নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কিছু কথা কিছু ব্যথা

ফেরদৌস প্রামানিক

আমি মানুষ হিসেবে একটু ভাবুক টাইপের , যেসব ভাবনার সমাধান আগে হয়নি আর সামনেও হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই ।

ফেরদৌস প্রামানিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

আঁধারের যাত্রী

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৫০

আঁধারের যাত্রী
---------------

স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে সাঁটানো বর্গাকৃতির আয়নাটা কে কোত্থেকে এনে লাগিয়েছিল তা জানা নেই পারভেজের । শুধু আয়নার নিচে কলমের কালিতে লেখা এক মহাবাণী – ‘‘কাল আমি ছিলাম, আজ নেই। আজ তুমি আছ, কাল থাকবেনা ।’’ কথা তো নয়, যেন প্রবাদ । মেস জীবনে কে আর জনম জনম ধরে বসে বসে ধ্যান করবে । বিদ্যের বোঝা যত তাড়াতাড়ি পিঠ থেকে নামানো যায় ততই ভালো । তারপর আবার ছুটে চলা । সংসার ধর্ম পালনের জন্য । কী অদ্ভুত ! মানুষের জীবন । থেমে থাকেনা, তবে থেমে যায় একেবারে । তারপর আর ছুটতে হয় না, ইচ্ছে থাকলেও । এই দেখ, আবার ভাবতে শুরু করে দিয়েছে পারভেজ । আজকাল বড্ড ভাবে , যখন যা মনে আসে তাই । যখন তখন, সময় পেলেই । কাজ করতে করতেও । ভাবতে ভালোই লাগে । তবে এর বেশীর ভাগই যে আকাশ কুসুম সে ব্যাপারে নিশ্চিত সে । তাই পরে খারাপ লাগে । সম্বিত ফিরে পেয়ে চিরুনিটা হাতে নেয় । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে । সমাজ বিজ্ঞানে, ২য় বর্ষে । নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন কোন পরিবারের ছেলে সে নয় । তার পরিবারে নুন থাকলে পান্তাই থাকেনা অথবা পান্তা থাকলে নুন থাকেনা । তাই নিজের গরজে ভার্সিটিতে ভর্তি হয় সে । দুটো প্যান্ট আছে তার । কোমরের মাপের চেয়ে ২ ইঞ্চি বড় । অন্যের দান । একটা গেঞ্জি বেশ ফ্যাকাশে রঙের । ওটার রঙের নাম বলতে গেলে বলতে হবে ‘ময়লা ময়লা কালার’ । আরও দুটো ফুলহাতা শার্টও আছে । বেশ ঢিলে ঢালা । যেন পরিধেয়গুলো ওকে দেখে ঠাট্টা করে । তার পুরাতন বেল্টটারও কৃতিত্ব অনেক, তার ভুঁড়িওয়ালা প্যান্টগুলোর জন্য । বিধ্বস্ত মানুষের চারপাশটা বুঝি এরকম বিধ্বস্তই হয় । আজ দুপুরের পর ঘুমিয়েছিল সে । এটা তার অভ্যাস বিরুদ্ধ । তখন সবেমাত্র গোসল করেছে । মাথাটা হালকা ভেজা ভেজা ছিল । বালিশের চাপে তাই মাঝখানের চুলগুলো সিধির উল্টো দিকে খাড়া হয়ে গেছে । আর সেগুলোই চিরুনী দিয়ে সোজা করার চেষ্টা করছিল সে । যখন হলো না, তখন অগত্যা ছেড়ে দিল । শার্ট প্যান্ট পরে নিয়ে বের হল মেস থেকে । দুটো টিউশনি করে সে । তার মধ্যে প্রথমটা বিনোদপুরে । তার ছাত্রমশায় ভার্সিটির কর্মচারীর ছেলে । তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র । বেশ বোকা সোকা । পড়াশুনা তাই মাথায় বেজায় কম ঢুকে । তার রেজাল্টেও তাই থার্ড ক্লাস মার্কা একটা ভাব আছে । সাতশো টাকা মাইনে পারভেজের । রেজাল্ট ভালো না হলে মাইনেটাও বাড়বেনা বলে দিয়েছে তার জন্মদাতা মাতাপিতাগণ । হাল তাই ধরেই আছে পারভেজ । যদি সোনা ফলে ।

