নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শব্দকবিতা : শব্দেই দৃশ্য, শব্দেই অনুভূতি [email protected]

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

গতানুগতিক দুঃখ

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১১:০৯


সন্ধ্যা হলেই সারা বাড়ি ভরে লুকোচুরি খেলার ধুম পড়ে যেতো। পিয়ারীবুবু আমার ছোট্ট শরীরের সবটুকু তার বুকের ভেতর লেপ্টে পেলব হাতে আমার চোখ বাঁধতেন। পোলাপানেরা দৌড়ে কোনাকাঞ্চিতে লুকিয়ে চিকন ও লম্বা ‘টুউউউ’ শব্দ করলে বুবু আমাকে কোল থেকে ঠেলে দিয়ে বলতেন— ‘যা, ছু‌’। হাওয়ার বেগে ভোঁ ভোঁ ছুটে গিয়ে যে কাউকে ছুঁয়ে ফেললেই সে ‘গাভি’।
পিয়ারীবুবুর বিয়ে হয়ে গেলে অনেকদিন অমন মজা করে লুকোচুরি খেলা হলো না। পিয়ারীবুবুর বিরহে আমার খুব কান্না পেতো।
যুদ্ধের সময়ে পাখিবুবুরা গ্রামে চলে এলেন। আমাদের তখন কী অস্থির সময়; কিছু বুঝি, অনেকখানিই বুঝি না।
কিছুদিন পর আবারো আমাদের সন্ধ্যাগুলো মুখর হলো। আঁধার নামলেই তড়িঘড়ি জড়ো হই। পিয়ারীবুবুদের সেই ঘরের দাওয়ায়, যেখানে বুবু আমাকে খুব ঘনিষ্ঠ করে কোলে চেপে বসতেন, সেখানে এখন পাখিবুবু বসেন। বুবুর কাছে দৌড়ে ছুটে যাই ‘গাভি’ হবো বলে; কিন্তু তাঁর কৃপানজরে পড়ি না, ‘গাভি’ও হতে পারি না; ‘গাভি’ হতে কোনো গর্ব নেই, সবচেয়ে নিঃস্ব, অপারগ ও ছাপোষা পোলাপানই ‘গাভি’ হবার যোগ্যতা রাখে। ‘গাভি’ হবার যন্ত্রণা, কষ্ট ও বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি; ‘গাভি’র কোনো আনন্দ নেই; ‘গাভি’কে সবাই খাবলে-খামচে ঘা করে দেয়; আমি পিয়ারীবুবুর কোল থেকে লাফিয়ে নেমে একদৌড়ে সবাইকে তাড়া করেও কাউকে ছুঁতে পারি নি; আমি সারাজীবন খামচিখাওয়া ‘গাভি’ই হতে চেয়েছি।
একদিন ‘গাভি’ হবার বাসনায় পাখিবুবুর কোলে বসতে উদ্যত হতেই বুবু ভর্ৎসনা করে বলে উঠলেন, ‘বুইড়া পোলা...., যা সর্‌।’
পিয়ারীবুবুর জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। পাখিবুবুর জন্যও গোপনে গোপনে কেঁদেছি অনেকদিন। আমি ‘বুড়ো’ হতে হতে অনেক বড়ো হয়ে গেছি, বুবুরা আমাকে মনে রাখেন নি; আমিও তাঁদের ঠিকানা জানি না।
যে মেয়েটি আমাকে জীবনে প্রথম ফুল দিয়েছিল, আর অপূর্ব কিছু হাসি, ভাঙা কয়েকটি শব্দে একটা চিঠি, আর বলেছিল আমাকে তার ভালো লাগে, আমি তাকে সুদীর্ঘ কিছু চিঠি লিখে কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলাম। অনেক অনেক দিন পর ধলেশ্বরী নদীর তীর ধরে ধু-ধু দূরে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে মনে হয়েছিল— ওর নামই হতে পারে আফরোজা।
পারুল আপা একদিন অ্যালবাম ঘেঁটে আমার সবচেয়ে ফুটফুটে ছবিটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘এটা আমি নিলাম। ঘরে ঝুলিয়ে রাখবো, বুঝলি খোকা?’ আর আদর করে আমার নাক টিপেছিলেন। আমি তিনদিন চুরি করে পারুল আপার ঘরে ঢুকেছিলাম। আমার বুক আজও পুড়ে যায়। পারুল আপা আমায় ফাঁকি দিয়েছিলেন।
আরো একটা ঘটনা জীবনে প্রথম ঘটলো, এই সেদিন, এই অর্ধ প্রৌঢ়ে এসে। মহীয়সী বললেন, ‘আপনি চিরকালই আমার মন জুড়ে থাকবেন।’ ... তারপর তিনিও তাঁর কথা রাখতে পারেন নি।


