নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফাতিন আরেফিন

ভালোবাসি- সাদাকালোর শুভ্রতা...

ফাতিন আরফি

অর্ন্তনীল পথ অন্তসারশূন্য হয় অঘোষিত মত নির্বাসিতই থেকে যায় যা বাঁচে তা মরার জন্যেই বাঁচে আর যা মরে যায়, তা কখনও বাঁচানো যায়না। ফেইসবুক আইডিঃ https://www.facebook.com/Arefin.Fathin1

ফাতিন আরফি › বিস্তারিত পোস্টঃ

রহস্য গল্প- “কাঁঠাল পাতা”

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:২৬

কুরবানি ঈদের দ্বিতীয় দিন। আছরের নামাজ পড়ে মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি। ইদানিং খাওয়াদাওয়ার সাথে সাথে বিশ্রামও একটু বেশি হচ্ছে। হালকা ঘুম পাচ্ছিল, তাই চোখ বন্ধ করে কিছুটা ঝিমুচ্ছিলাম। হটাতই একটা শব্দে আঁতকে উঠলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি একটি কাঁঠাল পাতা। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ বড়। অবাক দৃষ্টিতে এদিক-অদিক তাকালাম- কেউ নেই। তাহলে পাতাটি আসলো কোত্থেকে- আশে-পাশে তো কোন কাঁঠাল গাছও নেই, আমি ভাবতে লাগলাম। হুম, হয়ত বাতাসে উড়ে এসেছে। পাতাটি কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলাম। বিশেষ কিছু খুঁজে পেলাম না। তারপরও কেমন যেন কৌতহল জাগল। কারন, কয়েকদিন আগে এরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল। তখন সাথে দুঃসম্পর্কের ডালিম মামা ছিল। বছর দুয়েকের বড় হলেও তার সাথে বন্ধুর মত সম্পর্ক। পস্পরের বাসা প্রায় পাশাপাশি বলা চলে। রাত দুইটার দিকে আমি আর সে পুকুর ঘাটের সিড়িতে শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। হটাত করে একটা পাতা ঠিক মাথার পিছনে এসে পড়ে। আমি চমকে ওঠে দেখি একটা কাঁঠাল পাতা। মামাকে বললাম, কাঁঠাল পাতা আসলো কোত্থেকে? বাতাসে উড়ে আসছে মনে হয়। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে তখন কোন বাতাস ছিল না। কিন্তু বিষয়টি তখন কোন গুরুত্ব দেইনি। আর না দেয়াটাই স্বাভাবিক, সেদিন ঐ পাতাটি ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকের ঘটনা আমার মনে অজানা এক সন্দেহের সৃষ্টি করল। আমার মনে হল এই পাতাটি আমি আগেও হয়ত দেখেছি। তাই অনেকটা হাস্যকর হলেও পাতাটি মানিব্যাগে ভাঁজ করে রেখে দিলাম।



