নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
শাহনাজ যখন আমাকে ফোন করলো, তখন ওর ওখানে দুপুর একটা, আর আমি সবে রাত ১১টা পার করলাম।
- ‘হ্যালো, তুই কে?’ আমি আমার গতানুগতিক প্রশ্ন করতেই শাহনাজ হেসে দিয়ে ওর গতানুগতিক জবাব দেয়- আমারে চিনবি না রে
‘হ্যালো, তুই কে?’ - এটা আমার খুবই প্রিয় একটা প্রশ্ন। আমার অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, এমনকি শ্যালক-শ্যালিকারাও যখন আমাকে ফোন করে, কল রিসিভ করেই প্রশ্নটা করি - ‘হ্যালো, তুই কে?’ এটা ওদের সদাশয় বদান্যতা যে, দিনের পর দিন আমার এই প্রশ্নটা শুনেও ওদের কাছে কখনো একঘেঁয়ে মনে হয় নি, ওরা কোনোদিন বিরক্তও হয় নি – বরঞ্চ ফিক করে হেসে দিয়ে একেকজন একেক রকমের একেকটা উত্তর দিয়ে থাকে, যেমন শাহনাজের উত্তর ঐ একটাই – ‘আমারে চিনবি না রে’! আর, এই যে ওরা একগাল ফিক-করা হাসি দিয়ে আমাকে রিপ্লাই দেয়, এটাই আমাকে আনন্দ দেয়; সত্যি কথা, ওদের এরকম একটা রেসপন্স শোনার জন্যই আমি এ প্রশ্নটা করে থাকি।
‘আমারে চিনবি না রে’ – শাহনাজের এ উত্তর শোনার পর আমি অবাক হবার ভান করে বলি- ‘ওওও, তুই!’ তারপর ক্ষুদ্র একটু দম নিয়ে, ওর উত্তর দেয়ার আগেই বলে ফেলি, ‘আচ্ছা বল তো, তোর ঐখানে এখন কয় তারিখ?’ শাহনাজ গত নভেম্বরে নিউ ইয়র্কে যাবার পর আরও ২/৩ বার কল করেছিল। প্রতিবারই আমার কমন প্রশ্ন ছিল- ‘বল তো, তোর ঐখানে এখন কয় তারিখ?’ ও একটু সময় নিয়ে হিসাব করে যে তারিখ বলতো, তাতে দেখা যেতো আমেরিকা বাংলাদেশের চেয়ে দুই দিন এগিয়ে আছে। ওর হিসাব মতে আমেরিকার তারিখ এভাবে দুই দিন এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, ওর হিসাবটা ছিল খুব অদ্ভুত। ওর অদ্ভুত হিসাবের রহস্যটা সহজ করে বুঝিয়ে বলি- বাংলাদেশে ২২ এপ্রিল সকাল ৮টায় নিউ ইয়র্কে ২১ এপ্রিল রাত ১০টা হয়; শাহনাজ শুধু বাংলাদেশের তারিখটা মনে রাখে, আর তা থেকে ১দিন বিয়োগ না করে ১দিন যোগ করে ফেলে। ফলে বাংলাদেশের সময় থেকে আমেরিকা ১দিন পিছিয়ে থাকার বদলে ২দিন এগিয়ে যায়
ওর দিনতারিখে এরূপ ভুল হয় বলে একদিন সাধারণ একটা সূত্র বলে দিলাম : ‘তর ঐখানে দিন শুরু হইবার পর দুপুর ১টা পর্যন্ত বাংলাদেশ আর আমেরিকার দিনতারিখ একই থাকবে; দুপুর ১টার পর আমেরিকা ১দিন পিছাইয়া পড়বে, আবার রাত ১টায় বাংলাদেশ আর আমেরিকা দিনের হিসাবে একই লেভেলে চইলা আসবে।’ শাহনাজকে যখন এই ফর্মুলা বলছিলাম তখন আমেরিকা-বাংলাদেশ টাইম গ্যাপ ১১ ঘণ্টা ছিল, যা এখন ১০ ঘণ্টা। সুতরাং এ পোস্ট পড়ে যারা অংক কষতে বসবেন, তারা উপরে দুপুর ১টার জায়গায় দুপুর ২টা ধরে নিবেন, দয়া করে
শাহনাজকে এবার দিনতারিখ বলতে বললে ও হেসে দিয়ে বললো, ‘আজ ২২ এপ্রিল। আর ভুল হবে না রে!’ বলে কিটকিট করে হাসতে থাকে। ‘যাক, তর বুদ্ধি আগের চাইতে বাড়ছে তাইলে। আমার ভালো লাগতেছে।’
- ‘কী করতেছিস?’
