![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষ হিসেবে একটু ভাবুক টাইপের , যেসব ভাবনার সমাধান আগে হয়নি আর সামনেও হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই ।
পাথুরে মায়া
========
ফেরদৌস আলম
----
ঠিক সেদিনটাও ছিল এমন মেঘছায়ায় বিষণ্ণ সাদামাটা এক পৌষের পড়ন্ত শহুরে বিকেল । যেন আচমকা আনন্দ হারিয়ে গেছে এই কোলাহলময় ব্যস্ততা ফেরি-করা ঢাকা শহরের বুকের জমিন থেকে । যদিও ছোটাছুটি থেমে নেই, থেমে নেই ধুলো-বালিদের আহ্লাদি উড়াউড়ি, কাঁকগুলোর কা-কা ডাকের খাঁ-খাঁ করা শুন্যতাও নেই স্তব্ধ হয়ে । তবুও এই গুমোট ভ্যাবসা টাইপের মেঘলা শীতের আকাশ দেখে কেন জানি মনে নিরানন্দ আবেগগুলো হানা দেয় অনিচ্ছা সত্বেও । পিলার ঘেষে বসা এই চরম কৌতুহলী কিশোর তার উল্টো দিকে বসা শুভ্র কেশ ও দাড়িভর্তি বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি দেয় বারবার । বিশ্বাস হয়না তার কাউকে, করা সম্ভব নয় অন্তত এই মুহুর্তে ; কারণ এই শহরটার নাম নাকি ‘ঢাকা’ । এখানে সকল মানুষেরই আসল রুপ নাকি বাহিরের ছদ্মবেশের আড়ালে ঢাকা, মিষ্টি ভাষ্যের আড়ালে হিংস্র দৃষ্টি, স্বার্থপরতা উঁকি দেয় সকল মনোমুগ্ধকর হাসির আড়াল থেকে, এই শহরে। পাথরে পাথরে ঢাকা এই দালান-কোঠার নিচে নাকি চাপা পরে আছে এই শহরে বসতি-গড়া আজব আজব চরিত্রের মানুষগুলোর মায়া, ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতির সকল জোনাকি । আর অন্যদিকে এই শহরে আসল জোনাকির বদলে রুপ বদলে-ফেলা মরিচিকাময় জোনাকির ছড়াছড়িও অনেক । জোনাকিগুলো শুধুই হঠাৎ হঠাৎ দুঃস্বপ্নে দেখা দেয়, ধরা দেয় এই মানুষগুলোর কাছে । বিছানায় শায়িত মানুষগুলো সে স্বপ্ন দেখতে ঘেমে ঘেমে হয়রান হয়ে যায় , ভেবে বসে যে অন্যরকম জোনাকিগুলো তাদের একেবারেই হাতের মুঠোয় ! কিন্তু না, স্বপ্নভঙ্গ হয়, নিঃশ্বাস খুব জোরে উঠানামা করে , গ্লাস বা মগে থাকা পানি খেয়ে নেয় এবং পরের দিনে আবারো ছুটে চলে ! সেই জোনাকিগুলো ধরার আশায় । অস্তিত্বহীন এ জোনাকিগুলো তাদের পিছন পিছন ছুটে নিয়ে বেড়ায় এই দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য এক বিশাল জনস্রোতকে । তাই তো কিশোরটির ভয়ের মাত্রা তুঙ্গে, শুধু কাউকে চুড়ান্তভাবে বিশ্বাস করতেই । এই কিশোরটি আমিই ছিলাম , যে কিনা প্লাটফর্মে বসে, হাতে একটা মামুলি ব্যাগ, পকেটের চোরা পকেটেও বারবার হাত দিয়ে দেখি শ তিন চারেক টাকা ঠিকঠাক আছে কিনা । ডান পকেটে রাখা নোকিয়া এগারশ মডেলের এত এত দামী মোবাইলটাও বেহাল তবিয়তে আছে তো ! কারণ সময়টা ছিল প্রায় অর্ধযুগ আগের একটা সময় । বিমানবন্দর সংলগ্ন উত্তরার ‘বিমানবন্দর রেলস্টেশন’ সেই প্রথম আমার পদচারণায় হয়তো প্রচণ্ড বিরক্ত, এমন গাঁইয়া এক উটঁকো কিশোরকে দেখে ।
স্টেশনে ঢুকেই একটা পিলারের বসার জায়গাটাই বসে পড়ি। মনে হয়, এই যথেষ্ট । যাত্রীদের ওয়েটিং রুমের বারান্দায় আমার চোখ আটকে যায় রোদ চশমা পরা পরিপাটি, সম্ভ্রান্ত ও লাবণ্যময়ী ত্রিশোর্ধ্ব এক মহিলাকে দেখে । বাংলা সিনেমার দেখা সেই ‘ বড় লোকের মেয়ে’র ছবি চিত্রপটে ভেসে আসে আমার অথবা ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসের মেমসাহেবের মত । পরনের সালোয়ার কামিজ খুব খুব আভিজাত্যের ছাপ বহন করে চলেছে । লম্বা চুলগুলো সম্ভবত লোকে বলে ‘সিল্কি’ টাইপের হবে এবং প্রচণ্ড রকমের পরিপাটি । চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ বেশ কড়াই মনে হচ্ছে । পাশের ট্রাভেল ব্যাগদুটিও দাড় করে রাখা হয়েছে সমান করে । হালকা ঘামছে এই শীতেও, তাই সম্ভবত অফ হোয়াইট কালারের একটি টিস্যু বাম হাতে । আর ডান হাতে ধরা আছে অসম্ভব সুন্দর একজন মানবপ্রাণী । আমি হতবাক সেই অসম্ভব সুন্দর মানবপ্রাণীটিকে দেখেই । মানুষ এত সুন্দর হয় ! যেমন মিষ্টি ফর্সা, টোল পড়া গাল বেশ ফোলা ফোলা, ঘন কালো মাথার চুল, চেহারার মধ্যে মায়ার ছাপ যেন ষোলো-কলা পূর্ণ করা, প্রচণ্ড আদুরে মুখাবয়বের এই মানবপ্রাণীটি মনে হয় এই মহিলারই পাঁচ-ছ বছরের ছেলে সন্তান ! আমার সমস্ত মনযোগ এই দূরন্ত এবং মিষ্টি ছেলেটার চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগলো ।
ছেলেটি বেশ করে ঠোট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলছে আর ওর আম্মুর হাত ধরে জোরে জোরে টানছে, ঝাঁকুনি দিচ্ছে । এমন মায়াভরা কান্না দেখে যে কারও ইচ্ছে হবে ওর গালে আদর করে কান্না থামিয়ে দিতে । কিন্তু মহিলাটি নির্বিকার , সোজা সামনে তাকিয়ে, রেল লাইনের পাথরের মত স্থির হয়ে কিছু একটা ভাবছে । মনে হল ছেলেটি কিছু একটা খাওয়ার জন্য বুঝি জেদ করছে । কিন্তু পরক্ষণেই আমার ভ্রম ছুটে গেল, নাহ, মহিলাটি তো তার ছেলেকে কোন খাওয়ার আবদার থেকে দূরে রাখবেনা । কারণ তার অর্থবিত্ত তো কম থাকার কথা নয় ! কিছুক্ষণ চেষ্টার পর রাগে, ক্ষোভে ছেলেটি ওর আম্মুর হাত ছেড়ে দিল । প্রায় দু হাতের মত দুরত্ব তৈরি করলো তার মায়ের থেকে, কিছুক্ষণ পরে আরো দু হাত এবং প্রায় দু মিনিট পরে আরও দু হাত সরে গেল । গালসুদ্ধ কান্নাভেজা দৃষ্টি নিয়ে বারবার মায়ের দিকে তাকায় , যেন চাচ্ছে মা তাকে একটু হলেও আটকে রাখুক, বাধা দিক । না, তা হলনা । নিরুপায় হয়ে পুর্বের দৃশ্যের অবতারণা করলো সে । হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে স্টেশনের বাইরে তার মাকে । কিন্তু জননী তার আগের মতই অটল তবে মুখে এবার খানিকটা আদুরে সান্ত্বনা দেখলাম, মাথায় কোমল হাতের পরশ বুলিয়ে দিল, যেন স্নেহ গলিয়ে দিল । তবে এসবের কিছুই সে মানছে না । সে বাইরে যাবেই যাবে । এহেন দৃশ্য আমায় আরও আগ্রহী করে তুলল – আসলে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে তা দেখার জন্য ।
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে কয়েকটা দামী চকলেট ধরিয়ে দিলেন মহিলাটি তার ছেলের হাতে । সে প্লাটফর্মের বারান্দায় তা অত্যন্ত অগ্নিশর্মা হয়ে ছুড়ে দিল । মহিলা সেগুলো তুলল না । উনি আবারো স্তব্ধ, কী যেন ভাবছেন উদাস হয়ে, সারাটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে । যেন কষ্টের বিষ বাতাস তাকে ঘিরে রয়েছে সর্বশক্তি নিয়ে । এই দু অভিনেতার মারাত্মক রকমের আবেগপ্রবণ আর বেদনাসমৃদ্ধ অভিনয়ে আমার মত দর্শক কুপোকাত হয়ে গেল নিমেষেই । মিনিট পাঁচেকের জন্য ছেলেটি কান্না ভুলে গেল , প্লাটফর্মের বারান্দার কিণারায় এসে দাড়াল, এদিক ওদিক হাটল । হাতে ধরে রাখা পটেটো চিপ্সের প্যাকেট থেকে দু একটা ছুড়ে ফেলে দেখল- কতটা দূরে নিক্ষেপ করতে পারে সে । আর অন্য দিকে ওর মা এদিক ওদিক হালকা পায়চারী করল । অনবরত বিন্দু বিন্দু করে ছুটে চলা ঘাম আবারো টিস্যু দিয়ে মুছে নিল । কয়েকবার মোবাইলটা কানে নিয়ে কারো সাথে কথা বলে ফেলল অনেকটা উদ্বেগ নিয়ে ।
এবার দৃশ্য নতুন উত্তেজনা ছড়িয়ে আগের সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল । প্রথমবারের মত ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে ওর আম্মুকে বাহিরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে । মহিলা হাতটিকে আগের মত অবশ করে এলিয়ে দিয়েছে । আবার ছেলেটি দুরত্ব বাড়াতে থাকল, মা হয়তো ভেবেছে বেশী দূরে যাবেনা ও । কিন্তু এবার সে সোজা স্টেশনের বাইরে উধাও! মহিলা হতদন্ত ছুটে গেল বাইরে এবং প্রায় দশমিনিট পরে টেনে হিঁচড়ে ছেলেকে নিয়ে আবার আগের জায়গায় হাজির । ছেলেটিও আগের চেয়ে করুণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে যে, আমারই মনে হচ্ছে ওকে একটু থামিয়ে দেয়া উচিত; যে কোনকিছুর বিনিময়ে হলেও । হঠাৎ এবার দৃশ্যে তৃতীয় চরিত্রের প্রবেশ এবং সেটি সম্ভবত ছেলেটির বাবা । এখন ও বাবার একটি এবং মায়ের একটি হাত ধরে টানছে আর কাঁদছে । বাবাটা তার সারা দুনিয়ার স্নেহমাখা শব্দরাজির ব্যবহার করে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেই চলেছে । আর এর ফাঁকেই স্বামী-স্ত্রী কিছু সিরিয়াস বা মনে হয় বিদায়ী কথাবার্তা চালিয়ে নিচ্ছে । হঠাৎ শুনি ট্রেনের হুইসেল, শেষ দৃশ্য না দেখার চরম আক্ষেপ নিয়ে সকল হুমড়ি খাওয়া যাত্রীর মত আমিও পাগলপ্রায় হয়ে ছুটলাম বগির দিকে । অনেক ঘাম ছুটিয়ে জানতে পারলাম যে, এটি রাজশাহীর ট্রেন নয়, চট্টগ্রামের । বিফল মনোরথে ফিরে এসে বসলাম আবার আগের পিলারটায়, দৃষ্টি ফেরালাম সেই বারান্দায় । কেউ নেই ! কী আশ্চর্য ! আগের চেয়ে এবার বেশী মন খারাপ হয়ে গেল । দৃষ্টি ঘোরালাম সেই ট্রেনটার দিকেই । যা দেখলাম তাতে থমকে গেল আমার কিশোর চঞ্চলা মন !
একটি বগিতে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যদিয়ে সেই মহিলা, ছেলে আর তার স্বামী বগিতে উঠে গেল । ছোঁয়াচে বা পুষে রাখা অথবা চেপে রাখা আবেগগুলি জলের ধারা হয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে চাইছে এবার মহিলার চোখদুটি দিয়ে । ছেলেটি তার কোলে । এমনভাবে জাপটে ধরে আছে যেন পৃথিবীর কোন শক্তি নেই তাকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করার । কেঁদে কেঁদে অনেক অনুনয়-বিনয় করে সে যেন জানাচ্ছে তার শেষ আকুতি । আর মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে চুমো দিচ্ছে তার নিষ্পাপ ছেলেটির সারা মুখমণ্ডলে । দিনটি ছিল শুক্রবার । বুঝতে বাকী রইলনা আমার যে, মহিলাটি হয়তো সরকারী চাকুরীজীবি, কর্মস্থল চট্টগ্রামে । কিন্তু স্থায়ী বসতি এই পাথুরে শহরে । ট্রেনের চাকা নড়ে উঠলো, বাবা তার ছেলেকে নিয়ে নেমে আসলো, যেমন লতা জড়ানো গাছ থেকে টেনে ছিড়ে ফেলা হয় অবাঞ্চিত লতাগুলোকে, ঠিক তেমন করে । চলন্ত ট্রেনের বগির বারান্দায় এক মা দাঁড়িয়ে, যার চোখের জল গাল বেয়ে নামছে বুকে রক্তক্ষরণ করে, ছেলে প্লাটফর্মে হাত উঁচিয়ে তার মায়ের দুর্মূল্যের আদুরে পরশের সীমানার নাগাল পেতে বৃথাই কেঁদে যাচ্ছে । শেষ অব্দি আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল ! এই শহরের মানুষগুলোর মাঝেও মায়া আছে, পাথুরে মায়া ! শ্যাওলা পরা পাথুরে দেয়ালের উপরেও যেমন অনেক পরগাছা জন্মে অসাধ্যকে সাধন করে, তেমন করে সকল বাধা পেরিয়েই এই পাথুরে মায়ার কারণেই পাথুরে দেয়ালগুলো অপার সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে !
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৯
সজীব তালহা বলেছেন: ভালো লাগলো।