বরিশাল থেকে লঞ্চে চড়ে ঢাকা আসছি। বিশেষ একটা কাজে সারাদিন বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সাথে শারীরিক পরিশ্রমও হয়েছে বেশ। একটা মাত্র সোফায় আমি আর ছোট মামা। মামা ঘুমিয়ে পড়েছে সেই রাত ৮টার দিকে। এখন প্রায় ১.৩০ বাজে, ঘুমে পড়ে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। অনেক চেষ্টা করলাম, ঘুম আর আসলো না। এক পর্যায়ে অনেকটা বিরক্ত হয়ে ভাবলাম- ছাদ থেকে ঘুরে আসি, হয়ত ভালো লাগবে। ছাদে উঠতে গিয়েই কেমন যেন খটকা লাগলো। দুইটা সিঁড়ি, সাধারনত ছাদে ওঠার একটা সিঁড়ি থাকে। কেন যেন আমার কাছের সিঁড়িটা বাদ দিয়ে পরেরটা দিয়ে উঠতে গেলাম। লঞ্চের রেলিং ডেঙ্গিয়ে ছাদে এক পা দিব এমন সময় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য মনে হল, পানির উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছি। সামনে একটা কাঁঠাল পাতা ভেসে যাচ্ছে আর আমি এক ধ্যানে ওটার পিছু ছুটছি। এরপর ঐ রাতের আর কিছুই আমার মনে নেই। বাকিটা ঐদিন যারা লঞ্চের সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার পর সাহায্য করেছিল- তাদের মুখ থেকে শোনা। তখন আনুমানিক রাত ২টা। আমি সিঁড়ি থেকে লঞ্চের ডেকে পড়ে বেহুঁশ হয়ে যাই এবং ফযরের আযান অবধি ঐ অবস্থায়ই থাকি। আমার শরীর পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর মুখ দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ বের হচ্ছিল। পুরো লঞ্চে হট্টগোল লেগে যায়। মাইকিং করা হয় আমার পরিচিত বা সাথে কেউ আছে কিনা খুঁজতে। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি। লঞ্চ তখনও সদরঘাট পৌঁছেনি। চারিদিকে হইচই, জ্ঞান ফেরছে-জ্ঞান ফেরছে। চারপাশে আবছা চোখে তাকাই, দেখি, লঞ্চের ডেকে শুয়ে আছি আর অনেক মানুষ আমাকে ঘিরে তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে এখানে কেন প্রশ্ন করতেই তারা বিস্তারিত খুলে বলল। আমি স্তম্ভিত হয়ে রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই মনে আসল না। এর মধ্যেই লোকজন এটা-সেটা প্রশ্ন করতে লাগল। আমি কোন উত্তর না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে সোফার ক্যাবিনে চলে যাই। মামা তখনও নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। বুঝলাম এসবের কিছুই সে টের পাইনি। আমিও আর তাকে কিছু জানালাম না। কিন্তু আমার মনে অজানা এক ভয় দানা বাঁধতে লাগল যা আমি কিছুতেই ভাবতে চাই না।



ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকা এসেছি। এসেই পড়াশুনার চাপ। দুদিন বাদে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা, কিছুই পড়া হয়নি। এভাবে পরীক্ষার আগে কোন রকম পড়েই বিবিএ ৭টা সেমিস্টার পার করলাম। রাত একটা পর্যন্ত জেগে কোনরকম এক চাপ্টার পড়েছি। এরপর আর মাথায় কিছুই ঠুকল না। অদিকে ঘুমও আসছে না। ল্যাপটপ খোলাই ছিল। লারসনের প্রোজেক্ট ম্যানেজমান্ট বইটা হার্ড কপি না কিনে অনলাইন থেকে ফ্রি ডাউনলোড করে নিয়েছিলাম। শীটের পাশাপাশি ওটার দিকেও পুরোটা সময় তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। মাথাটা তাই কেমন ঝিম ধরে আছে। বেশ খানিকটা সময় ফেইসবুকে ঘোরাঘুরি করলাম। প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনেও চোখ বুলালাম। ভালো লাগলো না। সেই চিরচেনা বিরক্তিকর নিউজ- দুই নেত্রী মুখোমুখি, দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর একটু খেলার খবর পড়ে ১.৩০ নাগাদ ঘুমুতে গেলাম।



দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্লাট। সাথে বেশ বড় একটা বারান্দা। তবে মেইন রাস্তার পাশে হওয়ায় বারান্দার কোন সুফলই পাওয়া যায় না। এর এক রুমে আমি আর অন্য রুমে ভাইয়্যা-ভাবী থাকেন। কয়েকদিন হল ভাবীর ভার্সিটি পড়ুয়া ছোট বোন তাসনীম এসেছে বেড়াতে। এজন্যে আমি এবং বড় ভাইয়্যা এক রুমে আর ভাবি ও তার ছোট বোন অন্য রুমে ঘুমায়। প্রতিদিনের মত সেদিনও বড় ভাইয়্যা আগে ভাগে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি দেড়িতে এসে চুপচাপ তার পাশে শুয়ে পড়লাম। ভাইয়্যা খুব সকালে ওঠেন। ব্যাংকের অফিসার, রাত অবধি ব্যস্ত থাকেন। তাই ঘুমে ডিস্টার্ব হলে বেশ রেগে যান। অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু ঘুম আসল না। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে আনিতাকে একটা মেসেজ দিলাম। জানতাম কোন রিপ্লাই আসবে না, ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। বেশ কয়েকদিন ধরেই ও খুব চাপের মধ্যে আছে। তেমন একটা যোগাযোগ করতে পারছে না। লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে ফোন দেয়। ওর বাবা-মা আমাদের ব্যাপারটা জেনে গেছে। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক তারা মানতে নারাজ। হুম, না মানাই স্বাভাবিক, চাল-চুলাহীন ছেলের সাথে কোটিপতির মেয়ের সম্পর্ক ক’জন বাবা-মাই বা মেনে নেয়!



সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বাইরে কিছুক্ষণ পর পর একটা কুকুর পাগলের মত কান্নাকাটির সুরে চিতকার করছে। কুকুর আর বিড়ালের এই মরা কান্না স্বভাবটা খুব ভয়ঙ্কর। বুকটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হয়, আশে-পাশে অদ্ভুত কিছু ঘটতে চলেছে। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসল। সারা ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার, অন্ধকার হাতরে কোনোভাবে পানির জগটা খুঁজে পেলাম। গ্লাস ছাড়া পানি খেতে গিয়ে এক গাদা পানি গায়ে পড়ে গেল। এমনিতেই শীত শীত লাগছিল তার উপর ঠান্ডা পানি, শরীরটা আচমকা শিউরে উঠল। পানি খেতে না খেতেই প্রকৃতির ডাক। এটাকে বদ অভ্যাস বলি অথবা সমস্যাই বলি, অসময়ে প্রকৃতির ডাক আশা নিয়মিত একটা অনিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনতো ঢাকায় থাকি, ঘরের মধ্যেই টয়লেট। কিন্তু ছোটবেলা যখন গ্রামে থাকতাম, তখন রাত-বিরাতে ঘরের বাইরে টয়লেটে যাওয়া খুবই ভয়ের কাজ ছিল। গভীর রাত- বাঁশ ঝাড়, বেত গাছ, পুকুর পাড়, কেওড়া গাছের ঝোপ, শিয়ালের ডাক- ভাবতেই কেমন গা শিউরে ওঠে। এখনও যখন গ্রামে যাই, রাতে ওয়াসরুমে যেতে কিছুটা হলেও ভয় করে। তবে এখন সেই গ্রামের মতই একটু ভয় ভয় লাগছে। তাই লাইটের সুইচটা অন করে দ্রুত টয়লেটে ঢুকে দরজা লাগালাম। হটাত অন্ধকার থেকে আলোতে আসায় চোখটা কেমন যেন ঝলসে উঠল। অনেকটা মুভির ফ্লাস ব্যাকের মত, নিজেকে স্থির মনে হল, সময়কে স্থির মনে হল, পুরো বিশ্বকে স্থির মনে হল। অথচ মাথাটা ঘুরছে। এরপর প্রচন্ড এক ঝাঁকুনিতে নিজেকে খুঁজে পেলাম আমদের গ্রামের বাড়িতে। জামিল মামাদের নির্জন সেই ঘর। তারা সপরিবারে প্রায়ই ঢাকা চলে যান। তাদের ঘরটা অনেকদিন জনশুন্য পড়ে থাকে। মাটির ঘর, তার উপর অনেক দিনের পুরোনো। রাত্রিবেলা টিনের চালে ইঁদুর ছুটোছুটি করে। ধপাস ধপাস, চিউ চিউ- অদ্ভুদ সব শব্দ। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে ঐ শব্দ শুনলে যে কারো মনেই ভয় ঢুকে যাবে। আবার প্রায়ই ঐ ঘরে বড় বড় সাপ ঢুকতে দেখা যায়। একদিন সন্ধাবেলা নানা জান স্থানীয় কইয়্যা জাল নামে পরিচিত মাছ ধরার জাল ঐ বাসার চারপাশে পেতে রেখেছিলেন। পরের দিন সকালে দশ-বারো হাতের বিশাল এক গোখরা সাপ ঐ জালে ধরা পড়ে। সে এক ভয়ানক সাপ। সমস্ত জালটা পেঁচিয়ে স্তূপ করে ফেলেছিল। পাঁচ বাড়ির লোকজন সব জড়ো হয়েছিল সাপটি দেখতে। আমি মাঝে মাঝেই মাগরিবের নামায পড়ে বাসায় আসার সময় ঐ ঘরের পিছনে আলো দেখতে পেতাম। আমি তখন ক্লাস সিক্স এ। বইতে আলেয়ার আলোর কথা পড়েছিলাম। ঐ আলো আসলে নাকি মিথেন গ্যাস। আমি কোতুহলী হয়ে সেদিন আলোটির দিকে এগিয়ে গেলাম। যেতে যেতে একে বারে বাঁশের তৈরী বেড়ার কাছে। আলোটা আসছে তাদের ঘরের ভেতর থেকে। আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে অস্পষ্টভাবে দেখলাম, একটি মেয়ে হ্যারিক্যানের সামনে বসে আছে। বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে। হাতে পায়ে প্রকান্ড এক শিকল পড়ানো। কিন্তু এই বদ্ধ ঘরে এই মেয়েটি আসলো কোত্থেকে! ভাবতেই গা শিউরে উঠল। এমন সময় হটাত মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করল। ওমা গো বলে চিৎকার দিয়ে এক দৌড়ে আমি নানুদের বাসায় হাজির হলাম।



