নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পর্ব - ১
পর্ব - ২
পর্ব - ৩
চার
সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পুকুর ঘাটে কাছাকাছি আসতেই জোড়া নারিকেল গাছে চোখ চলে গেল মারুফের। সন্ধ্যা হতে এখনো কিছুটা সময় বাকী। দুপুরে হালকা বিশ্রাম নেবার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবুও দিনের আলো থাকতে থাকতে বের হতে পেরে খানিকটা ভালো লাগলো। মতিন মিয়া জোড়া নারিকেল গাছের হেঁটে যাবার যে অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে তা নিজের চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারেনি সে। তাই গ্রাম ঘুরে দেখার ইচ্ছা থাকলেও প্রথমেই এখানে চলে এসেছে।
পুকুর পাড়ে এসে মতিন মিয়াকে পেল। সে ঘাটের নীচের দিকের সিঁড়িতে বসে বিড়ি ফুঁকছে। ওর বিড়ি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো মারুফ। তারপর হাঁক দিল, মতিন সাহেব নাকি?
অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মতিন মিয়া হকচকিয়ে গেল, বিশেষ করে নামের সাথে সাহেব জুড়ে কেউ কখনো ডাকে না ওকে। ঘাড় ঘুড়িয়ে শহুরে মেহমানকে দেখে খানিকটা স্বস্তি বোধ করলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। বললো, ভাইজান গাছ দেখতে আইছেন?
- গাছ দেখতেই তো এলাম।
- এই রকম আচানক ঘটনা বারংবার ঘটে না।
মারুফ কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নীচে নামলো। পুকুরের প্রায় মাঝামাঝি নারিকেল গাছ জোড়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কেউ সাঁতার কাটতে কাটতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলে গাছের শরীর ধরে কিছুক্ষণ ভেসে থাকতে পারবে, তারপর বুক ভরে দম নিয়ে পাড়ের দিকে রওয়ানা দেবে। গাছ দুটো দেখে খানিকটা বিস্মিত হলেও মতিন মিয়ার দেয়া গাছ হেঁটে যাবার বর্ণনা সে বিশ্বাস করে না। সম্ভবত গাছের নিচের মাটি সরে গিয়ে পুকুরের ঢাল বেয়ে পিছলে নীচে চলে গেছে। গাছ দুটো যদি পানিতে পড়ে যেত তাহলে আর অলৌকিক গল্পের জন্ম নিতো না, কেউ এই নোংরা পানিকে কুসংস্কারবশত চিকিৎসার পথ্যও মনে করতো না। বড়োই অদ্ভুত মানুষের মনোজগত, সে যে কী বিশ্বাস করবে তা নিজেই জানে না! একই ঘটনাকে অনেক ভাবে বর্ণনা করা যায়, তবে যে বর্ণনাটা সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাস্য মনে হবে মানুষ সেটাই সহজে বিশ্বাস করবে। অবিশ্বাস্য গল্পকে বিশ্বাস করার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে আর দুর্বল মানুষেরা সেটা খুবই পছন্দ করে।
ওর হঠাৎ খেয়াল হলো, মতিন কি চলে গেছে? ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে গাছের দিকে কিংবা বলা যায় স্পষ্টভাবে কোনো কিছুই দেখছে না সে। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে অথচ বাঁচাল মানুষটা কোনো কথা বলেনি। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঠেকলো না। বললো, কী ব্যাপার মতিন সাহেব? সব ঠিক তো?
- সব ঠিকঠাকই ছিল, তয় মনটা ভালা না।
মারুফ কিছু বললো না। সে আবার বললো, পরিবারের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে।
- মনোমালিন্য হলো কেন?
- পরিবার সকালে কইছিল নুন কিনতে। আমি তো ভাইবা নিছলাম- ঘরে নুন আছে, হেয় ঘর থাইকা বাইর হওনের লাইগা নুনের কথা কইতে আইছে। যোহরের সময় নুন খরিদ কইরা ঘরে গেছি। হেরে না কইয়া আগেই সরায় রাখছিলাম। খাওনের সময় কইলাম, তরকারীত নুন কম হইছে, নুন দে।
হেয় কইলো, তুমারে না নুন আনতে কইছিলাম, আনো নাই?
আমি কইলাম, নুন তো আনি নাই।
হেয় কইলো, নুন আনো নাই ক্যান?
