খ তারীখে ইসপাহান গ্রন্হে উল্লেখ করেছেন যে, হাম্মাদ আল্যকাল থেকেই ছিলেন সুফী প্রকৃতির। ইবরাহীম নখয়ীর রহ. সাহচর্যে তাঁর আল্লাহপ্রদত্ত মেধা এবং আধ্যাত্মিক সুষমা জূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছিল।

বাল্যকালের একটি ঘটনা। একদিন ইবরাহীম নখয়ী হাম্মাদকে গোশত আনার জন্য বাজারে পাঠালেন। জথে হাম্মাদের পিতা আবু সুলায়মান দেখতে পেলেন, তার জুত্র হাতে একটি থৈ নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। বালকপুত্রের বেশবাস এবং হাতে থলি দেখে ‘রঈস’ পিতার আত্মমর্যাদা বোধ আহত হলো। তিনি পুত্রের হাত থেকে থলিটা নিয়ে দূরে ফেলে দলেন্ কিন্তু হাম্মাদ সরই থলি কুড়িয়ে নিয়েই দ্রুত উস্তাদের বাড়ীতে চলৈ গেলেন। ইবরাহীম নখয়ী রহ. ইন্তেকালের পর যখন হাদিস শিক্ষার্থীগণ দলে দলে হাম্মাদের বাড়ীতে এসে সমবেত হতে লাগলেন, তখন একদিন আবু সুলায়মান হাম্মাদকে লক্ষ্য করে বলেছলেন, বৎস! ইবরাহীম নখয়ী রহ. সেই জীর্ণ থলেটির তধ্যে যে কত বড় মর্যাদা ও বরকত লুক্কায়িত ছিল, তা এতকাল পর আমার বুঝে এসেছে। (তরজুমানুস-সুন্নাহ)

ইবরাহীম নখয়ী রহ. ইন্তেকালের পর হাম্মাদ তাঁর স্বতন্ত্র শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। কূফায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অসহনীয় দৌরাত্ম উপেক্ষা করেই তিনি তাঁর শিক্ষাদান কার্য অব্যাহত রেখেছিলেন। এলেমের গভীরত, অসাধারণ জনপ্রিয়তা এবং পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে শাসন কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁর জক্ষে স্বীয় সাধনায় অবিচল থাকে সম্ভবপর হয়েছিল। তাঁর যুগে কূফার সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম ছিলেন হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান। তাঁর অনুপম উদারতা ও চরিত্র মাধুর্য্য সম্পর্কিত বহু কাহিনী রূপকথার ন্যায় বিভিন্ন গ্রন্হে ছড়িয়ে আছে। কথিত আছে, একবার পথিমধ্যে তাঁর অশ্বের ছিন্ন জিনটি মেরামত করার বিনিময়ে গরীব চর্মকারের হাতে তিনি আশরাফীর একটি থলি তুলে দিয়েছিলেন। রমযান মাসে তিনি অন্যুন পঞ্চাশজন দীনদার ব্যক্তি রাখতেন। তাদের সাথে ইফতার করতেন। খানা খেতেন। রমযান শেয়ে প্রত্যেককেই আশাতীত পারিতোষিক দিয়ে বিদায় করতেন। শিক্ষার্থীগণের প্রতি তাঁর স্নেহ-মমতা ও উদারতা ছিল সীমাহীন। শিক্ষাদান কার্য্যে অতুলনীয় নিষ্ঠা এবং শিক্ষার্থীগণের প্রতি পিতৃসুলভ মমত্ববোধের ফলেই তার শিক্ষায়তন থেকে ইমাম আবু হানীফার রহ. ন্যায় সর্বকালের সেরা জ্ঞানতাপসের সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল। ইরাক, বিশেষতঃ কূফাবাসীগণের মহান উস্তাদ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের রা. একজন বিশিস্ট উত্তরসুরী রূপে বিবেচিত হতেন হাম্মান ইবনে আবু সুলায়মান।

হিজরী প্রথম দুইশতাব্দি কালের মধ্যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন ছিল না। এক একজন বিশিষ্ট আলেমকে কেন্দ্র করে এক একটি দরছের হালকা বা শিক্ষাদান কেন্দ্র গড়ে উঠতো। শিক্ষার্থীগণ নিজেদের উদ্যোগ সমবেত হতেন এবং বিশেষ একটি বা দু’টি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। শিক্ষার্থীগণ তা গভীর মনোযোগ সহকারে এলেম বিস্তৃত ও সংরক্ষিত হতো।

ইমাম হাম্মাদের শিক্ষায়তনেও পাঠদানের ক্ষেত্রে এই সনাতন পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। তবে শিক্ষার্থীদের বসবার ক্ষেত্রে শ্রেণী বিন্যাসের কড়াকড়িভাবে অনুসরণ করা হতো। মেধাবী এবং পুরাতন শিক্ষার্থীদেরকে প্রথমসারিতে বসতে দেওয়া হতো। আবু হানীফা রহ. যে দিন দরসে শরীক হন, তার পরদিন থেকেই তাঁকে প্রথম কাতারে স্হান করে দেওয়া হয়।

আবু হানীফা নোমান ইবনে ছাবেত যেমন ছিলেন একজন বিরল প্রতিভাধর শিক্ষার্থী তেমনি তাঁর উস্তাদ হাম্মাদ ইবনে আবু সুলায়মান ও ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ শিক্ষক। একনিষ্ঠ এই সাগরেদের জ্ঞানঅন্বেষায় মুগ্ধ হয়ে একদা তিনি আবেগপ্লুত কন্ঠে বলেছিলেন, তুমি আমার ভান্ডার একেবারে শুন্য করে নিলে হে আবু হানিফা! উল্লেখ্য যে, সত্যনিষ্ঠ সঠিক অনুধাবন শক্তির প্রতি ইঙ্গিত করেই মহান উস্তাদ তাঁর এই প্রিয় সাগরেদকে “আবু হানিফা” নামে সম্বোধন করেছিলেন। কালে উস্তাদের সেই স্নেহের সম্বোধনই কালজয়ী মহান ইমামের বরকতময় নামের প্রধান অংশে পরিণত হয়ে যায়! (আল-মুয়াফফেক)

ইমাম হাম্মাদের শিক্ষায়তনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে আবু হানীফা বলেন-বেশ কিছুকাল তর্কাসভায় সময় অতিবাহিত করার পর এক সময় আমার মনে এরূপ একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য যে এলেমের অংশবিশেষও কি আমি আয়ত্ব করতে পেরেছি?

সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী তাবেয়ীগণের অগ্রনী জামাত যে এলেমের অনুশীলন করতেন, তাতে কি তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোন অবকাশ ছিল? আমার বিবেকই বলল, না, তাঁরা এলেম চর্চা করতেন আমলে সুষ্ঠতা আনয়নের লক্ষ্যে। তাঁদের এলেম ছিল একান্তই জীবনবাদী। এরূপ একটা বোধদয়ের আলোকেই আমি এলমে-কালামের চর্চা ত্যাগ করে ফেকাহ পাঠ গ্রহণ করি। (আল-মুয়াফফেক)

আবু হানীফার রহঃ নিষ্ঠা এবং একাগ্রতায় মুগ্ধ ছিলেন ইমাম হাম্মাদ রঃ। উস্তাদের প্রতি এমন অসাধারণ ভক্তি ছিল আবু হানীফার রঃ যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কখনও তিনি উস্তাদের বাড়ীর দিকে পা মেলে শয়ন করেন নি। এতদসত্ত্বেয় জ্ঞানের বিয়য় আলোচনার ক্ষেত্রে মোটেও নমনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করতেন না।

একদা উস্তাদ-সাগরেদ মিলে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে পানি ফুরিয়ে গেলে ইমাম হাম্মাদ তায়াম্মুম করে আসরের নামায পড়ে ফেললেন। কিন্তু আবু হানীফা উস্তাদের সাথে নামায পড়লেন না। বললেন, যতক্ষন পানি পাওয়ার আশা থাকে, ততক্ষন অপেক্ষা করতে হবে এবং ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করে নামায পড়া বৈধ হবে। পরে হাম্মাদ রঃ প্রিয় সাগরেদের এই এজতেহাদ মেনে নিয়েছিলেন। (আল বেনায়া)

ইমাম আবু হানীফার শিক্ষা-জীবনের অনুরূপ আরও বহু ঘটনাই বিভিন্ন কিতাবে ছড়িয়ে আছে, যদ্বারা তাঁর অসাধারণ ধীশক্তি এবং শরীয়তের সূক্ষ্ম বিষয়াদি অনুধাবনের অনন্য যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইমাম যুফার রহঃ বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানীফা রঃ বলেছিলেন, এক সময় আমার মনে এমন একটা চিন্তার উদয় হয়েছিল যে, উস্তদের নিকট থেকে বিদায় গ্রহণ করে নিজস্ব একটি শিক্ষায়তন গড়ে তুললে কেমন হয়! ঘটনাক্রমে এ সময় একজন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে ইমাম হাম্মাদ রঃ বসরায় চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি আমাকে তাঁর স্হলাভিষিক্ত করে গেলেন। নানা করণেতা৭র প্রত্যাবর্তন মাস তিনেক বিলম্বিত হয়। তাঁর অনুপস্হিতিতে আমি বিভিন্ন লোকের যে সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলৈন, সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। ফিরে আসার পর উস্তাদের সামনে সুগলো পেশ করলে আমার বেশ কয়েকটি ভুল হয়েছে বলে তিনি চিহ্নিত করলেন। এই ঘটনায় আমি মনে মনে শিউরে উঠলাম। সংকল্প গ্রহণ করলাম যে, যতদিন ইমাম হাম্মাদ জীবিত থাকবেন, ততদিন আর তাঁর হালকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা চিন্তাও করবোনা।

জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে কঠোর সাধনার দীর্ঘ আঠারো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর হিজরী ১২০ সনে ইমাম হাম্মাদের রঃ ইন্তেকাল হয়। অতঃপর আবু হানীফাকেই উস্তাদের শিক্ষাকেন্দ্রটি সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। মৃত্যুর আগে ইমাম হাম্মাদ আবু হানীফাকে রঃ আনুষ্ঠানিক ভাবেই তাঁর স্হলাভিষিক্ত মনোনীত করে যান। এভাবেই নো’মান ইবনে ছাবেত উস্তাদের দেওয়া নাম এবং স্হলাভিষিক্ত হওয়ার দায়িত্ব লাভ করে আহলে ছুন্নাতুল জামাতের মর্যাদাবান ইমামরূপে বরিত হন।

অন্যান্য উস্তাদগণঃ

আবু হানীফা রঃ ছিলেন সর্বকালেন সেরা মজতাহেদ ফিকাহবিদ ইমাম। বিশেষজ্ঞ শ্রেণীর কোন আলেমকে মুজতাদেদের স্তরে পৌছাতে হলে হাদীসের হাফেজ, তফসীর শাস্ত্রের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ এবং সাহাবীগণের জীবন ধারা সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জ্ঞান থাকা অপরিহর্য হয়ে যায়। হযরত আবু হানীফাকে মজতাহেদ ইমামের স্তরে পৌছার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলিতে সর্বাধিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিলো। ফেকাহশাস্ত্র তথা কুরআন-মহাসাগর মন্হন করে মাসআলা-মাসায়েল নির্ধারণ করার প্রশিক্ষণ তিনি ইমাম হাম্মাদের নিকট থেকেই আয়ত্ব করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর এলমে-ফেকাহর আর একজন বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন আহলে বাইতের উজ্জলতম নক্ষত্র যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দেস ও ফকীহ ইমাম জাফর সাদেক রঃ।

ইমাম আবু হানীফার মন্তব্য হচ্ছে, যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফকীহ ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক রঃ। তার চাইতে অধিক ধীসম্পন্ন কোন ফকীহর সাক্ষাত অন্য কোথাও পাইনি। (আল-মওয়াফেক)

হাদিস এবং তফসীর শাস্ত্র আয়ত্ব করার উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানীফা সে যুগের যে সব সেরা মুহাদ্দেসগণের শরনাপন্ন হয়েছিলেন, তাদের সংখ্যা হাফেজ জাহাবীর মতে ২৯০ জন। এঁদের মধ্যে এমন পন্ঞাশ ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় যাদের বর্ণনা বুখারী-মুসলিম সহ সেহাহ-সেত্তার সকল কিতাবেই বিশেষ যত্নের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। (ইমামে আজম, আবু হানীফাহ রহঃ)

একই কারণে যেমন মোয়াত্তা ইমাম মালেক গ্রন্হটি প্রথম দিকে সংকলিত সর্বাধিক শুদ্ধ কিতাব রূপে গন্য করা হয, তেমনি হাদিস শাস্ত্রের প্রথম সংকলন গ্রন্হ “মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা” নামক হাদিস সংকলনটি বিশুদ্ধতার দিক থেকে যে সর্বাগ্রগন্য তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।