- ‘ফেইসবুকে গান লিখতেছি।’
- ‘বাহ! চমৎকার তো! কিন্তু তুই যে গান লেখস তা তো জানতাম না। ভালোই, তর প্রতিভা চাইরদিকে ছড়াইয়া পড়তেছে।’ শাহনাজ এসব বলে আর হাসতে থাকে। তারপর বলে, ‘গানে সুর করস নাই?’
- ‘হ, সুর দিসি তো। শুনবি?’ বলেই আমি গেয়ে উঠি, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন মন রে আমার।’ অমনি শাহনাজ গলা ফাটিয়ে হেসে উঠে বলে, ‘এই তর গান লেখা?’
- ‘হ। আমিই তো লিখতেছি। পুরাডা শুনবি না?’
- ‘শোনা। এত কইরা যেহেতু শুনাইতে চাইতেছস, না শুইন্যা কি উপায় আছে?’
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন
মন রে আমার
তাই জনম গেলো শান্তি পেলি নারে মন
মন রে আমার
যে পথ দিয়ে চলে গেলি
সে পথ এখন ভুলে গেলি রে
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন
মন রে আমার
নদীর জলে থাকি রে কান পেতে
কাঁপে রে প্রাণ পাতার মর্মরেতে
মনে হয় যে পাবো খুঁজি
ফুলের ভাষা যদি বুঝি রে
যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পাড়ে মন
মন রে আমার
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন
মন রে আমার
আমি পুরা গানটা গেয়ে ফেলি। গাওয়া শেষে শাহনাজের প্রান্ত নীরব। আমি বলি, ‘গানটার ১ম লাইন শুইন্যা তর যেমন হাসি পাইতেছিল, এখন ঠিক ততখানিই খারাপ লাগতেছে, তাই না?’
শাহনাজ খুব ধরা গলায় বলে, ‘হ। ঠিক বলছস। খুব ভালো গাইছস তুই। অনেক ভালো গাইছস।’
আমার ধেড়ে গলায় গাওয়া গানটা শুনে শাহনাজের মন খারাপ হয়ে যেতে পারে এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করেছি। অনেক আগে, যখন আমি ঢাকায় ছিলাম, আমার টিএন্ডটি ফোনে আমাদের আরেক ক্লাসমেট ইমরানের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হতো। হাস্যচ্ছলে ইমরানকেও অনেক গান শুনিয়েছি। দেখতাম, ইমরানও নীরব হয়ে যায়। মন ভারী হয়ে ওঠে।
টাকার প্রয়োজনে রাজ্জাক ভাই (শাহনাজের জামাই) সুদীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকায় প্রবাস জীবন পার করছেন। শাহনাজেরর এক ছেলে বুয়েট, এক ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল; ছোটো ছেলে ঢাকা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ছিল। ওর সন্তানদের ভবিষ্যত শাহনাজ নিজহাতে গড়ে তুলছিল। কিন্তু সবকিছুর মায়া কাটিয়ে, নিজদেশে সন্তানদের শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠা সত্ত্বেও ওদেরকে চলে যেতে হলো সুদূর আমেরিকায়। সবকিছুর মূলে কাজ করেছে ছেলেদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করা, সংসারকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করা; বাংলাদেশে বসবাস করে সেই অর্থের সংকুলান করা রাজ্জাক ভাইয়ের জন্য সম্ভব ছিল না।
আমি বেশ ক’বার বিদেশে থেকেছি- কখনো এক বছর, কখনো এক মাস, কখনো বা দুই-তিন মাস দীর্ঘ ছিল সেই প্রবাসকাল। দেশে স্ত্রীছেলেমেয়ের সংসার, বন্ধুবান্ধব, চেনা পথঘাট ফেলে বিদেশের মাটিতে অল্প দিনেই আমি ‘নদীর মাছ ডাঙ্গায় তোলার মতো’ অবস্থায় পড়ে যেতাম। আমার মনপ্রাণ সবসময়ই ছটফট করতো। যেদিন ফিরতি বিমানে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম, উত্তেজনায় আমার সময় কাটতো না – কতক্ষণে আমি বাংলার মাটিতে নামবো! আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে! তারপর যখন ঢাকার বিমান বন্দরে নামতাম, মনে হতো আমি স্বর্গের দরজায় পা রাখছি। সুদীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলতাম – এ আমাদের দেশের বাতাস! এ আমার দেশের আলো! কী মিষ্টি, কী গন্ধ, আহ, আমার বুক ভরে গেল, প্রাণ জুড়িয়ে গেল!