আমার খালাতো বোন তিন্নি। নানুদের বাসায় থেকে পড়াশুনা করে। আমাদের এবং নানুদের বাসা একই বাড়িতে। আমার চেয়ে চার-পাচঁ বছরের বড় হলেও তিন্নি আপুর সাথে আমার সখ্যতা অনেক বেশি। আমি তখনই তার কাছে গিয়ে সব খুলে বললাম। সে চুপ করে শুনে গেল, আর অদ্ভুতভাবে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার তাকানোর ধরন দেখে আরো বেশি ভয় করছিল। নিজেকে স্বাভাবিক করতে তাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, কি ব্যাপার তুমিও ভয় পাইছ নাকি।

সে মুচকি হাসল- না রে, তোর মত আমি পিচ্চি নাকি যে ভয় পাবো। এরপর কিছু দেখলে আমাকে বলিস। আর শোন, অন্য কাউকে বলিস না কিন্তু, ভয়ের কথা সবাইকে বলে বেড়ালে ভয় কিন্তু আরো বেশি চেপে ধরে। মনে থাকবে তো। আমি আচ্ছা ঠিক আছে বলে ভয়ে ভয়ে বাসায় চলে আসলাম। আপু মনি হ্যারিক্যান নিয়ে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।



তিন্নি আপুর অদ্ভুত একটা রোগ আছে। বারো মাস তার হাত-পা ফেটে থাকে। দেখতে সুন্দর হলেও হাত-পায়ের তালুর দিকে তাকানো যেত না। হাত-পা ফেটে বিশ্রী হয়ে থাকত। আর মাঝে মাঝেই ভীষণ জ্বর আসত। তখন ঐ ফাটা জায়গা গুলো থেকে ফোটায় ফোটায় রক্ত বের হত। সে এক বীভৎস অবস্থা।



আমি আর ডালিম মামা রাতে একত্রে ঘুমাতাম। একা একা ভয় করত বলেই তাকে সাথে নিতাম। আমাদের পুরানো ঘড়টি ভেঙ্গে চাচা আলাদা ঘর তুলেছেন। আমাদের ঘর তখনও তোলা হয়নি। তাই ছোট্ট ঘুপরির মত আলাদা দুটি অস্থায়ী ঘরে থাকতাম। আমার ঘরটা ছিল বাড়িতে ঢোকার শুরুতে। ঘরের পাশে রাস্তা দিয়ে রাত্রিবেলা লোকজন যাতায়াত করে। তাদের পায়ের শব্দে প্রায়ই ঘুম ভেঙ্গে যেত। সেদিনও কারো পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কে? একটি কচি মেয়ে কন্ঠ উত্তর দিল, আমি। আবার প্রশ্ন করলাম, আমি কে? মেয়েটি আবার উত্তর দিল, আমি। কৌতহল নিয়ে জানলা থেকে তাকালাম। দেখি, সেদিন জামিল মামাদের ঘরের মধ্যে দেখা শিকল পরা মেয়েটি। এখনও শিকল পড়ে আছে। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। এরপর মেয়েটি আবার খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে শুরু করল। আমি ভয়ে ভয়ে ডালিমকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। জানলা দিয়ে মেয়েটিকে দেখাতেই ও ভয়ে আঁতকে উঠল। দু’ তিন বাক্যে ওকে সেদিনের কথা তুলে ধরে বললাম- চল, দেখি মেয়েটা কোথায় যায়। ও বলল, না বাবা, আমি যাবো না। আমি অভয় দিয়ে বললাম, আমরা লোহার দা-কাছি নিয়ে যাবো। ভয়ের কিছু নেই। তখন প্রচলিত ছিল যে লোহা আর আগুন সাথে থাকলে অশরীরী কোন শক্তি কাছে আসে না।



মামাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সামনে আমি থাকার শর্তে মেয়েটির পিছু নিলাম। ইতোমধ্যে মেয়েটি জামিল মামাদের ঘরের সামনে পৌঁছে গেছে। আমরা কাছে যেতে না যেতেই ও ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের কাছে গিয়ে দেখি সেই পুরানো অবস্থা। শিকল পরা মেয়েটি একটি হারিকেনের পাশে বসে আছে। আমি বললাম, চল দোস্তো, ভিতরে ঠুকি। ও রাজি হল না। ভয় পাইছ না, আমি আছি না। আমার সাহস দেখে ও একটু সাহস পেলো। বলল, আচ্ছা চল। আমি ঘরের দরজা নক করতেই দরজা খুলে গেল। সামনের রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছুঁচোগুলো এদিক-অদিক দৌড়ে পালালো। কয়েকটা ইঁদুরও টিনের চালের উপর দিয়ে দৌড়ে গেল। ভেতরের রুম থেকে আলোর রশ্মি এসে চোখে লাগছে। ডালিম ভয়ে কাপছে। দুই হাত দিয়ে আমার এক হাত চেপে ধরেছে। আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। মেয়েটি হারিকেনটা আড়াল করে পিছন ফিরে বসে আছে। আমি ডাকলাম, এই শুনছ। মেয়েটি উত্তর দিল না। আবার ডাকলাম। এবারও কোন উত্তর পেলাম না। একটু সামনে আগালাম। মেয়েটিকে হাত বাড়িয়ে ছুতে যাব ঠিক তখনই কেউ একজন মেয়ে কন্ঠ বলে উঠল, তুই এখানে। আমাকে না জানিয়ে কেন এখানে এসেছিস। হারিকেনের আলোতে ভেসে উঠল তিন্নি আপুর চেহারা। আমরা ভয়ে আঁতকে উঠলাম। ডালিম মা ...গো বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। আমি থর থর কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিন্নি আপু বলল, ভয়ের কিছু নেই। তোরা সামনে বস, আমি আসতেছি। আমরা তাড়াহুড়ো করে সামনের রুমের বিছানায় বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর হ্যারিকেনের আলোতে তিন্নি আপুর ছায়া দেখা গেল। আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে তার ছায়া দেখা যাচ্ছে। কারন, প্রচলিত ছিল যে ভূত- প্রেতাত্মাদের ছায়া থাকে না। তিন্নি আপু এসে আমাদের সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। এরপর সে এক এক করে এই মেয়েটির কাহিনী বলতে লাগল। কাহিনাটা এরকম, মেয়েটি কে, কোথা থেকে এসেছে সে নিজেও জানে না। একদিন সন্ধ্যাবেলা পুকুর ঘাটে এসে সে মেয়েটিকে দেখতে পায়। মেয়েটি তখন কান্নাকাটি করছিল। মেয়েটিকে সে অনেক প্রশ্ন করেছিল কিন্তু কোন উত্তর দেইনি। কান্নাকাটি করেই যাচ্ছিল। এরপর হটাত করে মেয়েটি পানিতে নেমে যায়। ভয়ে বাসায় দৌড়ে আসার পর পরই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। রাতে সে স্বপ্নে দেখে, মেয়েটি তাকে এই ঘটনা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। বললে তার অনেক ক্ষতি হবে। এজন্য সে আজ পর্যন্ত কাউকে এসবের কিছুই বলেনি। এরপর নাকি প্রায়ই সে মেয়েটিকে পুকুর ঘাটে সন্ধ্যা বেলা দেখত। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে গভীর রাতে পুকুর ঘাটে আসত এই মেয়েটির কাছে। জামিল মামারা বাড়ি না থাকলে মেয়েটি এই ঘরে রাত্রে এসে থাকে আবার ভোর হতে না হতেই পানিতে নেমে যায়। মাঝে মাঝে মেয়েটি তাকে এখানে ডেকে আনে। কিন্তু মেয়েটি কখনও তার কোন ক্ষতি করেনি।কখনও কখনও কান্না-কাটি করে, এছাড়া কোন কথাও সে বলে না। এসব শুনে ভয়ে আমার আর ডালিমের গলা শুকিয়ে আসছিল। আমি আর কোন প্রশ্ন করার সাহসই পেলাম না। আমাদের কাউকে কিছু না বলার নির্দেশ দিয়ে তিন্নি আপু বাসায় চলে যেতে বলল। আমরা আয়তাল কুরসি এলোমেলোভাবে পড়তে পড়তে কোনরকম বাসার ভিতর ঢুকি। ঐ রাতে আমি আর ডালিম আর কোন কথা বললাম না। দু’জনেই চুপ করে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরও পাইনি।