ইমাম সাহেবের হলকায়ে দরছ ও ফতওয়াঃ

দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাঃ কর্তৃক কূফা নগরীর গোড়াপত্তন করার পর পরই কূফা তথা সমগ্র ইরাকবাসীগণের জন্য এলমে-নববী শিক্ষা দান এবং ফতোয়া প্রদানের নিয়োজিত হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একান্ত সহচর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ দীর্ঘকাল কূফায় অবস্হান ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দ্বিনী এলেম চর্চার একটা বিশেষ ধারা গড়ে উঠেছিলো। প্রকৃত প্রস্তাবে এলমে-ফেকাহর গোড়াপত্তনকারীও ছিলেনহযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ। ইবরাহীম নখয়ীর রঃ মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর প্রবর্তিত এলেমের সেই বিশেষ ধারার উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন ইমাম হাম্মাদ রঃ। তার হাতেই ইবনে মাসউদের রাঃ দ্বারা বপনকৃত ফেকাহ নামের চারাগাছটি একটি পরিপূর্ণ বৃক্ষের আকার ধারণ করে। ইমাম হাম্মাদের রঃ প্রতিষ্ঠিত দরসগাহের পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করার পর ইমাম আবু হানীফা রঃ তার অচিন্ত্যনীয় মেধা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সে বৃক্ষটি ফলে ফুলে সমৃদ্দ করে তুলেন। ইমাম আবু হানীফা রঃ এর মাধ্যমেই হযরত মসউদের রাঃ এলম ও প্রজ্ঞার মীরাছ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ইমাম হাম্মাদের তিরোধানের পর কূফঅর জ্ঞানী সামাজ যে শুন্যতা অনুভব করছিলেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ইমাম আবু হানীফা রঃ তা পূরণ করে দিতে সমর্থ হয়েছিলে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম যুফার, আসাদ ইবনে ওমর, কাসেম ইবনে মাআল প্রমুখ সেরা আলেমগণও এ হালকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার পর ইমাম আবু হানীফা রঃ পরিচালিত শিক্ষায়তনটিই কূফা তথা সমগ্র ইরাকের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়।

একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন এবং সেরা স্বপ্নতত্ববিদের ব্যাখ্যাঃ

এ সময়ে ইমাম আবু হানীফা রঃ একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। দেখলেন, যেন তিনি প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর শরীফ খনন করে কিছু হাড়-কংকাল সংগ্রহ করছেন। স্বপ্নটি দেখার পর কিছু দিন তিনি ছিলেন মানসিক ভাবে খুবই উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নদ্রষ্টার পরিচয় গোপন রেখে তিনি স্বপ্নের বিবরণ তাবীর শাস্ত্রের ইমাম মুহম্মদ ইবনে সিরীনের রঃ খেদমতে পেশ করেন। ইবনে সিরীন রঃ এই স্বপ্নটিকে একটি মোবারক স্বপ্ন রূপে আখ্যায়িত করে বলেন, স্বপ্নদ্রষ্টা যুগের ইমাম এবং প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এলমের উত্তরাধিকার পুনজ্জীবিত করবেন। (আল-মোয়াফেক)

ইমাম মুহম্মদ ইবনে সিরীন রঃ কর্তৃক প্রদত্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা ইমাম আবু হানীফার জীবন-সাধনার মধ্য দিয়ে কেমন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিলো তা বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কুরআন-হাদিসের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের মাধ্যমে ইমাম আবু হানীফা রঃ ইসলামী বিধানশাস্ত্র তথা শরীয়তের আদেশ-নিষেধ এমন চমৎকার ভাবে বিশ্লেষন করে দিয়েছেন, যা পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বাপেক্ষা নিরাপদ এবং সর্বাধিক সংখ্যক লোকের অনুসৃত বিধান শাস্ত্রের স্হান দখল করতে সমর্থ হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রঃ সময়কাল থেকে শুরু করে হিজরী একাদশ শতাব্দীর সমাপ্তিকাল অর্থাৎ হাজার বছরেরও আধিককাল পর্যন্ত সমড়্র আলমে-ইমলামের কোর্ট-কাচারী, লেন-দেন, বিবাহ-তালাক এবং সকল আনুষ্ঠানিক এবাদত-বন্দেগীতে আবু হানীফার ফেকাহই ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে। কারণ একমাত্র ইমাম আবু হানীফা রঃ ছাড়া অন্যকোন ইমাম বা মনীষীই জীবনের সকল চাহিদা পূরণ উপযোগী বিস্তারিত বিধান উম্মতের সামনে পেশ করতে সক্ষম হননি। একারনেই যারা ইমাম আবু হানীফার মাযহাব মেনে নিতে অস্বীকার করেন, তারাও বিচার-পদ্ধতি পরিচালনায় বা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের বহু ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার রঃ মাযহাব মেনে নিতে বাধ্য হন।

হাদীস ও ফেকাহঃ

হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ, প্রভৃতি নির্ণয়ের মানদন্ড হচ্ছে কুরআনের আয়াত এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস। কোন আয়াতের কি মর্ম, কোন হাদীসখানার দ্বারা কোন হুকুম নির্ধারিত হলো এসব তাৎপর্য উদঘাটনের নামই ফেকাহ। মুহাদ্দিছ বা হাদীস তত্ববিদের কাজ হচ্ছে হাদীস রূপে বর্ণিত বাক্যটির শুদ্ধাশুদ্ধ নির্ণয়। হাদীসখানার মর্মার্থ কি এবং এর দ্বারা কোন কোন হুকুম প্রমাণিত হচ্ছে, তা খুজে বের করার সাধনায় যাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন তাদেরকেই ফেকাহবিদ নাবে অভিহীত করা হয়েছে।

ওবায়দুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণনা করেন, আমরা কয়েকজন বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দেছ হযরত আ’মাশের রঃ দরবারে বসা ছিলাম। এক ব্যক্তি এসে মাসআলা জিজ্ঞেস করলো। আ’মাশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর জবাব দিলেন- মাসআলাটির জবাব আমার জানা নাই। আবু হানীফাও রঃ সেই মজলিসে বসা ছিলেন। তাঁর প্রতি লক্ষ্য করে আমাষ বললেন, আবু হানিফা! তোমার জানা থাকলে সমাধানটি বলে দাও। আবু হানীফা রঃ জিজ্ঞাসিত বিষয়টির একটি চমৎকার জবাব দিয়ে দিলেন। জবাবটি আমাশের খুব পছন্দ হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জবাবটি তুমি কোন হাদীসের ভিত্তিতে দিলে? আবু হানীফা বললেন, আপনার কাছ থেকে শিক্ষা করা অমুক হাদীসের ভিত্তিতে। শুনে আ’মাশ মন্তব্য করলেন, আমরা (মুহাদ্দেসরা) হচ্ছি যারা ঔষধি দ্রব্য নিয়ে নাড়াচাড় করে তাদের ন্যায় (আত্তার বিশেষ)। আর তোমরা হলে ঐ ঔষধ তৈরি করে এবং রোগ নির্ণয় করে রোগীকে তা সেবন করতে দেয়।

অনুরূপ আর একটি মাসআলা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী-লোকের পক্ষে তার সহগামী হওয়া হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। আবু দাউদ শরীফে এ মর্মে বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু কূফার এ সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারের একটি কিশোর মারা গেলে শোকে তার মা অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মৃতদেহ জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় শোকে কাতর মাতাও সঙ্গে রওয়ানা হলেন। হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁকে হাজার বারণ করার পরও তিনি মানলেন না। বরং এক পর্যায়ে জেদের বশবর্তী হয়ে তিনি কছম খেয়ে বসলেন যে, তিনি পুত্রের জানাযা পড়বেনই। অপর দিকে ছেলের পিতা স্ত্রীর এই অন্যায় জেদ দেখে বলে বসলেন যে, এখান থেকে ফিরে না গেলে তুমি তালাক হয়ে যাবে। ফলে মৃতদেহ নিয়ে সেখানেই সকলে থেমে গেলেন। বিষয়টা কিভাবে মিমাংসা করা যায়, এ নিয়ে সকলেই ভাবলেন, কিন্তু কোন সমাধান খুজে পাওয়া গেল না। নিরূপায় হয়ে ইমাম আবু হানীফাকে ডাকা হলো। তিনি এসে ছেলের মাকে বললেন, আপনি এখানে দাড়িয়েই ছেলের জানাযা পড়ুন এবং ফিরে যান। কেননা, হাদীস শরীফে স্ত্রীলোকের জন্য মৃতের অনুগমন করতে নিষেধ করা হয়েছে। জানাযা পড়তে নিয়েধ করা হয়নি। এখানে জানাযা পড়ে নিলে আপনার কসম পুরা হয়ে যাবে। আর এখান থেকে ফিরে গেলে আপনার স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত তালাকও কার্যকর হবেনা।

উক্ত স্ত্রীলোক ইমাম সাহেবের সমাধান মেনে নিলেন এবং সেখানেই (একা একা) জানাযা আদায় করে বাড়ী ফিরে গেলেন। জানাযার সাথে কুফার বিশিষ্ট আলিমগণের অনেকেই উপস্হিত ছিলেন। সমস্যাটি নিয়ে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ইমাম আবু হানীফার এই তাৎক্ষনিক সমাধান শুনে হাদীস তত্ববিদ ইবনে শাবরা রঃ মন্তব্য করেছিলেন, সম্ভবত কোন মাতাই আবু হানীফা রঃ এর ন্যায় মেধা সম্পন্ন সন্তান প্রসব করতে সক্ষম হবেননা।

প্রকৃত প্রস্তাবে হাদিসের মর্মার্থ উদ্ধার করে তার আলোকে উদ্ভৃত সমস্যার সমাধান বের করার নামই তো ফেকাহ। ফেকাহবিদগণকে হাদিসের মতন (মুলপাঠ) যেমন জানতে হয়ে, তেমনি এর অন্তর্নিহীত অর্থ সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হয়। ইমাম তিরমিযীর রঃ মন্তব্য হচ্ছে, হাদিসের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে ফেকাহবিদগণই সর্বাধিক অবগত হয়ে থাকেন।

হিজরী চতুর্থ শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দেস ইমাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে ইসহাক রঃ তাঁর রচিত ‘মাআনিউল-আখরার’ নামক গ্রন্হে লিখেছেন, শরীয়ত বিশেষজ্ঞ কেবলমাত্র ফেকাহবিদগণকেই বলা চলে। অন্যান্য এলেম বিশেষ একটি বিষয় কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। যেমন তফসীরবিদগণ শুধুমাত্র পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। মুহাদ্দেসগণের চর্চা প্রধাণতঃ হাদিসের শব্দ, সনদ ও মতনের মধ্যেই আবর্তিত হয়। কিন্তু একজন ফেকাহবিদ অত্যাবশ্যকীয়ভাবেই হাদিস-তফসীরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি আরো অনেকগুলি জাগতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। সম্ভবতঃএ কারণেই কুরআন এবং হাদিসের প্রকৃত মর্ম অনুধাবনের জন্য ফেকাহ আয়ত্ব করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতিঃ

যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করা। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)

ইমাম ইবনে হাযম রঃ বলেন, আবু হানীফার রঃ সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হবে। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার রঃ মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রঃ বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রঃ হারামাইন শরীফে কাশফ যুগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আমাকে অবগত করেছেনযে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার রঃ সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামন্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)

সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা রঃ বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্হান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।



শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ

সে জামানার দরসের হালকা বা শিক্ষাঙ্গনের চিত্র ছিল, উস্তাদ কোন একটি উচ্চ আসনে বসে তকরীর করতেন। ছাত্রগণ চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে নিতান্ত নিবিষ্টতার সাথে তকরীর শ্রবণ করতেন। অনেকেই তকরীর শুনে তা আয়ত্ব করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এসব তকরীর উস্তাদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে যিনি তকরীর করতেন তাঁর নামেই সেগুলো গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হতো। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দির সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফার রঃ শিক্ষাদান কার্যক্রমেও সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। কোন কোন মাসআলায় তর্ক শুরু হয়ে যেত। সে তর্ক কয়েকদিন পর্যন্তও চলতো। শেষ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যা সাব্যস্ত হতো সেটাই লিপিবদ্ধ হতো। কোন কোন মাসআলায় উস্তাদ ও সাগরেতের মধ্যকার মতভেদ অমীমাংসিতই থেকে যেত। সেই মত পার্থক্যগুলিও স্ব স্ব যুক্তি সহকারেই কিতাব লিপিবদ্ধ করা হতো। এভাবেই হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্হগুলি সংকলিত হয়েছে।

ইমাম সাহেবের দরছগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্হানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনেরা সমবেত হতেন। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন।

কর্মদিবস গুলিতে তিনি এশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। জোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। ফতোয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিল। তবে অবস্হা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো।