সোনার স্বদেশকে ছেড়ে গিয়ে স্বপ্নের আমেরিকায় মনে হয় শাহনাজের মন টিকছে না। কেবলই ঢাকা শহরে ফেলে যাওয়া দিনগুলোর কথা ওর মনে পড়ছে। ওর ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন ঢাকায় বাস করে; ওর নাড়ি পড়ে রয়েছে ঢাকার দোহারে। চড়ুই পাখির মত শাহনাজ ঢাকা শহরের একগলি থেকে আরেক গলি, ভাইয়ের বাসা থেকে বোনের বাসা, দোহারে বাপ-দাদা-শ্বশুরের ভিটায় উড়ে বেড়াতো। মাঝে মাঝেই আমাদের ক্লাসমেটদের দাওয়াত দিত, জম্পেশ আড্ডা হতো! অন্য ক্লাসমেটদের বাসায় (এবং আমার বাসায়ও) ক্লাসমেটরা আসতো। জেনে রাখুন, সকল আড্ডায় শাহনাজই থাকতো মধ্যমণি। এসব ছেড়েছুঁড়ে, আমেরিকার বরফঢাকা ছাদের নীচে শাহনাজের মন কি টেকে? ওর মন কেবলই কাঁদে। ওর ক্রন্দসী মন যখন আমার কণ্ঠে শুনতে পেলো ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’, তখন ওর ভিতরে তূষের আগুন জ্বলে উঠছিল – ‘তাই শান্তি পেলি নারে মন মন রে আমার।’
দেশের মায়া এমনই। তুমি যেখানেই যাও, তোমার বুকে দেশ জ্বলতে থাকবে। স্বপ্নের দেশে তুমি যত সুখেই থাকো না কেন, তোমার মন সঙ্গোপনে কেঁদে কেঁদে খুন হতে থাকবে। তুমি দেশ ছেড়ে যেখানেই যাও, তোমার নাড়ির মূল রয়ে যায় বাংলাদেশের গভীরে। সেই নাড়ি কাটা যায় না, ছেঁড়া যায় না। যেদিন ছিঁড়ে যাবে, সেদিন তোমার মৃত্যু হবে।
শাহনাজ আর ওর সংসারের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা থাকলো; শুভ কামনা থাকলো নাড়ি ছিঁড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে থাকা প্রবাসী সকল ভাইবোনের জন্য।
২৪ এপ্রিল ২০১৪
২৭ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ১:২৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আমাদের বেশিরভাগ মানুষই ভাগ্য বদলের জন্য বিদেশে যায়। কিন্তু বিদেশের আলো-বাতাস দেশের আলো-বাতাসের মতো কাউকে চিরস্থায়ী সুখ বা শান্তি দিতে পারে বলে মনে হয় না। এই বোধ জন্মেছে আমার নিজেকে দিয়েও। তাই, এত সাধের বিদেশে গিয়েও শাহনাজের মনে ছিল অব্যক্ত কষ্ট, যা ওর দীর্ঘশ্বাস থেকে বোঝা যেত।
পুরোনো নিক থেকে এ পোস্ট পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপু।
২| ২৭ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:৩১
ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:
দেশ দেশ নিজ দেশ নিজ মাতৃভূমি। দুপুরে টেংড়া মাছ জলপাই/কাঁচা আমের টক তরকারি দিয়ে সাদা ভাত খেয়ে একটি লম্বা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস ঠান্ডা শীতল শরবত অথবা এক কাপ গরম চা।
২৭ শে আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৩৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
দুপুরে টেংড়া মাছ জলপাই/কাঁচা আমের টক তরকারি দিয়ে সাদা ভাত খেয়ে একটি লম্বা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস ঠান্ডা শীতল শরবত অথবা এক কাপ গরম চা। এই তো আমার দেশ - যেখানে এই প্রশান্তির দেখা মেলে।
চমৎকার কমেন্টের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় ঠাকুর মাহমুদ ভাই। শুভেচ্ছা।
৩| ২৭ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১১:২৯
জটিল ভাই বলেছেন:
হুম্...
নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপাড়েতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস......
২৮ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১:৪৭
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অনেকটাই।
৪| ২৭ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:০৫
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: তুই ফেলে এসেছিস কারে - অ্যাড করে রাখলাম।
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ১:০৪
অপ্সরা বলেছেন: হুম যারা বিদেশে যায় হয়ত অনেক ভালো থাকার জন্য। কিন্তু আসলেই কি ভালো থাকে?
দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে