![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষ হিসেবে একটু ভাবুক টাইপের , যেসব ভাবনার সমাধান আগে হয়নি আর সামনেও হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই ।
রিকশা থেকে নেমেছি খুব জ্যামের মধ্যে, থানা মোড়ে । সাতমাথা থেকে বেশ খানিকটা উত্তরের এই থানা মোড় আমার অনেক পরিচিত একটি জায়গা, যেখানে আসতাম হকার্স মার্কেটে সুলভ মুল্যের জামা কাপড় কেনার জন্য । মনে আছে আমার, সে সময়কার চল্লিশ টাকার একটি হাফ সোয়েটার আজও অনেকে অনেক দামী মনে করে ভুল করে থাকে । যাই হোক, রেলের দু' লাইনের মাঝ বরাবর দিয়ে হাঁটছি একান্ত আপন মনে । বিকেলের সোনালী রোদে পশ্চিমের আকাশ বেশ লাজুক লাজুক লাল রঙ ধারণ করেছে । রেল লাইনের উপর সে রোদের আলো পরে লোহার সমতল পাতগুলো চিকমিক করছে । সে ঝিলিক আমার চোখে এসে লাগছিল । দুরের রাস্তায় বিদ্যুতের তারে কয়েকটা পাখি সারি হয়ে বসে সারাদিনের ক্লান্তি পালকের ঝাপটায় ঝেড়ে ফেলছে বেশ চমৎকারভাবে । নানাবাড়ি যাচ্ছি আমি অনেক দিন পরে, তাই মনে আনন্দের দোলনা দুলতেছিল দারুণ আনন্দে । হাঁটতে হাঁটতে দু'পাশের নানারকম দোকান আর তার গ্রাহকদের নানামুখি ভাব ভঙ্গিমা লক্ষ্য করছি আর ভাবছি সৃষ্টিকর্তা এত বিচিত্র করে মানুষের চরিত্র বানিয়েছেন যে হতবাক না হয়ে কোন উপায়ই নেই । কথার ভঙ্গি , হাত নাড়ানো, চোখের ইশারা, রাগের মাত্রা, হাসির ধরণ, কান্নার আওয়াজ, শিশুদের জেদ, বৃদ্ধদের পরিপূর্ণতার অভিব্যক্তি...আরও কত কী ! মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় রহস্য বুঝি সে নিজেই; কোন মানুষই নিজের চিন্তা-ভাবনা, চাওয়া-পাওয়া, খারাপ-ভাল গুণগুলোর শেষটুকু পর্যন্ত কোনটি কেন ঘটে তার কোন প্রত্যাশিত সুরাহা করতে পারেনা । কারো থাকেনা সে সাধ্য, কারো থাকেনা সে সাধ আবার কারও থাকেনা ধৈর্য বা ইচ্ছা । চলুক না, যেমন চলছে জীবন ।
হঠাৎ করে কাপড়ের দোকানগুলো পেরিয়ে আসতে আসতে চোখ আটকে যায় বাম দিকের এক লুঙ্গিওয়ালার দিকে । নীল রঙের পলিথিন বিছিয়ে পঞ্চাশ ষাটটার মত লুঙ্গি নিয়ে দু' হাঁটুর মধ্যে হাত দুটি গুটিয়ে রেখে উদাস দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে । কপালটা বেশ চওড়া, তেল মাখা চুলগুলো উপরের দিকে ভাজ করা । পরনের সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গির মধ্যে আভিজাত্যের একটা চমৎকার লক্ষণ উঁকি মারছে । আনমনে এগিয়ে গেলাম তার কাছে । ছেদ পড়ল তার উদাস ভাবনায় । বললেন- বাবা, লুঙ্গি নিবেন ? আমি বললাম- না চাচা, লুঙ্গি ঠিক নেবনা তবে দামের আইডিয়াটা নেব । আচ্ছা চাচা, আপনি কতদিন ধরে লুঙ্গির ব্যবসা করেন ? বৃদ্ধ- খুব বেশী দিন না । হবে গোটা চার পাঁচ বছর । আমি বললাম- হু, বুঝলাম । তাহলে তার আগে কী করতেন ? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ বললেন- সেডে অনেক লম্বা হিসটরি !
- কী হিসটরি ? বলা যাবে আমাকে ?
- হামার হিসটরি আপনেক কয়ে কি হবে ?
কিছু হবেনা তবে শুনতে এমনিতেই ইচ্ছে করছে, না বললে জোর করবনা আপনাকে ?
এবার বৃদ্ধের চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে এল । ভরসা পেলাম এই ভেবে মেঘ যেহেতু অনেক কালো হয়েছে বৃষ্টি তো হবেই । গল্পের নায়ক এবার যা বলল তাতে আমার ভাষা হুবহু আসবে কি না তাতে ঢের সন্দেহ আছে ।কারণ বগুড়া শহরের সাথে সম্পর্কের বাধন অনেক শিথিল এখন । আঞ্চলিক ভাষাটা তাই পুরোপুরি আসেনা তাই ।
উনি বলতে শুরু করলেন -" হামাগেরে বাড়ি ছিল চিলেকারে গাঁয়ে । হামার বাপ দাদার প্রায় তিনশো বিঘে সয়- সম্পত্তি ছিল । হামরা ছিলাম তিন ভাই, কোন বোন ছিলনা । বাপের কাছ থেকে প্রায় একশো বিঘে জমি পাছিলাম । আল্লাহর রহমতে হামারও দুই বেটা হছিল । বড় বেটাটা লেখা- পড়ায় অনেক ভালো আছিল । কোনদিন অভাব কি জিনিস হামরা বুঝিনি । কুনটি ( কোথা ) থেকে যমুনা নদী আসলো সবকিছু গ্রাস করার জন্য- হামরা টেরই পাইনি । নদীর জন্যে জমি আর কেউ কিনে নিবের চায় না । সব জমি চলে গেল নদীর মদ্যে ।আগে কিছু জমি বেচে শেরপুরে জমি কিনছিলেম । তিন বিঘের মত । কয়েক রাতের মধ্যে পুরো চিলেকারে সাবার করে দিল ! বউ বেটাগ্যারে সাথে করে চলে অ্যাসে শেরপুরে বাড়ি করলাম । বড় বেটা এই বগরেত ( বগুড়াতে) এসে ভর্তি হল আর হামি শেরপুরে একটা কাপড়ের দোকান দিলেম । একদিন হঠাৎ করে শুনি যে, ম্যাস থেকে হামার বেটাক পুলিশ ধরে নিয়ে গ্যাছে ! মাথাতাটা গরম হয়ে গেল । যে ম্যাসত উই (ও ) থাকত অডেত নাকি বড় জেগলে ছিল সব দল করত, রাজনীতি করত । অকও নাকি মাথা নষ্ট করে দলত ঢুকে নিছিল । যাই হোক অক ছাড়ানোর জন্য হামার দোকানের প্রায় অর্ধেক চলে গেল । পরে অকতো অনেক শাসন করলাম, ওর মা অনেক কান্নাকাটি করে বুঝাল আর অগলে না করার জন্য । অক আবার পাঠালাম বগরেত । কিন্তু বাবা, হামার দুঃখের কপাল আর হামার পিছে থ্যাকে গ্যাল না । অর কলেজত মারামারি হল । এক ছাত্র মরল! অর উপর মার্ডারের কেস হল । নিজের যা ছিল সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করলাম, তবুও রক্ষা হলই না ! ব্যটাডা হামার আজও জেলত আছে, জানিনা কবে উই ছাড়া পাবে ।
কপালত যদি দুঃখ থাকে তালে নাকি স্বর্গত গ্যালেউ দুঃখ হয় ! তারপরে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ল হামার জন্য । ছোট বেটার মাথার ব্রেন একবারেই ভালো ছিলনা । তাই অক ঢাকাত পাঠালাম কোম্পানির চাকরি করবের জন্য । করলও ভালভাবে ছয় মাসের মত । তারপরে হাঙেরে এই দেশত শুরু হল সেই সর্বনাশা আগুন ! হরতাল আর মারামারি ঢাকাত যেন আজরাইল হয়ে ন্যামে অ্যাসল । কোম্পানির চাকরিত একদিন না গেলে নাকি ব্যাতন ক্যাটে র্যা খ্তো । অরা মানে মালিকরা নাকি হরতাল তরটাল কিছুই মানত না । এই অবস্তার মদ্যে একদিন বাসত চড়ে উই অফিসত যাচ্ছিল । এক জায়গায় গাড়িত মাস্তান আর গুন্ডেরা হরতাল করার জন্য বাস থামায়ে বাসের মানুষজন আর বাসের উপর লাঠি সোডা নিয়ে পশুর মত অ্যাটাক করে । হামার বেটার মাথায় লাঠির বাড়ি লাগে আর তারপরি..................
চোখের জল গড়ানো দেখে আমার খারাপ লাগার মাত্রাটা চরম হল এই কারণে যে মানুষটার শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতে আমি বুঝি আবার আঘাত করলাম । কেন যে আমার এমন হতবুদ্ধি হল ! বৃদ্ধ আবার বলা শুরু করলো,
“ হামাগেরের জন্যই উই মরল । হামাগেরেক কামাই করে খাওয়ানোর জন্যই তো অক ঢাকাত পাটাছিলাম । এখন ভাত খেতে গ্যালে ভাতকে বিষ মনে হয় । অর মরার পর থেকেই অর মা কোন কথা বলতে পারেনা - জবানবন্দী হছে । খালি ফ্যাল ফ্যাল করে ত্যাকে থাকে । সব শ্যাষ হবার পরে আজ এরকম ফেরি করে লুঙ্গি বেচি আর অর মার অসুদের টাকা যোগাড় করি । তাও সবদিনই হয়না ! আল্লাহ আর কী লেখে রাখছে এই কপালততা আল্লাহই ভালো জানেন।য্যাক বাবা, দুয়া কর হামার ব্যাটাগেরে জন্য ! "
বৃদ্ধের চোখের দু' কোণ থেকে লোনা জলের দুটো ধারা দু গাল বেয়ে নিচে নেমে এসেছে । আর তা দিয়ে যতক্ষণ পানি গড়িয়ে গেছে তা আমি খেয়াল করলাম ঠিক, কিন্তু তা নিবারণের কোন উপায় খেয়ালে আনতে পারলাম না । মনে হল অনেকক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেলাম । 'আসি চাচা' - বললাম বৃদ্ধকে । জবাবে উনি কিছুই আর বলতে পারেনি । বাকী পথটুকু হাঁটতে গিয়ে আমি আর ডান বাম কোন দিকে তাকাইনি, না কোন মানুষের দিকে, না কোন বিদ্যুতের তারে বসা পাখির পানে । সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছিল, বৃদ্ধের জীবনে যেমন এসেছিল, কিন্তু ফিরে আর যায়নি ; হয়তোবা যাবেও না !
©somewhere in net ltd.