যাহোক, মেহেরচন্ডী থাকে পারভেজ । সবচেয়ে কম ভাড়ার মেস এখানে মিলে, তাই সে এখানেই থাকে। অবশ্য হল পেলে হলেই উঠে যাবে । মেস ছেড়ে বাজার পরে তার পথে, এরপর সোজা রাস্তা ধরে বিনোদপুর । দু’ পাশের লম্বা লম্বা কড়ই আর ইউক্যালিপটাস বৃক্ষগুলো তার নিত্যদিনের ভ্রমণসঙ্গী , তবে নিশ্চল । যেতে যেতে কত কথা হয় এদের সাথে । যেন খুব দরদ নিয়ে এরা পারভেজের কথাগুলো শুনে, দুঃখ বোঝে আর সেই সাথে অশ্রু ফেলে । আজ এদের মনটাও যেন খুব খারাপ । দুপুরে খাইনি সে । বেশ ক’দিন ধরেই সে দুপুরে না খেয়ে থাকে । হাতে যে টাকাগুলো ছিল তাতে তিনবেলা ভাত খেলে মাস যাবেনা তার । দুটো বিস্কুট খেয়েছে । এখন কিন্তু তার শাস্তি টের পাচ্ছে ভীষণভাবে । মাথাটা বেশ ঘুরছে, পেটটা শক্তভাবে মোচড় দিচ্ছে । তবুও তার লম্বা লম্বা পা ফেলে পথের দুরত্ব কমিয়ে আনছে । শরীরটা বেশ হালকা গড়নের । দেখলে মনে হবে আস্ত কঙ্কালের উপর চামড়া বসিয়ে দিয়েছে, আর সেই সাথে কিছু রক্ত – ব্যস, পুর্ণ মানুষ হয়ে গেছে । যার নাম পারভেজ । সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় চলে আসে টিউশনির বাসায় । ছাত্রের নাম সোহাগ । আসলেও তার উপরে বাবা মা, আত্মীয় স্বজন এমনকি সৃষ্টিকর্তারও অনেক দরদ আর সোহাগ । তাই নামখানি বেশ সার্থক । সোহাগকে নিয়ে সে টেবিলে বসল । মিনিট দশেক পরে নাস্তা আসলো । ছোলা আর মুড়ি মাখা । দুপুরের না খাওয়া পেটের জন্য এটা কিছুই না, তবুও আপাতত ক্ষুধার ঝড় তো থামবে । ছাত্রকে পড়ায় আর গোগ্রাসে গিলতে থাকে পারভেজ । একসময় ছাত্র বলে,
বলুন তো স্যার, আমার এই শার্ট আর প্যান্টের প্রাইজ কত ?
- কত হবে ? এক হাজার ।
- হাসিতে ফেটে পরে সোহাগ বলে, স্যার আপনার তো কোন আইডিয়াই নাই। এটার দাম তিন হাজার দুইশো টাকা ।
- তাই নাকি ? অবাক হয় পারভেজ ।
- তাও তো এটা অনেক কম । আমার আরও অনেক ভালো একটা ড্রেস পছন্দ হয়েছিল কিন্তু আব্বু কিনে দেয়নি । ওটার দাম ছিল পাঁচ হাজার ।
হঠাৎ করেই আনমনা হয় পারভেজ । জীবন কোথায় কেমন । আমার পুরো মাস চলে পনেরশো টাকায় । আর আমার ছাত্রের ড্রেসের দামটাই..... ! ছেলে বেলার কথা মনে পরে । বাবা মারা যাওয়াই সে কোনদিনও কারো কাছে আবদার করতে পারেনি যে, আমাকে এটা কিনে দাও,ওটা কিনে দাও । অনেক চাপা আর ঘন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর । পড়ানো শেষে তার হাতে একটা হলুদ খাম ধরিয়ে দেয়া হয় । বাড়ির বাইরে এসে খুলে সে । একশো টাকার নোট, সাতটি । আরেকটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের ভিতর থেকে । আধো আধো সন্ধ্যা নেমে আসে । কাউকে কিছু বলার নেই, বলেই বা লাভ কতটুকু । বলতে বলতে বলার ইচ্ছেশক্তি ফুরিয়ে যায় , নিস্তেজ হয়ে আসে মনোবল । আবার হাটতে শুরু করে সে । কাজলা যেতে হবে । দ্বিতীয় টিউশনিটা ওর এখানেই । ছাত্রের বাবা থানার ওসি । তাই টাকাও অঢেল । তাই একশো টাকা মাইনে বেশী