আমাদের ঘুম ভাঙ্গল অনেক দেড়ি করে। চারিদিক চিৎকার চেঁচামেচি, হই-হুল্লোড়। পুরো গ্রামের মানুষ এসে জড়ো হয়েছে আমাদের বড় পুকুর পাড়ে। গত রাতে পুকুরে নাকি মাইড নামছে। প্রচলিত আছে, আগেরকার দিনের লোকজন হাঁড়িপাতিল, সিন্দুক বা বড় কোন পাত্রে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র মাটির নিচে লুকিয়ে রাখত। এগুলো কয়েক দশক পুরানো হলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করে। মাঝে মাঝে এগুলো বিভিন্ন পুকুরে ভেসে ওঠে। এগুলোকেই মাইড নামে বলা হয়। আমি নিজেও অনেক বয়স্ক লোককে বলতে শুনেছি যে তারা নিজেরাও নাকি স্বচক্ষে মাইড দেখেছে। আমাদের বাড়ির লোকজন গতরাতে নাকি ঘুমুতে পারেনি পুকুরে ধপাস ধপাস, ধুম ধুম শব্দের কারনে। ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হওয়ারও সাহস পাইনি। এখন সারা গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হয়েছে এর কারন উদ্ঘাটন করতে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল পুকুরের পানি সেচ করে দেখবে বিষয়টা কি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুকুরে তিনটি পানি তোলার পাম্প বসিয়ে সেচ করা শুরু হল। ঘন্টা দিনেকের মধ্যেই বিশাল পুকুরের পানি অর্ধেক কমে গেল। কিন্তু এরপরই ঘটল আসল ঘটনা। একসাথে তিনটি পাম্পেরই পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই বিচলিত হয়ে পড়ল। চারিদিকে চিল্লা-চিল্লি সে এক ধুন্দুমার অবস্থা। এর মধ্যে ছোট মামা চিৎকার করে বলল, এতো চিল্লাচিল্লির কি আছে, মনে হয় ময়লায় পাম্পের পাইপ আটকে গেছে। মামা লুঙ্গিটা খাট করে পেঁচিয়ে পানিতে নামলেন। হটাত করে পুকুরের অন্য পাশ দিয়ে তিন্নি আপুও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাথে সাথে পানি এতোটা কেঁপে উঠল যে মনে হল পুকুরের পানি কানায় কানায় পূর্ন হয়ে গেছে। সবাই একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। মামার চিৎকারে নীরবতা ভাঙল। সে তিন্নি আপুকে শাসিয়ে বলল, তুই নামছিস কেন? তাড়াতাড়ি উঠ, নাইলে কিন্তু টনি দিয়া পিঠায় চামড়া তুলে দিমু। এর মধ্যে নানু বলল, এই মাইয়্যাডার কি বেরাম হইছে, সকাল বেলা দেহি পুকুরে আদমরা হইয়া পুকুরে ভাসতাছে। মামা অবাক হয়ে নানুর দিকে তাকালো। তারপর বলল, তাইলে দেখ তোমার নাত্নীরে জ্বীনে পাইছে কিনা। সারা রাত ও নিজেই পুকুরে লাফালাফি করছে কিনা। সবাই এর ওর মুখের দিকে তাকা-তাকি করতে লাগল। কেউ একজন বলে উঠল, হেডাও হইতে পারে।এরপর অনেকেই বলাবলি করতে লাগল যে, আসল কাহিনী তাইলে এইডাই। তিন্নি আপু চুপচাপ পুকুর থেকে উঠে গেল। আর ঠিক তখনই পাম্পগুলোর ভেতর থেকে একসাথে উচ্চ শব্দে গড় গড় করে পানি নেমে গেল। সবাই আরেক বারের জন্য নীরব হয়ে গেল। এরপর বিষয়টি তিন্নি আপুর রাত্রিবেলা পানিতে লাফালাফি ধরে নিয়ে সবাই যার যার কাজে হাসি-তামাসা করতে করতে চলে গেল।



দুপুরে তিন্নি আপুর প্রচন্ড জ্বর আসল ।হাত-পা ফেটে রক্ত জ্বড়ছে। আমি ভয়ে দুই তিন তার কাছে যায়নি।এরপর একদিন রাতে তাকে দেখতে যাই। জ্বরে আদমরা হয়ে পড়েছিল। শরীরটা শুধু মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। বেশিক্ষন আর সেখানে থাকলাম না। তাড়াতাড়ি বাসায় এসে দরজা-জানলা ভালোভাবে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝ রাতে হটাত শুনতে পেলাম জানলার পাশে কে যেন ডাকছে।আমি ঘুম চোখে ত্রিশ টাকার কেসিও ঘড়িটার বাতি টিপে দেখি ঠিক দুইটা বাজে। আমি বললাম, এতো রাতে কে? আমি উঠে বসতেই দেখি জানলা খোলা, তিন্নি আপু এলোমেলো চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আপু বলল, কিরে কথা বলছিস না কেনো। আমি কোন উত্তর দিলাম না। সে তার বিদঘুটে হাতটা বাড়িয়ে বলল, এই কাঁঠাল পাতাটি রাখ।



ঠাস ঠাস শব্দে আমার চৈতেন্য ফিরল, বড় ভাইয়্যা চিৎকার করছে, নামাযের টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে আর কতখন ধরে বাথরুমে বসে আছো। বাথরুমে কতক্ষন ধরে পানির কল ধরে দাঁড়িয়ে আছি তা জানি না। মনে হয় রাত দুইটা থেকে। হাত-পা শরীর সব কিছু অবশ হয়ে গেছে। আমি ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। মানি ব্যাগের ভাঁজকরা কাঁঠাল পাতাটি ফ্লোরে এসে ছিটকে পড়ল। হতভম্ব হয়ে ওটার দিকে তাকালাম। পানির টেপ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল আর সাথে অদ্ভুত কিছু শব্দ যার ভাষা অনেকটা এরকম, কাঁঠাল পাতাটি রাখ। সাথে সাথে বাথরুম থেকে বের হয়ে মানি ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখি ওখানে কাঁঠাল পাতাটি নেই। শরীর প্রচন্ডভাবে শিউরে উঠল। গা হীম হয়ে আসছিল। জলদি একটা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।



খুব সকালে আম্মুর ফোন। হ্যালো বলতেই আম্মু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সকালে তিন্নি আপুর লাশ বড় পুকুরে ভেসে উঠেছে। গতরাতে হটাত করেই প্রচন্ড জ্বর ওঠে। মধ্যরাত পর্যন্ত নানু পাশেই ছিল। এরপর কখন সে বাইরে গেল কেউ তা টের পায়নি। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। বিস্ময় আর উৎকণ্ঠায় কাঁঠাল পাতাটি দেখতে লাগলাম। ঘন্টা খানেক পর ডালিমের ফোন। ও শুধু একটা কথাই বলল, এবার আর বিষয়টি গোপন রাখিস না। আমি হ্যাঁ বলে লিখতে শুরু করলাম। ৪ঘন্টা লাগলো লেখটি শেষ করতে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.