কইলাম, তুই তো গেছস পাড়া বেড়াইতে, নুনের কথা তো কইতে যাইস নাই।
হেয় চেইতা গেল, কইলো, আমি পাড়া বেড়াইতে গেছি- এইডা তুমি কী কইলা? তুমার মুখে কুনো কতা আটকায় না। এই শরীল লইয়া আমি কি পাড়া বেড়াইতে যামু?
হেরপর আরো এক দুই কথায় মেজাজটা বিগড়ায়া গেল। খাওনটাও ঠিকমতন হইলো না। ভাইজান, বউটা আমার আটমাসের পোয়াতী, বেশি কিছু কইতেও পারি না।
- কাজটা কি ঠিক হলো?
- ঠিক হয় নাই বুঝবার পারছি।
- আপনার পরিবার কি দুপুরে খেয়েছে?
- হেয়ও খায় নাই।
- খুব খারাপ কথা। এসময় অবহেলা করা উচিত না। আপনি বাসায় যান। উনার খবর নিন। ভালো কথা, লবণ কি দিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত?
- নাহ, নুনও দেই নাই। ঘর থাইকা বাইর হইয়া গেছি।
মারুফ আর কিছু বললো না। প্রায় সদ্য পরিচিত একজন মানুষকে এরচেয়ে বেশি কিছু বলা যায় না। মতিন মিয়াও চলে গেল না। সে একটা বিড়ি বের করে জ্বাললো। মারুফের মনে হলো মতিনকে খানিকটা সময় দেয়া দরকার। সম্ভবত সে অপরাধবোধে ভুগছে। বরং এর মধ্যেই নিজের কাজ নিয়ে খানিকটা ভাবা দরকার। একটা সঠিক পরিকল্পনা করা হলো না, অথচ মাঠে নেমে পড়লো। কাজটা ঠিক হয়নি। দুই এক দিনের মধ্যে সবকিছু ফাইনাল করে ফেলতে হবে।
গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ওর মনে হলো, পুকুরের পাড় থেকে গাছ নেমে গেছে পানিতে, কিন্তু কোন পাড় থেকে? আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। গাছ দুটোকে পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে না, একটা আরেকটাকে প্রায় আড়াল করে রেখেছে। কাজেই ধরে নেয়া যায় যে, ডান বা বাম পাশের পাড়ে ছিল। ডান দিকে তাকাতেই দুইজন তরুণীকে পাড়ে হাঁটতে দেখলো। এদিকেই হেঁটে আসছে। মতিন মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বললো, মতিন সাহেব কোন্ পাড়ে গাছ দুটো ছিল?
ঐ পাড়ে- বলে মতিন মিয়া হাত তুলে ডান দিকের পাড়ে ইশারা করার জন্য তাকাতেই তরুণীদের দেখতে পেল।
মারুফ বললো, ওরা কারা?
- উনারা হইলেন, বড়ো আপামনি আর ছুডো আপামনি। চেয়ারম্যান সাবের দুই মাইয়া।
- ও আচ্ছা। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে মেয়ে কয়জন?
- এই দুইজনই। পোলা নাই, এই লইয়া চেয়ারম্যান সাবের মনে বড়োই দুঃখ।
- দুঃখ করার কিছু নেই। এখন তো ছেলে মেয়ে সবাই সমান। ছেলেরাও যা করতে পারে মেয়েরাও তাই করতে পারে।
- তা পারে। হেরপরেও গেরাম দেশে পোলা গো আলাদা একটা ডিমান্ড আছে না?
মতিন মিয়ার কথা শুনে হেসে ফেললো মারুফ। গ্রামের মানুষের চিন্তা ভাবনা এখনো বদলায়নি। বললো, আপনার স্ত্রী তো গর্ভবতী, জানেন নাকি ছেলে হবে, নাকি মেয়ে হবে?
- হে হে হে, এইডা আমি জানি ভাইজান। আমার হইবো- মাইয়া।
- কিভাবে জানলেন? নাকি ধারণা করে বললেন?
- ডাক্তার আপায় কইছে। গেল মাসে হেরে হাসপাতাল লইতে হইছিলো, তহন জানছি। আমার একটা মাইয়ার খুব সাধ আছিল।
- ডিমান্ড একটু কমে গেল না? গ্রাম দেশে তো মেয়েদের ডিমান্ড কম।
- আমার কতাই আমারে ফিরায়া দিলেন ভাইজান!
শব্দ করে হেসে উঠেলো মারুফ। বললো, না না, ফিরিয়ে দিই নি। আচ্ছা, এটা আপনার কি প্রথম সন্তান?