দরসের মজলিসে শিক্ষার্থীগণের সাথে অনেক সাধারণ লোকও শরীক হতেন। তর্কচ্ছলে অনেকে আপত্তিকর মন্তব্যও করত। কিন্তু কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে পরম ধৈর্যের সাথে জবাব দিতেন। চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের মোকাবেলাতেও তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না। প্রায সময়ই তিনি একটা কবিতাংশ আবৃত্তি করতেন। যা অর্থ ছিলো- ইয়া আল্লাহ ! যাদের অন্তর আমাদের দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আছে, আমাদের অন্তর তাদের প্রতি প্রশস্ত করে দাও। (আবু যোহরা)

শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ

দরসের মজলিসে তিনি এমনই নিবিষ্টচিত্ত হয়ে পড়তেন যে, অনেক সময় পারিপর্শ্বিকতার জ্ঞান লোপ পেত। একবার তকরীর করার সময় ঘরের ছাদ থেকে একটা সাপ তার কোলের উপর পতিত হ। তিনি শুধু কাপড় ঝাড়া দিয়ে সাপটি দুরে ফেলে দিলেন। একটা বাক্যও উচ্চারণ করলেন না বা এ ঘটনা তাঁর নিবিষ্টতায় মাসান্যতম ব্যাঘাতও সৃষ্টি করতে পারল না।

প্রতিটি তকরীরের শেষে তিনি বলতেন, এটি আমার অভিমত। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, তা আমি বললাম। কেউ যদি আমার চাইতেও মজবুত দলীল ও যুক্তির অবতারনা করতে পারেন, তবে তাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। (আবু যোহরা)

কোন একটি বিষয় আলোচনার সময় একবার একজন ছাত্র বলেছিলেন, আপনার এই অভিমতটি খুবই চমৎকার। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে, এক পর্যায়ে এটি ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)

ইমাম আবু ইউসুফ রঃ তাঁর সব আলোচনারই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতেন। ইমাম সাহেব বলতেন, আমার তকরীর শুনে তা অনুধাবন করতে বেশি যত্নবান হও। এমনও হতে পারে যে, আজকের এই কথাগুলি পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)

যারা বিরূপ মন্তব্য করতো, তাদের সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মন্তব্য ছিল- যদি কেউ আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমার মধ্যে নাই, তবে সে ভুল বলছে। আর আলেমদের কিছু না কিছু দোষ চর্চা তো তাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।

ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফ রঃ এর দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফা রঃ এর নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।

মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রঃ ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।

ইসলামের প্রাথমিক কয়েকটি শতাব্দি ব্যাপী জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণের সর্বাপেক্ষা বড় কেন্দ্র ছিল মক্কা ও মদীনার হারামাইন শরীফাইন। পবিত্র দুই মসজীদে নিয়মিত হাদিস, তফসীর, কেরাআত ও ফেকাহ-ফাতাওয়ার দরছ হতো। দুনিয়ার সমস্ত অঞ্চল থেকেই জ্ঞান পিপাসুগণ মক্কা-মদীনায় সমবেত হতেন। হজের মওসুমে এলেম চর্চার হালকাগুলি সর্বাপেক্ষা বেশি সক্রিয় হযে উঠতো। সাধারণতঃ রমযানের আগেই দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে হজের কাফেলা মক্কা-মদীনায় পৌছে যেত। দুর-দুরান্তের পথ অতিক্রম করে আলেমগণ আসতেন তাদের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করার মানসে। হারামাইন শরীফে জগৎ বিখ্যাত আলেমগণের দরসের হালকা বসত। প্রতিটি হালকায় আলেমগণ সমবেত হয়ে তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে নিতেন। ইমাম আবু হানীফা রঃ জীবনের প্রথম সফরে (৯৬ হিজরী) মক্কার হরম শরীফে সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল হারেছ রাঃ এর সাথে সাক্ষাত করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এবং তাঁর পবিত্র যবান থেকে হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমেই এলমে-হাদিসের প্রতি তাঁর আগ্রহের সুত্রপাত হয়। তাঁর শুত প্রথম হাদিসখানা ছিল- যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনের বিশেষ জ্ঞান এলমে ফেকাহ আয়ত্ব করতে সমর্থ হয়, তার সকল চিন্তা ভাবনার দায়িত্ব আল্লাহ পাক স্বয়ং গ্রহণ করেন এবং তাকে এমন স্হান থেকে রিজিক পৌছান, যা তার ধারণায়ও আসে না। (জামে রযানুল এলেম)

এরপর ইমাম সাহেব আরও ৫৪ হজ করেন। তাঁর জীবনের সর্বমোট ৫৫ট হজের লক্ষ্য ছিল প্রধানত পবিত্র এই মহা সমাবেশ দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের আলেম-সাধক এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণের সাথে মতবিনিময় এবং এর মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করা।

হজের সফরে ইমাম সাহেব শুধু যে, জ্ঞান আহরণ করতেন তাই নয়, জ্ঞান বিতরণও করতেন। তাঁর অসাধারণ জ্ঞানগরিমার খ্যাতি পূর্ব-পশ্চিমের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো্ ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী-গুনিগণ তাঁর সাক্ষাত লাভের জন্য আগ্রহী হয়ে থাকতেন।

শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ

হাফেজ শামসুদ্দীন যাহাবী রঃ লিখেছেন- ইমাম লাইছ ইবনে সাআদ রঃ বলেন, আমি ইমাম আজম আবু হানীফা রঃ সুখ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। ফলে তাঁর সাথে সাক্ষাতের আকাঙ্খা খুবই প্রবল ছিল। সৌভাগ্যক্রমে মক্কা মোয়াজ্জমায় আমার সে আকাঙ্খা পূর্ণ হয়। একদিন দেখতে পেলাম, অগণিত লোক এক ব্যক্তিকে ঘিরে রয়েছে। এদের মধ্যে এক ব্যক্তি বেশ উচ্চৈস্বরে বলছিল- ইয়া আবু হানীফা রঃ। শুনে মনে মনে বললাম, ভীড়ের ভিতরে উপবিষ্ট এই ব্যক্তিই আমার দীর্ঘ আকাঙ্খার ধন ইমাম আবু হানীফা। (মানাকেবে আবু হানীফা, যাহাবী)

ইমাম লাইছ ইবনে সাআদ রঃ এর এ সাক্ষাতকারটি ছিল নিতান্তই আকষ্মিক। এরপর একবার ইমাম লাইছ ইমাম আবু হানীফা রঃ সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই সফর করেন। এ সম্পর্কে ফেকাহতত্ত্ববিদ আবদুর রহমান ইবনুল কাছেম রঃ বর্ণনা করেন, আমি ইমাম লাইছ ইবনে সাআদের মুখে শুনেছি, তিনি বলতেন, একবার আমি জানতে পারলাম যে, এ বছর ইমাম আবু হানীফা রঃ হজের উদ্দেশ্যে আসছেন। আমি শুধুমাত্র ইমাম আবু হানীফার রঃ সাথে সাক্ষাত করার লক্ষ্য নিয়েই এ বছর হজের সফরে যাই। মক্কার তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়। আমি তাঁর নিকট থেকে অনেকগুলি জটিল বিষয়ের মিমাংসা বিশেষতঃ কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা বা ভুলক্রমে হত্যার শাস্তি সম্পর্কিত মাসআলারও মীমাংসা অবগত হই। (সদরুল=আয়েম্মা ২য় খন্ড)

বিভিন্ন জটিল বিষয় অবগত হওয়ার লক্ষ্যে শুধুমাত্র ইমাম লাইস ইবনে সাআদ নয়, তাঁর ন্যায় আরো অগণিত জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি সর্বক্ষণ ইমাম আবু হানীফা রঃ কে ঘিরে থাকতেন। ইতিপূর্বে ইমাম লাইছ ইবনে সাআদের যবানীই তা জানা গেছে।

ইমাম আবু আসেম রঃ বর্ণনা করেন- আমরা মক্কায় ইমাম আজম আবু হানীফা রঃ সাহচর্য্যে থাকতাম। সব সময় তাঁর নিকট হাদিস এবং ফেকাহ বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ভীড় লেগে থাকতো। কোন কোন সময় এই ভীড় সহ্য সীমার বাইরে চলে যেত। কোন কোন সময় এই ভীড় সহ্য সীমার বাইরে চলে যেত। অনেক সময় ইমাম সাহেব লোকজনের জটলা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করতেন। (এলাউস সুনান, ভূমিকা অংশ)

হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেন, ইমাম আবু হানীফা রঃ নিকট যারা সমবেত হতেন, তারা ছিলেন, সে যুগের শীর্ষ স্হানীয় হাদিস বিশেষজ্ঞ এবং ফেকাহর ইমাম। (সদরুল আইম্মাহ)

প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি) চারবছর নয় মাস কাল ইমাম আবু হানীফা রঃ মক্কা শরীফে স্বেচ্ছনির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানীফা রঃ প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসিয়দের শাসন-ব্যবস্হা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখ গণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যবস্হার পুনঃ প্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগনের সে আকাঙ্খা নস্যাত করে দেয়। এই পরিস্হিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্হান মোটেও নিরাপদ ছিল না। শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকালে (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কাশরীফেই অবস্হান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা রঃ নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেজ যাহাবীর রঃ বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।









জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

ইমাম আবু হানীফা হিজরী ৮০ সনে কুফার এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মড়্রহণ কবেন। তাঁর জৌত্র ইসমাঈলের জবানী- আমার পিতামহ ছিলেন নোমান ইবনে ছাবেত ইবনে নোমান ইবনে মুরযেবান। মুরযেবান ছিলেন পারস্য অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ভূম্যাতিপতি। তাঁর পুত্র যুতী যুদ্ধবন্দিরূপে কুফায় আসেন। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার হওয়ার পর তাঁর নামকরণ করা হয় নোমান। তিনি কূফার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত আলীর (রাঃ) খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর দোয়া লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যূতী বা নোমাদের পৌত্র আবু হানীফা রহঃ বিদ্যা ও মনীয়ার অকল্পনীয় গভীরতার ক্ষেত্রে শেরে-খোদা হযরত আলীর দোয়ার বরকত আমরা গর্বের সাথে স্মরণ করি। (খতীব বাগদাদী রচিত তারীখে বাগদাদ।)

অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায়, ইমাম ইবু হানীফার পিতামহ নোমান (যুতী) ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারনে পরিবার-পরিজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি তখন জন্মভূমি ত্যাগ করে ইসলামী খেলাফতের তদানিন্তন বাজধানী কুফায় চলে আসেন। এখানেই তিনি ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে স্হায়ী বসতি স্হাপন করেন। (ইমামে-আজমর, শিবলি নোমানী)।

নোমান (যুতী) হযরত আলীর রা. খেদমতে হাজিরা দিতেন। হযরত আলীর রা. সান্নিধ্যেই তাঁর দীনি শিক্ষা এবং আমলের প্রশিক্ষন লাভ করার সুযোগ ঘটেছিলো।

জন্মস্হান কুফাঃ

ইমাম আবু হানীফার জন্মভূমি কুফার তখন গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাগত শতাব্দির প্রখ্যাত হাদিস তত্ববিদ আল্লাম কাউসারী ‘ নসবুর-রায়া ‘ নামক গ্রন্হে লিখেছেন- দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা. কর্তৃক হিজরী ১৭ সনে কূফা নগরের ভিত্তি স্হাপন করা হয়। প্রধানতঃ মুজাহেদীনের একটি ছাউনী শহর রূপে প্রতিষ্ঠিত কূফায় বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবঅং বহু সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। এই শহরে বসতি স্হাপনকারী মুসলমানদের মধ্যে দীনি এলেম প্রচার এবং ফতোয়া প্রদান করার গুরু দায়িত্বে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে রা. সরকারিভাবে নিয়োগ দান করা হয়। হযরত ওমর রা. কূফবাসীগণের প্রতি প্রেরীত এক ফরমানে উল্লেখ করেছিলেন যে আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তির এখানেই (রাজধানীর মদিনায়) বিশেয় প্রয়োজন ছিল। তা সত্বেও তোমাদে প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে তাঁকে কূফায় পাঠানো হলো। বলাবাহুল্য যে, খলীফার এই ফরমানের দ্বারাই বোঝা যায় যে, আবদুল।লাহ ইবনে মসউদ রা. কত প্রাজ্ঞ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন একজন সাহাবী ছিলেন। ইবনে মাসউদ রা. তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমানের রা. খেলাফত আমলের শেষ সময় পর্যন্ত জনগণের মধ্যে কুরআন, হাদিস এবং ফেকাহর তালীম দিতে থাকেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই কূফায় অন্যুন চার হাজার বিশিষ্ট মুহাদ্দেসম মুফাছছেরও ফকীহর সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত আলী রা. যখন রাজধানী যখন রাজধানী স্হানান্তর করে কূফায় আসেন, তখন এখানকার জ্ঞান চর্চার পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কাঁর মন্তব্য ছিল- আল্লাহ পাক ইবনে মাসউদের রা. কল্যাণ করুন। তিনি এই শহরকে এলেমের নগরীতে পরিণত করে দিয়েছেন।

এমন আরো প্রাজ্ঞ সাহাবী কূফায় বসতি স্হাপন করেছিলেন যাঁদের অবদানে এ উম্মতের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেযোগ্য ছিলেন হযরত সয়ীদ ইবনে জুবায়ের রা.। কুফার কোন লোক যদি তফসীর শাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা প্রাজ্ঞ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের নিকট কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করতে যেত, তখন তিনি বলতেন, তোমাদের শহরে সাঈদ আবনে জুবায়ের রা. এর ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তি থাকার পরও এখানে তুমি মাসআলা জিজ্ঞেস করতে এলে কেন?

