নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফাহীম সিদ্দীকী

ফাহীম সিদ্দীকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

তারাবী বিশ রাকাত পড়া সুন্নত

১১ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:৪৯

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মধ্যে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তারাবী পড়েছেন। কত রাকাত পড়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে হযরত উমর রা. এর খেলাফতের দ্বিতীয় বছর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ রাকাত তারাবী পড়া হয়ে আসছে। এ দীর্ঘ সময় কোথাও আট রাকাত পড়ার প্রচলন ছিলনা।

আমরা যাদেরকে লা-মাযহাবী বলি এরা ইংরেজ আমলে সৃষ্ট। প্রথম প্রথম এদের অনেকেই বিশ রাকাত তারাবী পড় গেছেন। সর্বপ্রথম ১২৮৪ হিজরী সালে ভারতের আকবরাবাদ থেকে এদের একজন আট রাকাত তারাবীর ফতোয়া দেন। তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই ফতোয়া টিকতে পারেনি। এরপর ১২৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী নামে এদের আরেক জন ফতোয়া দেন যে, আট রাকাত তারাবী পড়া সুন্নত। বিশ রাকাত পড়া বেদাত। তার ফতোয়ারও তীব্র বিরোধিতা হয়। এমনকি তাদেরই একজন বিখ্যাত আলেম মাওলানা গোলাম রাসূল ঐ ফতোয়ার খন্ডনে ‘রিসালা তারাবী’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ১২৯০ সালে সেটি প্রকাশিত হয়। (দ্র.রাসায়েলে আহলে হাদীস, ২খ, ২৮ পৃ)। কিন্তু এতেও আটের ফতোয়া বন্ধ হয়নি। পরবর্তীতে হাফেজ আব্দুল্লাহ সাহেব ও মাওলানা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী সহ এদের আরো কিছু আলেম জোড়ালোভাবে ঐ ফতোয়া প্রচার করতে থাকেন। আলেমদের পক্ষ থেকে মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী র. মাওলানা কাসেম নানুতুবী র. ও পরবর্তীতে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী র. প্রমুখ স্বতন্ত্র পুস্তিকা লেখে তাদের ফতোয়া খন্ডন করেন।

ভারতবর্ষের পরে আরবেও দু’একজন আটের ফতোয়া দিতে শুরু করেন। হারামাইন শরীফাইন তথা বাইতুল্লাহ শরীফ ও মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবী অব্যাহত থাকলেও সর্বপ্রথম সেখানে শায়খ নসীব রেফায়ী একটি পুস্তিকা লিখে আট রাকাতের ফতোয়াকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানীও তার সমর্থন করেন। এর খন্ডনে আরব জাহানের কয়েকজন আলেম কলম ধরেন। একাধিক আলেমের রচনার সমষ্টি الإصابة في الانتصار للخلفاء الراشدين والصحابة নামে প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁরা লিখেছেন,

ولم يشذ أحد منهم بمنعها غير هذه الشرذمة القليلة التي ظهرت في زماننا كالشيخ ناصر وإخوانه

অর্থাৎ আমাদের যুগে আত্মপ্রকাশকারী নাসিরুদ্দীন আলবানী ও তার সমর্থকদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া কেউই অনুরূপ ফতোয়া দিয়ে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেননি। (দ্র, পৃ, ৬১)

এ পুস্তিকাটির খন্ডনে আলবানী সাহেব ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করে ১৩৭৭ হি. সালে প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটিতে আলবানী সাহেবের উসূলে হাদীস (হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি), উসূলে ফিক্হ (ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি), রিজাল শাস্ত্র (হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনীমূলক গ্রন্থ) ও জারাহ-তাদীল (বর্ণনাকারীদের সমালোচনা) সম্পর্কিত মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের অপরিপক্কতা ও দৈন্যতা সুস্পষ্ট রূপে ফুটে উঠেছে। তদুপরি তিনি সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণের কোন একজনকেও দেখাতে পারেননি, যিনি আট রাকাত তারাবীর কথা বলেছেন। এমনিভাবে এমন কোন ঐতিহাসিক মসজিদের নজিরও দেখাতে পারেননি যেখানে আট রাকাত তারাবী হতো।

এতদ্সত্তেও আমাদের লা-মাযহাবী বন্ধুরা আলবানী সাহেবের গবেষণাকেই চুড়ান্ত জ্ঞান করে তারই অন্ধ অনুসরণ শুরু করেছে। অধিকন্তু আলবানী সাহেব যা করতে পারেননি অর্থাৎ বর্ণনাকারীদের নাম বিকৃত করা, বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীকে অবিশ্বস্ত আখ্যা দেওয়া, ভুল উদ্ধৃতি দেওয়া ও কোন গ্রন্থের নাম ভুল উচ্চারণ করা ইত্যাদি কাজেরও লজ্জাস্কর নজির স্থাপন করেছেন তাদেরই অনুদিত বুখারী শরীফের টীকায়। কবিগুরু সুন্দর বলেছেন, বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।

আলবানী সাহেবের পুস্তিকাটির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সাবেক গবেষক মুহাদ্দিস শায়খ ইসমাঈল আনসারী। তার কিতাবটির নাম- ‘তাসহীহু হাদীসি সালাতিত তারাবী ইশরীনা রাকআতান ওয়ার রাদ্দু আলাল আলবানী ফী তাযয়ীফিহী’। একইভাবে সৌদি আরবের বিখ্যাত আলেম, মসজিদে নববীর প্রসিদ্ধ মুদাররিস ও মদীনা শরীফের সাবেক কাযী শায়খ আতিয়্যা সালিম ‘আততারাবীহ আকছারু মিন আলফি আম’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সৌদির আরেকজন খ্যাতনামা আলেম, বহুগ্রন্থ প্রনেতা শায়খ মুহাম্মদ আলী সাবূনী সাহেবও এ বিষয়ে ‘আততারাবী ইশরূনা রাকআতান’ নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। আর লা-মাযহাবী আলেম মোবারকপুরী সাহেবের খন্ডনে কলম ধরেছেন বিগত শতকের সেরা মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী র. - মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, সুনানে সাঈদ ইবনে মানসূর, মুসনাদে হুমায়দী সহ বহু হাদীসগ্রন্থ সম্পাদনাপূর্বক যিনি পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন এবং আরব বিশ্বের বড় বড় আলেম শায়খ মুসতাফা যারকা, শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ, নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ যার কাছ থেকে হাদীসের ইজাযত হাসিল করেছেন। ‘রাকআতে তারাবী’ নামে উর্দূ ভাষায় তিনি অত্যন্ত সারগর্ভ ও তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এটি সর্বপ্রথম ১৩৭৬ হিজরী সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমাদের ঐসব বন্ধুরা উল্লিখিত গ্রন্থগুলো পড়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করেননা।

যাহোক , ভূমিকা-স্বরূপ লেখা এ কথাগুলো দীর্ঘ হয়ে গেল। এখন আমি বিশ রাকাত তারাবীর প্রমাণগুলো উপস্থাপন করবো। এবং সবশেষে আট রাকাতের প্রমাণগুলো সম্পর্কেও কিছু পর্যালোচনা পেশ করবো। আমার নিজস্ব রুচি ভিন্ন থাকলেও এখানে তাদের অনুদিত বুখারী শরীফের টীকার ধারাবাহিকতা যথাসম্ভব রক্ষা করে আলোচনার প্রয়াস পাব।

১নং দলিল: ইবনে আবী শায়বা র. বলেন,

حدثنا يزيد بن هارون قال انا ابراهيم بن عثمان عن الحكم عن مقسم عن ابن عباس أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة والوتر .

অর্থ: আমাদের নিকট ইয়াযীদ ইবনে হারূন বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে ইবরাহীম ইবনে উসমান জানিয়েছেন হাকামের সূত্রে, তিনি মিকসামের সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে বিশ রাকাত তারাবী ও বিতর পড়তেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৭৪; তাবারানী , আল কাবীর, হাদীস নং ১২১০২; আল আওসাত, হাদীস নং ৭৯৮; বায়হাকী, ১/৪৯৬।

এ হাদীসটির সনদে আবূ শায়বা ইবরাহীম ইবনে উসমান আছেন, তিনি যয়ীফ বা দূর্বল। এ কারণে বায়হাকী র.সহ অনেকেই এই হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন। কিন্তু আলবানী সাহেব ও তার অনুসারী লা-মাযহাবী বন্ধুরা এটিকে ‘মাওযূ’ বা জাল আখ্যা দিয়েছেন। অথচ পূর্ববর্তী কোন মুহাদ্দিসই এটিকে জাল আখ্যায়িত করেননি। জাল ও যয়ীফের মাঝে দুস্তর ব্যবধান। জাল হাদীস তো হাদীসই নয়। আর যয়ীফ হাদীসকে প্রায় সকল মুহাদ্দিসই শর্ত সাপেক্ষে ফযিলতের ক্ষেত্রে, ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে ও রিকাক বা চিত্তবিগলনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন। আর আহকাম বা বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ যয়ীফকে দুভাগে ভাগ করেছেন। এক. এমন যয়ীফ হাদীস, যার সমর্থনে কোন শরয়ী দলিল নেই, বরং এর বক্তব্য শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। এ ধরণের যয়ীফ আমলযোগ্য নয়। দুই. সনদের বিবেচনায় হাদীসটি যয়ীফ বটে, তবে এর সমর্থনে শরয়ী দলিল প্রমাণ আছে, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ হাদীস অনুসারে আমল চলে আসছে। এমন যয়ীফ হাদীস শুধু আমলযোগ্যই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসের মানোত্তীর্ণ। ‘আল আজবিবাতুল ফাযিলা’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ র. এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।

হাফেজ ইবনুল কায়্যিম র. তার ‘কিতাবুর রূহ’ গ্রন্থে একটি যয়ীফ হাদীস সম্পর্কে বলেছেন,

فهذا الحديث وإن لم يثبت فاتصال العمل به في سائر الأمصار والأعصار من غير إنكار كاف في العمل به

অর্থাৎ এ হাদীসটি প্রমাণিত না হলেও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শহরে কোন রূপ আপত্তি ছাড়া এ অনুযায়ী আমল চালু থাকাই হাদীসটি আমলযোগ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। (দ্র, পৃ,১৬)

ইমাম যারকাশী র. তাঁর হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘আননুকাত’ এ বলেছেন,

إن الحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول عمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر

অর্থাৎ যয়ীফ হাদীসকে যখন উম্মাহ ব্যাপকভাবে গ্রহন করে নেয়, তখন সঠিক মতানুসারে সেই হাদীসটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তা মুতাওয়াতির হাদীসের মানে পৌঁছে যায়। (দ্র, ১খ, ৩৯০ পৃ)

হাফেজ শামসুদ্দীন আসসাখাবী র.ও তাঁর ‘ফাতহুল মুগীছ’ গ্রন্থে লিখেছেন,

وكذا إذا تلقت الأمه الضعيف بالقبول يعمل به على الصحيح حتى أنه ينزل منزلة المتواتر في أنه ينسخ المقطوع به ولهذا قال الشافعي رحمه الله في حديث لا وصية لوارث إنه لا يثبته أهل الحديث ولكن العامة تلقته بالقبول وعملوا به حتى جعلوه ناسخا لآية الوصية.

অর্থাৎ উম্মাহ যখন যয়ীফ হাদীসকে ব্যাপকহারে গ্রহন করে নেয়, তখন সহীহ মত অনুসারে সেটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তার দ্বারা অকাট্য বিধান রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে সেটি মুতাওয়াতির দলিলের মানোত্তীর্ণ হয়। এ কারণেই ইমাম শাফেয়ী র. ‘উত্তরাধিকারীর জন্যে কোন ওসিয়ত নেই’ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন, হাদীস বিশারদগণ এটিকে সুপ্রমাণিত মনে না করলেও ব্যাপকহারে আলেমগণ এটি গ্রহণ করে নিয়েছেন, এ অনুযায়ী আমল করেছেন, এমনকি তারা এটিকে ওসিয়ত সম্পর্কিত আয়াতটির বিধান রহিতকারী আখ্যা দিয়েছেন। (দ্র,১খ, ৩৩৩পৃ)

আমাদের আলোচ্য হাদীসটি এই দ্বিতীয় প্রকার যয়ীফের অন্তর্ভূক্ত। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মাহর ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন আমল এ অনুযায়ী চলে আসছে। সুতরাং উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে এটি অবশ্যই আমলযোগ্য বলে গণ্য হবে। এটিকে জাল আখ্যায়িত করা হাদীস শাস্ত্রের স্বীকৃত মূলনীতি উপেক্ষা করারই নামান্তর।১

১. আলবানী সাহেব তিনটি কারণে এই হাদীসকে জাল আখ্যায়িত করেছেন। এক, এটি হযরত আয়েশা রা. ও হযরত জাবের রা. বর্ণিত হাদীসের বিপরীত।

এর জবাবে আমরা বলবো, হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে, আর এটি তারাবী সম্পর্কে। সুতরাং দুটির মধ্যে কোন বিরোধ নেই । তাছাড়া হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসে এগারো রাকাতের উল্লেখ এসেছে। তার আরেকটি বর্ণনায় তেরো রাকাতের উল্লেখ এসেছে। এই দুটি বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে আলেমগণ বলেছেন,

এগারো রাকাত সাধারণ আমল ছিল। আর তের রাকাত মাঝে মধ্যে পড়তেন। একইভাবে বলা চলে, বিশ রাকাতও মাঝে-মধ্যে পড়া হয়েছিল। তের রাকাত যেমন এগারো রাকাতের বিপরীত নয়, তেমনি বিশ রাকাতও এগারো রাকাতের বিপরীত হবেনা। আর হযরত জাবের রা. বর্ণিত হাদীসটি যয়ীফ। সুতরাং তার বিপরীত হওয়াতে কিছু আসে যায়না । এ সম্পর্কে আলোচনা শেষ দিকে আসছে।

দুই, আবূ শায়বাকে হযরত শো’বা র. মিথ্যুক বলেছেন। আর বুখারী র. তার সম্পর্কে বলেছেন, سكتوا عنه- তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাকে বর্জন করেছেন। আর এটা বুখারী র. এর কড়া সমালোচনামূলক শব্দ।

উল্লেখ্য, লা-মাযহাবী বন্ধুরা ইমাম বুখারী র. এর কথাটির অনুবাদ করেছেন, ‘তার ব্যাপারে কেউ মত ব্যক্ত করেনি’। এটা ভুল অনুবাদ।

এই দ্বিতীয় কারণটির জবাবে আমরা বলবো, মুহাদ্দিসগণের মধ্যে একমাত্র শো’বা র.ই তাকে মিথ্যুক বলেছেন,

.......................................................................................................................................