- জ্বে। দোয়া করবেন ভাইজান।
- অবশ্যই, অবশ্যই। আপনারদের গ্রামে কি হাসপাতাল আছে?
- না গেরামে নাই। তয় গঞ্জে আছে। এইহনা থাইকা পাঁচ ছয় মাইল হইবো। কমুনিটি হাসপাতাল। বাজার থাইকা যহন তহন ভ্যান পাওন যায়।
চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়েরা কখন কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা কেউ লক্ষ্য করেনি। রূপকথা বললো, মতিন ভাই, কেমন আছেন?
রূপকথার ডাকে ওরা সংবিৎ ফিরে পায়। মতিন মিয়া বললো, বড়ো আপামনি কেমুন আছেন? কখন আইছেন?
- ভালো আছি। গতকাল এসেছি। শুনলাম, আপনি নাকি এই আচানক ঘটনার সাক্ষ্যি, আপনার চোখের সামনেই ঘটনা ঘটেছে। কথা কি ঠিক?
মতিন মিয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। হাত কচলাতে কচলাতে বললো, জ্বে আপামনি কতা ঠিক।
- আপনি কি গাছকে হেঁটে যেতে দেখেছেন?
- জ্বে দেখছি।
- তাহলে তো গাছের পা দেখেছেন? গাছের পা দেখতে কেমন?
বড়ো আপামনির প্রশ্ন বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মতিন মিয়া। আপামনি বললো, বুঝেননি? আচ্ছা ধরুন, হেঁটে যেতে হলে তো পা থাকতে হয়। কমপক্ষে এক জোড়া পা না থাকলে তো কেউ ঠিক মতো হেঁটে যেতে পারবে না। তাই না?
- না মানে গাছের তো পা নাই।
- তাহলে আপনি গাছের পা দেখেননি?
মতিন মিয়া না-সূচক মাথা নাড়ে।
- আমি তো ভাবলাম, গাছের পা দেখতে কেমন তা জানা যাবে আপনার কাছে। পায়ের কথা ভেবে আমার তো ঘুমই হচ্ছিলো না। কিন্তু পা না থাকলে তো ওরা হেঁটে যেতে পারবে না। তারচেয়ে বরং ভেসে যেতে পারে, উড়ে যেতে পারে।
- হ, তা ঠিক।
- না ঠিক না। উড়ে যেতে হলে তো ডানা লাগবে। নাকি?
- তাও ঠিকই কইছেন।
বড়ো বোনের জেরা করা দেখে ছোট বোন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সে মতিন মিয়াকে বাঁচিয়ে দিয়ে বললো, মতিন ভাই, আপনি কেন বানিয়ে বানিয়ে এসব গল্প বলেন? আর বলবেন না। ঠিক আছে?
মতিন মিয়া কিছু বললো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। রূপকথা সিঁড়ি দিয়ে পানির কাছাকাছি নেমে গেল। মতিন মিয়া মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বললো, আপামনি আমি তো গল্প বানাই নাই। লোকে বলতাছে আর হেরাই মানতাছে।
চুপকথা মতিন মিয়ার কথার জবাব না দিয়ে মারুফের দিকে তাকালো। বললো, এই যে গবেষকভাই, আপনি কি বিজ্ঞানী?
এতক্ষণ সে ওদের কথোপকথন শুনছিল, হঠাৎ ওর দিকে যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হবে সেটা মারুফ ধারণা করতে পারেনি। বললো, আমাকে বলা হচ্ছে?
- হুম আপনাকেই বলছি। আপনি কি বিজ্ঞানী?
- কেন?
- গবেষণার কাজে এসেছেন শুনলাম। তাই ভাবলাম বিজ্ঞানী কিনা?
- না, ঠিক বিজ্ঞানী বলা যাবে না। আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বিজ্ঞানী হতে হলে সাইন্সের ছাত্র হতে হয়। আর আমি হলাম, আর্টসের ছাত্র।
- ও। তাহলে কাজ হবে না।
- বিজ্ঞানী দরকার? কাজটা কী?
- খুবই জটিল সমস্যায় পড়েছি। একটা আনস্মার্ট ফোনের টাইম চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে?
- আনস্মার্ট ফোন জিনিসটা আবার কী?
- বুঝলেন না? যেটা এন্ড্রোয়েড না।
- আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমও কিন্তু এন্ড্রোয়েড না।
- আইফোন না। বাটন ফোন।
- ও আচ্ছা। সমস্যা আরেকবার বলা যাবে?