এই কুফা শহরেই সর্বাপেক্ষা প্রজ্ঞাবান তাবেয়ী ইমাম শা’বী বসবাস করতেন। মা’বী সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের রা. মন্তব্য ছিল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় সবকটি যুদ্ধেই আমি শরীক ছিলাম। কিন্তু ইমাম শা’বী যুদ্ধগুলোর পুংখানুপুংকরূপে বর্ণনার ক্ষেত্রে যে নিপুনতার পরিচয় দেন, আমার ন্যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষেও সম্ভবতঃ সেরূপ নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।

কূফায় বসবাসকারী আর একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন ইবরাহীম নখয়ী রহ.। ইনি সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. এবং উম্মত-জননী হযরত আয়েশার রা. নিকট থেকেও হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লাম ইবনে আবদুল বার এর মন্তব্য হচ্ছে- ইবরাহীম নখয়ী তাঁর যুগের সকল আলেমের চাইতে উত্তম ছিলেন । হিপরী ৯৫ সনে ইবরাহীম নখয়ীর ইন্তেকালের পর আবু ইমরান তাঁর শষ্যদের সামনে এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে, তোমারা আজ এই যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফেকাহবিদকে সমাহিত করলে।

তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ইনি কি হাসান বসরী রহ. এর চাইতেও বড় আলেম ছিলেন? জবাব দিলেন নিঃসন্দেহে তিনি বসরা ‘কূফা’ শাম ও হেজাযের সকল আলেমের মধ্যে সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

কূফায় যে পনেরো শ সাহাবী বসতি স্হাপন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সত্তরজন ছিলেন বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী।

হযরত আলকামা রহ. ন্যায় জ্ঞানসাধক তাবেয়ীও কূফাতেই বসবাস করতেন। আল্লামা রমহরমুযী রহ. ক্বাবুসের এ মর্মের একটি বর্ণনা উদ্ধুত করেছেন যে – আমি আমর পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আপনি আলক্বামার নিকট মাসআলা- মাসায়েল জিজ্ঞেস করতে যান। তিনি তো হযরত ইবনে মাসউদের সাগরেদ। জবাবে তিনি বললেন- বৎস! আমি তাঁর নিকট হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনেক সাহাবীগণকেও বিভিন্ন মাসাআলা-মাসায়েল জানার উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতে দেথেছি।

প্রখ্যাত বিচারক কাজী শুরাইহ- এর কর্মস্হলও ছিলো কুফানগরী। হযরত আলী রা. বলতেন, শুরাইহ আরবের সর্বাপেক্ষা বিচক্ষন বিচারক। এ ছাড়াও এমন আরও ৩৩জন তাবেয়ী আলেমের কর্মস্হল ছিল এইকূফায় যাঁরা সাহাবয়ে কেরামের জমানাতেই ফতওয়া দানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এসব প্রাজ্ঞ সাহবী এবং তবেয়ীগণের নিকট যারা এলেম শিক্ষা করেছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল অগনিত। অত্যাচারী শাসনকর্তা হজ্জায আবনে ইউসুফের বিরুদ্ধে কূফার উপকন্ঠ ‘দাইরে- জামাজেম’ এ আবদুর রহমান ইবনে আশআস যখন যুদ্ধ ঘোষনা করেন, তখন তার সাথে কুরআন-হাদিস বিশেষজ্ঞ আলেমের সংখ্যাই ছিল চার হাজার। রামহরমুযীন ইমাম ইবনে সিরীনের পুত্র আনাসের বানী বর্ণনা করেন যে, আমি যখন কুফায় উপনীত হই তখন এই শহরে চার হাজার হাদীস বিশেষজ্ঞ এবং চারশতও বেশি ফেকাহবিদ আলেম বাস করতেন।

ইমাম বুখারী রহ. এবং ইমাম আহমদ রহ. ইবনে হাম্বলের উস্তাদ আফফান ইবনে মুসলিম বলেন- আমি কুফায় চার মাস অবস্হান করেছি। তখন সেখানে হাদিসের এমন ব্যাপক চর্চা ছিল যে, ইচ্ছা করলে আমি অন্যুন এক লক্ষ হাদিস লিপিবদ্ধ করতে পারতাম। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ করার পর আর আমি অগ্রসর হইনি। এই পঞ্চাশ হাজার হাদিস এই শহরের সকল শ্রেণীর লোকজনের মধ্যে আলোচিত হতো। ইমাম বুখারী রহ. বলেন, হাদিস সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে আমি বারবার কুফা গিয়েছি। (ফতহুল বারী)

ইমাম তিরমিযী রহ. বহু স্হলে কূফাবাসীদের অভিমতের উল্লেখ করেছেন। এই কুফা নগরীতেই ইমাম আবু হানীফার রহ. জন্ম এবং এই শহরেই তিনি জ্ঞানার্জন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। ইমাম সাহেবের যুগে যেসব সাহাবী ওবং প্রজ্ঞ তবেয়ী জীবিত ছিলেন তিনিও তাদের সকলের নিকট থেকেই হাদিস সংগ্রহ ও আয়ত্ব করেছিলেন। অপরদিকে তাবেয়ীগণেরও অনেকেই আবু হানীফার নিকট থেকে হাদিস শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তাবেয়ী ছিলেন।

এই উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন সাহাবায়ে-কেরাম। সাহাবীদের পরবর্তী মর্তবা হচ্ছে তাবেয়ীগণের। সর্বসম্মতভাবে সাহাবীর সংজ্ঞা হলোঃ যাঁরা ঈমানের সাথে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন এবং ঈমান নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাবেয়ী হচ্ছেন, যাঁরা ঈমানের সাথে সাহবীগণের সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন। (নাখবাতুল-ফেকার)

সাহাবী এবং তবেয়ীগণের মর্যাদা নির্দেশ করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ঈমান আনার ব্যাপারে অগ্রবর্তিগণ, মুহাজের ও আনসারবৃন্দ এবং তাদের সৎকর্মের যারা অনুসরণ করেছেন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।

হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, অত্যন্ত সৌভাগ্রবান সেই সমস্ত লোক যারা আমার সাক্ষাত লাভ করেছে এবং আমার সাক্ষাত যারা পেয়েছে, তাদেরকে পেয়েছে।

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে- সর্বাপেক্ষা বরকতময় হচ্ছে আমার সময়কাল এবং তার পরবর্তী যুগ আর তার পরবর্তী যুগ।

ইমাম আবু হানীফার রহ. জন্ম ৮০ হিজরী সনে। সর্বাপেক্ষা বয়স্ক সাহাবী হযরত আবু তোফায়েল রা. ইন্তেকাল করেছেন ১১০ হিজরীতে। আবু হানীফার জন্মকাল থেকে নিয়ে একশত দশ হিজরী এই দীর্ঘ ত্রিশ বছর সময়কালের মধ্যে শতাধিক সাহাবী জীবিত ছিলেন। হাফেযুল হাদিস ইমাম মুযনীর রহ. বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন ৭২জন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। (মুজামুল মুসান্নেফীন)

হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. বলেন, তাবেয়ী হওয়ার জন্য সাহাবীগণের সাক্ষাত লাভই যথেষ্ট। কেননা, হাদীস শরীফে শুধুমাত্র দেখা’র কথা বলা হয়েছে। সে মতে যারা তাবেয়ী হওয়ার জন্য দীর্ঘ সাহচর্য এবং সাহাবীগণের নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করাকেও শর্ত নির্ধারণ করেন তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। (নুযহাতুননযর)

শায়খ আবুল হাসান হাফেজ ইবনে হাজারের উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন- আল্লামা এরাক্বীর অভিমত অনুযায়ী এটাই অধিকসংখ্যক আলেমের অভিমত এবং এটাই সর্বাধীক গ্রহণযোগ্য তথ্য। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য থেকে তাই প্রমাণিত হয়। সুতরাং হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. সন্দেহাতীত ভাবে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রমাণিত হল। কেননা, তিনি আনাস ইবনে মালেক রা. এবং অন্য আরো কয়েকজন সাহাবীকে দেখেছেন। যেসব লোক ইমাম আবু হানীফকে রহ. তাবেয়ীদের মর্যাদা দিতে চান না, এরা নির্বোধ এবং বিদ্বষপরায়ন। (প্রাগুক্ত)

হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. আরো লিখেছেন- ইমাম আবু হানীফা রহ. বহুসংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন। কেননা, তিনি ৮০ হিজরী সনে কুফায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেসময় সেই শহরে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. জীবিত ছিলেন। তাঁর ইন্তেকাল ৮০ হিজরীর অনেক পরে হয়েছে। তেমনি বসরাতে আনাস ইবনে মালেক রা. ছিলেন। তাঁর ইন্তেকাল হিজরী নব্বই সনে পরে হয়েছে। সে মতে ইমাম আবু হানীফা রহ. নিঃসন্দেহে তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। (তানসীকুন-নেজাম)

বুখারী শরীফের ব্যাখাগ্রন্হে ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. উপরোক্ত সিদ্ধান্তটি আলেমগণের সর্বসম্মত অভিমত বলে উল্লেখ করেছেন। হাফেজ যাহাবী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেককে রা. অনেকবার দেখেছেন। (খাইরাতুল-হেসান)

আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী রহ. মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গন্হে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. অন্যুন আটজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন।

এঁরা হচ্ছেন-

১) হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. (ওফাত ৯৩ হিজরী)

২) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. (ওফাত ৮৭ হিজরী)

৩) সহল ইবনে সাআদ রা. (ওফাত ৮৮ হিজরী)

৪) আবু তোফায়ল রা. (ওফাত ১১০ হিজরী)

৫) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়দী রা. (ওফাত ৯৯ হিজরী)

৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. (ওফাত ৯৪ হিজরী)

৭) ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)

ইবনে সাআদ লিখেছেন- সার্বিক বিচারেই ইমাম আবু হানীফা রহ. একজন তাবেয়ী ছিলেন। তাঁর সতীর্থ ফেকাহর ইমামগণের মধ্যে আর কারো এই মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য হয় নাই। (তানসীক্ব)

আল্লামা খাওয়ারেজমী রহ. বলেন- ওলামাগণের এ বিষয়ে ঐক্যমত রয়েছে যে, ইমাম আবু হানীফা রহ. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের পবিত্র মুখ থেকে হাদিস শ্রবণ করে তা বর্ণনা করেছেন। তবে এরূপ হাদিসের সংখ্যা কত ছিল, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। (তানসীক্ব)

ইমাম আবু হানীফা রহ. কর্তৃক সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা কারো মতে ছয়, কারো মতে সাত এবং কারো মতে আটখানা। যেসব সাহাবী থেকে ইমাম সাহেব হাদিস বর্ণনা করেছিলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে – আনাস ইবনে মালেক রা., আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা., সহল আবনে সাআদ রা., আবু তোফয়ল রা., আমের ইবনে ওয়াছেলা রা., ওয়াছেলা ইবনে আশক্বা রা., মা’কাল ইবনে ইয়াসার রা., এবং জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. প্রমুখগণ।

হাদিস শাস্ত্রের ‘ আমিরুল মুমেনীন’ রূপে খ্যাত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক স্বরচিত কবিতার এক পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, নোমান ( আবু হানীফা ) এর পক্ষে গর্ব করার মতো এতটুকুই যথেষ্ট যা তিনি সরাসরি সাহাবীগণের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আবু হানীফা রহ. স্বয়ং একটি বর্ণনায় বলেন, আমার জন্ম হিজরী ৮০ সনে এবং ৯৬ সনে প্রথম হজে যাই। তখন আমার বয়স ষোল বছর। মসজিদুল-হারামে প্রবেশ করে দেখলাম, একটি বড় হালকায় বহু লোক সমবেত হয়ে রয়েছেন। আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের জমায়েত? তিনি বললেন, এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনুল হারেছের রা. পাঠদানের হালকা। এ কথা শুনে আমি সেদিকে অগ্রসর হলাম। তাঁকে বলতে শুনলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দীন সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করে, তার সকল প্রয়োজনের জিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হয়ে যান এবঙ তাকে এমন সব উৎস থেকে রিজিক পৌছাতে থাকেন, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। (মুসনাদে ইমাম আযম)

উল্লেখ্য যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেছের রা. ইন্তেকাল হয়েছে ৯৯ হিজরীতে। তখন ইমাম সাহেবের বয়স হয়েছিলো ১৯ বছর।

‘এলামুল-আখবার’ নামক গ্রন্হে বর্ণিত অন্য একখানা হাদিস ইমাম আবু হানীফা রহ. সরাসরি সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেকের রা. নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিসে বলা হয়েছে যে, এলেম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ।

একই সুত্রে হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে ইমাম আবু হানীফা রহ. কর্তৃক বর্ণিত অন্য আর একখানা হাদিস হচ্ছে- পাখীরা আল্লাহর উপর যতটুকু ভরসা করে জীবন ধারন করে কোন বান্দা যদি ততটুকু ভরসা করতে শেখে তবে আল্লাহ পাক তাকেও অনুরূপ রিজিক দান করবেন। পাখীরা সকাল বেলায় খালি পেটে বের হয়ে যায়, সন্ধায় পেট ভরে বাসায় ফিরে আসে।

ইমাম সাহেব আর একখানা হাদিস সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদিস খানা হচ্ছে- যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ পাক তার জন্য বেহেশতে গৃহ নির্মাণ করবেন।

শেষোক্ত হাদিসখানাকে ইমাম জালালুদ্দিন সিয়ুতী রহ. মোতাওয়াতের হাদিস রূপে অভিহিত করেছেন।

মোল্লা আলী কারী রহ. বরেন, এই হাদিসটির অন্যুন পঞ্চাশটি সনদ আমি সংগ্রহ করেছি। তম্মধ্যে ইমাম আবু হানীফার রহ. মাধ্যমে বর্ণিত সনদিই সর্বোত্তম।

ইমাম সাহেবের শিক্ষা জীবনঃ

সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্হিতি ইমাম আবু হানীফা রহ. যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন আলমে আসলামের খেলাফতের মনসদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান। ইরাকের শাসন কর্তৃত্ব ছিল হাজ্জান ইবনে ইউসুফের হাতে। সাহাবী এবং যুগশ্রষ্ঠ জ্ঞানীগুনিগণের শহর কুফা ছিল তার রাজধানী। হাজ্জাজকে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে জালেম প্রশাসকরূপে আখ্যায়িত করা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীসহ অগণিত সংখ্যক জ্ঞানী গুনীকে তার জুলুম অত্যাচরের কবলে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলতেন, পূর্ববর্তী উম্মতগণের সকল জালেমকে এক পাল্লায় এবং আমাদের হাজ্জাজকে যদি আর এক পাল্লায় তোলা হয় তবে নিঃসন্দেহে হাজ্জাজের জুলুমের পাল্লা অনেক ভারি হবে।

ইবরাহীম নখয়ীর রহ. ন্যায় সাধক ব্যক্তি হাজ্জাজের মৃত্যুসংবাদ শুনে সেজদায় পড়ে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে আল্লাহর শুকুর আদায় করেছিলেন। জুলুম-অত্যাচরের বিভীষিকাময় পরিস্হিতিতে আলেম-সাধক এবং দীনদার শ্রেণীর লোকেরা অনেকটা নিষ্ক্রীয়তা এবং নির্জনবাস বেছে নিয়েছিলেন। যারাই একটু সাহসের সাথে অগ্রসর হয়েছেন, তাদের কেউ এই জালেমের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাননি।

খলীফা আবদুল মালেকের ইন্তেকাল হয় হিজরী ৮৬ সনে। দুর্দন্তপ্রতাপ এই খলিফার শাসনামলে ইসলামী খেলাফতের সীমান্ত পূর্বে কাবুল-কান্দাহার এবং সিন্ধু-পান্জাব পর্যন্ত এবং পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু এলমে-দীনের বড় বড় কেন্দ্রগুলি ছিল স্তব্ধ। আলেমগণ নিজেদের নির্জন হুজরায় বরে দীনি এলেমের চর্চা নামেমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সত্য, কিন্তু বৃহত্তর জনগণের মধ্যে এলেমের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

হিজরী ৯৫ সনে হাজ্জাজ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। পরবর্তী বছর আব্দুল মালেকের পুত্র ওলীদেরও মৃত্যু হয়। ওলীদের মৃত্যুর পর সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। ইতিহাসবিদগণের বিবেচনায় সুলায়মান ছিলেন উমাইয়া বংশীয় খলীফাদণের মধ্যে অন্যতম সেরা সৎ শাসক। হিজরী প্রথম শতাব্দির মুজাদ্দেদ রূপে পরিচিত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. নিযুক্ত হন তার প্রধান উপদেস্টারূপে। মত্র পৌনে তিন বৎসর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার পর যখন তার ইন্তেকাল হয়, তখন খলিফার অসিয়্যত অনুযায়ী ওমর ইবনে আবদুল আজীজ পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হন। (হিজরী ৯৯ সন)

ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. স্বয়ং একজন সাধক প্রকৃতির আলেম ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও যত্নে সে যুগের বিশিষ্ট আলেমগণ হাদিস, তফসীর ও ফেকাহশাস্ত্রের চর্চায় ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম বুখারী লিখেছেন, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. আবু বকর ইবনে হাদম এর বরাবরে লিখিত এক পত্রে এ মর্মে আদেশ প্রদান করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস সুমূহ যত্নের সাথে সংগ্রহ ও তা লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্হা কর। আমার আশঙ্কা হয় (বিরাজমান অবস্হায়) এলেম চর্চা এবং আলেমগণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে না যায়! (সহীহ আল বুখারী)

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী বহ. বলেন ওমর ইবনে আবদুল আজীজ উপরোক্ত মর্মের আদেশনামাটি সে যুগের সব বিশিষ্ট আলেমের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হিজরী ১০০ সন থেকে হাদিস সংকলনের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়। তা না হলে আজ আমাদের নিকট হাদিসের যে বিরাট ভান্ডার মজুদ আছে, তা হয়ত থাকতো না। (ওমদাতুল-ক্বারী, ১ম খন্ড)

ওলীদের যখন মৃত্যু হয় (হিজরী ৯৬) তখন আবু হানীফা রহ. ষোল বছরের তরুণ। এ পর্যন্ত তাঁর লেখাপড়া পারিবারিক পরিবেশেই সীমিত ছিল। সে বছরই পিতার সাথে হজ্বে গমন করে মসজিদুল-হারামের দরছের হালকায় বসে আল্লাহর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীর জবানী হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমে এলমে-হাদিসের সাথে তাঁর সরাসরি পরিচিতি ঘটে। প্রথম যৌবনের সীমিত কিছুদিন ছাড়া ইমাম আবু হানীফার জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্তটি ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে কন্টকিত। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতেই উমাইয়া শাসনের পতন এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের উত্থান ঘটে। আব্বাসীয়দের দাবী ছিল খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন ব্যবস্হা পূনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শাসন ক্ষমতায় আহলে-বাইতের প্রাধান্য স্হাপন। যে কারণে সমসাময়িক বিশিষ্ট আলেম ওলামাগণের পাশাপাশি ইমাম আবু হানীফাও রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটানোর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শরীক হয়েছিলেন।

সেই বিস্ফোরণমূথী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই ইমাম আবু হনীফা কুরআন-সুন্নাহ এবং সাহাবীগণের জীবনপদ্ধতি মন্হন করে এলমে-ফেকাহ বা বিধান শাস্ত্র রচনা করে গেছেন। সর্বকালের মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞান সম্মত বিধিবিধান সম্বলিত এগরো লক্ষাধীক মাসআলা সংকলিত করে গেছেন তিনি। তাঁর সংকলিত মৌলিক মাসআলা-মাসায়েলের সুত্রগুলির মধ্যে এমন একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সমর্থনে কুরআন, হাদিস বা সাহাবীগণের আছার এর সমর্থন নাই। এর দ্বারাই অনুমিত হয় যে, তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটুকু বিস্তৃত ছিল।

ইমাম আবু হানীফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় প্রষ্ঠপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। তাঁর অন্যতম বিশিষ্ট সাগরেদ ইমাম মুহম্মদকে তিনি বাল্যকাল থেকেই লালন-পালন করে প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত শিখরে পৌছে দিয়েছিলেন। তাঁর অর্থ সাহায্যে লালিত এবং জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন শাখায় সুপ্রতিষ্ঠিত মনীষীবর্গের তালিকা অনেক দীর্ঘ।

কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ওবাং বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শা’বীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শা’বী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি! তুমি কোথায় যাওয়া-আসা কর?

ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শা’বী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে?

আবু হানীফা রহ. সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়।

কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শা’বী আবু হানীফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম সাহেব বলেন, ইমাম শা’বীর সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। (মুয়াফেক, আবু জোহরা)

এ সময় আবু হানীফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর কাল ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন। ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়, তখন আবু হানীফার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ইমাম সাহেবের শিক্ষা জীবনঃ(বাকী অংশ)

আবু হানীফা নিজমুখে বর্ণনা করেন, কিছুদিন এদিকে সেদিক কিছু লেখাপড় শিক্ষা করার পর একবার আমি বসরায় যাই। সেখানকার জ্ঞানীগুনীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পর বুঝতে পারলাম যে, কুল-কিনারাহীন জ্ঞান সাগরের অনেক কিছুই আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তারপরই আমি মনে মনে সংকল্প গ্রহণ করি যে, যতদিন বেঁচে থাকব, ইমাম হাম্মাদের সাহচর্য ত্যাগ করব না এবং এরপর দীর্ঘ আঠারো বছর তাঁর সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য থেকে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হই। (আবু জোহরা)

৯৬ হিজরীতে সুলায়মান ইবনে আবদুল মালেক খেলাফতের দায়িত্বগ্রহণ করার পর যখন দীনি এলেম চর্চার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই ইমাম আবু হানীফা নিয়মিত এলেম চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তখনকার দিনে কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি এলমে কালাম বা আকায়েদ শাস্ত্র নামের আর একটি বিষয় দীনি এলেমের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাহাবায়ে-কেরামের জামানা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা ও গুনাবলী (যাত ও সিফাত), পবিত্র কুরআনের আয়াত ইত্যাদিতে কোন প্রকার দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। ইহুদি তাত্ত্বিক আবদুল্লাহ ইবনে সাবার দৌরাত্ম, হযরত আলীর রা. এবং হযরত মোয়াবিয়ার রা. মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ, প্রাচীন ইরানী সভ্যতার সাথে ইসলামের সংমিশ্রণ প্রভৃতি কারণে মোতাযেলী, খারেজী, শিয়া প্রভৃতি বিভ্রান্তিকর মতবাদের সৃষ্টি হয়। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর চেতনায় এমন একটি স্হায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় নানা প্রকার বিভ্রান্তিকর মতবাদ অনুকূল পরিবেশ লাভ করে। ইমাম আবু হানীফার শিক্ষা জীবনের সূচানায় বিভিন্নমুখী মতবাদের মোকানেলায় এলমে-কালাম বা আকায়েদ শাস্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইয়হইয়্যা ইবনে শাইবানের বক্তব্য অনুযায়ী ইমাম আবু হানীফা রহ. তাঁর এলমেকালাম চর্চায় ইতিহাস সম্পর্কে বলেন, আমি বেশ বিছুকাল এলমে কালাম চর্চায় নিয়োজিত থাকি। বিভিন্ন জটিল বিষয়ে বিতর্কে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি বহুবার বসরা সফর করি। কেননা, তখনকার বসরা ছিল বিভিন্নমুখী দর্শনিক আলোচনার পীঠস্হান। এ উদ্দেশ্যে কোন কোন সময় মাসের পর মাস আমাকে বসরায় অবস্হান করতে হয়। (আবু জোহরা)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অনুমিত হয় যে, ৯৬ হিজরী থেকে শুরু করে ১০২ হিজরীতে ইমাম হাম্মাদের শিক্ষায়তনে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত অনুমান সাত বছর কাল ইমাম আবু হানীফা রহ. একান্তভাবে এলমে-কালামের চর্চায় ও অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

আকায়েদ সম্পর্কিত দার্মনিক আলোচনার ক্ষেত্রে ত্যাগ করে এলমে ফেকাহর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন, একদিন আমি দোকানে বসা ছিলাম। জনৈকা স্ত্রীলোক এসে তালাক সম্পর্কিত একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে তাকে অনতিদূরে অবস্হিত ইমাম হাম্মাদের দরসগাহে যেতে বললাম। আর বিশেষভাবে বলেদিলাম যে, ইমাম সাহেব তোমার এ সমস্যার কি সমাধান দেয় আমাকেও তা বলে যেও।

ইমাম সাহেব বলেন, সেদিন থেকেই আমার অন্তরে এলমে-ফেকাহ শিক্ষা করার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।

ইমাম হাম্মাদ এবং তাঁর শিক্ষায়তনঃ

হাম্মদ ইবনে আবূ সুলায়মান ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে একজন বিজ্ঞ আলেম। কুফার এক সম্ভ্রান্ত বিত্তবান পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তখনকার যুগে এলমে-ফেকাহর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দি ব্যক্তিত্ব। সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেকের রা. নিকট হাদিস শিক্ষা এবং তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর উস্তাদ ছিলেন প্রাজ্ঞ তাবেয়ী ইবরাহীম নখয়ী রহ.