নূরপুর মাঠে পৌষসংক্রান্তির মেলা। সারা বছরের সমস্ত সাধ জমা করে রাখি, কবে আসবে পৌষসংক্রান্তির দিন। তুমুল ঘোড়দৌড়, পাগলা ষাঁড়ের তেঁজ, মুরলি-চানাচুর— কী যে নেশা।
মেলার দিন ভোর হতেই অস্থির হয়ে উঠি। পাড়ার সাথিরা মিলে জটলা করি, সময় কাটে না কখন বিকেল হবে।
আবুল, নুরু, জসিম, আরো অনেকে। আমি দুপুর হতে না হতেই প্রস্তুত হয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করি।
‘নু, যাবি না?’ আমি, আবুল আর নুরুকে তাড়া দিই।
নুরুদের গরুগুলো তখনো চকের ক্ষেতে ঘাস খায়; আবুলেরও দেরি হয়ে যায় কী কারণে জানি না। আমি ওদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দুয়ারে অস্থির পায়চারি।
আবুল আর নুরু, ... ওরা কখন আমাকে ফেলে মেলায় চলে যায়, আমাকে ডাকেও না।


ছোটো খালা আমাকে খুব আদর করতো ছোট্টবেলায়। প্রতিবারই আমাদের বাড়িতে আসবার কালে কোঁচড়ভর্তি মোয়া আর রঙ্গিন নেবুনচুষ নিয়ে আসতো আমার জন্য। নানাবাড়িতে গেলে সারাদিন আমাকে নিয়েই মেতে থাকতো ছোটো খালা। আমি ছোটো খালার কলজের টুকরো ছিলাম।
ছোটো খালার বিয়ে হয়ে গেলে বেশি সময় আমি খালাদের বাসায়ই থাকতাম। খালা আমাকে কত আদর করতো!
আমার খালাতো ভাইবোনেরা বড়ো হতে হতে খালার আদর কমতে থাকলো না।
একদিন খালা আমাকে খুব কষ্ট দিল। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ে গেলো। খালা তা বুঝলো না বলে আমার বুক ফেটে যেতে থাকলো। খালু সেদিন বাজার থেকে অনেক বড়ো একটা ইলিশ মাছ এনেছিল। ডিমে ইলিশটার পেট ভর্তি ছিল। ডিম আমার অনেক ভালো লাগে। সব ভাইবোন মিলে খেতে বসলাম। খালা দু টুকরো ডিম দু খালাতো ভাইবোনের পাতে তুলে দিয়ে আমাকে দিল পিঠের কাঁটাঅলা মাছটা। আমি মনে মনে খুব কেঁদেছিলাম। আমি তো খালার হাতের ডিমের টুকরো চাই নি, খালা আমার কথা আর আগের মতো ভাবে না— কেবল এটাই আমার বুকে তোলপাড় ঢেউ তুলতে লাগলো।
এরপর খালার আদর ভুলে যেতে থাকলাম।


গালিমপুরে আমার এক ধর্মবোন থাকতো। পাখির মতো তার কণ্ঠে ‘ভাইয়া’ ডাকটি কী যে ভালো লাগতো! আমার জন্য সে জান দিত।
একদিন বিকেলে না বলে-কয়ে হীরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি মহাধুমধাম। হীরার ছেলের মুসলমানি। অনেক আত্মীয়স্বজন। আমাকে দেখে হীরা যে বেজার হলো তা নয়, তবে আন্দাজ করলাম সে বিব্রত হয়েছে; এমন একটা উপলক্ষ্যে আমাকে দাওয়াত করে নি, হয়ত সেজন্য।
খেতে বসে আমাকে দেখে কেউ একজন ‘এই কুটুমকে ঠিক চিনতে পারলাম না’ বললে হীরা শুকনো স্বরে যখন জানালো, ‘উনাদের বাড়ি পদ্মার পাড়ে’, আমি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সে এখনই বলবে, ‘উনি আমার অতি প্রিয় বড়ো ভাইয়া’। আমি আরো ভাবছিলাম, এই বুঝি হীরা অন্তত ‘ভাইয়া’টুকু সম্বোধনে ডেকে উঠে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে, আমি এ বাড়িতে অতি সম্মানীয় একজন, নিদেনপক্ষে অপ্রত্যাশিত কেউ নই।
ধর্মবোনের কথাও আমাকে ভুলে যেতে হয়েছে।

২৮ এপ্রিল ২০১০

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১১:৫৩

শায়মা বলেছেন: পুরানো সে দিনের কথা..

০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১২:৫৫

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: জি বুবু, অনেক অনেক আগের কথা।

২| ০১ লা মার্চ, ২০২২ ভোর ৬:২৮

সোহানী বলেছেন: এটা কি আগে পড়েছিলাম? খুব পরিচিত মনে হচ্ছে লিখাটা।

০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:০০

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: :)

জি আপু, আপনি আগেও পড়েছিলেন :) আবার পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

৩| ০১ লা মার্চ, ২০২২ সকাল ৯:৫২

জুল ভার্ন বলেছেন: বাহ! খুব ভালো লাগলো!

০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:০১

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ জুল ভার্ন ভাই। শুভেচ্ছা।

৪| ০১ লা মার্চ, ২০২২ সকাল ১১:৫৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: জীবনটা কেন যেন এমনই। আমার জীবনে সত্যিকার এমন কিছু চরিত্র ছিলো, কিভাবে যেন তারা হারিয়ে গেল, তাদের স্নেহ ভালোবাসা হারিয়ে গেল, হয়তো বা আমি হারিয়ে গেলাম তাদের জীবন থেকে।

এই লেখা আগে পড়া হয় নাই। লেখায় ভালোলাগা রইলো ++++

০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:০৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: জীবনে কত মান-অভিমানের ঘটনা ঘটে, কত স্নেহমমতাদায়িনীরা হারিয়ে যান- সব মিলিয়ে জীবন - কখনো বেদনা, কখনো সুখ। একসময় এগুলো হয়ে ওঠে স্মৃতিরোমন্থনের অনুষঙ্গ।

পোস্ট পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

৫| ০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১২:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: আমি অনেকটা এভাবেই জীবনকে সহজ করে নিয়েছিলাম। কারো কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে। কাউকে ক্ষমা করে দিয়ে।

মির্জা গালিব।

০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:০৮

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: মির্জা গালিব সুন্দর কথা বলেছেন।

৬| ০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১২:৫০

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
আহা! কি বেদনা এমনি করেই বুঝি সবাই ছেড়ে চলে যায়, চলে যেতে হয়.............।

+++

০১ লা মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:১৪

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: হ্যাঁ, একসময় সবাই ছেড়ে যায়। যা রয়ে যায় তা হলো স্মৃতি। ধন্যবাদ মাইদুল ভাই।

৭| ০১ লা মার্চ, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩০

জটিল ভাই বলেছেন:
স্মৃতি তুমি বড় বেদনাময়.......

০১ লা মার্চ, ২০২২ রাত ১১:১৯

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: কিন্তু সেই বেদনাও খুব মধুর হয়ে ওঠে একসময়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.