- অবশ্যই যাবে। সমস্যা হলো, ফোনটার ঘড়ি প্রতিদিন চার পাঁচ মিনিট করে স্লো হয়ে যাচ্ছে। ট্রেডিশনাল ঘড়ির ক্ষেত্রে ব্যাটারীর পাওয়ার বা চার্জ কমে গেলে ঘড়ি স্লো হয়ে যায় কিন্তু মোবাইল ফোনের ব্যাটারীতে তো রেগুলার চার্জ দেয়া হয়, কমার সুযোগ নেই, তাহলে স্লো হয়ে যাচ্ছে কেন?
- সমস্যা আসলেই জটিল মনে হচ্ছে।
- আমি কেসটা যখন হাতে নিয়েছে তখন সমাধান করবোই ইনশাল্লাহ। কী বলেন?
মারুফ কিছু না বলে হাসলো। চুপকথা বললো, আপনার সাথে তো আমার পরিচয়ই হলো না অথচ কতক্ষণ বকবক করলাম। আমার নাম চুপকথা, সবাই ‘কথা’ বলেই ডাকে।
- খুবই সুন্দর নাম। কিসে পড়া হয়?
- ক্লাশ এইটে, এবার জেএসসি পরীক্ষা দেব। আপনি কী গবেষণা করেন?
- আমি একটা ডেমোগ্রাফিক সার্ভে করছি, এর ওপর ভিত্তি করে কয়েকটা রিপোর্ট করতে হবে। মূলত পিএইডির জন্য গবেষণাকর্ম।
- বাহ, ডক্টরেট! আপনি তো তাহলে নামের সামনে ডক্টর লাগিয়ে ফেলবেন।
- অনেকটা সেরকমই।
- আমারো খুব ইচ্ছা হায়ার এডুকেশন করার। বিদেশ যাওয়ার।
- উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে হবে কেন?
- না গেলেও হয় কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা বিদেশ যাবার। দেখুন, আমাদের গ্রামে একটা জুনিয়র হাইস্কুল আছে। মানে জেএসসি পাশ করলে আমি আর এখানে পড়তে পারবো না। আমার ইচ্ছা হলো গঞ্জের গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় গিয়ে এইচএসসি পড়া। তারপর স্কলারশীপ ম্যানেজ করে দেশের বাইরে।
- খুবই ভালো প্ল্যান।
সিঁড়িতে বসে পানিতে হাত ভেজাতে ভেজাতে রূপকথা বললো, ঐসব প্ল্যানে কাজ হবে না। ও খুবই গাধা ছাত্রী। ঠিকঠাক মতো ম্যাট্রিক পাশ করতে পারলেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।
চুপকথা বললো, ওরে আমার ভালো ছাত্রী রে! তোমাকে বলেছে? আপাতত নিজেরটা সামলাও।
- আমারটা নিয়ে আমি ভাববো। তুই টেনশন করিস না।
- কপালে বিদেশ থাকলে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমি নিশ্চিত আমার কপালে আছে।
সিঁড়ির কাছ থেকে কোনো প্রতিউত্তর আসলো না। মারুফ বললো, কপাল তো দেখা যায় না কিন্তু হাত দেখা যায়। অনেক সময় হাতের রেখা দেখেও বোঝা যায় বিদেশ ভ্রমণযোগ আছে কিনা!
চুপকথার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, আপনি হাত দেখতে পারেন?
মুচকি হেসে মারুফ বললো, বিজ্ঞানীদের হাত দেখতে পারা উচিত না কিন্তু আমি পারি।
ডান হাতটা সামনে পেতে দিয়ে চুপকথা বললো, দেখে দিন না?
- আরেক হাত লাগবে।
চুপকথা আরেক হাত তুলে ধরলো। মারুফ বললো, আরো কিছু তথ্য লাগবে। যেমন, জন্ম তারিখ।
- তেরোই এপ্রিল।
- প্রিয় রং?
- বেগুনী।
একটু সময় নিয়ে মারুফ হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে নিজেও জ্যোতিষশাস্ত্র বিশ্বাস করে না। পুরোপুরি ভাওতাবাজী মনে হয়। তবে একটু মাথা খাটিয়ে দুয়েকটা পরিভাষা ব্যবহার করে সহজেই অন্যকে বিভ্রান্ত করে দেয়া যায়, যেমনটা সে এখন করার চেষ্টা করছে। গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে তবে সামনের মানুষটি যেন শুনতে পায়ে সেভাবে বললো, মেষ রাশি! এই রাশির জাতকরা খুবই আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। এক যোগ তিন যোগ চার, মোট আট। আট একটা শুভ সংখ্যা! যদিও মেষের জন্য এক, চার, নয় সংখ্যা হিসেবে ভালো তবুও আট সবসময় প্রভাবিত করে।
চুপকথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে তবে ওর সব আগ্রহ বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত ভবিষ্যত বাণী শোনার প্রতি। সে বললো, বিদেশ কি যেতে পারবো?