এর কারণও তিনি এই বলে উল্লেখ করেছেন, আবূ শায়বা তার উস্তাদ হাকাম থেকে বর্ণনা করেছেন, সিফফীন যুদ্ধে সত্তর জন বদরী সাহাবী শরিক ছিলেন। শো’বা বলেন, সে মিথ্যা বলেছে। আমি হাকামের সঙ্গে আলোচনা করে শুধু একজন বদরী সাহাবী পেয়েছি। তিনি হলেন হযরত খুযায়মা রা.।

যাহাবী র. ‘মীযানুল ইতিদাল’ গ্রন্থে এটি উল্লেখ করে শো’বার কথাটি এই বলে খন্ডন করেছেন,

سبحان الله أما شهدها علي أما شهدها عمار

অর্থাৎ বড়ই আশ্চর্য! সিফফীনে কি হযরত আলী রা. শরিক ছিলেননা? হযরত আম্মার রা. শরিক ছিলেননা? (দ্র, ১খ, ৪৭পৃ)

অর্থাৎ হযরত আলী রা. ও হযরত আম্মার রা. তো বদরী ছিলেন, তারাও তো সিফফীনে শরিক ছিলেন। তাহলে তো এখানেই তিনজন হয়ে গেল। খুঁজলে হয়তো এভাবে আরো অনেকের নাম বের হয়ে আসবে। তাহলে শো’বা র. এর কথা ঠিক হলো কি করে?

তাছাড়া শো’বা র. বলেছেন, কাযাবা যার একটি অর্থ হলো, মিথ্যা বলেছে। এ অর্থ ধরেই বলা হয়, শো’বা তাকে মিথ্যুক বলেছেন। অথচ এ শব্দটির এ অর্থও হতে পারে- ভুল বলেছে। এ অর্থে কাযাবা শব্দটির ব্যবহারের বহু নজির তুলে ধরা হয়েছে ‘আন-নিহায়া ফী গারীবিল হাদীস’ গ্রন্থে। এ অর্থটি গ্রহণ করলে ‘শো’বা তাকে মিথ্যুক বলেছেন’ সেটা প্রমাণিত হয়না। আর ইমাম বুখারী র. এর মন্তব্য সম্পর্কে বলবো, এমন একাধিক নজির রয়েছে, যেখানে বুখারী র. ঐ মন্তব্য করা সত্ত্বেও সেই ব্যক্তির হাদীস গ্রহন করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াকিদ আবূ কাতাদার জীবনী দেখুন। বুখারী র. তার ব্যাপারে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ইমাম ইবনে আদী র. তার ‘আল কামিল’ গ্রন্থে তার সঙ্গে একমত হন নি। মুকাতিল ইবনে সুলায়মানের জীবনী দেখুন। বুখারী র. উক্ত মন্তব্য করা সত্ত্বেও ইবনে আদী র. বলেছেন, له أحاديث صالحة তাঁর কিছু ভাল হাদীসও রয়েছে। আমাদের আলোচ্য আবূ শায়বা সম্পর্কেও ইবনে আদী র. লিখেছেন, له أحاديث صالحة وهو خير من إبراهيم بن أبي حية

অর্থাৎ তার কিছু ভাল হাদীসও রয়েছে, তিনি ইবরাহীম ইবনে আবূ হাইয়্যার চেয়ে ভাল। (দ্র, তাহযযযীব, ১খ, ১৪৫পৃ)

মোট কথা, আলবানী সাহেব আবূ শায়বা সম্পর্কে পূর্ণ ইনসাফ অবলম্বন করেননি। অন্যথায় ইবনে আদীর উপরোক্ত মন্তব্যও উল্লেখ করতেন। উল্লেখ করতেন ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. এর মন্তব্যও । ইয়াযীদ ইবনে হারূন ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও খ্যাতনামা হাফেজে হাদীস, তিনি বুখারী র. এর উস্তাদের উস্তাদও ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছেন,

ما قضى على الناس رجل يعني في زمانه أعدل في قضاء منه

অর্থাৎ আমাদের যুগে তাঁর চেয়ে বড় ন্যায়পরায়ন কাজি (বিচারক) কেউ হন নি। উল্লেখ্য, আবূ শায়বা যখন ওয়াসিতের কাজি ছিলেন, তখন ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. তার প্রাইভেট সেক্রেটারী ছিলেন। সুতরাং তাকে কাছ থেকে যাচাই করার যেমন সুযোগ তার হয়েছিল তেমনটি অন্য কারো হয়নি। সুতরাং তার উক্ত মন্তব্য আবূ শায়বার ইলম ও ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে উজ্জল সাক্ষী। কোন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে দুটি বিষয় বিশেষ লক্ষ্যনীয়। এক, তার দীনদারী ও ন্যায়পরায়নতা; দুই, তার মেধা ও স্মৃতিশক্তি। ইয়াযীদ র. এর সাক্ষ্যপ্রমাণে তার ন্যায়পরায়নতার বিষয়টি সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আর ইবনে আদীর বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, তার মেধাও এত খারাপ ছিলনা। তার কিছু ভাল হাদীসও পাওয়া গেছে। স্মর্তব্য, আলোচ্য হাদীসটি ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. নিজেই আবূ শায়বা থেকে বর্ণনা করেছেন।

আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য আবূ শায়বাকে নির্ভরযোগ্য আখ্যা দেওয়া নয়। বরং আলবানী সাহেব যে তার প্রতি পুরোপুরি ইনসাফ প্রদর্শন করেননি তা তুলে ধরা। আবূ শায়বা যয়ীফ হলেও তার হাদীসকে জাল আখ্যা দেওয়া যেতে পারে এমন পর্যায়ের নন। তাইতো আলবানী সাহেবের পূর্বে কেউ তার এই হাদীসকে জাল বলেননি। বরং ইমাম বায়হাকী র. তারাবীর রাকাত সংখ্যার জন্যে যে অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন তার অধীনে আবূ শায়বার এ হাদীসটিও উল্লেখ করেছেন।

তিন, আলবানী সাহেব এও উল্লেখ করেছেন, আবূ শায়বার হাদীসে বলা হয়েছে, নবী স. রমযান মাসে জামাত ছাড়া নামায পড়েছেন। এটি হযরত জাবের রা. ও হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসের বিরোধী। (পরের পৃষ্ঠায় দেখুন)

২নং দলিল: ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা র. বর্ণনা করেন:

عن السائب بن يزيد قال: كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب في شهر رمضان بعشرين ركعة

অর্থ: হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেছেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম রমযান মাসে বিশ রাকাত পড়তেন। ( বায়হাকী , আসসুনানুল কুবরা ২/৪৯৬)

ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফার নীচে বায়হাকী পর্যন্ত এই হাদীসের দুটি সনদ আছে। একটি সনদ ইমাম বায়হাকী তার ‘আসসুনানুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অপর সনদটি তিনি উল্লেখ করেছেন তার ‘আল-মারিফা’ গ্রন্থে। প্রথম সনদে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন ইমাম নববী, ওয়ালিউদ্দীন ইরাকী, বদরুদ্দীন আয়নী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী ও আল্লামা নিমাভী হিন্দী র. প্রমুখ। আর দ্বিতীয় সনদে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন তাজুদ্দীন সুবকী ও মোল্লা আলী কারী প্রমুখ। তার মানে মূল হাদীসটি সাত জন বড় বড় মনীষীর দৃষ্টিতে সহীহ। (দ্র, নবীজীর নামায, পৃ ৪০৯, রাকাতে তারাবী, পৃ ৫৪)। মোবাকরকপুরী ও আলবানী সাহেবের পূর্বে কোন মনীষী এই হাদীসকে যয়ীফ বলেননি।

লা-মাযহাবী বন্ধুরা প্রথম সনদটির কথা উল্লেখই করেননি। দ্বিতীয় সনদটি এনে

..............................................................................................

তার মানে হযরত আয়েশা ও হযরত জাবির রা. এর হাদীসে জামাতের সঙ্গে নামায পড়ার কথা আছে, আর আবূ শায়বা বর্ণিত এ হাদীসে জামাত ছাড়া নামায পড়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাস, তাই এটি জাল। এমন কথা কোন আলেমের মুখে শোভা পায়না। প্রথমত, ইবনে আবী শায়বা, আবদ ইবনে হুমায়দ ও তাবারানীর কাবীর ও আওসাত গ্রন্থে এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে জামাত ছড়া কথাটি নেই। শুধু বায়হাকীর বর্ণনায় একথার উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যকথায়, ইয়াযীদ ইবনে হারূন ও আলী ইবনুল জাদ দুজনই আবূ শায়বা থেকে ঐ শব্দটি ছাড়া হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। শুধু মানসূর ইবনে আবূ মুযাহিম ঐ শব্দটির কথা উল্লেখ করেছেন। আর মানসূরের তুলনায় ঐ দুজন অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই তাদের বর্ণনাই প্রাধান্য লাভ করবে। দ্বিতীয়ত, যদি জামাত ছাড়া কথাটিকে সহীহ ধরেও নেওয়া হয়, তবে এটাকে ভিন্ন ঘটনা আখ্যা দিলে তো আর কোন বিরোধিতা থাকেনা। মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে দেখা যায়, তারা কয়েকজন এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তারাবীতে দাঁড়িয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে নামায সংক্ষিপ্ত করে ভেতরে চলে যান। (মুসলিম, ১১০৪)। এ ঘটনাটিও হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসের বিপরীত। তাই বলে কি এটিকেও জাল বলতে হবে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. তো বলেছেন,

والظاهر أن هذا في قصة أخرى

অর্থাৎ বাহ্যত এটা ভিন্ন কোন ঘটনা হয়ে থাকবে। (ফাতহুল বারী, ৩খ, ৮পৃ)

অধিকন্তু পূর্বেও বলেছি, হযরত জাবির রা. এর হাদীসটিও দুর্বল। আলবানী সাহেব এটি সম্পর্কে ধোঁকায় পড়েছেন। তাই বারবার আলোচ্য হাদীসকে হযরত জাবির রা. এর হাদীসের বিপরীত বলে এটিকে জাল আখ্যা দেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন। হযরত জাবির রা. এর হাদীসটি শেষ দিকে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

তারা যে মন্তব্য করেছেন তা এখানে উল্লেখ করছি। তারা বলেছেন, এই হাদীসটির সনদ যয়ীফ। হাদীসের সনদে ১.আবূ উসমান বাসরী রয়েছে, সে হাদীসের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত; ২. খালিদ ইবনে মুখাল্লাদ রয়েছে, সে যয়ীফ, তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত, তার কোন বর্ণনা দলিল হিসেবে গন্য নয়, তদুপরি সে ছিল শিয়া ও মিথ্যাবাদী (তাহযীব, ২য় খন্ড); ৩.ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা রয়েছে, তার সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত। (মিযানুল ই’তিদাল, তাহযীবুত তাহযীব, ২য় খন্ড)

কথাগুলো পড়ে আমি মাথায় হাত দিয়েছি। মনে মনে বলেছি, এদের কি আখেরাতের ভয়ও নাই? ভয় থাকলে তারা এমন ডাহা মিথ্যা কথা লিখল কিভাবে? এরা বর্ণনাকারীর নামও শুদ্ধ করে লিখতে পারেনা। মাখলাদকে তারা মুখাল্লাদ বানিয়েছে। আবুল হাসনা কে আবুল হাসানা লিখেছে। রুফাই কে রাফে নামে উল্লেখ করেছে। এক পৃষ্ঠায় তিনটি ভুল। এত বড় বড় ডিগ্রীধারী সম্পাদকরা এমন ভুল করবেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা।

খালিদ ইবনে মাখলাদ ও ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা দুজনই বুখারী ও মুসলিম শরীফের রাবী । তাদের সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত হলে বুখারী ও মুসলিম শরীফে তাদের বর্ণিত হাদীসগুলোর কি দশা হবে? ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম কি মিথ্যুকের হাদীসও গ্রহণ করেছেন? হায়, হায়!!