আবুল শায়খ তারীখে ইসপাহান গ্রন্হে উল্লেখ করেছেন যে, হাম্মাদ আল্যকাল থেকেই ছিলেন সুফী প্রকৃতির। ইবরাহীম নখয়ীর রহ. সাহচর্যে তাঁর আল্লাহপ্রদত্ত মেধা এবং আধ্যাত্মিক সুষমা জূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছিল।

বাল্যকালের একটি ঘটনা। একদিন ইবরাহীম নখয়ী হাম্মাদকে গোশত আনার জন্য বাজারে পাঠালেন। জথে হাম্মাদের পিতা আবু সুলায়মান দেখতে পেলেন, তার জুত্র হাতে একটি থৈ নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। বালকপুত্রের বেশবাস এবং হাতে থলি দেখে ‘রঈস’ পিতার আত্মমর্যাদা বোধ আহত হলো। তিনি পুত্রের হাত থেকে থলিটা নিয়ে দূরে ফেলে দলেন্ কিন্তু হাম্মাদ সরই থলি কুড়িয়ে নিয়েই দ্রুত উস্তাদের বাড়ীতে চলৈ গেলেন। ইবরাহীম নখয়ী রহ. ইন্তেকালের পর যখন হাদিস শিক্ষার্থীগণ দলে দলে হাম্মাদের বাড়ীতে এসে সমবেত হতে লাগলেন, তখন একদিন আবু সুলায়মান হাম্মাদকে লক্ষ্য করে বলেছলেন, বৎস! ইবরাহীম নখয়ী রহ. সেই জীর্ণ থলেটির তধ্যে যে কত বড় মর্যাদা ও বরকত লুক্কায়িত ছিল, তা এতকাল পর আমার বুঝে এসেছে। (তরজুমানুস-সুন্নাহ)

ইবরাহীম নখয়ী রহ. ইন্তেকালের পর হাম্মাদ তাঁর স্বতন্ত্র শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। কূফায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অসহনীয় দৌরাত্ম উপেক্ষা করেই তিনি তাঁর শিক্ষাদান কার্য অব্যাহত রেখেছিলেন। এলেমের গভীরত, অসাধারণ জনপ্রিয়তা এবং পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে শাসন কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁর জক্ষে স্বীয় সাধনায় অবিচল থাকে সম্ভবপর হয়েছিল। তাঁর যুগে কূফার সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম ছিলেন হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান। তাঁর অনুপম উদারতা ও চরিত্র মাধুর্য্য সম্পর্কিত বহু কাহিনী রূপকথার ন্যায় বিভিন্ন গ্রন্হে ছড়িয়ে আছে। কথিত আছে, একবার পথিমধ্যে তাঁর অশ্বের ছিন্ন জিনটি মেরামত করার বিনিময়ে গরীব চর্মকারের হাতে তিনি আশরাফীর একটি থলি তুলে দিয়েছিলেন। রমযান মাসে তিনি অন্যুন পঞ্চাশজন দীনদার ব্যক্তি রাখতেন। তাদের সাথে ইফতার করতেন। খানা খেতেন। রমযান শেয়ে প্রত্যেককেই আশাতীত পারিতোষিক দিয়ে বিদায় করতেন। শিক্ষার্থীগণের প্রতি তাঁর স্নেহ-মমতা ও উদারতা ছিল সীমাহীন। শিক্ষাদান কার্য্যে অতুলনীয় নিষ্ঠা এবং শিক্ষার্থীগণের প্রতি পিতৃসুলভ মমত্ববোধের ফলেই তার শিক্ষায়তন থেকে ইমাম আবু হানীফার রহ. ন্যায় সর্বকালের সেরা জ্ঞানতাপসের সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল। ইরাক, বিশেষতঃ কূফাবাসীগণের মহান উস্তাদ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের রা. একজন বিশিস্ট উত্তরসুরী রূপে বিবেচিত হতেন হাম্মান ইবনে আবু সুলায়মান।

হিজরী প্রথম দুইশতাব্দি কালের মধ্যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন ছিল না। এক একজন বিশিষ্ট আলেমকে কেন্দ্র করে এক একটি দরছের হালকা বা শিক্ষাদান কেন্দ্র গড়ে উঠতো। শিক্ষার্থীগণ নিজেদের উদ্যোগ সমবেত হতেন এবং বিশেষ একটি বা দু’টি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। শিক্ষার্থীগণ তা গভীর মনোযোগ সহকারে এলেম বিস্তৃত ও সংরক্ষিত হতো।

ইমাম হাম্মাদের শিক্ষায়তনেও পাঠদানের ক্ষেত্রে এই সনাতন পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। তবে শিক্ষার্থীদের বসবার ক্ষেত্রে শ্রেণী বিন্যাসের কড়াকড়িভাবে অনুসরণ করা হতো। মেধাবী এবং পুরাতন শিক্ষার্থীদেরকে প্রথমসারিতে বসতে দেওয়া হতো। আবু হানীফা রহ. যে দিন দরসে শরীক হন, তার পরদিন থেকেই তাঁকে প্রথম কাতারে স্হান করে দেওয়া হয়।

আবু হানীফা নোমান ইবনে ছাবেত যেমন ছিলেন একজন বিরল প্রতিভাধর শিক্ষার্থী তেমনি তাঁর উস্তাদ হাম্মাদ ইবনে আবু সুলায়মান ও ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ শিক্ষক। একনিষ্ঠ এই সাগরেদের জ্ঞানঅন্বেষায় মুগ্ধ হয়ে একদা তিনি আবেগপ্লুত কন্ঠে বলেছিলেন, তুমি আমার ভান্ডার একেবারে শুন্য করে নিলে হে আবু হানিফা! উল্লেখ্য যে, সত্যনিষ্ঠ সঠিক অনুধাবন শক্তির প্রতি ইঙ্গিত করেই মহান উস্তাদ তাঁর এই প্রিয় সাগরেদকে “আবু হানিফা” নামে সম্বোধন করেছিলেন। কালে উস্তাদের সেই স্নেহের সম্বোধনই কালজয়ী মহান ইমামের বরকতময় নামের প্রধান অংশে পরিণত হয়ে যায়! (আল-মুয়াফফেক)

ইমাম হাম্মাদের শিক্ষায়তনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে আবু হানীফা বলেন-বেশ কিছুকাল তর্কাসভায় সময় অতিবাহিত করার পর এক সময় আমার মনে এরূপ একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য যে এলেমের অংশবিশেষও কি আমি আয়ত্ব করতে পেরেছি?

সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী তাবেয়ীগণের অগ্রনী জামাত যে এলেমের অনুশীলন করতেন, তাতে কি তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোন অবকাশ ছিল? আমার বিবেকই বলল, না, তাঁরা এলেম চর্চা করতেন আমলে সুষ্ঠতা আনয়নের লক্ষ্যে। তাঁদের এলেম ছিল একান্তই জীবনবাদী। এরূপ একটা বোধদয়ের আলোকেই আমি এলমে-কালামের চর্চা ত্যাগ করে ফেকাহ পাঠ গ্রহণ করি। (আল-মুয়াফফেক)

আবু হানীফার রহঃ নিষ্ঠা এবং একাগ্রতায় মুগ্ধ ছিলেন ইমাম হাম্মাদ রঃ। উস্তাদের প্রতি এমন অসাধারণ ভক্তি ছিল আবু হানীফার রঃ যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কখনও তিনি উস্তাদের বাড়ীর দিকে পা মেলে শয়ন করেন নি। এতদসত্ত্বেয় জ্ঞানের বিয়য় আলোচনার ক্ষেত্রে মোটেও নমনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করতেন না।

একদা উস্তাদ-সাগরেদ মিলে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে পানি ফুরিয়ে গেলে ইমাম হাম্মাদ তায়াম্মুম করে আসরের নামায পড়ে ফেললেন। কিন্তু আবু হানীফা উস্তাদের সাথে নামায পড়লেন না। বললেন, যতক্ষন পানি পাওয়ার আশা থাকে, ততক্ষন অপেক্ষা করতে হবে এবং ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করে নামায পড়া বৈধ হবে। পরে হাম্মাদ রঃ প্রিয় সাগরেদের এই এজতেহাদ মেনে নিয়েছিলেন। (আল বেনায়া)

ইমাম আবু হানীফার শিক্ষা-জীবনের অনুরূপ আরও বহু ঘটনাই বিভিন্ন কিতাবে ছড়িয়ে আছে, যদ্বারা তাঁর অসাধারণ ধীশক্তি এবং শরীয়তের সূক্ষ্ম বিষয়াদি অনুধাবনের অনন্য যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইমাম যুফার রহঃ বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানীফা রঃ বলেছিলেন, এক সময় আমার মনে এমন একটা চিন্তার উদয় হয়েছিল যে, উস্তদের নিকট থেকে বিদায় গ্রহণ করে নিজস্ব একটি শিক্ষায়তন গড়ে তুললে কেমন হয়! ঘটনাক্রমে এ সময় একজন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে ইমাম হাম্মাদ রঃ বসরায় চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি আমাকে তাঁর স্হলাভিষিক্ত করে গেলেন। নানা করণেতা৭র প্রত্যাবর্তন মাস তিনেক বিলম্বিত হয়। তাঁর অনুপস্হিতিতে আমি বিভিন্ন লোকের যে সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলৈন, সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। ফিরে আসার পর উস্তাদের সামনে সুগলো পেশ করলে আমার বেশ কয়েকটি ভুল হয়েছে বলে তিনি চিহ্নিত করলেন। এই ঘটনায় আমি মনে মনে শিউরে উঠলাম। সংকল্প গ্রহণ করলাম যে, যতদিন ইমাম হাম্মাদ জীবিত থাকবেন, ততদিন আর তাঁর হালকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা চিন্তাও করবোনা।

জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে কঠোর সাধনার দীর্ঘ আঠারো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর হিজরী ১২০ সনে ইমাম হাম্মাদের রঃ ইন্তেকাল হয়। অতঃপর আবু হানীফাকেই উস্তাদের শিক্ষাকেন্দ্রটি সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। মৃত্যুর আগে ইমাম হাম্মাদ আবু হানীফাকে রঃ আনুষ্ঠানিক ভাবেই তাঁর স্হলাভিষিক্ত মনোনীত করে যান। এভাবেই নো’মান ইবনে ছাবেত উস্তাদের দেওয়া নাম এবং স্হলাভিষিক্ত হওয়ার দায়িত্ব লাভ করে আহলে ছুন্নাতুল জামাতের মর্যাদাবান ইমামরূপে বরিত হন।

অন্যান্য উস্তাদগণঃ

আবু হানীফা রঃ ছিলেন সর্বকালেন সেরা মজতাহেদ ফিকাহবিদ ইমাম। বিশেষজ্ঞ শ্রেণীর কোন আলেমকে মুজতাদেদের স্তরে পৌছাতে হলে হাদীসের হাফেজ, তফসীর শাস্ত্রের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ এবং সাহাবীগণের জীবন ধারা সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জ্ঞান থাকা অপরিহর্য হয়ে যায়। হযরত আবু হানীফাকে মজতাহেদ ইমামের স্তরে পৌছার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলিতে সর্বাধিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিলো। ফেকাহশাস্ত্র তথা কুরআন-মহাসাগর মন্হন করে মাসআলা-মাসায়েল নির্ধারণ করার প্রশিক্ষণ তিনি ইমাম হাম্মাদের নিকট থেকেই আয়ত্ব করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর এলমে-ফেকাহর আর একজন বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন আহলে বাইতের উজ্জলতম নক্ষত্র যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দেস ও ফকীহ ইমাম জাফর সাদেক রঃ।

ইমাম আবু হানীফার মন্তব্য হচ্ছে, যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফকীহ ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক রঃ। তার চাইতে অধিক ধীসম্পন্ন কোন ফকীহর সাক্ষাত অন্য কোথাও পাইনি। (আল-মওয়াফেক)

হাদিস এবং তফসীর শাস্ত্র আয়ত্ব করার উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানীফা সে যুগের যে সব সেরা মুহাদ্দেসগণের শরনাপন্ন হয়েছিলেন, তাদের সংখ্যা হাফেজ জাহাবীর মতে ২৯০ জন। এঁদের মধ্যে এমন পন্ঞাশ ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় যাদের বর্ণনা বুখারী-মুসলিম সহ সেহাহ-সেত্তার সকল কিতাবেই বিশেষ যত্নের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। (ইমামে আজম, আবু হানীফাহ রহঃ)

একই কারণে যেমন মোয়াত্তা ইমাম মালেক গ্রন্হটি প্রথম দিকে সংকলিত সর্বাধিক শুদ্ধ কিতাব রূপে গন্য করা হয, তেমনি হাদিস শাস্ত্রের প্রথম সংকলন গ্রন্হ “মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা” নামক হাদিস সংকলনটি বিশুদ্ধতার দিক থেকে যে সর্বাগ্রগন্য তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।

ইমাম সাহেবের হলকায়ে দরছ ও ফতওয়াঃ

দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাঃ কর্তৃক কূফা নগরীর গোড়াপত্তন করার পর পরই কূফা তথা সমগ্র ইরাকবাসীগণের জন্য এলমে-নববী শিক্ষা দান এবং ফতোয়া প্রদানের নিয়োজিত হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একান্ত সহচর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ দীর্ঘকাল কূফায় অবস্হান ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দ্বিনী এলেম চর্চার একটা বিশেষ ধারা গড়ে উঠেছিলো। প্রকৃত প্রস্তাবে এলমে-ফেকাহর গোড়াপত্তনকারীও ছিলেনহযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ। ইবরাহীম নখয়ীর রঃ মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর প্রবর্তিত এলেমের সেই বিশেষ ধারার উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন ইমাম হাম্মাদ রঃ। তার হাতেই ইবনে মাসউদের রাঃ দ্বারা বপনকৃত ফেকাহ নামের চারাগাছটি একটি পরিপূর্ণ বৃক্ষের আকার ধারণ করে। ইমাম হাম্মাদের রঃ প্রতিষ্ঠিত দরসগাহের পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করার পর ইমাম আবু হানীফা রঃ তার অচিন্ত্যনীয় মেধা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সে বৃক্ষটি ফলে ফুলে সমৃদ্দ করে তুলেন। ইমাম আবু হানীফা রঃ এর মাধ্যমেই হযরত মসউদের রাঃ এলম ও প্রজ্ঞার মীরাছ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ইমাম হাম্মাদের তিরোধানের পর কূফঅর জ্ঞানী সামাজ যে শুন্যতা অনুভব করছিলেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ইমাম আবু হানীফা রঃ তা পূরণ করে দিতে সমর্থ হয়েছিলে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম যুফার, আসাদ ইবনে ওমর, কাসেম ইবনে মাআল প্রমুখ সেরা আলেমগণও এ হালকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার পর ইমাম আবু হানীফা রঃ পরিচালিত শিক্ষায়তনটিই কূফা তথা সমগ্র ইরাকের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়।

একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন এবং সেরা স্বপ্নতত্ববিদের ব্যাখ্যাঃ

এ সময়ে ইমাম আবু হানীফা রঃ একটি অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। দেখলেন, যেন তিনি প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর শরীফ খনন করে কিছু হাড়-কংকাল সংগ্রহ করছেন। স্বপ্নটি দেখার পর কিছু দিন তিনি ছিলেন মানসিক ভাবে খুবই উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নদ্রষ্টার পরিচয় গোপন রেখে তিনি স্বপ্নের বিবরণ তাবীর শাস্ত্রের ইমাম মুহম্মদ ইবনে সিরীনের রঃ খেদমতে পেশ করেন। ইবনে সিরীন রঃ এই স্বপ্নটিকে একটি মোবারক স্বপ্ন রূপে আখ্যায়িত করে বলেন, স্বপ্নদ্রষ্টা যুগের ইমাম এবং প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এলমের উত্তরাধিকার পুনজ্জীবিত করবেন। (আল-মোয়াফেক)

ইমাম মুহম্মদ ইবনে সিরীন রঃ কর্তৃক প্রদত্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা ইমাম আবু হানীফার জীবন-সাধনার মধ্য দিয়ে কেমন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিলো তা বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কুরআন-হাদিসের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের মাধ্যমে ইমাম আবু হানীফা রঃ ইসলামী বিধানশাস্ত্র তথা শরীয়তের আদেশ-নিষেধ এমন চমৎকার ভাবে বিশ্লেষন করে দিয়েছেন, যা পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বাপেক্ষা নিরাপদ এবং সর্বাধিক সংখ্যক লোকের অনুসৃত বিধান শাস্ত্রের স্হান দখল করতে সমর্থ হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রঃ সময়কাল থেকে শুরু করে হিজরী একাদশ শতাব্দীর সমাপ্তিকাল অর্থাৎ হাজার বছরেরও আধিককাল পর্যন্ত সমড়্র আলমে-ইমলামের কোর্ট-কাচারী, লেন-দেন, বিবাহ-তালাক এবং সকল আনুষ্ঠানিক এবাদত-বন্দেগীতে আবু হানীফার ফেকাহই ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে। কারণ একমাত্র ইমাম আবু হানীফা রঃ ছাড়া অন্যকোন ইমাম বা মনীষীই জীবনের সকল চাহিদা পূরণ উপযোগী বিস্তারিত বিধান উম্মতের সামনে পেশ করতে সক্ষম হননি। একারনেই যারা ইমাম আবু হানীফার মাযহাব মেনে নিতে অস্বীকার করেন, তারাও বিচার-পদ্ধতি পরিচালনায় বা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের বহু ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার রঃ মাযহাব মেনে নিতে বাধ্য হন।

হাদীস ও ফেকাহঃ

হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ, প্রভৃতি নির্ণয়ের মানদন্ড হচ্ছে কুরআনের আয়াত এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস। কোন আয়াতের কি মর্ম, কোন হাদীসখানার দ্বারা কোন হুকুম নির্ধারিত হলো এসব তাৎপর্য উদঘাটনের নামই ফেকাহ। মুহাদ্দিছ বা হাদীস তত্ববিদের কাজ হচ্ছে হাদীস রূপে বর্ণিত বাক্যটির শুদ্ধাশুদ্ধ নির্ণয়। হাদীসখানার মর্মার্থ কি এবং এর দ্বারা কোন কোন হুকুম প্রমাণিত হচ্ছে, তা খুজে বের করার সাধনায় যাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন তাদেরকেই ফেকাহবিদ নাবে অভিহীত করা হয়েছে।

ওবায়দুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণনা করেন, আমরা কয়েকজন বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দেছ হযরত আ’মাশের রঃ দরবারে বসা ছিলাম। এক ব্যক্তি এসে মাসআলা জিজ্ঞেস করলো। আ’মাশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর জবাব দিলেন- মাসআলাটির জবাব আমার জানা নাই। আবু হানীফাও রঃ সেই মজলিসে বসা ছিলেন। তাঁর প্রতি লক্ষ্য করে আমাষ বললেন, আবু হানিফা! তোমার জানা থাকলে সমাধানটি বলে দাও। আবু হানীফা রঃ জিজ্ঞাসিত বিষয়টির একটি চমৎকার জবাব দিয়ে দিলেন। জবাবটি আমাশের খুব পছন্দ হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জবাবটি তুমি কোন হাদীসের ভিত্তিতে দিলে? আবু হানীফা বললেন, আপনার কাছ থেকে শিক্ষা করা অমুক হাদীসের ভিত্তিতে। শুনে আ’মাশ মন্তব্য করলেন, আমরা (মুহাদ্দেসরা) হচ্ছি যারা ঔষধি দ্রব্য নিয়ে নাড়াচাড় করে তাদের ন্যায় (আত্তার বিশেষ)। আর তোমরা হলে ঐ ঔষধ তৈরি করে এবং রোগ নির্ণয় করে রোগীকে তা সেবন করতে দেয়।

অনুরূপ আর একটি মাসআলা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী-লোকের পক্ষে তার সহগামী হওয়া হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। আবু দাউদ শরীফে এ মর্মে বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু কূফার এ সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারের একটি কিশোর মারা গেলে শোকে তার মা অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মৃতদেহ জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় শোকে কাতর মাতাও সঙ্গে রওয়ানা হলেন। হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁকে হাজার বারণ করার পরও তিনি মানলেন না। বরং এক পর্যায়ে জেদের বশবর্তী হয়ে তিনি কছম খেয়ে বসলেন যে, তিনি পুত্রের জানাযা পড়বেনই। অপর দিকে ছেলের পিতা স্ত্রীর এই অন্যায় জেদ দেখে বলে বসলেন যে, এখান থেকে ফিরে না গেলে তুমি তালাক হয়ে যাবে। ফলে মৃতদেহ নিয়ে সেখানেই সকলে থেমে গেলেন। বিষয়টা কিভাবে মিমাংসা করা যায়, এ নিয়ে সকলেই ভাবলেন, কিন্তু কোন সমাধান খুজে পাওয়া গেল না। নিরূপায় হয়ে ইমাম আবু হানীফাকে ডাকা হলো। তিনি এসে ছেলের মাকে বললেন, আপনি এখানে দাড়িয়েই ছেলের জানাযা পড়ুন এবং ফিরে যান। কেননা, হাদীস শরীফে স্ত্রীলোকের জন্য মৃতের অনুগমন করতে নিষেধ করা হয়েছে। জানাযা পড়তে নিয়েধ করা হয়নি। এখানে জানাযা পড়ে নিলে আপনার কসম পুরা হয়ে যাবে। আর এখান থেকে ফিরে গেলে আপনার স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত তালাকও কার্যকর হবেনা।

উক্ত স্ত্রীলোক ইমাম সাহেবের সমাধান মেনে নিলেন এবং সেখানেই (একা একা) জানাযা আদায় করে বাড়ী ফিরে গেলেন। জানাযার সাথে কুফার বিশিষ্ট আলিমগণের অনেকেই উপস্হিত ছিলেন। সমস্যাটি নিয়ে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ইমাম আবু হানীফার এই তাৎক্ষনিক সমাধান শুনে হাদীস তত্ববিদ ইবনে শাবরা রঃ মন্তব্য করেছিলেন, সম্ভবত কোন মাতাই আবু হানীফা রঃ এর ন্যায় মেধা সম্পন্ন সন্তান প্রসব করতে সক্ষম হবেননা।

প্রকৃত প্রস্তাবে হাদিসের মর্মার্থ উদ্ধার করে তার আলোকে উদ্ভৃত সমস্যার সমাধান বের করার নামই তো ফেকাহ। ফেকাহবিদগণকে হাদিসের মতন (মুলপাঠ) যেমন জানতে হয়ে, তেমনি এর অন্তর্নিহীত অর্থ সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হয়। ইমাম তিরমিযীর রঃ মন্তব্য হচ্ছে, হাদিসের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে ফেকাহবিদগণই সর্বাধিক অবগত হয়ে থাকেন।

হিজরী চতুর্থ শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দেস ইমাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে ইসহাক রঃ তাঁর রচিত ‘মাআনিউল-আখরার’ নামক গ্রন্হে লিখেছেন, শরীয়ত বিশেষজ্ঞ কেবলমাত্র ফেকাহবিদগণকেই বলা চলে। অন্যান্য এলেম বিশেষ একটি বিষয় কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। যেমন তফসীরবিদগণ শুধুমাত্র পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। মুহাদ্দেসগণের চর্চা প্রধাণতঃ হাদিসের শব্দ, সনদ ও মতনের মধ্যেই আবর্তিত হয়। কিন্তু একজন ফেকাহবিদ অত্যাবশ্যকীয়ভাবেই হাদিস-তফসীরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি আরো অনেকগুলি জাগতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। সম্ভবতঃএ কারণেই কুরআন এবং হাদিসের প্রকৃত মর্ম অনুধাবনের জন্য ফেকাহ আয়ত্ব করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতিঃ

যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রঃ অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করা। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)

ইমাম ইবনে হাযম রঃ বলেন, আবু হানীফার রঃ সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হবে। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার রঃ মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রঃ বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রঃ হারামাইন শরীফে কাশফ যুগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আমাকে অবগত করেছেনযে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার রঃ সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামন্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)

সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা রঃ বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্হান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।



শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ

সে জামানার দরসের হালকা বা শিক্ষাঙ্গনের চিত্র ছিল, উস্তাদ কোন একটি উচ্চ আসনে বসে তকরীর করতেন। ছাত্রগণ চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে নিতান্ত নিবিষ্টতার সাথে তকরীর শ্রবণ করতেন। অনেকেই তকরীর শুনে তা আয়ত্ব করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এসব তকরীর উস্তাদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে যিনি তকরীর করতেন তাঁর নামেই সেগুলো গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হতো। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দির সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফার রঃ শিক্ষাদান কার্যক্রমেও সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। কোন কোন মাসআলায় তর্ক শুরু হয়ে যেত। সে তর্ক কয়েকদিন পর্যন্তও চলতো। শেষ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যা সাব্যস্ত হতো সেটাই লিপিবদ্ধ হতো। কোন কোন মাসআলায় উস্তাদ ও সাগরেতের মধ্যকার মতভেদ অমীমাংসিতই থেকে যেত। সেই মত পার্থক্যগুলিও স্ব স্ব যুক্তি সহকারেই কিতাব লিপিবদ্ধ করা হতো। এভাবেই হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্হগুলি সংকলিত হয়েছে।

ইমাম সাহেবের দরছগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্হানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনেরা সমবেত হতেন। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন।

কর্মদিবস গুলিতে তিনি এশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। জোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। ফতোয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিল। তবে অবস্হা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো।

দরসের মজলিসে শিক্ষার্থীগণের সাথে অনেক সাধারণ লোকও শরীক হতেন। তর্কচ্ছলে অনেকে আপত্তিকর মন্তব্যও করত। কিন্তু কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে পরম ধৈর্যের সাথে জবাব দিতেন। চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের মোকাবেলাতেও তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না। প্রায সময়ই তিনি একটা কবিতাংশ আবৃত্তি করতেন। যা অর্থ ছিলো- ইয়া আল্লাহ ! যাদের অন্তর আমাদের দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আছে, আমাদের অন্তর তাদের প্রতি প্রশস্ত করে দাও। (আবু যোহরা)

শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ

দরসের মজলিসে তিনি এমনই নিবিষ্টচিত্ত হয়ে পড়তেন যে, অনেক সময় পারিপর্শ্বিকতার জ্ঞান লোপ পেত। একবার তকরীর করার সময় ঘরের ছাদ থেকে একটা সাপ তার কোলের উপর পতিত হ। তিনি শুধু কাপড় ঝাড়া দিয়ে সাপটি দুরে ফেলে দিলেন। একটা বাক্যও উচ্চারণ করলেন না বা এ ঘটনা তাঁর নিবিষ্টতায় মাসান্যতম ব্যাঘাতও সৃষ্টি করতে পারল না।

প্রতিটি তকরীরের শেষে তিনি বলতেন, এটি আমার অভিমত। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, তা আমি বললাম। কেউ যদি আমার চাইতেও মজবুত দলীল ও যুক্তির অবতারনা করতে পারেন, তবে তাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। (আবু যোহরা)

কোন একটি বিষয় আলোচনার সময় একবার একজন ছাত্র বলেছিলেন, আপনার এই অভিমতটি খুবই চমৎকার। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে, এক পর্যায়ে এটি ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)

ইমাম আবু ইউসুফ রঃ তাঁর সব আলোচনারই লিপিবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতেন। ইমাম সাহেব বলতেন, আমার তকরীর শুনে তা অনুধাবন করতে বেশি যত্নবান হও। এমনও হতে পারে যে, আজকের এই কথাগুলি পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হবে। (আবু যোহরা)

যারা বিরূপ মন্তব্য করতো, তাদের সম্পর্কে ইমাম সাহেবের মন্তব্য ছিল- যদি কেউ আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে, যা আমার মধ্যে নাই, তবে সে ভুল বলছে। আর আলেমদের কিছু না কিছু দোষ চর্চা তো তাদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।

ইমাম সাহেব প্রথম যখন শিক্ষা দান শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র ইমাম হাম্মাদের সাগরেদগণই তাতে শরীক হতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাতে কূফার সর্বস্তরের মানুষ, বিশিষ্ট জ্ঞানীগুনী, এমনকি ইমাম সাহেবের উস্তাদগণেরও কেউ কেউ এসে শরীক হতেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসআব ইবনে কোদাম, ইমাম আমাশ প্রমুখ নিজে আসতেন এবং অন্যদেরকেও দরসে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন। একমাত্র স্পেন ব্যতীত তখনকার মুসলিম-বিশ্বের এমন কোন অঞ্চল ছিল না, যেখানকার শিক্ষার্থীগণ ইমাম আবু হানীফ রঃ এর দরসে সমবেত হননি। মক্কা-মদীনা, দামেস্ক, ওয়াসেত, মুসেল, জায়িরা, নসীবাইন, রামলা, মিসর, ফিলিস্তিন, ইয়ামান, ইয়ানামা, আহওয়ায, উস্তুর আবাদ, জুরজান, নিশাপুর, সমরকন্দ, বুখারা, কাবুল-হেমস প্রভৃতিসহ বিখ্যাত এমন কোন জনপদ ছিল না যেখান থেকে শিক্ষার্থীগণ এসে ইমাম আবু হানীফা রঃ এর নিকট শিক্ষা লাভ করেননি।

মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রঃ ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।

ইসলামের প্রাথমিক কয়েকটি শতাব্দি ব্যাপী জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণের সর্বাপেক্ষা বড় কেন্দ্র ছিল মক্কা ও মদীনার হারামাইন শরীফাইন। পবিত্র দুই মসজীদে নিয়মিত হাদিস, তফসীর, কেরাআত ও ফেকাহ-ফাতাওয়ার দরছ হতো। দুনিয়ার সমস্ত অঞ্চল থেকেই জ্ঞান পিপাসুগণ মক্কা-মদীনায় সমবেত হতেন। হজের মওসুমে এলেম চর্চার হালকাগুলি সর্বাপেক্ষা বেশি সক্রিয় হযে উঠতো। সাধারণতঃ রমযানের আগেই দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে হজের কাফেলা মক্কা-মদীনায় পৌছে যেত। দুর-দুরান্তের পথ অতিক্রম করে আলেমগণ আসতেন তাদের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করার মানসে। হারামাইন শরীফে জগৎ বিখ্যাত আলেমগণের দরসের হালকা বসত। প্রতিটি হালকায় আলেমগণ সমবেত হয়ে তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে নিতেন। ইমাম আবু হানীফা রঃ জীবনের প্রথম সফরে (৯৬ হিজরী) মক্কার হরম শরীফে সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল হারেছ রাঃ এর সাথে সাক্ষাত করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এবং তাঁর পবিত্র যবান থেকে হাদিস শ্রবণ করার মাধ্যমেই এলমে-হাদিসের প্রতি তাঁর আগ্রহের সুত্রপাত হয়। তাঁর শুত প্রথম হাদিসখানা ছিল- যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনের বিশেষ জ্ঞান এলমে ফেকাহ আয়ত্ব করতে সমর্থ হয়, তার সকল চিন্তা ভাবনার দায়িত্ব আল্লাহ পাক স্বয়ং গ্রহণ করেন এবং তাকে এমন স্হান থেকে রিজিক পৌছান, যা তার ধারণায়ও আসে না। (জামে রযানুল এলেম)

এরপর ইমাম সাহেব আরও ৫৪ হজ করেন। তাঁর জীবনের সর্বমোট ৫৫ট হজের লক্ষ্য ছিল প্রধানত পবিত্র এই মহা সমাবেশ দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের আলেম-সাধক এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণের সাথে মতবিনিময় এবং এর মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করা।

হজের সফরে ইমাম সাহেব শুধু যে, জ্ঞান আহরণ করতেন তাই নয়, জ্ঞান বিতরণও করতেন। তাঁর অসাধারণ জ্ঞানগরিমার খ্যাতি পূর্ব-পশ্চিমের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো্ ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী-গুনিগণ তাঁর সাক্ষাত লাভের জন্য আগ্রহী হয়ে থাকতেন।

শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ

হাফেজ শামসুদ্দীন যাহাবী রঃ লিখেছেন- ইমাম লাইছ ইবনে সাআদ রঃ বলেন, আমি ইমাম আজম আবু হানীফা রঃ সুখ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। ফলে তাঁর সাথে সাক্ষাতের আকাঙ্খা খুবই প্রবল ছিল। সৌভাগ্যক্রমে মক্কা মোয়াজ্জমায় আমার সে আকাঙ্খা পূর্ণ হয়। একদিন দেখতে পেলাম, অগণিত লোক এক ব্যক্তিকে ঘিরে রয়েছে। এদের মধ্যে এক ব্যক্তি বেশ উচ্চৈস্বরে বলছিল- ইয়া আবু হানীফা রঃ। শুনে মনে মনে বললাম, ভীড়ের ভিতরে উপবিষ্ট এই ব্যক্তিই আমার দীর্ঘ আকাঙ্খার ধন ইমাম আবু হানীফা। (মানাকেবে আবু হানীফা, যাহাবী)

ইমাম লাইছ ইবনে সাআদ রঃ এর এ সাক্ষাতকারটি ছিল নিতান্তই আকষ্মিক। এরপর একবার ইমাম লাইছ ইমাম আবু হানীফা রঃ সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই সফর করেন। এ সম্পর্কে ফেকাহতত্ত্ববিদ আবদুর রহমান ইবনুল কাছেম রঃ বর্ণনা করেন, আমি ইমাম লাইছ ইবনে সাআদের মুখে শুনেছি, তিনি বলতেন, একবার আমি জানতে পারলাম যে, এ বছর ইমাম আবু হানীফা রঃ হজের উদ্দেশ্যে আসছেন। আমি শুধুমাত্র ইমাম আবু হানীফার রঃ সাথে সাক্ষাত করার লক্ষ্য নিয়েই এ বছর হজের সফরে যাই। মক্কার তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়। আমি তাঁর নিকট থেকে অনেকগুলি জটিল বিষয়ের মিমাংসা বিশেষতঃ কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা বা ভুলক্রমে হত্যার শাস্তি সম্পর্কিত মাসআলারও মীমাংসা অবগত হই। (সদরুল=আয়েম্মা ২য় খন্ড)

বিভিন্ন জটিল বিষয় অবগত হওয়ার লক্ষ্যে শুধুমাত্র ইমাম লাইস ইবনে সাআদ নয়, তাঁর ন্যায় আরো অগণিত জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি সর্বক্ষণ ইমাম আবু হানীফা রঃ কে ঘিরে থাকতেন। ইতিপূর্বে ইমাম লাইছ ইবনে সাআদের যবানীই তা জানা গেছে।

ইমাম আবু আসেম রঃ বর্ণনা করেন- আমরা মক্কায় ইমাম আজম আবু হানীফা রঃ সাহচর্য্যে থাকতাম। সব সময় তাঁর নিকট হাদিস এবং ফেকাহ বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ভীড় লেগে থাকতো। কোন কোন সময় এই ভীড় সহ্য সীমার বাইরে চলে যেত। কোন কোন সময় এই ভীড় সহ্য সীমার বাইরে চলে যেত। অনেক সময় ইমাম সাহেব লোকজনের জটলা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করতেন। (এলাউস সুনান, ভূমিকা অংশ)

হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেন, ইমাম আবু হানীফা রঃ নিকট যারা সমবেত হতেন, তারা ছিলেন, সে যুগের শীর্ষ স্হানীয় হাদিস বিশেষজ্ঞ এবং ফেকাহর ইমাম। (সদরুল আইম্মাহ)

প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফফাহর পূর্ণ শাসন আমল (১৩২-১৩৬ হি) চারবছর নয় মাস কাল ইমাম আবু হানীফা রঃ মক্কা শরীফে স্বেচ্ছনির্বাসনে কাটান। কারণ, বনী-উমাইয়ার শাসন কর্তৃত্বের পতন ঘটানোর আন্দোলনে ইমাম আবু হানীফা রঃ প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব উমাইয়্যা বংশের পতনের পর আব্বাসিয়দের শাসন-ব্যবস্হা চাইতেন না। তাঁর মতানুসারী সে যুগের ওলামা-মাশায়েখ গণ খোলাফায়ে-রাশেদীনের শাসন-ব্যবস্হার পুনঃ প্রতিষ্ঠা চাইতেন। কিন্তু আব্বাসীয়দের প্রথম শাসক আবু আব্বাস অকল্পনীয় নির্মমতার আশ্রয় গ্রহণ ওলামা-মাশায়েখগণ এবং ধর্মপ্রাণ জনগনের সে আকাঙ্খা নস্যাত করে দেয়। এই পরিস্হিতিতে ইমাম সাহেবের পক্ষে কূফায় অবস্হান মোটেও নিরাপদ ছিল না। শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ইমাম সাহেব তখন মক্কা শরীফ চলে যান এবং আবুল আব্বাসের মৃত্যুকালে (যিলহজ্জ ১৩৬) পর্যন্ত মক্কাশরীফেই অবস্হান করেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কার পবিত্র মসজিদে ইমাম আবু হানীফা রঃ নিয়মিত দরছ দিতেন। হাফেজ যাহাবীর রঃ বর্ণনা অনুযায়ী তখনকার দিনে ইমাম সাহেবের দরছে যেমন হাদিসের ছাত্রগণ দলে দলে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলেমগণও বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতেন।





মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.