- দেখছি।
- ইউরোপ?
- দেখছি। একটু সময় লাগবে। বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না, বয়স তো অনেক কম মনে হচ্ছে-
- মোটেই কম না। আপনি বলুন প্লিজ।
- বিয়ের আগে কোনো প্রেম আসার সম্ভাবনা কম। জোড়া ভুরুর একজন মানুষ জীবনে আসতে পারে, হতে পারে সে রুক্ষ মেজাজী। তবে অর্থকড়ির অভাব হবে না। আচ্ছা, কখনো কি এমন হয় যে, কোনো একটা কাজ করা খুব দরকার কিন্তু মন থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না? কিংবা কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে? সবচেয়ে বেশি সমস্যা হবার কথা- জামা কাপড় পছন্দ করার সময়? হয়তো দেখা গেল যে, এক ধরনের ডিজাইন পছন্দ করে দোকানে যাওয়া হলো কিন্তু সামনাসামনি দেখে সেটা আর পছন্দ হয় না।
- হ্যাঁ এমন তো হয়ই।
- এটা এক ধরনের দ্বন্দ্ব। চরিত্রে দ্বান্দ্বিকতার প্রভাব রয়েছে। কাজেই যেকোনো বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে কিংবা জানতে হবে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় ভেতরের সত্ত্বা দ্বান্দ্বিকতা তৈরি করবে। পড়ার প্রতি অনেক ঝোঁক, তাই না? গল্পের বই হতে পারে।
- জ্বী প্রচুর গল্পের বই পড়ি।
- রিসেন্টলি কারো সাথে কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য হয়েছে?
চুপকথা একটা ভাবলো, তারপর হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। বললো, আমার এক ক্লাশমেটের সাথে।
- শুক্রবার বিকেলে?
ও অবিশ্বাসী চোখে তাকালো। ব্যাপারটা মিলে গেছে ভেবে মারুফ খানিকটা স্বস্তি পেল। বললো, খুব সহজে কাউকে বিশ্বাস করে মনের কথা বলে দেয়া যাবে না, কারণ বন্ধু ভাগ্য মন্দ। প্রকৃত বন্ধু পাওয়াটা খুবই কঠিন হবে।
- আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই।
- কিন্তু আমার তো মনে হয় বন্ধু আছে। মা-বোন এরা কি বন্ধু হতে পারে না? অবশ্যই পারে।
- হু পারে। আপনি বিদেশ ভ্রমণের রেখাটা পেলেন?
- একটা কথা বলা দরকার, হস্তরেখা কিন্তু পরিবর্তনশীল!
- মানে?
- মানে আজকে রেখা যেদিকে আছে কাল যে সেদিকেই থাকবে ব্যাপারটা এমন নয়। অনেক কিছু প্রভাবক হিসেবে কাজ করে যেমন, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, পাথর ব্যবহার করার রীতি আছে, সবচেয়ে বড়ো প্রভাবক হলো- মানুষের চেষ্টা। হয়তো বিদেশ ভ্রমণ যোগ নেই কিন্তু নিজের চেষ্টায় সেটা অর্জন করা যেতে পারে।
- তাহলে বলতে চাইছেন যে, আমার বিদেশ ভ্রমণ লেখা নেই?
- উহু, তা বলিনি। বিদেশ ভ্রমণ যোগ আছে। বিদেশ ঘুরতে যাওয়া হতে পারে, কিন্তু কত সময় অবস্থান করা হবে তা তো বোঝা যায় না। এটা অনেকটা স্ববিরোধী।
চুপকথা হাত টেনে নিল। হস্তবিদ গবেষকের কথায় সে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারলো না। বললো, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো?
মারুফ কিছু বলার আগেই সিঁড়ির নীচের দিক থেকে ভেসে এলো, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে, যদি উনাকে বিশ্বাস করতে চাস তাহলে তোর বিদেশ যাওয়া নেই, আর যদি বিদেশ যেতে চাস তাহলে উনাকে বিশ্বাস করতে নেই! খুবই স্ববিরোধী কথা!
মারুফ বললো, অনেকাংশে ঠিক। নিজের চেষ্টা থাকাটাই বড়ো কথা।
রূপকথা মারুফের কথা শুনলো বলে মনে হলো না। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে উঠতে বললো, অন্ধকার হয়ে আসছে। ছোট, চল বাড়ি যাই।
দুই বোন পুকুরের শান বাঁধানো ঘাট ছাড়লো। চুপকথা কয়েক কদম এগিয়ে আবার ফিরে এলো, অন্যজন হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেও থেমে গেল না। ফিরে এসে মারুফের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি যা বললেন তা কি সত্যি?
- সত্য মিথ্যা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন।
- আমি একটা কথাও বিশ্বাস করি না।
- আমিও করি না।
- এসব তাহলে কিভাবে বললেন?
- এমনি এমনি বলেছি।
- এমনি এমনি? এমনি এমনি এসব বলা যায়?
মারুফ কিছু বললো না।
- তাহলে মিথ্যা মিথ্যি বলতেন, বিদেশ পড়াশুনা করতে যাবো!
- হুম তা বলা যেত। আচ্ছা পরেরবার বলবো।
- জ্বী না। সে সুযোগ আপনি পাবেন না।
মারুফ হাসলো। চুপকথা ঘুরে গটগট করে হাঁটা ধরলে মতিন মিয়া খুবই অবাক চোখে শহুরে আগুন্তককে জিজ্ঞেস করলো, ভাইজান, আপনে কি ডাক্তার?
জোড় কদম হেঁটে বোনকে ধরে ফেললো চুপকথা। বললো, দেখলে আপু, লোকটা বানিয়ে বানিয়ে কতগুলো কথা বললো! তোমার বিশ্বাস হয়?
- বিশ্বাস ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক।
- হেঁয়ালি কোরো না।
- তুই কি খেয়াল করেছিস- সে পুরো সময় ভাববাচ্যে কথা বলেছে?
- ইয়াল্লা, তাই তো!
- আমি তো ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত ভাববাচ্য চালিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু পারলো!
- লোকটা কিন্তু ভালোই!
- এতো সহজে ভালো বলা যাবে না।
- তোমার তো নাক উঁচু!
- সময় হলে তোর নাকও উঁচু হয়ে যাবে।
চুপকথা আরো কিছু একটা বলছিল কিন্তু ও সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে হু-হা বলে চালিয়ে দিল। মানুষটাকে নিয়ে ভাবছিলো, আর যাই হোক মানুষটা চাপা স্বভাবের না। ছোটর হাত দেখার নাম করে খানিকক্ষণ চাপাবাজী করলেও যথেষ্ট মিশুক। ছিপছিপে গড়নের, গোঁফ নেই, চশমাটাও বেশ মানিয়েছে। এরকম একজন মানুষকে সহজে অপছন্দ করা যায় না যদি অন্য কোনো সমস্যা না থাকে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, উনার গায়ে থেকে আঁশটে গন্ধ আসে না!
(চলবে)
ছবি: গুগলমামা।
০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:৫২
ফয়সাল রকি বলেছেন: হে হে হে, রাজীব ভাই আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, আমি মারুফ নই! তবে চেয়ারম্যান সাহেবের দুই মেয়ে।
মতিন চরিত্রটা আরেকটু সময় নিয়ে ভাবতে হবে আমাকে।
ধন্যবাদ।
২| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:৫৫
মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
ঘটনা মনে হয় অন্যদিকে বাক নিবে। প্রেমের দিকে। দেখা যাক কি হয়। মারুফকে বেশ লাগছে।
০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:০০
ফয়সাল রকি বলেছেন: টানা তিনটা পর্ব পড়ে মন্তব্য রেখে যাবার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো।
এই পর্বটা একটু বড়ো হয়ে গেছে। ভাবছিলাম দুইটা আলাপ পোষ্ট দিব কিনা!
পাঠকের ডিমান্ড অনুযায়ী ঘটনা বাঁক নিতেই পারে।
৩| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৯
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: ভালো লাগলো
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:১৪
ফয়সাল রকি বলেছেন: ধন্যবাদ আপু।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৪০
রাজীব নুর বলেছেন: মারুফ কি আপনি নিজে?
চেয়ারম্যান সাহেবের দুই মেয়ে। মাশাল্লাহ।
মতিন কে ঠিক বুঝতে পারলাম না।