বন্ধুগণ! এভাবে লাগামহীন ও অসত্য কথা বলে হাদীস অস্বীকারকারী জঙ্গীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেননা, এই অনুরোধ রাখছি আপনাদের কাছে।

পাঠক, সত্যি বলছি, যে কিতাব দুটির উদ্ধৃতি তারা দিয়েছেন, তাতে এসব কথার গুষ্ঠিও নেই। আরবী কোন কথাটির অর্থ যে তারা লিখেছেন ‘তার হাদীস প্রত্যাখ্যাত’ তা আমরা বুঝতে পারছিনা। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আমাদের এই বন্ধুরা মদীনা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী হাসিল করলেও তারা আরবীও বোঝেননা, বাংলাও না।

খালিদ কে উসমান ইবনে আবী শায়বা র., সালিহ ইবনে মুহাম্মাদ র., ইবনে হিব্বান র. ও ইবনে শাহীন র. প্রমুখ মুহাদদ্দিসগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইবনে মাঈন বলেছেন, ما به بأس অর্থাৎ তার ব্যাপারে কোন অসুবিধা নেই। আবূ দাউদ ও ইবনে হাজার র. তাকে সাদূক বা সত্যবাদী বলেছেন। ইবনে আদী র. বলেছেন,

هو عندي إن شاء الله لا بأس به

অর্থাৎ ইনশাআল্লাহ আমার দৃষ্টিতে তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। ইমাম বুখারী তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন।

হ্যাঁ, ইমাম আহমাদ র. প্রমুখ বলেছেন, له مناكير অর্থাৎ তার কিছু কিছু বর্ণনা আপত্তিকর। (সম্ভবত এ শব্দটির অর্থই তারা করেছেন- প্রত্যাখ্যাত)। ইবনে আদী র. ঐ ধরণের বর্ণনাগুলো উদ্ধৃতও করেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী র. ফাতহুল বারীর ভূমিকায় তার সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেছেন:

أما التشيع فقد قدمنا أنه إذا كان ثبت الأخذ والأداء لا يضره لا سيما ولم يكن داعية إلى رائه

অর্থাৎ বাকি রইল তার শিয়া হওয়ার ব্যাপারটি । এসম্পর্কে আমরা পূর্বেই বলেছি, তিনি যখন হাদীস গ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে মজবুত ছিলেন, তাই তার শিয়া হওয়াটা ক্ষতিকর নয়। বিশেষ করে এ কারণে যে, তিনি তার মতবাদের প্রতি কাউকে দাওয়াত দিতেননা।

এসব কথা ‘তাহযীবুত তাহযীব’, ‘ফাতহুল বারী’ ও ‘মিযানুল ই’তিদাল’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি মিথ্যাবাদী ও তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত- এমন কথা কোন গ্রন্থেই নেই। কোন মুহাদ্দিসই তাঁর সম্পর্কে বলেননি। এটা তাঁর উপর লা-মাযহাবীদের বড় অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।

যাহোক, তাঁর কিছু কিছু বর্ণনায় আপত্তি থাকলেও আলোচ্য হাদীসটি তার অন্তর্ভূক্ত নয়। কারণ একে তো এতে আপত্তির কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, তিনি ছাড়াও অন্য সনদে ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা র. সম্পর্কে তো তাদের বক্তব্য আরো মারাত্মক। ইয়াযীদ ছিলেন প্রসিদ্ধ তাবেয়ী, সিহাহ সিত্তার রাবী। বুখারী র. ও মুসলিম র. তার সূত্রে বহু হাদীস গ্রহণ ও উদ্ধৃত করেছেন। আবূ হাতিম র., নাসায়ী র. ও ইবনে সাদ র. তাকে ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইবনে মাঈন র. বলেছেন, ثقة حجة অর্থাৎ তিনি নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য। আছরাম র. এর বর্ণনা মতে ইমাম আহমাদও তাকে ছিকাহ বলেছেন। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, মুনকারুল হাদীস। এই শব্দটির অর্থ হয়তো তারা করেছেন প্রত্যাখ্যাত। আর তার সকল বর্ণনা কথাটি নিজেদের পকেট থেকে জুড়ে দিয়েছেন। অথচ ঐ শব্দটির সাধারণ অর্থ আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। কিন্তু ইমাম আহমাদ এই অর্থে শব্দটি ব্যাবহার করতেননা। কোন বর্ণনাকারী কিছু কিছু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে যদি নিঃসঙ্গ হন তার ক্ষেত্রেই তিনি ঐ শব্দ ব্যবহার করেন। ফাতহুল বারীর ভূমিকা গ্রন্থে ইবনে হাজার র. ইয়াযীদের আলোচনাতেই এই কথা পরিস্কার করেছেন।

বাকি রয়ে গেলেন আবূ উসমান। তিনি প্রত্যাখ্যাত এমন কোন কথা কোন কিতাবে নাই। তার নাম আমর ইবনে আব্দুল্লাহ। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবূ তাহির র. ও হাসান ইবনে আলী ইবনে মুআম্মাল তার কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন। তার বর্ণিত বহু হাদীস বায়হাকী র. তার সুনানে উদ্ধৃত করেছেন। কোন মুহাদ্দিসই তাকে যয়ীফ বলেননি। এধরণের অনেক রাবী বুখারী ও মুসলিম শরীফেও আছে। তাছাড়া আবূ উসমানের সূূত্র ছাড়াও হাদীসটির অন্য আরেকটি সহীহ সূত্র আছে। তাই তার কারণে মূল হাদীসটির উপর কোন প্রভাব পড়বেনা।

এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হলো, হযরত উমর রা. এর আমলে তাঁরই ব্যবস্থাপনায় সাহাবায়ে কেরাম -যাদের মধ্যে মুহাজির ও আনসার সকলেই ছিলেন- মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবী পড়তেন। এতে তাঁদের কেউ কোন আপত্তি করেননি। এটাকেই সাহাবীগণের ইজমা বা সম্মিলিত কর্মপন্থা বলা হয়।

হযরত উমর রা. এর আমলে যে বিশ রাকাত তারাবী পড়া হতো সে কথা শুধু সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেছেন তা নয়, আরো চারজন শীর্ষ তাবেয়ীও একই কথা বলেছেন।

ক. ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল আনসারী র. এর বক্তব্য:

إن عمر رض أمر رجلا يصلي بهم عشرين ركعة

অর্থাৎ হযরত উমর রা. জনৈক সাহাবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সাহাবীদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৪।

এই বর্ণাটির সনদ সহীহ। তবে ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ যেহেতু হযরত উমর রা. এর যুগ পাননি, আবার কার কাছ থেকে শুনেছেন তাও বলেননি, এই কারণে এটিকে মুনকাতি’ বা সূত্র-বিচ্ছিন্ন বলা হয়। কিন্তু যেহেতু এই ধরণের তাবেয়ীগণের উস্তাদ পর্যায়ে দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলনা বললেই চলে, তাই তাদের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য। তদুপরি তিনি একা নন। আরো তিনজন তাবেয়ী একই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। তাই এগুলো পূর্ববর্তী সহীহ ও অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির সমর্থক ও অতিরিক্ত সাক্ষী হিসেবে গণ্য হতে পারে। লা-মাযহাবী বন্ধুরা এই বর্ণনাটির ব্যাপারে সূত্রবিচ্ছিন্নতার আপত্তি ছাড়াও আরো তিনটি আপত্তি পেশ করেছেন। দুটি আলবানী সাহেবের উদ্ধৃতিতে। অপরটি নিজেদের পক্ষ থেকে।

প্রথম আপত্তিটি হলো, এই হাদীসটি হযরত উমর রা. থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত প্রতিষ্ঠিত হাদীসের বিপরীত। হাদীসটি হলো- হযরত উমর রা. দুজন সাহাবী হযরত উবাই বিন কাব ও তামীম দারীকে (রমযান মাসে ) ১১ রাকাত পড়ানোর নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। (মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ২৫৩)।

ইমাম মালেক র. এই হাদীসটি মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের সূত্রে সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ বর্ণিত এ হাদীসে রাকাত-সংখ্যা নিয়ে তার ছাত্রদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। মালেক র. ১১ রাকাতের কথা বলেছেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ১৩ রাকাতের কথা বলেছেন। আর দাউদ ইবনে কায়স ২১ রাকাতের কথা বলেছেন। শেষোক্ত সংখ্যাটি মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে দাউদ থেকে উদ্ধৃত। ( দ্র, হাদীস নং ৭৭৩০)। দাউদ ইবনে কায়স একাই যে বলছেন তাও নয়। আব্দুর রাযযাক বলেছেন, عن داود وغيره অর্থাৎ দাউদের সঙ্গে আরো কেউ কেউ ২১ রাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন।

পক্ষান্তরে পূর্বে উল্লিখিত ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফার সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসটিতে এ ধরণের মতভেদ নেই। আবার দীর্ঘ বারশ’ বছরের ইতিহাসে কোন মনীষী আট রাকাত তারাবীর প্রবক্তা ছিলেন না, এর উপর কারো আমলও ছিলনা। বরং এর বিপরীতে হযরত উমর রা. এর যুগ থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় বিশ রাকাত বা তার বেশী তারাবীর প্রচলন চলে আসছে। এসব কারণে অনেকে এগার রাকাতের বর্ণনাকে বর্ণনাকারীর ভুল আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. (মৃত্যু ৪৬৩ হি.) ইমাম মালেক র. এর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এই এগার রাকাতের বর্ণনাকে ইমাম মালেকের ভুল আখ্যা দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। একেই বলা হয় ইনসাফ।

আবার কেউ কেউ এটাকে সুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের ভুল বলেও মন্তব্য করেছেন। (দ্র, আওজাযুল মাসালিক, ১খ, ৩৯৪পৃ)। তাছাড়া দুটি বর্ণনার মধ্যে কেউ কেউ সমন্বয় সাধন করেও পরস্পর বিরোধিতা দূর করেছেন। তারা বলেছেন, প্রথম দিকে যখন কেরাত খুব দীর্ঘ পড়া হতো তখন এগারো রাকাত পড়া হতো। পরে কেরাত কিছুটা হালকা করে রাকাত বাড়িয়ে বিশে উন্নীত করা হয়েছিল। তখন থেকেই বিশ রাকাত পড়ার ধারা অব্যাহত থাকে। ইমাম বায়হাকীসহ আরো কিছু মনীষী এরূপ সমন্বয়ের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয় আপত্তি হলো, বিশ রাকাতের এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী।

এখানে হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত তাহাজ্জুদের এগারো রাকাত সম্পর্কিত হাদীসটির দিকে ইংগিত করা হয়েছে। এটি আমরা শেষ দিকে উল্লেখ করবো। সেখানেই প্রমাণিত হবে আলোচ্য হাদীসটি ঐ হাদীসের বিরোধী নয়।

তৃতীয় আপত্তি লা-মাযহাবী বন্ধুরা করেছেন বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের ব্যাপারে। এটাকে আপত্তি না বলে জালিয়াতি বললে অত্যুক্তি হবেনা।

তারা বলেছেন, তাছাড়া ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদকে কেউ কেউ মিথ্যাবাদীও বলেছেন। যেমন, ইমাম আবূ হাতিম র. বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ কর্তৃক বর্ণিত কোন কথাই সত্য নয়, বরং প্রত্যাখ্যাত । কারণ সে হলো মিথ্যাবাদী। (জরহে আততাদীল, ৯ম খন্ড; তাহযীবুত তাহযীব ৬ষ্ঠ খন্ড)।

হায়, হায়! ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ বিখ্যাত তাবেয়ী, ইমাম মালেকের উস্তাদ। বুখারী ও মুসলিম শরীফে তাঁর সূত্রে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাঁর নাকি কোন কথাই সত্য নয়, তিনি নাকি মিথ্যাবাদী। কথাগুলো পড়ে কান্না আসার উপক্রম। ইলমে হাদীস আজ কোন অযোগ্য ও অশুভ লোকদের হাতে এসে পড়েছে? দুটি উদ্ধৃতির কোথাও এমন কথা নেই, থাকতে পারেনা। তাঁকে তো কেউ যয়ীফও বলেননি, মিথ্যাবাদী বলাতো দূরের কথা।

এজন্যেই আমি সাধারণ আহলে হাদীস ভাইদের বলি, আপনারা কাদের অন্ধ অনুসরণ করছেন ভেবে দেখুন। যারা বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে এমন ডাহা মিথ্যা তথ্য পেশ করতে পারে, তারা ইমাম আবূ হানীফা র. সম্পর্কে আপনাদেরকে কত ভুল ধারণায় ফেলে রাখতে পারে। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত নসীব করুন।

খ. তাবেয়ী আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই র. এর বক্তব্য:

عن عبد العزيز بن رفيع قال: كان أبي بن كعب يصلي بالناس في رمضان بالمدينة عشرين ركعة ويوتر بثلاث.

অর্থ: আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই র. (তারা লিখেছেন, রাফে) বলেন, হযরত উবাই ইবনে কাব রা. রমযানে মদীনা শরীফে লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৬।

এ হাদীসটির অনুবাদে তারা জালিয়াতি করেছেন। ‘পড়তেন’ এর স্থলে তারা লিখেছেন ‘পড়েছেন’। অথচ সাধারণ আরবী জানা লোকও বুঝেন, كان يصلي অর্থ ‘পড়তেন’, ‘পড়েছেন’ নয়। যেহেতু ‘পড়তেন’ কথাটি নিয়মিত পড়াকে বোঝায়, আর ‘পড়েছেন’ কথাটি তা বোঝায় না, তাই এই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এর উল্টো পরবর্তী হাদীসটিতে আছে,

عن أبي بن كعب أنه صلى في رمضان ....

অর্থাৎ হযরত উবাই ইবনে কাব রা. বলেন, তিনি রমযানে পড়েছেন ----। এখানে صلى অর্থ ‘পড়েছেন’। অথচ তারা অর্থ করেছেন- ‘আদায় করতেন’। এখানেও তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

তাইতো আমি বলি, বুখারী শরীফের পূর্ববর্তী অনুবাদগুলো যদি না থাকতো তবেই দেখা যেত বাবু সাহেবরা কত হাজার ভুলের শিকার হয়েছেন।

যাহোক, হাদীসটি একজন তাবেয়ীর সাক্ষ্য। তিনি উমরী যুগ পাননি। একে মুহাদ্দিসগণ মুনকাতি’ বা মুরসাল বলে থাকেন। অর্থাৎ যার সূত্র বিচ্ছিন্ন। সূত্র-বিচ্ছিন্ন হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ এ কারণেই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন যে, মাঝখানে কোন দুর্বলব্যক্তি থেকে যাওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু আব্দুল আযীয র. তাবেয়ী ছিলেন। তার উস্তাদগণের মধ্যে দুর্বল কেউ নাই বললেই চলে। তাছাড়া তিনি একা নন। তার মতো আরো তিনজন একই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। অধিকন্তু এগুলো পূর্বোল্লিখিত অবিচ্ছিন্ন ও সহীহ সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির অতিরিক্ত সাক্ষী ও সমর্থক। তাই এতে কোন অসুবিধা নেই।

এ হাদীসটির ব্যাপারেও তারা সূত্রবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ ছাড়া আরও দুটি অভিযোগ এনেছেন। এক. এটি হযরত উমর রা. বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। দুই. অনুরূপ এটি হযরত উবাই রা. এর সপ্রমাণিত বর্ণনার বিরোধী।

হযরত উমর রা. এর হাদীসের বিরোধী না হওয়ার বিষয়টি আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। আর হযরত উবাই রা. এর হাদীসটি দুর্বল। তদুপরি সেটা একদিনের ঘটনা মাত্র। সুতরাং সেটির বিরোধী হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।

গ. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. এর বক্তব্য:

عن يزيد بن رومان أنه قال: كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان بثلاث وعشرين ركعة

অর্থ: ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. বলেন, হযরত উমর রা. এর যুগে লোকেরা রমযান মাসে ২৩ রাকাত নামায পড়তেন। (মুয়াত্তা মালিক, ৪০)

এটিও একজন তাবেয়ীর সাক্ষ্য। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এটিকে মুনকাতি’ বা মুরসাল বলা হয়। কারণ ইয়াযীদ ইবনে রূমান হযরত উমর রা. এর যুগ পাননি। এটিকে যয়ীফ বলা উচিত নয়। কেউ যয়ীফ বলেনও নি। সকলে মুনকাতি’ বা মুরসাল বলেছেন। অথচ লা-মাযহাবী বন্ধুরা বায়হাকী র., নববী র. যায়লায়ী র. ও আইনী র. এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন - তারা এটিকে যয়ীফ বলেছেন। এটা তাদের একটি জালিয়াতি । এ ধরণের মুনকাতি’ বা সূত্র বিচ্ছিন্ন হাদীসকে যয়ীফ বলা হাদীসের শাস্ত্রীয় জ্ঞান সম্পর্কে দৈন্যতা ও অজ্ঞতারই পরিচায়ক। আল্লামা ইবনে তায়মিয়া র. লিখেছেন,

والمرسل الذي له ما يوافقه أوالذي عمل به السلف حجة باتفاق الفقهاء

অর্থাৎ যে সূত্র বিচ্ছিন্ন হাদীসের অনুকুলে অন্য কোন কিছুর সমর্থন থাকে কিংবা পূর্বসূরীগণের আমল পাওয়া যায় সেটি ফকীহগণের সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণযোগ্য। (আল ফাতাওয়াল কুবরা, ৪খ, ১৭৯পৃ)

ঘ. তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে কাব আল কুরাযী র. এর বক্তব্য:

عن محمد بن كعب القرظي قال: كان الناس يصلون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان عشرين ركعة يطيلون فيها القراءة ويوترون بثلاث.

অর্থ: মুহাম্মদ ইবনে কাব র. বলেন, হযরত উমর রা. এর যুগে রমযানে লোকেরা বিশ রাকাত পড়তেন। তাতে তারা দীর্ঘ কেরাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (ইবনে নাস্র মারওয়াযী, কিয়ামুল লায়ল, পৃ ৯১)

এসব দলিল-প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, হযরত উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাতই পড়া হতো। আহলে হাদীস দলের কিছু সংখ্যক আলেম ছাড়া সারা পৃথিবীর সকল আলেম একথা স্বীকার করেছেন এবং করেন। অবশ্য এই দলের একজন বড় আলেম মাওলানা গোলাম রাসূলও ২০ রাকাত তারাবীর ব্যাপারে সাহাবীগণের ইজমা হওয়ার ব্যাপারে মত ব্যক্ত করেছেন।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. লিখেছেন,

وهو الصحيح عن أبي بن كعب من غير خلاف من الصحابة

অর্থাৎ বিশ রাকাত তারাবীই হযরত উবাই ইবনে কাব রা. থেকে বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত। সাহাবীগণের এক্ষেত্রে কোন দ্বিমত ছিলনা। (আল ইসতিযকার , ৫খ, ১৫৭পৃ)

ইমাম ইবনে কুদামা র. আল মুগনী গ্রন্থে বিশ রাকাতকে দলিল প্রমাণ দ্বারা প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন,

ما فعله عمر وأجمع عليه الصحابة في عصره أولى بالاتباع

অর্থাৎ উমর রা. যা করেছেন এবং তাঁর আমলে সাহাবীগণ যে বিষয়ে একমত হয়েছেন তাই অনুসরণের অধিক উপযুক্ত। (দ্র, ২খ, ৬০৪পৃ)

আল্লামা ইবনে তায়মিয়া র. বলেছেন,

انه قد ثبت أن أبى بن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة فى قيام رمضان ويوتر بثلاث فرأى كثير من العلماء أن ذلك هو السنة لأنه أقامه بين المهاجرين والانصار ولم ينكره منكر

অর্থাৎ একথা প্রমাণিত যে, উবাই ইবনে কাব রা. রমযানে তারাবীতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তেন। এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। তাই বহু আলেমের সিদ্ধান্ত এটাই সুন্নত। কেননা তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই তা আদায় করেছিলেন। কেউ তাতে আপত্তি করেননি।(মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৩খ, ১১২-১৩পৃ)

আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী র. তার ‘আলমানহাজুল কারীম’ গ্রন্থে লিখেছেন,

ثم التراويح وهي عشرون ركعة في كل ليلة من رمضان وتعيين كونها عشرين جاء في حديث ضعيف لكن أجمع عليه الصحابة رض

অর্থাৎ তারাবী রমযানের প্রত্যেক রাতেই বিশ রাকাত করে। বিশ রাকাতের নির্ণয়ণ একটি দুর্বল হাদীসে আসলেও সাহাবীগণ এর উপর সকলে একমত হয়েছিলেন।( দ্র, পৃ ২৪০)

ইমাম আবূ হানীফা র. এর চমৎকার বিশ্লেষণ:

روى أسد بن عمرو عن أبي يوسف قال: سألت أبا حنيفة عن التراويح وما فعله عمر فقال: التراويح سنة مؤكدة ولم يتخرصه عمر من تلقاء نفسة ولم يكن فيه مبتدعا ولم يأمر به إلا عن أصل لديه وعهد من رسول الله صلى الله عليه وسلم ولقد سن عمر هذا وجمع الناس على أبي بن كعب فصلاها جماعة والصحابة متوافرون، منهم عثمان وعلي وابن مسعود والعباس وابنه وطلحة والزبير ومعاذ وأبي وغيرهم من المهاجرين والأنصار رضي الله عنهم أجمعين وما رد عليه واحد منهم بل ساعدوه ووافقوه وأمروا بذلك.

অর্থাৎ আসাদ ইবনে আমর র. ইমাম আবূ ইউসুফ র. থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি ইমাম আবূ হানীফা র.কে তারাবী ও এ ব্যপারে হযরত উমর রা.এর কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তারাবী সুন্নতে মুয়াক্কাদা। হযরত উমর রা. অনুমান করে নিজের পক্ষ থেকে এটা নির্ধারণ করেননি। এ ক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছু উদ্ভাবন করেননি। তিনি তাঁর নিকট বিদ্যমান ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রাপ্ত কোন নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই আদেশ প্রদান করেছেন। তাছাড়া হযরত উমর রা. যখন এই নিয়ম চালু করলেন এবং হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. এর ইমামতিতে লোকদেরকে একত্রিত করলেন, ফলে তিনি জামাতের সাথে এই নামায আদায় করলেন, তখন বিপুল সংখ্যক সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে হযরত উসমান, আলী, ইবনে মাসউদ, আব্বাস, ইবনে আব্বাস, তালহা, যুবায়র, মুআয ও উবাই রাদিয়ল্লাহু আনহুম প্রমুখ মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ ছিলেন। তাঁদের কেউই তাঁর উপর আপত্তি করেননি। বরং সকলেই তাঁকে সমর্থন করেছেন, তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন এবং অন্যদেরও এরই আদেশ দিয়েছেন।(আল ইখতিয়ার লি তালীল মুখতার,১/৭০)

ইমাম সাহেবের এই সারগর্ভ বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, ২০ রাকাত তারাবী রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যক্ষ নির্দেশে না হলেও তাঁর পরোক্ষ নির্দেশেই হয়েছিল। উসূলে ফিকহের পরিভাষায় এটাকে মারফূ হুকমী বলা হয়।

স্বাভাবিকভাবেই কোন একজন সাহাবীর কোন কথা বা কর্ম যা ইজতিহাদের আওতাবহির্ভূত, সকল ফকীহ ও আলেমের দৃষ্টিতে মারফূ হুকমী (অর্থাৎ এর পেছনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনা ছিল) বলে গণ্য, তখন হযরত উমর রা. এর মতো ব্যক্তির উদ্যোগ এবং সকল সাহাবীর ঐকমত্য পোষণ কেন মারফূ হুকমী হবে না? কোন নামাযের রাকাত সংখ্যা নির্ধারণ ইজতিহাদের আওতা-বহির্ভূত ব্যাপার। সুতরাং এর পেছনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা অবশ্যই ছিল বলতে হবে। ইমাম ইবনে আবদুল বার র. তাঁর ‘আততামহীদ’ গ্রন্থে কত সুন্দর লিখেছেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. নতুন কিছু করেননি। তিনি তাই করেছেন যা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করতেন। কিন্তু শুধু এ আশংকায় যে, নিয়মিত জামাতের কারণে তারাবী উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যেতে পারে জামাতের ব্যবস্থা করে যাননি। হযরত উমর রা. এই বিষয়টি জানতেন। তিনি দেখলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর এখন আর এই আশংকা নেই, কেননা ওহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, এবং শরীয়ত নির্ধারণের বিষয়টি চুড়ান্ত হয়ে গেছে। তখন তিনি নবী-পছন্দের অনুসরণ করে ১৪ হি. সনে জামাতের ব্যবস্থা করে দেন। আল্লাহ তায়ালা যেন এই মর্যাদা তাঁর ভাগ্যেই নির্ধারিত রেখেছিলেন। (দ্র.৮খ, ১০৮,১০৯পৃ.)

লা-মাযহাবী বন্ধুরা কখনো বলেন, বিশ রাকাত তারাবী হযরত উমর রা. থেকে প্রমাণিত নয়। তিনি এগার রাকাতেরই নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার কখনো বলেন, এটা হযরত উমর রা. এর কর্ম, যার পেছনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমোদন ছিল না।

হরত উমর রা. যদি এগারো রাকাতের আদেশই দিয়ে থাকেন, তবে তার আদেশ লংঘন করে কারা কখন থেকে বিশ রাকাত তারাবীর নিয়ম চালু করলো, সেটা তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু কখনোই তারা সেটা প্রমাণ করতে পারবেনা।

আর হযরত উমর রা. এর কর্মের পেছনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমোদন ছিলনা, এটা কেমন কথা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেননি, আমার সুন্নত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত তোমরা আকড়ে ধরবে। তিনি কি বলেননি, তোমরা আমার পরে আবূ বকর ও উমরকে অনুসরণ করবে?

আল্লামা ইবনুল হুমাম র. কত চমৎকার বলেছেন,

وكونها عشرين سنة الخلفاء الراشدين وقوله عليه السلام عليكم بسنتي وسنة الخلقاء الراشدين ندب إلى سنتهم

অর্থাৎ বিশ রাকাত তারাবী খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: আমার সুন্নত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত তোমরা আঁকড়ে ধর- এতে তাঁদের সুন্নতের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। (দ্র, ফাতহুল কাদীর ১খ, ৪৮৬পৃ)

৩ নং দলিল: হযরত আলী রা. এর কর্মপন্থা:

عن أبي عبد الرحمن السلمي عن علي قال: دعا القراء في رمضان فأمر منهم رجلا يصلي بالناس عشرين ركعة قال: وكان علي يوتر بهم

অর্থ : আবূ আব্দুর রহমান সুলামী র. হযরত আলী রা. সম্পর্কে বলেন, তিনি রমযানে হাফেজদেরকে ডাকলেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে নির্দেশ দিলেন। তিনি বলেন, হযরত আলী রা. নিজে তাদের নিয়ে বিতর পড়তেন। (সুনানে বায়হাকী, ২খ, ৪৯৬,৪৯৭পৃ)

এই হাদীসটি বায়হাকী র. অন্য আরেকটি বর্ণনাকে শক্তিশালী করার জন্যে এনেছেন। এতে বোঝা যায়, এটিও তার দৃষ্টিতে মজবুত বর্ণনা। তাছাড়া ইবনে তায়মিয়া র. ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে (২/২২৪) ও যাহাবী র. ‘আল মুনতাকা’ গ্রন্থে (৫৪২) এটিকে দলিলরূপে পেশ করেছেন এবং এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, হযরত আলী রা. তারাবীর জামাত, রাকাত-সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এর নীতিই অনুসরণ করেছিলেন।

হযরত আলী রা. থেকে ভিন্ন একটি সনদেও এই হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেটি এরূপ:

عن أبي الحسناء أن عليا أمر رجلا أن يصلي بهم في رمضان عشرين ركعة

অর্থ: আবুল হাসনা (তারা লিখেছেন, হাসানা- এটা ভুল) থেকে বর্ণিত। হযরত আলী রা. রমযানে জনৈক ব্যক্তিকে আদেশ দিয়েছিলেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৩।

লা-মাযহাবী বন্ধুরা প্রথম বর্ণনাটি উল্লেখই করেননি । দ্বিতীয় বর্ণনা উল্লেখ করে তারা দুটি হাদীসগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ও বায়হাকী ২/৪৯৬। এরপর তারা লিখেছেন, ইমাম বায়হাকী বলেন, এর সনদে দুর্বলতা রয়েছে।

এখানে বায়হাকী র. এর উদ্ধৃতিটি ভুল। বায়হাকী র. এটি উদ্ধৃত করেননি। বরং প্রথম বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে বলেছেন,

وروينا ذلك من وجه آخر عن علي رض

অর্থাৎ এই হাদীসটি হযরত আলী রা. থেকে ভিন্ন একটি সনদে আমাদের নিকট পৌঁছেছে। ধারণা করা হয়, তিনি হয়তো মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার আবুল হাসনার বর্ণনাটির প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।

এরপর তারা বায়হাকীর যে বক্তব্য উল্লেখ করেছেন তাতো পুরোপুরি জালিয়াতি এবং ডাহা মিথ্যা। বায়হাকী র. এমন কথা কোথাও বলেননি।

এরপর তারা লিখেছেন, আল্লামা আলবানী র. বলেন, এতে আবুল হাসানা ত্রুটিযুক্ত। তার সম্পর্কে ইমাম যাহাবী র. লিখেছেন, সে কে তা জানা যায়নি। হাফেজ র. বলেছেন, সে অজ্ঞাত। আবুল হাসানা কর্র্র্তৃক বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যাত। মিযানুল ই’তিদাল ১ম খন্ড, যয়ীফ সুনানুল কুবরা ২য় খন্ড, বায়হাকী।

এ হলো আলবানীর অন্ধ অনুসারীদের শেষ তহবিল। আলবানী ভুল করেছেন তো তারাও ভুল করেছেন। একই ভুল করেছেন মোবারকপুরীও। আসলে যাহাবী ও হাফেজ ইবনে হাজার র. যে আবুল হাসনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি আর এই আবুল হাসনা দুই ব্যক্তি। ইনি হযরত আলী রা.এর শাগরিদ আর উনি হযরত আলী রা. এর ছাত্রের ছাত্র হাকাম ইবনে উতায়বার শাগরিদ। এই আবুল হাসনার ছাত্র আমর ইবনে কায়স ও আবূ সাদ আল বাক্কাল, আর ঐ আবুল হাসনার ছাত্র শারীক নাখায়ী। ঐ আবুল হাসনাকে ইবনে হাজার র. ‘তাকরীবে’ ৭ম স্তরের বলে উল্লেখ করেছেন। আর এই আবুল হাসনার ছাত্র আবূ সাদ বাক্কালকে ৫ম স্তরের উল্লেখ করেছেন। তাহলে তার উস্তাদ আবুল হাসনা অবশ্যই ৩য় বা ৪র্থ স্তরের হয়ে থাকবেন। সুতরাং দুজন এক ব্যক্তি হয় কিভাবে? তাছাড়া ইবনে হাজার র. তাকরীবের ভূমিকায় লিখেছেন, যে ব্যক্তি থেকে শুধু একজন ছাত্র হাদীস বর্ণনা করেছে, আর কেউ তাকে ছিকাহ বা বিশ্বস্ত বলেননি তাকেই আমি মাজহুল বা অজ্ঞাত বলে পরিচয় দেব। তার এ কথার আলোকেও বোঝা যায়, এই আবুল হাসনাকে তিনি মাজহুল বা অজ্ঞাত বলেননি। কারণ তার থেকে দুজন ছাত্র হাদীস বর্ণনা করেছেন।

যাহোক, এতটুকু তো ছিল ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু এর পরে তারা হাফেজ ইবনে হাজার র. এর বক্তব্য হিসেবে একথা লিখেছেন, আবুল হাসানা কর্তৃক বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যাত. এটা নিঃসন্দেহে জালিয়াতি। হাফেজ ইবনে হাজার একথা বলেননি।

আমাদের আলোচ্য আবুল হাসনাকে মাসতূর বলা যেতে পারে। অর্থাৎ যার একাধিক বর্ণনাকারী ছাত্র আছে, কিন্তু তার ব্যাপারে কারো পক্ষ থেকে সুনাম বর্ণিত হয়নি। মাসতূরের বর্ণনা অনেকেই নিঃশর্তে গ্রহণ করেছেন। এর জন্যে ‘আর রাফউ ওয়াত তাকমীলে’র পরিশিষ্ট দেখা যেতে পারে। কেউ কেউ শর্ত আরোপ করেছেন সমর্থক বর্ণনাকারীর। অর্থাৎ তার সমর্থনে যদি অন্য কোন ব্যক্তির বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে। এখানে তাও পাওয়া যাচ্ছে। আবুল হাসনার মতো আবূ আব্দুর রহমান সুলামীও হযরত আলী রা. থেকে একই কথা উল্লেখ করেছেন। এ মূলনীতিটি ‘শারহুন নুখবা’য়ও বিধৃত হয়েছে। হযরত আলী রা. যে বিশ রাকাত তারাবী শিক্ষা দিয়েছেন, তা এ থেকেও স্পষ্ট হয় যে, তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র শুতাইর ইবনে শাকাল, আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বাকরা, সাঈদ ইবনে আবূল হাসান, সুয়াইদ ইবনে গাফালা ও আলী ইবনে রাবীআ প্রমুখ বিশ রাকাত তারাবী পড়াতেন ও পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, সুনানে বায়হাকী, ২/৪৯৮; কিয়ামুল লাইল লি ইবনে নাসর, পৃ২০০-২০২)।

৪. বিভিন্ন শহরে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের আমল:

ক. মক্কা শরীফের আমল:

সাহাবা ও তাবেয়ীনের যুগে মদীনা শরীফে যেমন বিশ রাকাত তারাবী পড়া হতো, মক্কা শরীফেও তেমনি বিশ রাকাতই পড়া হতো। আতা ইবনে আবূ রাবাহ (মৃত্যু, ২১৪ হি)- যিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন এবং বহু সংখ্যক সাহাবীর সাক্ষাৎলাভে ধন্য ছিলেন, মক্কা শরীফেই তার নিবাস ছিল- বলেছেন,

أدركت الناس وهم يصلون ثلاثا وعشرين ركعة بالوتر

অর্থাৎ আমি লোকদেরকে ( সাহাবা ও প্রথম সারির তাবেয়ীদেরকে) পেয়েছি তারা বিতর সহ ২৩ রাকাত পড়তেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৭০।

এমনি ভাবে ইবনে আবী মুলাইকা র. মক্কার অধিবাসী ছিলেন। তিনি সেখানকার কাজি (বিচারক ) ও মুয়াজ্জিন ছিলেন। ১১৭ হি. সনে তার ওফাত হয়। তার সম্পর্কে নাফে’ ইবনে উমর বলেন,

كان يصلي بنا في رمضان عشرين ركعة

অর্থাৎ আমাদেরকে নিয়ে তিনি বিশ রাকাত পড়তেন।

ইমাম শাফেয়ী র.ও মক্কার অধিবাসী ছিলেন। ২০২ হি. সালে তাঁর ওফাত হয়। তিনি বলেছেন, هكذا أدركت ببلدنا بمكة يصلون عشرين অর্থাৎ অনুরূপ ভাবে আমি আমাদের শহর মক্কা শরীফে পেয়েছি,তারা বিশ রাকাত নামায পড়তেন। (তিরমিযী শরীফ)

ইমাম শাফেয়ী র.ও যেহেতু বিশ রাকাত তারাবীকে অবলম্বন করেছেন, তাই তাঁর অনুসারীরা মক্কা ও অন্যান্য স্থানে বিশ রাকাতের উপরই আমল করতেন। মক্কার হারাম শরীফে চালু হওয়া এ আমল আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

সাহাবী যুগের শেষ দিকে মদীনাবাসীগণ যখন দেখলেন মক্কাবাসীগণ বিশ রাকাত তারাবী পড়েন বটে, কিন্তু তারা প্রত্যেক তারবীহার (বিশ্রামের জন্যে বিরতি ) সময় তওয়াফ করে অতিরিক্ত ফায়দা লাভ করছেন তখন থেকে তারা সেখানে প্রত্যেক তারবীহার সময় চার রাকাত বাড়িয়ে পড়তে লাগলেন। এভাবে সেখানে ২০+১৬=৩৬ রাকাত পড়ার প্রচলন হতে থাকে। কেউ আরো দু’রাকাত যোগ করে ৩৮ রাকাত পড়তে থাকেন। এভাবে তিন রাকাত বিতর সহ তাদের ৩৯ বা ৪১ রাকাত হতো।

ইমাম মালেক র. মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ১৭৯ হি. সনে তার ওফাত হয়। তিনি বলেছেন, হাররার ঘটনার (যা ৬৩ হি সনে ঘটেছিল) পূর্ব থেকে একশো বছরের অধীক সময় জুড়ে মদীনা শরীফে ৩৮ রাকাত তারাবী পড়া হতে থাকে। সালেহ মাওলাত তাওয়ামা র. (তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন) এর বর্ণনাও অনুরূপ।

মুআয আবূ হালীমা রা. সাহাবী ছিলেন এবং তিনি হাররার ঘটনায় শহীদ হয়েছিলেন। তার সম্পর্কে ইবনে সীরীন র. সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ৪১ রাকাত তারাবী পড়াতেন। এ তিনটি বর্ণনা ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থেও বিধৃত হয়েছে।(দ্র, ২খ, ৭২পৃ)

নাফে র. ছিলেন হযরত ইবনে উমর রা. এর আযাদকৃত দাস। হযরত আয়েশা রা., আবূ হুরায়রা রা. ও আবূ রাফে রা. প্রমুখেরও ছাত্র ছিলেন তিনি। ১১৭ হি সনে তাঁর ওফাত হয়। তাঁর বর্ণনা হলো, আমি লোকদেরকে ৩৬ রাকাত তারাবী ও তিন রাকাত বিতর পড়তে দেখেছি ও পেয়েছি। ( দ্র, প্রাগুক্ত, ২/৭৩)

দাউদ ইবনে কায়স র. বলেন, আমি হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয র. (মৃত্যু ১০১হি) ও আবান ইবনে উসমান র. (মৃত্যু ১০৫ হি, ইনি হযরত উসমান রা. এর ছেলে ছিলেন) এর আমলে মদীনাবাসীকে ৩৬ রাকাত পড়তে দেখেছি। (দ্র, কিয়ামুল লায়ল, পৃ৯১)।

তিনি এও বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয র. হাফেজদেরকে ৩৬ রাকাত পড়াতে হুকুম দিতেন। (প্রাগুক্ত, পৃ ৯০)

ইমাম মালেক র. এর এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। ২০ রাকাত ও ৩৬ রাকাত । তার অনুসারীরা ৩৬ রাকাতকেই তার মাযহাব আখ্যা দিয়েছেন। মদীনা মিশর স্পেনসহ বিভিন্ন শহরে তার অনুসারীরা ৩৬ রাকাত তারাবী পড়তে থাকেন। ইমাম তিরমিযী (মৃত্যু ২৭৯ হি) এর যুগে মদীনায় ৩৬ রাকাতই পড়া হতো। (দ্র, তিরমিযী মরীফ)

শায়খ আতিয়া সালেম লেখেন,

مضت المأة الثانية والتراويح ست وثلاثون وثلاث وتر ودخلت المأة الثالثة وكان المظنون أن تظل على ما هي عليه تسع وثلاثون بما فيه الوتر

অর্থাৎ মদীনায় ২য় হিজরী শতকে তারাবী ৩৬ রাকাত ও বিতর তিন রাকাত পড়া হতো। তৃতীয় শতকেও তাই হয়ে থাকবে। (আততারাবী আকছার মিন আলফি আম, পৃ ৪১)

হিজরী ৪র্থ শতকে মদীনার এ আমল পরিবর্তিত হয়ে বিশ রাকাতে এসে পৌঁছেছে। শায়খ আতিয়া লেখেন,

عادت التراويح في تلك الفترة كلها إلى عشرين ركعة فقط بدلا من ست وثلاثين في السابق

অর্থাৎ এ সময়ে পূর্বের ৩৬ রাকাতের পরিবর্তে তারাবী বিশ রাকাতে ফিরে আসে। (প্রাগুক্ত পৃ, ৪২)

তখন থেকে আজ পর্যন্ত মদীনার মসজিদে নববীতে ২০ তারাবী অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, আলবানী ও মোবারকপুরী দুজনই ইমাম মালেক র. এর এগারো রাকাতের একটি মতও উল্লেখ করেছেন। এ মতটি ভুয়া । ইমাম মালেকের কোন ছাত্র বা তাঁর মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কোন গ্রন্থে এ মতটি বর্ণিত হয়নি। জূরী নামক শাফেয়ী মাযহাবের জনৈক ব্যক্তি এ মতটির কথা উল্লেখ করেছেন। এই ব্যক্তি ইমাম মালেকের কয়েকশো বছর পরে এসেছেন। তার নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কেও কিছু জানা যায়না। এ ব্যক্তির উদ্ধৃতিতে আলবানী সাহেব এ দাবীও করেছেন, মালেক র. ২০ রাকাত পড়তে নিষেধ করতেন। সুবহানাল্লাহ!



খ. কূফাবাসীর আমল:

কূফাবাসীর আমলও মক্কা ও মদীনাবাসী সাহাবী ও তাবেয়ীগণের আমল থেকে ব্যতিক্রম ছিলনা। কূফা ছিল হযরত আলী রা. এর দারুল খেলাফত বা রাজধানী। তিনিই তো বিশ রাকাত পড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কূফায় বসবাস করতেন। তিনিও বিশ রাকাত পড়তেন। ( কিয়ামুল লাইল, পৃ,৯১)

আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ র. ছিলেন শীর্ষ তাবেয়ী। হযরত উমর, ইবনে মাসউদ ও হুযায়ফা রা. প্রমুখ বড় বড় সাহাবীগণের সাহচর্য লাভে তিনি ধন্য হয়েছিলেন। ৭৫ হি সনে তার ওফাত হয়। তিনিও চল্লিশ রাকাত তারাবী পড়তেন। সুয়াইদ ইবনে গাফালা ছিলেন হযরত আলী ও ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখের শীর্ষ ছাত্র । তিনিও বিশ রাকাত পড়াতেন। বায়হাকী, ২/৪৯৬। হযরত আলী রা. এর শিষ্য হারেছও বিশ রাকাত পড়াতেন। আলী ইবনে রাবীআ ছিলেন হযরত আলী ও সালমান ফারসী রা. এর সাহচর্য ধন্য। তিনিও বিশ রাকাত পড়াতেন । সাঈদ ইবনে জুবায়ের ছিলেন হযরত ইবনে আব্বাস রা. সহ বহু সাহাবীর শিষ্য। তিনিও বিশ রাকাতের বেশী তারাবী পড়তেন। ৯৫ হি সনে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সুফয়ান ছাওরী (মৃত্যু ১৬১ হিজরী) ছিলেন কূফার বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ, সিহাহ সিত্তায় তার সূত্রে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বুখারী রা. এর উস্তাদের উস্তাদ ছিলেন। তিনিও বিশ রাকাত তারাবীর পক্ষে। ইমাম আবূ হানীফা (মৃত্যু ১৫০ হি) বিশ রাকাত তারাবীকে সুন্নত বলার পর তার অনুসারীরা কূফা ও অন্যান্য শহরে বিশ রাকাতই তারাবী পড়তে থাকেন। বৃটিশ আমলে এই আহলে হাদীস ফেরকার উদ্ভবের পূর্বে উপমহাদেশের সর্বত্র বিশ রাকাত তারাবীই পড়া হতো।

গ.বসরা বাসীর আমল:

সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগে ইরাকের বসরা নগরী ইলম ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী ছিল। সেখানেও কেউ বিশ রাকাতের কম তারাবী পড়তেন না। আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বাকরা, সাঈদ ইবনে আবুল হাসান ও ইমরান আবদী ৮৩ হিজরীর পূর্বে বসরার জামে মসজিদে বিশ রাকাত তারাবী পড়াতেন। (কিয়ামুল লাইল, পৃ ৯২)

যুরারা ইবনে আবূ আওফা (মৃত্যু ৯৩ হি) শীর্ষ তাবেয়ী ছিলেন। তিনিও বিশ রাকাতের বেশী তারাবী পড়াতেন।

ঘ. বাগদাদ বাসীর আমল:

বাগদাদে ইমাম আহমাদ র. (মৃত্যু ২৪১ হি) বিশ রাকাত তারাবীকে সুন্নত বলেছেন। ফলে তার অনুসারীরা বাগদাদ ও অন্যান্য শহরে বিশ রাকাত তারাবী আদায় করতেন। হাম্বলী মাযহাবের সকল কিতাবে বিশ রাকাত তারাবীকে সুন্নত বলা হয়েছে। দাউদ জাহিরীও ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী। তিনিও ছিলেন বিশ রাকাত তারাবীর পক্ষে।

এমনিভাবে মার্ভের অধিবাসী আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক র. (মৃত্যু ১৮১ হি) বিশ রাকাত কে অবলম্বন করেছেন। ইসহাক ইবনে রাহাওয়ায়হ র. ৪১ রাকাতকে অবলম্বন করেছেন।

ইবনে তায়মিয়া র. এর মতেও বর্তমানে ২০ রাকাত পড়াই উত্তম। ইবনে তায়মিয়া র. বলেছেন,

والأفضل يختلف بإختلاف أحوال المصلين فإن كان فيهم إحتمال لطول القيام فالقيام بعشر ركعات وثلاث بعدها كما كان النبى يصلى لنفسه فى رمضان وغيره هو الأفضل وإن كانوا لا يحتملونه فالقيام بعشرين هو الأفضل وهو الذى يعمل به أكثر المسلمين فإنه وسط بين العشر وبين الأربعين وإن قام بأربعين وغيرها جاز ذلك ولا يكره شىء من ذلك

অর্থাৎ তারাবী কত রাকাত পড়া উত্তম তা নির্ভর করবে মুসল্লীদের ধৈর্য্য-সৈর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্য্যরে উপর। তারা যদি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়, তবে ১০ রাকাত ও পরে তিন রাকাত পড়া - যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ও গায়রে রমযানে নিজের জন্যে অবলম্বন করেছিলেন- উত্তম হবে। আর যদি তারা এর সামর্থ না রাখে তবে বিশ রাকাত পড়াই উত্তম হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এ অনুযায়ীই আমল করে আসছে। কারণ এটা ১০ ও ৪০ এর মাঝামাঝি। যদি কেউ ৪০ রাকাত বা তার কমবেশি পড়তে চায় তবে সেটাও জায়েয। এর কোনটাই মাকরূহ বা অপছন্দনীয় নয়। মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৪/২২৪।

বর্তমানে মানুষের সক্ষমতার কথা সকলের জানা । তাই ইবনে তায়মিয়ার মতেও বর্তমানে বিশ রাকাত পড়াই উত্তম। আরেকটি কথাও তিনি স্পষ্ট করেছেন, চল্লিশ বা অন্য যে কোন সংখ্যায় তারাবী পড়া হোক না কেন, তা মাকরূহ হবেনা, বরং জায়েযই হবে। অথচ আলবানী সাহেব বলেছেন, জোহরের ফরজ পাঁচ রাকাত পড়া যেমন, এগারো রাকাতের বেশী তারাবী পড়াও ঠিক তেমন।এমন দুঃসাহসিক কথা আলবানী ছাড়া কে বলতে পারবে? আমাদের জানামতো সমগ্র পৃথিবীর আলেমদের কেউই এমন কথা বলেননি।

এমনকি লা-মাযহাবী আলেমদের মুরুব্বী মাওলানা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানও স্পষ্ট বলেছেন, বিশ রাকাতের ভেতর যেহেতু এগারো রাকাতও অন্তর্ভূক্ত, তাই বিশ রাকাত আদায়কারীও সুন্নত অনুযায়ী আমলকারী বলে বিবেচিত হবে। (দ্র, ‘আল ইন্তিকাদ’ুর রাজীহ, পৃ ১৩৮)



আট রাকাতের দলিল: কিছু পর্যালোচনা

আট রাকাতের পক্ষে তিনটি দলিল পেশ করা হয়:

১.হযরত আবূ সালামা র. হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নামায কিরূপ হতো? তিনি বললেন, রমযান ও গায়র রমযানে তিনি এগানো রাকাতেন বেশী পড়তেন না। তিনি চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। এরপর চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। এর পর তিন রাকাত পড়তেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যে বিতর পড়ার আগেই ঘুুুমিয়ে পড়েন? তিনি বললেন, আয়েশা! আমার চোখ ঘুমায় বটে, তবে আমার কল্ব জাগ্রত থাকে। (বুখারী, মুসলিম)।

এ হাদীসটি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। কিন্তু আসলে এ হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে, তারাবী সম্পর্কে নয়। এটিকে তারাবী সম্পর্কে মনে করা ভুল। কারণ:

ক. এ হাদীসে সেই নামাযের কথা বলা হয়েছে যা রমযান ও অন্য সময় পড়া হতো, অথচ তারাবী রমযান ছাড়া অন্য সময় পড়া হয়না।

খ. এখানে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে একাকী পড়তেন। অথচ তারাবী জামাতের সঙ্গে মসজিদে পড়া হয়।

গ. এখানে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। পরে ঘুম থেকে উঠে বিতর পড়তেন। অথচ তারাবীতে নামায শেষ করে বিতর পড়া হয়। তাছাড়া এখানে যে বিতর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তা তিনি একাকী পড়তেন। অথচ তারাবীতে বিতর জামাতে পড়া হয়।

ঘ. এই নামায চার রাকাত, চার রাকত ও তিন রাকাত পড়া হয়েছিল। লা-মাযহাবী আলেম মোবারকপুরী তার তিরমিযী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থে বলেছেন, চার রাকাত এক সালামে পড়া হয়েছিল, এমনিভাবে তিন রাকাতও এক সালামে। অথচ তারাবী দুরাকাত করে পড়া হয়।

ঙ. এই নামায যদি তারাবী সম্পর্কে হতো, তবে ফকীহগণের কেউ না কেউ এগারো রাকাতের মত পোষণ করতেন। অথচ তাদের কেউই অনুরূপ মত পোষণ করেননি। ইমাম তিরমিযী ফকীহগণের মত উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ইমাম মালেক র. এর মত ৪১ রাকাত, আর অধিকাংশ আলেমের মত ২০ রাকাত। ৮ রাকাতের কোন মত থাকলে তিনি অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। বোঝা যায়, ফকীহগণের কেউই এই হাদীসকে তারাবীর ক্ষেত্রে মনে করেননি। অথচ ইমাম তিরমিযী র. জানায়েয অধ্যায়ে লিখেছেন,

كذلك قال الفقهاء وهم أعلم بمعاني الحديث

অর্থাৎ ফকীহ অনুরূপ বলেছেন, আর হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই অধিক জ্ঞাত।

চ. মুহাদ্দিসগণও এই হাদীসকে তারাবীর ক্ষেত্রে নয়, তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রেই মনে করতেন। ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইমাম মালেক, আব্দুর রাযযাক, দারিমী, আবূ আওয়ানা ও ইবনে খুযায়মা র. প্রমুখ সমলেই এই হাদীসকে তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন; তারাবী বা কিয়ামে রামাযান অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি।

এমনকি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে নাসর মারওয়াযী র. তার ‘কিয়ামুল লাইল’ গ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন,

باب عدد الركعات التي يقوم بها الإمام للناس في رمضان

অর্থাৎ অনুচ্ছেদ: রমযানে লোকদেরকে নিয়ে ইমাম যে নামায পড়বেন তার রাকাত-সংখ্যা। উক্ত অনুচ্ছেদে তিনি তারাবীর রাকাত-সংখ্যা সম্পর্কে বহু হাদীস উল্লেখ করেছেন। অথচ হযরত আয়েশা রা. এর এ হাদীস উচ্চ মানের সহীহ হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখ করা তো দূরের কথা, এর প্রতি কোন ইশারা-ইংগিতও করেননি। এতে বোঝা যায়, তাঁর গবেষণায়ও এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে নয়, তাহাজ্জুদ সম্পর্কে।

মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শুধু ইমাম বুখারী র. এ হাদীস তারাবী ও তাহাজ্জুদ উভয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারীর নীতি সকলের জানা। তিনি সামান্য সম্পর্কের কারণেই হাদীস পুনরুল্লেখ করেন। তিনি একথাও বুঝিয়ে থাকতে পারেন, রমযানে তারাবী পড়া হলেও শেষে তাহাজ্জুদও পড়ে নেয়া উচিৎ । বুখারী র. নিজেও তারাবী পড়ে শেষরাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন। ফাতহুল বারীর মুকাদ্দিমা, পৃ ৬৪৫।

ছ. এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে হলে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে বিশ রাকাত পড়া আদৌ সম্ভব ছিলনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, তাঁর সুন্নত ও আদর্শের প্রতি তাঁদের চেয়ে অধিক মহব্বত আর কারো হতে পারে? যারা এমন পাগল ছিলেন যে, প্রস্রাবের প্রয়োজন না হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সফরে যেখানে যেখানে প্রস্রাব করতে বসেছিলেন, ঠিক সেখানে গিয়ে বসেছেন। তাঁদের পক্ষে এমন একটি সুন্নত ছেড়ে দেওয়া কি কল্পনা করা যায়? লা-মাযহাবীদের ভূমিকা প্রমাণ করে, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী।

জ. খোদ হযরত আয়েশা রা.ও মনে করতেননা এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে। অন্যথায় তাঁর চোখের সামনে ৪০টি বছর মসজিদে নববীতে তাঁরই হুজরার পাশে এভাবে সুন্নতের পরিপন্থী কাজ করা হবে, আর তিনি প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকবেন- তা হতে পারে না।

ঝ. এ হাদীস তারাবী সম্পর্কে হলে লা-মাযহাবী আলেম শাওকানী সাহেব ও নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান কেন বলবেন: তারাবীর রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে কোন সহীহ হাদাীস নেই?

শাওকানী সাহেব বলেছেন,

فقصر الصلاة المسماة بالتراويح على عدد معين وتخصيصها بقراءة مخصوصة لم ترد به سنة

অর্থাৎ তারাবী নামাযকে বিশেষ সংখ্যায় ও বিশেষ কেরাতে আবদ্ধ করার ব্যাপারে কোন হাদীস আসেনি। দ্র, নায়লুল আওতার।

নওয়ার সাহেব তো আরো স্পষ্ট করে বলেছেন,

ان صلاة التراويح سنة بأصلها ثبت أنه عليه السلام صلاها في ليالي ثم ترك شفقة على الأمة أن لا تجب على العامة أو يحسبوها واجبة ولم يأت تعيين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة ولكن يعلم من حديث كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجتهد في رمضان ما لا يجتهد في غيره - رواه مسلم- أن عددها كان كثيرا.



অর্থাৎ তারাবী মূলতঃ সুন্নত। একথা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েক রাত এটি পড়েছিলেন। অতঃপর উম্মতের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তিনি এটি ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর আশংকা ছিল সাধারণের উপর এটি ফরজ হয়ে যায় কিনা, কিংবা তারাই এটিকে ফরজ মনে করে বসে কিনা। তবে এর নির্দিষ্ট সংখ্যা কোন সহীহ মারফূ হাদীসে উল্লেখ করা হয়নি। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে এত বেশী ইবাদতে তৎপর হতেন, অন্য মাসে এত তৎপর হতেননা। এ হাদীস থেকে এতটুকু বোঝা যায়, তারাবীর রাকাত সংখ্যা ছিল অনেক। দ্র, আল ইনতিকাদুর রাজীহ, পৃ,৬১

সুবকী র.ও তার ‘শারহুল মিনহাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন,

اعلم أنه لم يبنقل كم صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم في تلك الليالي هل هو عشرون أو أقل

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ রাতগুলোতে বিশ রাকাত না তার কম পড়েছিলেন সে কথা বর্ণিত হয়নি। দ্র, আল মাসাবীহ, পৃ ৪৪

জালালুদ্দীন সুয়ূতী র. ও তার ‘আল মাসাবীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন,

ان العلماء اختلفوا في عددها ولو ثبت ذلك من فعل النبي صلى الله عليه وسلم لم يختلف فيه

অর্থাৎ তারাবীর রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলেমগণের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। যদি এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ম থেকে প্রমাণিত থাকতো, তবে এ নিয়ে তারা দ্বিমত করতেন না। দ্র, পৃ ৪২।

আল্লামা ইবনে তায়মিয়া র.ও প্রায় একই ধরণের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন,

ومن ظن أن قيام رمضان فيه عدد معين موقت عن النبي صلى الله عليه وسلم لا يزاد فيه ولا ينقص فقد أخطأ

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মনে করবে রমযানের তারাবীর রাকাত সংখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত, এতে বাড়ানো কমানো যাবেনা, সে ভুল করবে। দ্র, মিরকাত।

এসব থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে, তারাবী সম্পর্কে নয়। ইমাম ইবনে তায়মিয়া র. যে ভুলের প্রতি ইংগিত দিলেন আলবানী সাহেব সেই ভুলেই পতিত হয়েছেন।

আমরা অবশ্য বলি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন-মেজায, রুচি-প্রকৃতি, আমল ও কর্ম সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে ভাল জানতেন। সুন্নতের প্রতি তাঁদের আসক্তি, সুন্নতকে সজিব রাখার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রণী ভূমিকা সকলেরই জানা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদেশই শুধু নয়, তাঁর ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন তাঁদের জীবনের বড় লক্ষ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে খুলাফায়ে রাশেদীন ছিলেন আরো অগ্রগামী। হযরত উমর রা. সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে নবী হওয়ার সুযোগ থাকলে উমরই হতো। তিনি আরো বলেছেন, আমার উম্মতে মুহাদ্দাস (যার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এলহাম হয়) থেকে থাকলে সে হবে উমর। তিনি আরো বলেছেন, উমর যে পথ ধরে চলে শয়তান সে পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ দিয়ে চলে। এই তিনটি হাদীসই বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে।

অন্যদিকে বেদ’আত বা নব-উদ্ভাবিত আমল ও কর্মের প্রতি সাহাবীগণের ঘৃণা ও অসন্তোষ ছিল চরম পর্যায়ের। মুয়াজ্জিন আযান দিয়ে পুনরায় ডাকাডাকি করতে শুনে হযরত ইবনে উমর রা. সেই মসজিদ থেকে রাগে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেকে নামাযে সূরা ফাতেহার পূর্বে বিসমিল্লাহ জোরে পড়তে শুনে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রা. ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ছেলেকে সাবধান করে তিনি বলেছিলেন,

إياك والحديث في الإسلام

অর্থাৎ খবরদার ! ইসলামে নতুন কিছু উদ্ভাবন করোনা। এদুটি হাদীস তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে।

তামাত্তু হজ্জ সম্পর্কে জনৈক ব্যক্তি হযরত ইবনে উমর রা.কে একথা বললেন, আপনার বাবাই তো এটা করতে নিষেধ করেছেন। এর উত্তরে তিনি বলেছেন, মনে কর একটি কাজ সম্পর্কে আমার বাবা নিষেধ করছেন, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেইকাজ করেছেন, তবে তুমি কোনটি ধরবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমলটি নয়কি? (বুখারী শরীফ)

কুরআন সংকলনের ব্যাপারে যায়েদ ইবনে ছাবেত রা.কে দায়িত্ব দিতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন,

كيف تفعل شيئا لم يفعله رسول الله صلى الله عليه وسلم

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজ করেননি সে কাজ আপনি কিভাবে করবেন? কিন্তু হযরত উমর রা. তাঁকে ও আবূ বকর রা.কে বুঝিয়ে একাজটি করিয়ে নিয়েছেন। এটিকে কি আমরা বেদ’আতে উমরী বলবো?

এসব কথা বিবেচনায় রাখলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি তারাবী সম্পর্কে হয়ে থাকলে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে ২০ রাকাত পড়ার উপর ঐকমত্য হওয়া আদৌ সম্ভব হতোনা। অনুরূপ ভাবে ২০ রাকাতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন নির্দেশনা না থাকলে তাও তাদের পক্ষে পড়া সম্ভব হতোনা। কেউ না কেউ অবশ্যই প্রতিবাদ বা আপত্তি করে বসতেন। আমার উম্মত গোমরাহীর উপর একমত হবেনা- নবীজীর এ বাণী কে না শুনেছেন?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর রা. এর আমলে সাহাবীগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ হয়ে মসজিদে তারাবী পড়েছেন। উমর রা. যখন তাদের এক ইমামের পেছনে একত্রিত করতে চাইলেন, তখনই হযরত উবাই ইবনে কাব রা. আপত্তি করে বসলেন। মুসনাদে আহমদ ইবনে মানী’ ও জিয়া মাকদিসীর ‘আল মুখতারাহ’ হাদীস গ্রন্থদ্বয়ে আবূল আলিয়া র. থেকে বর্ণিত হয়েছে,

أن عمر أمر أبيا أ، يصلي بالناس في رمضان فقال: إن الناس يصومون النهار ولا يحسنون أن يقرأوا فلو قرأت القرآن عليهم بالليل فقال: يا أمير المؤمنين! هذا شيئ لم يكن فقال: قد علمت ولكنه أحسن فصلى بهم عشرين ركعة.

অর্থাৎ হযরত উমর রা. উবাই রা.কে রমযানে লোকদের নিয়ে নামায পড়তে আদেশ দিলেন এবং একথা বললেন যে, লোকেরা দিনভর রোযা রাখে, তারা সুন্দর ভাবে কুরআন পড়তেও পারেনা। তাই যদি আপনি রাত্রে তাদের সামনে কুরআন পড়তেন। তিনি তখন বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! একাজ তো ইতিপূর্বে হয়নি। তিনি বললেন, আমি তা জানি। তবে এটা উত্তম। এরপর উবাই রা. লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত পড়লেন। দ্র, আলমুখতারা, ১১৬১।

এ হাদীসের সনদ হাসান। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, জামাতে পড়ার ব্যাপারে তিনি আপত্তি করে বসলেন। কিন্তু বিশ রাকাতের ব্যাপারে তিনি কোন আপত্তি না করে বিনা দ্বিধায় বিশ রাকাত পড়িয়ে দিলেন। অথচ প্রথম বিষয়টি ছিল ব্যবস্থাপনাগত এবং শরীয়ওতের রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর দ্বিতীয় বিষয়টি শরীয়তের একটি বিধান। কোন নামাযের রাকাত সংখ্যা নিজের থেকে নির্ধারণ করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে যদি ৮ রাকাত পড়া নির্ধারিত থাকতো তাহলে তিনি স্বেচ্ছায়ও বিশ রাকাত পড়াতেননা। অন্য কেউ পড়াতে বললেও তিনি আপত্তি করে বলতেন, এ কাজ তো ইতিপূর্বে হয়নি, আমি কিভাবে করবো?

২নং দলিল:

عن أبي بن كعب أنه صلى في رمضان بنسوة في داره ثمان ركعات

অর্থ: হযরত উবাই ইবনে কাব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি রমযানে তার ঘরের মহিলাদের নিয়ে আট রাকাত পড়েছেন।

অনুরূপ আবূ ইয়ালায় বর্ণিত হযরত জাবির রা. এর হাদীস: জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন,

جاء أبي بن كعب إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال يا رسول الله إن كان مني الليلة شيئ يعني في رمضان قال: وماذا يا أبي؟ قال نسوة في داري قلن إنا لا نقرأ القرآن فنصلي بصلاتك قال : فصليت بهن ثمان ركعات ثم أوترت

উবাই ইবনে কাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! গত রাতে Ñ তার উদ্দেশ্য হলো রমযানে- আমার থেকে একটি ব্যাপার ঘটে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উবাই! সেটা কি? তিনি বললেন,আমার ঘরের নারীরা বললো যে, আমরা তো কুরআন পড়তে পারিনা (অর্থাৎআমাদের কুরআন মুখস্থ নেই)। তাই আমরাও তোমার পেছনে নামায পড়বো। আমি তাদের নিয়ে আট রাকাত পড়লাম। এবং পরে বিতরও পড়লাম।

এ হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে বন্ধুদের কয়েকটি ভুল তুলে ধরছি। বুখারী শরীফের টীকায় তারা হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। সেখানে ركعات শব্দের স্থলে তারা লিখেছেন ركعة । প্রথম শব্দটি বহুবচন। দ্বিতীয়টি একবচন। হাদীসটির অনুবাদে তারা ৩টি ভুল করেছেন। এক, ‘রমযানের রাত্রিতে’ কথাটি তারা জুড়ে দিয়েছেন, যা মূল হাদীসে নেই। দুই, ব্র্যাকেটে তারা ‘তারাবী’ কথাটি জুড়ে দিয়েছেন, এটিও মূল হাদীসে নেই। তিন, এর পরের ভুলটিতো পুরো জালিয়াতি। ‘পড়েছেন’ স্থলে তারা লিখেছেন, ‘আদায় করতেন’। ‘পড়েছেন’ বললে বোঝা যায় কোন একবারের ঘটনা। আর ‘পড়তেন’ বা ‘আদায় করতেন’ বললে বোঝা যায়, এটা তার নিয়মিত আমল ছিল। ৫ম ভুল করেছেন এই বলে যে, ‘আব্দুল্লাহ বলেন’। সঠিক হবে ‘জাবির রা. বলেন’।

এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। এ হাদীসটি আবূ ইয়ালা র. তার মুসনাদে (১৭৯৫) , মুহাম্মদ ইবনে নাসর র. তার ‘কিয়ামুল লাইলে’ (পৃ ৯০) , তাবারানী তার ‘আওসাতে’ (৩৭৩১) ও আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ তার ‘যাওয়ায়েদে মুসনাদে আহমদে’ (৫/১১৫ Ñ ২১৪১৫) উদ্ধৃত কনেছেন। হায়ছামী র. আবূ ইয়ালার শব্দে মাজমাউয যাওয়ায়েদে (২/১৭৯) এটি উল্লেখ করেছেন। সকলে একই সনদে বা সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই হাদীস যয়ীফ, এটি প্রমাণযোগ্য নয়। কারণ:

ক. এর সনদে ঈসা ইবনে জারিয়া আছেন, তিনি যয়ীফ। তার হাদীস প্রমাণযোগ্য নয়। তার সম্পর্কে ইবনে মাঈন র. বলেছেন, ليس حديثه بذاك অর্থাৎ তার হাদীস মজবুত নয়। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, ليس بشيئ অর্থাৎ তিনি কোন বস্তুই নন। অপর এক বর্ণনায় আছে عنده مناكير অর্থাৎ তার নিকট আপত্তিকর বর্ণনা আছে। ইমাম নাসায়ী ও আবূ দাউদ র. বলেছেন, منكر الحديث অর্থাৎ তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। অপর এক বর্ণনায় ইমাম নাসায়ী বলেছেন متروك الحديث অর্থাৎ তার হাদীস বর্জনযোগ্য। ইবনে আদী বলেছেন, أحاديثه غير محفوظة অর্থাৎ তার হাদীস সঠিক নয়। সাজী র. ও উকাইলী র. তাকে যয়ীফদের কাতারে গণ্য করেছেন। ইবনুল জাওযী র.ও তাকে যয়ীফ বলেছেন। (দ্র. তাহযীব ও মীযানুল ইতিদাল)

এই সাতজনের সমালোচনার বিপরীতে শুধু আবূ যুরআ র. বলেছেন, لا بأس به অর্থাৎ তাতে কোন অসুবিধা নেই। আর ইবনে হিব্বান তাকে ‘সিকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে ব্যাখ্যা সম্বলিত র্জাহ বা সমালোচনা অগ্রগন্য হয়ে থাকে। ফলে ঈসা যয়ীফ প্রমাণিত হন। বিশেষত নাসায়ী ও আবূ দাউদ র. যে বলেছেন ‘মুনকারুল হাদীস’- এটি সম্পর্কে খোদ মোবারকপুরী সাহেব সাখাবী র. এর উদ্ধৃতিতে বলেছেন, منكر الحديث وصف في الرجل يستحق به ترك حديثه অর্থাৎ ‘মুনকারুল হাদীস’ হওয়া ব্যাক্তির এমন একটি দোষ যার কারণে তিনি এর উপযুক্ত হন যে তার হাদীস গ্রহণ করা হবেনা। (দ্র, ইবকারুল মিনান)

এসব কারণেই ইবনে হাজার ‘তাকরীবে’ তার সম্পর্কে বলেছেন, فيه لين তার মধ্যে দুর্বলতা আছে। সুতরাং হায়ছামী ও আলবানী সাহেব হাসান বললেই এটা হাসান হয়ে যাবেনা।

খ. এ হাদীসের কোথাও তারাবীর কথা নেই। সুতরাং এর দ্বারা আট রাকাত তারাবী প্রমাণ করার চেষ্টা হবে ব্যর্থ চেষ্টা । মহিলাদের নিয়ে ঘরে নামায পড়া ঘেকে তাহাজ্জুদ পড়ার কথাই সাধারণভাবে বুঝে আসে।

গ. তারাবী সংক্রান্ত ঘটনা হওয়া তো দূরের কথা, এটাকে রমযানের ঘটনা প্রমাণিত করাও মুশকিল। কারণ এই হাদীস মুসনাদে আহমাদে ও তাবারানীর আওসাত গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, সেখানে রমযানের কোন কথাই নেই। আর মুসনাদে আবূ ইয়ালায় বলা হয়েছে, يعني في رمضان অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য হলো, রমযানে। একথাটি নিশ্চয়ই হযরত জাবির রা. বা ঈসা ইবনে জারিয়া কিংবা অন্য কেউ বলেছেন। এমতাবস্থায় মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এটি মুদরাজ বলে বিবেচিত হবে এবং প্রমাণযোগ্য থাকবেনা। অবশ্য ‘কিয়ামুল লাইলে’র বর্ণনায় আছে,

جاء أبي بن كعب في رمضان فقال يا رسول الله الخ

অর্থাৎ হযরত উবাই ইবনে কাব রমযানে আসলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ÑÑÑÑ। উপরোক্ত বর্ণনাগুলোর আলোকে অনুমিত হয় যে এটা বর্ণনাকারীর হস্তক্ষেপে ঘটেছে। নতুবা একথা বলা অনিবার্য হবে যে, ঈসা ইবনে জারিয়া কখনো রমযানে আসার কথা বলেছেন; কখনো বলেছেন, তার উদ্দেশ্য হলো রমযানে; আবার কখনো তিনি রমযানের প্রসঙ্গই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এতে করে তার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতাই বেশী করে প্রমাণিত হবে। কেননা হাদীসটি কেবল তার সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া কিয়ামুল লাইলের সনদে মুহাম্মদ ইবনে হুমায়দ রাযী আছেন। ইমাম বুখারী তার সম্পর্কে বলেছেন فيه نظر অর্থাৎ তার ব্যাপারে আপত্তি আছে। ইবনে হাজার বলেছেন, حافظ ضعيف অর্থাৎ দুর্বল হাফেজে হাদীস। যাহাবী র. ‘কাশেফ’ গ্রন্থে বলেছেন, الأولى تركه অর্থাৎ তাকে বর্জন করাই শ্রেয়। সুতরাং ‘রমযানে আসলেন’ কথাটি তার বৃদ্ধিও হতে পারে।

ঘ. হাদীসটি যে প্রমাণযোগ্য নয় তার একটি প্রমাণ এও হতে পারে, এটি সহীহ হয়ে থাকলে হযরত উমর রা. এর আমলে হযরত উবাই রা. যখন তারাবীর ইমাম হলেন, তখন তিনি আট রাকাতই পড়াতেন। অথচ পেছনে বহু সূত্রে আমরা প্রমাণ করে এসেছি, তিনি বিশ রাকাতই পড়িয়েছেন।

৩নং দলিল: হযরত জাবির রা. বলেন,

صلى بنا رسول الله صلى الله صلى الله عليه وسلم في رمضان ليلة ثمان ركعات والوتر فلما كان من القابلة اجتمعنا في المسجد ورجونا أن يخرج إلينا فلم نزل فيه حتى أصبحنا إلى آخر الحديث

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে রমযানে আট রাকাত ও বিতর পড়লেন। পরের রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হলাম এবং আশা করলাম তিনি বেরিয়ে আমাদের কাছে আসবেন। কিন্তু সকাল পর্যন্ত আমরা মসজিদে (অপেক্ষা করতেই) থাকলাম। (অর্থাৎ তিনি আর বের হননি)।

এ হাদীসটিও যয়ীফ, প্রমাণযোগ্য নয়। কেননা এর সনদেও ঐ পূর্বোক্ত ঈসা ইবনে জারিয়া আছেন। তাছাড়া এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, এটা কেবল এক রাতের ঘটনা ছিল। যেহেতু সে সময় তারাবী নামায জামাতের সঙ্গে পড়ার প্রচলন ছিলনা, তাই এই হাদীসকে সহীহ ধরে নিলেও এই সম্ভাবনা থাকে যে, অবশিষ্ট নামায জামাত ছাড়া একাকী পড়ে নেওয়া হয়েছে। আর এটা নিছক অনুমান নয়। মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রা. এর এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তারাবীতে শরীক হওয়ার একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন,

ثم صلى صلاة لم يصلها عندنا

অর্থাৎ এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হুজরায় গিয়ে ) কিছু নামায পড়েছেন যা আমাদের নিকট পড়েননি। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১১০৪

ঈসা ইবনে জারিয়া বর্ণিত হাদীসটি সঠিক না হওয়ার আরো একটি কারণ এই যে, সহীহ হাদীস সমূহে একাধিক সাহাবী কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তারাবী পড়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা রা. এর বর্ণনা বুখারী (৯২৪) ও মুসলিমে (৭৬১) উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত আনাস রা. এর বর্ণনা মুসলিম শরীফে (১১০৪), হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রা. এর বর্ণনা বুখারী (৭৩১) ও মুসলিমে (৭৮১) উদ্ধৃত হয়েছে। আবূ যর রা. এর বর্ণনা আবূদাউদ (১৩৭৫) ও তিরমিযী শরীফে (৮০৬) উদ্ধৃত হয়েছে এবং নুমান ইবনে বাশীর রা. এর বর্ণনা নাসায়ী শরীফে (১৬০৬) উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু তাদের কারো বর্ণনাতেই রাকাত-সংখ্যার উল্লেখ আসেনি। এসেছে শুধু হযরত জাবির রা. এর বর্ণনায়। তাও ঈসা ইবনে জারিয়ার মতো দুর্বল বর্ণনাকারীর সূত্রে।

আলোচনার এ পর্যায়ে লরামাযহাবী বন্ধুদের আরেকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। তারা আমাদের হানাফী ও অন্যান্য কিছু আলেমের মতামত উল্লেখ করে বোঝাতে চেয়েছেন, এঁরাও তাদের সঙ্গে একমত। সর্বপ্রথম তারা আব্দুল হক দেহলভী র. এর কথা এনেছেন, কিন্তু তাঁর কোন গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেননি। অথচ তিনি তার ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন,

والذي استقر عليه الأمر واشتهر من الصحابة والتابعين ومن بعدهم هو العشرون

অর্থাৎ ২০ রাকাত তারাবীই সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও পরবর্তী আলেমগণ থেকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং এটাই শেষ পর্যন্ত বহাল হয়েছে।

২য় নম্বরে তারা ইবনুল হুমাম র. এর নাম উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি বলেছেন, ৮ রাকাত নবীজীর সুন্নত আর ২০ রাকাত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত। সেটার অনুসরণের তাগিদ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই দিয়ে গেছেন। ২০ রাকাতের আমল হযরত উমর রা. এর যুগ ধেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসছে।

৩য় নাম এসেছে কাশ্মীরী র. এর ‘আল আরফুশ শাযী’ ( তারা লিখেছেন, উরফুশ শাযী, এটা ভুল) গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে। এটি কাশ্মীরী র. রচিত কোন কিতাব নয়। বরং তাঁর ক্লাসের আলোচনা এক ছাত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে এতে কিছু ভুল-ভ্রান্তিও ঘটে গেছে। কাশ্মীরী র. বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফায়যুল বারী’তে বলেছেন, আহলে হাদীস নামধারীদের উচিৎ সেহরী খাওয়া ছুটে যাওয়ার আশংকা হয়, এমন সময় পর্যন্ত ( অর্থাৎ সারারাত) তারাবী পড়া। কেননা এটাই নবীজীর সর্বশেষ আমল ছিল। কিন্তু যারা আট রাকাত পড়ে উম্মতের ‘সাওয়াদে আযম’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এমনকি তাদের উপর বেদআতের দোষ আরোপ করে, তাদের উচিৎ নিজের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করা। (দ্র, ৩খ, ১৮১পৃ)

৪র্থ নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোল্লা আলী কারী র. এর । কিন্তু যে বক্তব্যটি পেশ করা হয়েছে সেটি মূলতঃ ইবনুল হুমাম র. এর । কারী সাহেব এর পূর্বে ইবনে তায়মিয়া রা. এর কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, যারা মনে করে এগারো রাকাতের বেশী পড়া যাবেনা, তারা ভুল করবে। আবার ইবনুল হুমাম র. এর বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর কারী সাহেব ইবনে হাজার মক্কী র. এর একথাও উদ্ধৃত করেছেন যে, ২০ রাকাত তারাবীর উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসব থেকে তারা শুধু নিজেদের মতলবের কথাটিই উল্লেখ করেছেন।

পঞ্চম উদ্ধৃতি তারা দিয়েছেন ইবনে হাজার আসকালানী র. এর । তিনি নাকি বলেছেন, ২০ রাকাতের হাদীস সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ায় তা বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়। এ হলো লা-মাযহাবীদের আরেক জালিয়াতি । ইবনে হাজার র. আবূ শায়বা বর্ণিত মারফূ হাদীসে যে বিশ রাকাতের উল্লেখ এসেছে, সে সম্পর্কে বলেছেন, এটা হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। ‘তা বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়’ কথাটি বন্ধুরা নিজেদের পকেট থেকে যোগ করেছেন। (দ্র, ফাতহুল বারী, ৪/৩১০Ñ হাদীস নং ২০১৩) এর পূর্বে ইবনে হাজার রা. ৩০৮ পৃষ্ঠায় ১১,১৩ ও ২০ রাকাত তারাবী সম্পর্কিত বর্ণনাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে বলেছেন বিশ রাকাত শেষ আমল ছিল।

ইবনে হাজার র. এর উপরোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর তারা লিখেছেন, একই ধরণের মন্তব্য করেছেন ইমাম নাসায়ী ‘যু’আফা’ গ্রন্থে, আল্লামা আইনী হানাফী র. ‘উমদাতুল কারী’ গ্রন্থে, আল্লামা ইবনে আবেদীন ‘হাশিয়া দুররে মুখতার’ গ্রন্থে এবং অন্যান্য বহু মনীষীগণ।

এ হলো তাদের জালিয়াতির আরেকটি দৃষ্টান্ত। নাসায়ী র. যু’আফা গ্রন্থে অনুরূপ কোন কথাই বলেননি। তিনি শুধু ২০ রাকাতের মারফূ হাদীস বর্ণনাকারী আবূ শায়বাকে মাতরূক বলেছেন। এতেই যদি ঐ বক্তব্য অনিবার্য হয়, তবে আমরাও তো বলতে পারি হযরত জাবির রা. এর আট রাকাতের হাদীসটি সম্পর্কে নাসায়ী র. বলেছেন, এটি বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়। কেননা তিনি এর বর্ণনাকারী ঈসা ইবনে জারিয়া সম্পর্কেও মাতরূক বলেছেন।

আল্লামা আইনী র.ও উমদাতুল কারী গ্রন্থে অনুরূপ কোন বক্তব্য দেননি। তিনি বরং বিশ রাকাতকেই দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে প্রাধান্য দিয়েছেন। এমনকি হযরত উমর রা. এর যুগে ২০ রাকাত তারাবীর উপর সাহবায়ে কেরামের ইজমা বা ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছেন। সর্বশেষ ইবনে আবেদীন র. এর হাশিয়া দুররুল মুখতারের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, এটা তো রীতিমত তার উপর মিথ্যারোপ। তিনি বরং স্পষ্ট বলেছেন,

)وهي عشرون ركعة ) هو قول الجمهور وعليه عمل الناس شرقا وغربا .

وعن مالك ست وثلاثون . وذكر في الفتح أن مقتضى الدليل كون المسنون منها ثمانية والباقي مستحبا ، وتمامه في البحر ، وذكرت جوابه فيما علقته عليه . ٢/٤٩٥

অর্থাৎ তারাবী বিশ রাকাত। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এটাই। পূর্ব-পশ্চিমে এ অনুসারেই মানুষের আমল। হযরত মালেক র. এর মত হলো ৩৬ রাকাত। ফাতহুল কাদীর গ্রন্থে বলা হয়েছে, দলিল প্রমাণের দাবী হলো ৮ রাকাত মাসনূন হওয়া ও বাকী রাকাতগুলো মুস্তাহাব হওয়া। এর পূর্ণ বিবরণ ‘আল বাহরুর রায়েক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের টীকায় (অর্থাৎ মিনহাতুল খালেক- এ ) আমি এ কথার জবাব লিপিবদ্ধ করেছি। (দ্র, ২খ, ৪৯৫পৃ)

তার মানে যিনি এত মজবুত ভাবে ২০ রাকাত তারাবী প্রমাণ করছেন, এমনকি ইবনুল হুমামের মতটিও খন্ডন করছেন, তার প্রতিই তারা এমন কথা আরোপ করছেন যে, তিনি বলেছেন, বিশ রাকাত বিনা দ্বিধায় বর্জনীয়। একই ভাবে আলবানীর অনুসরণে তারা ইমাম শাফেয়ী র. ও ইমাম তিরমিযী র. সম্পর্কে বলেছেন, তারা নাকি হযরত উমর রা. এর বিশ রাকাত তারাবীর হাদীসকে দুর্বল বর্ণনা বলেই নির্দেশনা দিয়েছেন।

অথচ তারা কোথাও অনুরূপ নির্দেশনা দেননি। এ আজব তথ্যটি আলবানী সাহেব আবিষ্কার করেছেন তাঁদের একটি কথা থেকে। তাঁরা বলেছেন, روي عن عمر অর্থাৎ হযরত উমর থেকে বর্ণিত। ব্যাস, এটাকেই তিনি ধরে নিয়েছেন দুর্বল বলেই নির্দেশনা দেওয়া। অথচ স্বয়ং তিরমিযী র. সহীহ বর্ণনার ক্ষেত্রেও ঐ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। দ্র, হাদীস নং ১২৪, ১৭৮, ১৮৪।









































মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.