নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
বড়শির গল্পটা লিখতে বসেছিলাম। লিখতে গিয়ে দেখি লেখা বের হয় না। যারা নৃত্যশিল্পী, বা কণ্ঠশিল্পী, তাঁরা বহুদিন বিরতির পর নাচতে বা গাইতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনায় পড়েন কিনা জানি না, তবে, লেখকরা লেখার বিরতি দিলে নতুন করে লিখতে গেলে এমন সংকটে যে পড়তে পারেন তার উদাহরণ আমি নিজেই তো!
ছোটোবেলায় গাঁওগেঁরামের পোলাপান মাছ ধরে নি, এমন উদাহরণ বিরল। চকে আর খালেবিলেই তো ছোটোবেলাটা কেটেছে। একটা পাখির ছানা ধরার জন্য মান্দার গাছের কাঁটায় পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছি। ঘুড়ি উড়িয়েছি চাঁন্দিফাটা রোদে লাঙ্গলচষা ক্ষেতের উপরে পাথরের মতো শক্ত ইটায় পা আর হাঁটু রক্তাক্ত করে। দোহারের খাল, ধাপারির খাল, আড়িয়াল বিল, এবং আমাদের বাড়ির সামনে ছোটো নালাটিতে মাছ ধরতে ধরতে শরীরে চর পড়ে যেত।
মাছ ধরার ছোটোখাটো অনেক গল্প আগে লিখেছি। সেগুলো ছিল উছা, ঝাঁকিজাল, টানাজাল, পোলো বা দোহাইর দিয়ে মাছ ধরার কাহিনি। আজ বড়শিতে মাছ ধরার গল্প বলছি।
দোহারের খালটি দোহার গ্রাম থেকে বের হয়ে চকের মাঝখান দিয়ে আমাদের গ্রামে প্রবেশ করেছে এবং গ্রামের উত্তর মাথায় ফকির বাড়ির পাশ দিয়ে আড়িয়াল বিলে গিয়ে পড়েছে। ফকির বাড়ির ঘাটে বিশাল একটা ‘মোড়’ আছে, যেটি খুব গভীর; বর্ষাকালে এখানে কাটালের শক্তিশালী ‘ঘোল’ বা ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়, যার ভেতরে পড়লে ছুটে আসা দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আশ্বিন মাসের শেষদিকে বর্ষা ফুরিয়ে গেলেও দোহারের খালে পানি থাকে। খালের নানা জায়গায় ঝাঁকিজাল, টানাজালে মাঝ ধরার ধুম পড়ে যায়। অনেকে উবু হয়ে, কিংবা পানির নীচে ডুব দিয়ে কাঁদা হাতড়ে মাছ ধরে; ঘন ঝোপঝাঁড়ের নীচে বিরাট গর্তের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ধরে আনে বাইন, শিং বা মাগুর মাছ। মাছ ধরতে গর্তে হাত ঢুকিয়ে কতজনে যে সাপের কামড় খেয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ছোটোবেলা থেকেই মাছ ধরার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল খুব বেশি। খালে কিংবা মধ্যপাড়ার ফয়জল খা’র আড়ায় যেদিন মাছ গাবাতো, আমি ছুট দিতাম ওড়া, কিংবা বাবার গামছা নিয়ে। ঐ বয়সে একটা-দুটো ট্যাংরা কিংবা পুঁটি ধরতে পারলেই উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠতাম এবং মাথার উপরে হাত উঁচু করে মাছ তুলে লাফাতে লাফাতে বাড়িতে ছুটে এসে মাকে বলতাম- ‘মা দ্যাক, কত্ত বড়ো পুডি দরছি।’ এরপর উছা, টানাজাল, ঠেলাজাল, ঝাঁকিজাল ও পোলো দিয়ে মাছ ধরেছি। একই সাথে বড়শিতেও মাছ ধরেছি।
প্রথম প্রথম বড়শিতে মাছ ধরতাম বাড়ির ঘাটে; এরপর পাশের বাড়ির পুকুরে। একটু বড়ো হলে একদিন বিকেলে মাছ ধরতে গেলাম ফকির বাড়ির ঘাটে। তখন বর্ষা নেমে গেছে।
ফকির বাড়ির ঘাটের উলটো দিকে একটা বাঁশঝাড়। তার নীচে বসার জায়গাটা বেশ মনোরম এবং ওখানে পানির গভীরতাও একটু বেশি হওয়ায় মাছের আনাগোনাও বেশি। আমি রোজ বিকেলে ওখানে গিয়ে বড়শি ফেলি। আমার মাছের রাশ ভালো। ছিপ ফেলা মাত্র মাছ বড়শি ঠোকরানো শুরু করে। তবে, ছোটো ছোটো চ্যালামাছগুলোই এ জ্বালাতন করে বেশি। আমরা এগুলো খুব একটা খাই না, যদি না আকারে কিছুটা বড়ো হয়। কিন্তু বড়শিতে ধরা বেশিরভাগ চ্যালাই খুব ছোটো, বড়শি থেকে খোলার সময়ই ওগুলোর মাথা থেতলে যায় এবং পানিতে ফেলে দিই।
মাছ ধরার দ্বিতীয় দিনে একটা সরপুঁটি ধরা পড়লো। সরপুঁটি ধরার পর খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়িতে চলে যাই। সরপুঁটি দেখে মা খুব খুশি হলো।
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই একটা, কোনো-কোনোদিন দুটো বা তিনটাও সরপুঁটি পেতে থাকলাম। এর সাথে থাকে ছোটো পুঁটি, চিংড়ি, ট্যাংরা, ফলি, শিং। মাঝে মাঝে বাইন, কই ও খোলসে মাছও পাই।
একদিন বিকেলে হঠাৎ দুটো ছেলেমেয়ে আমার পাশে এসে বসলো। ছেলেটা লুঙ্গি পরা, মেয়েটা শাড়ি। মেয়েটার শাড়ি পরা আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। বাড়িতে আমার ছোটোবোন নলেছাকে মা মাঝে মাঝে শখ করে তার নিজের শাড়ি পরায়। বোনের তুলনায় শাড়ির ওজন অনেক বেশি হওয়ায় সে শাড়ি পরে বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। কিন্তু এ মেয়েটি পরেছে ছোটোদের শাড়ি; এবং পরেছে খুব সুন্দর করে। আমি বার বার ওর দিকে তাকিয়ে ওর শাড়ি পরা দেখি। ওর হাসিটা খুব সুন্দর। ওরা কারা জানি না, কোনোদিন আমাদের গ্রামে দেখি নি। ছেলেটা আমার খালুইটা নেড়েচেড়ে দেখছে। মেয়েটা ওর খালুই নাড়াচাড়া দেখে, আর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। ওর হাসিতে আমার প্রাণ ভরে যায়।
‘তুমাগো বাড়ি কই?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘বিলাসপুরের চরে।’ ছেলেটা বলে।
‘বিলাসপুর কুন জাগায়?’
‘পদ্মার পাড়ে।’
‘তুমরা বেড়াইতে আইছাও?’
‘হ।’
‘কাগো বাইত্তে?
‘আদম ফকিরের বাইত্তে আইছি। নতুন বিয়া করছি তো, তাই বউ নিয়া বেড়াইবার আইছি।’
আমি এ কথায় খুব আশ্চর্য হই। ওরা আমার চাইতে বড়োজোর দু বছরের বড়ো হবে। ১০-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হতো আমার দাদার আমলে, আমার দাদির কাছে শুনেছি; কিন্তু এ আমলে এমনটা হয় তা আমার জানা ছিল না।
‘তুমার বউডা খুব সুন্দর। ওর নাম কী?’ আমি বলি।
‘ওর নাম জয়নব। মাদবর বাড়ির মেয়া তো, তাই এত সুন্দর।’ এটা বলতে যেয়ে ছেলেটা সুখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এবং একটা চাপা অহংকারে চোখদুটো সামান্য সরু করে ও আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসে।
‘আমার নাম চানু। তুমার নাম কী?’ চানু নিজের নাম বলে আমার নাম জানতে চায়। আমি যখন ‘আমার নাম কুডিমিয়া’ বললাম, তখন জয়নব হাসতে হাসতে প্রায় গলে পড়ে গেল।
‘কুডিমিয়া কি কুনো নাম অয়? জীবনেও এই নাম হুনি নাই।’ জয়নবের হাসি আর থামে না।
চানু ওর বউরে বলতে থাকে, ‘ও অইলো ভাইবোনের মধ্যে সবার ছুডো। ছুডোগো নাম কুডিমিয়াই অয়।’
এমন সময় বড়শিতে বেশ বড়ো একটা কুইচ্চা ধরা পড়লো। কুইচ্চা কেউ খায় না, তবে, গরীব মানুষেরা কেউ কেউ বড়ো আকারের কুইচ্চা পেলে খায়। আমি কুইচ্চাটাকে বড়শির মুখ থেকে খুলতে গেলে ওটা সাপের মতো আমার বাম হাত পেঁচিয়ে ধরলো, এবং আমি একটু ভয়ও পেলাম, কেমন সাপের মতো মোচড় দিচ্ছে, জোঁকের মতো বিদ্ঘুটে শরীর; আমার শরীরটা একটু ঝাঁকি দিয়ে উঠলো, কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে ধীরে ধীরে বড়শির মুখ থেকে কুইচ্চাটাকে খুললাম। ওটার মাথা ধরে ঘুরিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারতে যাব, এমন সময় চানু বলে উঠলো, ‘করোছ কী, করোছ কী? ঐডা ফালাছ ক্যা? আমাগো দে।’ আমি ভাবলাম, ওরা হয়ত ধনীর ঘরের কেউ না বলেই কুইচ্চাটা নিতে চাইছে। ও দ্রুত কাছে এসে খুব উচ্ছ্বাসের সাথে আমার হাত থেকে কুইচ্চাটা তুলে নিল। এরপর সুন্দর করে খালের পানিতে ধুলো। ওর হাতে কুইচ্চাটা তখনো সাপের মতো মোচড়াচ্ছে। এরপর দুজনে পেছনের একটু উঁচু জায়গায় যেয়ে ঘাসের উপর বসলো। ওরা নেড়েচেড়ে কুইচ্চাটা দেখতে লাগলো; মনে হলো ওটাকে ওরা আদর করছে; হয়ত বহুদিন পর অনেক খায়েশের একটা মাছ পেয়ে ওরা নিজেদের খুব ভাগ্যমান মনে করছে। আমি আপন মনে বড়শিতে মাছ ধরতে থাকলাম। ওরা দুজন টুকটাক কথা বলতে থাকলো।
‘অনেক মজা রে!’ চানুর কথায় আমি পেছনে ফিরে তাকাই এবং যা দেখলাম তা কোনোদিনই আমার কল্পনায় আসে নি। কুইচ্চাটার একমাথা ধরে ছেলেটা চিবিয়ে খাচ্ছে, আরেক মাথা ধরে খাচ্ছে মেয়েটা। এই দেখে মুহূর্তে আমার বমি আসার উপক্রম হলো। কাঁচা ডিম বা কাঁচা মাংস তেল-মসলা দিয়ে মাখিয়ে খাওয়ার গল্প অনেক শুনেছি, কিন্তু কাঁচা মাছ, তাও কুইচ্চা কেউ এভাবে খেতে পারে, তা দেখে আমার পাকস্থলি দুমড়ে-মুচড়ে পাক দিয়ে উটকি আসতে শুরু করলো। আমি জোরে শব্দ করে ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে থাকলাম। এবং একসময় আমার জ্ঞান চলে গেল। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম, ওরা দুজন আঁজল ভরে খাল থেকে পানি এনে আমার মাথা ধোয়াচ্ছে। আমি গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওদের গা থেকে একটা উৎকট চ্যাংটা গন্ধ বের হচ্ছে, তাতে আমার আবারো বমি হতে পারে ভেবে আমি দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম।
বাড়ির কাছে আসতেই একটা সুমিষ্ট গন্ধে আমার বুক ভরে গেল। দুয়ারে পা ফেলে দেখি একটি অতি রূপবতী যুবতী আমার মায়ের পাশে বসে খুব সুন্দর করে হাসছে আর আমোদ করছে। আমাকে দেখেই যুবতী দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল- ‘আল্লারে আল্লা, আমার বাজানডার শরীলের এই অবস্থা ক্যা রে বাজান? আইজক্যা কি পানিটুকুনও মুখে দেস নাই?’ আমার জন্য যুবতী রমণী হাহাকার করে উঠলো। আমি মুহূর্তেই বুঝে ফেললাম, এ আমার সুফী খালা! মায়ের মুখে খালার কত্ত গল্প শুনেছি! খালার চেহারা আমার মোটেও মনে নেই - আমার খুব ছোট্টবেলায় অল্প বয়সে খালার বিয়ে হয়ে গেলে খালুর সাথে সুফী খালা শহরে চলে গেছে, আজ এতদিন পর আমার প্রতি আকুলতা দেখে বুঝতে বিন্দু দেরি হলো না, এ আমার আজন্মচেনা প্রিয়তমা সুফী খালা।
‘তোর লগ দিয়া এত গন্ধ ক্যান রে বাজান? মাছের আইশটা গন্দে শরীল বইরা গেছে। নু, নাওয়াইয়া দেই।’ বলেই আমাকে হাত ধরে দুয়ারের একটা কোনায় নিয়ে কলশ থেকে পানি ঢেলে খালা আমাকে গোসল করিয়ে দিল। কলশের পানি বেশ ঠান্ডা ছিল, এবং শীতের দিন না হওয়া সত্ত্বেও একটু কাঁপতে থাকলাম। এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে, একটা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে, খুব সুন্দর ও মায়াবী, বয়স ৪ বা ৫ বছর হবে, দেখতে অবিকল জয়নবের মতো, এবং অবিকল জয়নবের মতোই সুন্দর করে শাড়ি পরেছে মেয়েটি, দুয়ারের কোনা থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে একটা গামছা বাড়িয়ে দিয়ে বললো- ‘বাই, গামছা নেও। তোমার ঠান্ডা লাকতেছে?’ বলেই ও আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসতে লাগলো। আমি ওর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছি- চানুর বাল্যবধূ জয়নবের ক্ষুদ্রতর প্রতিমূর্তি যেন। ওর কণ্ঠ আর হাসিটা এতই মিষ্টি, আমার বুক ভরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো। আমার ছোটোবোন নলেছা, ওর চাইতে ছোটো, এখনো ভালো করে কথা বলতে পারে না, আমার প্রাণ আনচান করে উঠলো, হায়, নলেছা কবে ওর মতো করে ‘বাই’ বলে ডেকে উঠবে?
গল্প এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু শেষ হতে পারলো না খালার কথায়। খালা বললো, ‘এইডা তর আরেকটা বইন। ওর নাম জয়নব।’
অদ্ভুত! কী করে সম্ভব? ওর নামও জয়নব! বিস্ময়ে আমার ঘোর লেগে যায়। চানুর ছোট্টবধূ জয়নব আর আমার খালাতো বোন জয়নবকে পাশাপাশি দাঁড় করালে সহজেই সহোদরা দু’বোনের মতো মনে হবে। ওদের বয়স সমান হলে হয়ত যমজ বোন বলেও অনেকে ভুল করতে পারতো। হাসিটা, চাহনিটা, সবকিছুতে কী অদ্ভুত মিল!
আমি গামছা দিয়ে গা মুছলাম। তারপর কৌশলে গামছাটা পরে ভেজা থামিটা পালটে ফেললাম। থামি চিপড়ে পানি ফেলে একটা ঝাড়া দিয়ে বেড়ায় মেলে দিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছি, জয়নব ছুটে এসে দু'হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘বাই, কোলে নেও।’ আহ! আবারো আমার বুক জুড়িয়ে গেল! কত মিষ্টি করে জয়নব আমাকে ‘বাই’ বলে ডাকছে! আমার সামনে হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠার জন্য আহ্লাদী বালিকার মতো হাঁটু দুলিয়ে নাচছে। ওকে আমি পাঁজাকোল করে তুলে নিলাম। ও দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। নলেছাকে কোনোদিন এভাবে কোলে নিই নি। জয়নবের মাথার দু’দিকে লাল রঙের দুটো ফিতা ঝুলছে। ওর সারা শরীরে একটা অজানা ফুলের গন্ধ। ও আমাকে আরো জোরে গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি আদরে ওর গলার কাছে মুখ নিয়ে চুমু খাই। আহ! কী সুন্দর ফুলের গন্ধ জয়নবের সারা গায়ে। ও খিলখিল করে হেসে ওঠে।
জয়নবের শোনাশুনি নলেছা আমাকে ঘন ঘন ‘বাই’ ‘বাই’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমার খুব ভালো লাগছে। আমি যেখানে যাই, ওরা দু’জন আমার পিছে পিছে যায়। আমার খুব ভালো লাগে। অনেক আদরের দুটো বোন আমার গলায় গলায় ঝুলে থাকবে, এমনটা ভাবতেই আমার খুব ভাল লাগতে থাকে।
রাতে আমার একপাশে নলেছা, অন্যপাশে জয়নব শুলো। ওরা দুজন খুব শক্তভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। জয়নব নানা ধরনের বায়না ধরতে থাকলো। জয়নবের দেখাদেখি নলেছাও বায়না ধরতে শিখছে। আমাদের বাড়ির পাশে একটা দইল্লা গাছ আছে। দইল্লা গাছে আমি রোজ দোলনা বেঁধে দোল খাই। জয়নব বললো, কাল সক্কালেই ওকে দোলনায় চড়াতে হবে। নলেছারও একই বায়না। জয়নবকে নিয়ে দুপুরে ঘুড়ি উড়াবো। ওকে বাবুই পাখির বাসা দেখাতে নিয়ে যাব মাদবর বাড়ির তালগাছতলায়। হঠাৎ জয়নব বলে উঠলো, ‘বিয়ালে আমারে কিন্তু বড়শি দিয়া মাছ ধরতে নিবা।’
সকালে মা আমাকে ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম থেকে উঠালো। আমার পাশে বাবা শুয়ে আছে। নলেছা ঘরে নেই, জয়নবকেও দেখছি না। ওরা কখন উঠে বাইরে গেছে কে জানে! দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম- না, ওদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কারো কথাও শোনা যাচ্ছে না।
‘খালায় কইরে মা?’
‘কুন খালায়?’ মা একটু অবাক হয়ে পালটা জিজ্ঞাসা করে?
‘সুফী খালা!’
‘সুফী খালায় কই গনে আইবো?’
‘কই গনে আইবো মানি? খালায় না ঘরে আছিল?’
‘পুলায় কয় কী? খালায় ঘরে আইবো কই গনে?’
‘কী আবুলতাবুল কছ? রাইত্রে তো খালায় ঘরেই আছিল। জয়নব আছিল আমার পাশে।’
মা চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী অইছে রে বাজান? তর খালায় দেহি কুন জনমে মইরা গেছে! মরা খালায় ঘরে আইবো কই গনে?’
**
আমার মনটা খুব ভার। ভার মনেই দইল্লা গাছে যেয়ে দোলনা বাঁধলাম। দোলনায় চড়ে একমনে উত্তরের বিরান চকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে, এই সকালটাতেই সারা চক ভরে রোদের খরা ধু-ধু করছে। খুব দূরে আবছা ধুলোর ভেতর ধীরপায়ে আমার সুফী খালা হেঁটে যাচ্ছে। তার পরনে একটা শাড়ি। এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, আমার সুফীখালা খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছে, আর রোদের ভেতরে তার শরীরের রূপ চিক চিক করে জ্বলছে।
খালা যে বছর মারা গেল, তার পরের বছরই মারা গেল নলেছা। আমার খালা নেই, নলেছাও নেই। অথচ, পুরো পৃথিবীর সবখানেই যেন ওদের ছায়া লুকিয়ে আছে। কান পাতলেই ওদের কণ্ঠ শুনি, চোখ বুঝলে ওদের মুখ দেখি। ওরা কি আমাকে দেখে?
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯
শব্দ-পরিচয় :
বিয়ালে – বিকালে
বাই – ভাই
কই গনে – কোথা থেকে
০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৩
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আড়িয়াল বিলের স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ সাজ্জাদ ভাই।
২| ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৪
মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:
মিয়া বাই,
আপনের এই গপ্পোডা কুন বইতে ছাপচে?
বইড্যার নাম কন।
আমি কিনুম।
০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৪
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
মিয়াবাই, এটা কোনো বইতে ছাপানো হয় নাই এটা কেবল আমার পিসিতে আর অনলাইনেই প্রকাশিত
৩| ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।
৪| ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১১
মায়াস্পর্শ বলেছেন: অসাধারণ। শেষে এসে মন খারাপ হয়ে গেল।
০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ মায়াস্পর্শ। শুভেচ্ছা।
৫| ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৪
খায়রুল আহসান বলেছেন: এই ব্লগে যখন প্রথম অন্তর্ভুক্ত হলাম, সেটা প্রায় আট বছর বা তারও কিছু বেশি আগের কথা, তখন ইলিশ নিয়ে লেখা আপনার একটা গল্প পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। এর পর থেকে আপনার বহু লেখা পড়েছি বিভিন্ন বিষয়ে। বলতে দ্বিধা নেই-- গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গান, খেলাধুলা, রম্যরচনা ইত্যাদি যে বিষয়েই আপনি লিখেন না কেন, তাই সুখপাঠ্য হয়। মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যেও আপনি একজন মার্জিত, শানিত, সহনশীল ও বন্ধু্সুলভ ব্লগার। দীর্ঘ এ ব্লগীয় পদযাত্রায় আপনি তাই আজ ব্লগের একজন মহীরুহ ব্লগারে পরিণত হয়েছেন।
আঞ্চলিক সংলাপ গল্পটাকে প্রাণবন্ত ও বাস্তব করে তুলেছে। পাদটীকায় 'শব্দ পরিচয়' এ বোধহয় আরও কয়েকটা শব্দ/শব্দগুচ্ছ যোগ করা যেত।
গল্পের নামকরণ নিয়ে আমার একটু সংশয় রয়ে গেছে। গল্পের মূল ফোকাস কি 'বড়শি'? আমার তো মনে হয় গল্পের শেষ অনুচ্ছেদে যে ভাব ও ভাবনাটি মূর্ত, সেটাকে কেন্দ্র করেই একটা বা দুটো শব্দ গল্পের শিরোনাম হলে তা আরও উপযুক্ত হতো।
আপনি সব্যসাচী লেখক। আপন খেয়ালে আপনি যখন যে বিষয় নিয়ে এনগেজড থাকেন সে বিষয়েই লিখে চলেছেন বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। আপনার লেখনির এ ফল্গুধারা চির প্রবহমান থাকুক, এই শুভকামনাটি রেখে গেলাম।
১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: স্যার, আপনার এ অসাধারণ অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যটি যথাসময়েই দেখেছিলাম। আপ্লুত ও উদ্বেলিত হয়েছি মন্তব্য পড়ে। এমন উদার ও নির্মোহ মন্তব্য কেবল আপনার মতো মহান, মেধাবী, ব্যক্তিত্ববান ও মনোযোগী পাঠক-ব্লগারের কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। যে-কোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকে তার নির্যাস তুলে এনে লেখকের কাছে পরিশীলিত ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপনে আপনি এ ব্লগে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। হাতে-গোনা স্বল্প কয়েকজন ব্লগারের মধ্যে আপনি একজন, যিনি শতভাগ ব্লগারের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত। আপনার মতো ব্লগারের কাছ থেকে এমন মন্তব্য পাওয়া আসলেই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
গল্পের নামকরণ বিষয়ে আপনি একটা ভালো কথা বলেছেন। আমিও শেষ পর্যন্ত 'বড়শি' নামকরণ নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল। বড়শি দিয়ে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করেই গল্পের শুরু। কিন্তু নায়কের মনে একটা গভীর বেদনা আছে, তার বোন, খালাকে হারানোর বেদনা। সেই বেদনাও যেন বড়শিতে আটকা পড়ে গেছে।
আপনি নিজেও সব ধরনের লেখাই লিখছেন। কাজেই সব্যসাচী বলতে কিছু বোঝালে সেটা আপনার নামেও আসে কিন্তু
স্যার, দেরিতে রিপ্লাই দেয়ার জন্য লজ্জিত ও দুঃখিত। মাঝে মাঝেই এরকম অসাধারণ কমেন্টে আমাকে অনুপ্রাণিত করায় আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা ও স্নেহই প্রকাশ পায়। এজন্য আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ভালো থাকবেন স্যার।
৬| ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ছেলেবেলায় বাবা চাচাদের কাছে মাছ ধরা নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। সেসবের সব যে বেশ সহজ সরল তা না, কিছু গল্প বেশ অদ্ভূত।
গল্পে কিছু বিষয় একান্ত নিজের মতামতে জানালাম। আপনি কী ভেবে লিখেছেন জানি না। জয়নবের শাড়ি পরা দেখে, একটা কোমলতার ভাব গল্প কথকের মনে এসেছিল, কাঁচা মাছ খাওয়াতে সে ভাবে প্রচণ্ড এক ধাক্কা লাগে। জয়নবের সাথে ছোটো বোন কিংবা খালার মতন পরিপাটি শাড়ি পরার চিন্তায়, মাছ খাওয়ার পর মেছো গন্ধে বমি আসার পরিপ্রেক্ষিতে গল্প কথক বাড়ি ফিরে জয়নবের শরীরে ফুলের গন্ধ পায়, সে বমি ভাবটা কাটাবার জন্য কিংবা মনের মাঝে আসা ধাক্কাটা তাড়াবার জন্য।
এছাড়া প্রিয় কিংবা ভালো লাগা ছোটো বোন হারিয়ে যাবার বেদনা বারবার ফিরে না আসে যেন সেজন্য, নিজের কল্পনায় প্রিয় আশেপাশে দেখে।
গল্পে শব্দের ব্যবহার ও প্রাঞ্জলতা মন কেড়েছে। বেশ লেগেছে। গল্পটায় কমেন্ট করব করব করে করা হয়নি এতদিন।
১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:০৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আরেকটা চমৎকার কমেন্ট। একগুচ্ছ মুগ্ধতা।
গল্পের ব্যাপারে আপনার মতামত অনেক ভালো লেগেছে। আপনি নিজেও একজন উঁচু মানের লেখক, আপনার পক্ষে এসব ব্যাপারে মতামত দেয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার, এবং মতামতগুলোও নিশ্চয়ই উঁচু মানেরই হবে।
এ গল্পটা শুরুতে শুধু বড়শিতে মাছ ধরা, জয়নবের শাড়ি পরা, কুইচ্চা খাওয়া, অতঃপর বাড়িতে ফিরে যাওয়া পর্যন্তই ছিল। কিন্তু তাতে ছিল গল্পটা অসম্পূর্ণ। কুইচ্চা মাছ খাওয়ার ঘটনা পড়লে অনেক পাঠকেরও হয়ত মনে একটা বিশ্রী প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই একটা সুন্দর সুগন্ধিময় কিন্তু বিষাদপূর্ণ একটা পরিণতি চাইছিলাম। নলেছা নামক চরিত্রটি একটা বাস্তব চরিত্রের ছায়া।
গল্পটি পড়ার জন্য এবং এ চমৎকার কমেন্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ রিয়াদ ভাই। আপনার আরো কয়েকটা বিশদ কমেন্টের রিপ্লাই পেন্ডিং আছে। সময়মতো দিব রিপ্লাই। ভুলে গেলে ক্ষমা করবেন প্লিজ।
©somewhere in net ltd.
১| ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১২:১৮
মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:
দোহারের সৌন্দর্যই আলাদা ।
বিশেষ করে আড়িয়াল বিলের উপর দিয়ে যখন যাতায়াত করা হয়।
অসাধারণ সুন্দর।