এখানে – আটশো টাকা । একশো টাকা কতটুকু বেশী তা শুধু আল্লাহ্‌ই ভালো জানেন । মিনিট পনের খরচ হয় এখানে আসতে । তিনতলার বড়সড় বাড়ি । দ্বিতীয় তলায় পড়াতে হয় । বিলাসিতা আর আরাম আয়েশ কী জিনিস- এ বাড়িতে প্রথম এসে জানতে পায় পারভেজ । কী নেই ? সব আছে । অনেক জিনিসের নামই সে জানেনা । তার এই ছাত্রের নাম মিথ । মিথ্যা বলায় ‘মিথ’ এর মিথের বা রহস্যেরও শেষ নেই , সেই সাথে পড়াতে ফাঁকি দেয়ার হাজারটা কৌশল তার আয়ত্বে । পড়ানো শুরু করার বেশ কিছুক্ষণ পরে তার নাস্তা আসে । মিথের মা প্রত্যেক দিন নাস্তা আনে । চেহারায় তার আভিজাত্যের ভাব বেশ স্পষ্ট । দামী পোশাক, গহনা, সবই তার পরনে শোভা পায় । যাহোক, একটি মিষ্টি আর গোটা চারেক বিস্কুট দিয়ে তিনি চলে যান । আবার খায় সে, আগের মতই গোগ্রাসে । হঠাৎ মিথ জিজ্ঞেস করে ,
- স্যার, বলুন তো আম্মুর মধ্যে আজ একটা পরিবর্তন হয়েছে । সেটা কী ?
- আমি কিভাবে বলব ? তোমার আম্মু তো আগের মতই আছে ।
- না স্যার, খুব ভালো করে মনে করুন না । মিথ তাড়া দেয় !
- পড়তো ঠিক করে । পড়া ফাঁকি দেয়ার কৌশল, তাই না? ঢের বিপদ তো !
এবার পারভেজ সত্যি সত্যি ভাবে । কিন্তু ভেবে মাথামুণ্ডু কিছুই পায়না । শেষে মিথকে বলে,
- আচ্ছা, আমি পেলাম না । তুমি বলে দাও ।
- আরে স্যার, পেলেন না । আজ দেখলেন না আম্মুর চুল কত সুন্দর, সোজা সোজা আর চকমকে ।
- কই ? আমিতো দেখলাম না ।
- আপনি ভালো করে খেয়াল করেননি, তাই । আচ্ছা স্যার, বলুন তো আম্মুর চুলের এইসব কাজে কত টাকা লেগেছে ?
- কত আর লাগবে, পাঁচ – ছয়শো ।
- হা, হা, হা, হা, .................. । অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে সে, এটা করতেই আম্মুর পাঁচ হাজার টাকা লেগেছে।
কিছুক্ষণ হা করে থাকে পারভেজ । তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে মিথকে বলে পড়তে । আনমনা হয়ে আবারও ভাবনায় ডুবে যায় পারভেজ । পাঁচ হাজার থেকে তার মাইনে বিয়োগ দিলে যা বাকী থাকে তা অনেক । সহস্র লক্ষ মাইলের দুরত্ব । যেমন দুরত্ব কারো চুল আর কারো মাইনের মধ্যে, সারা মাসের অন্নের আর কারো ড্রেসের মধ্যে । কিছুক্ষণ পর আবার একটা হলুদ খাম আসে । মিথ বলে,
- খুলব স্যার এটা ?
- খোল ।
- এবার টাকা গুণে মিথ । একশো, দুইশো, ........ আটশো ও ও ও ও । এবার মিথ জিজ্ঞেস করে এত টাকা দিয়ে কী করবেন স্যার ?
- বিস্কুট খাব ।
- কেন স্যার, আইসক্রিম খান না আপনি ? আমরা প্রত্যেক দিন বিকেলে একটা করে খাই । একেকটার দামই তো দেড়শো টাকা । স্যার, আপনি আটশো টাকায় কয়দিন বিস্কুট খাবেন ?
- যে কয়দিন যায় ।
পারভেজ ভাবে আর ভাবে , চোখে মুখে বিসন্নতা আর হতাশা নিয়ে । ওর যখন টাকা বেশী থাকেনা, তখন তো ও বিস্কুট খেয়েই পার করে দেয় । আজ যেমন খেয়েছে । বেশ রাত হয়েছে । মিথদের ফ্ল্যাট থেকে রাস্তায় নেমে আসে সে । চোখের কোণায় জল ছল ছল করছে । পা’ দুটো ভারী হয়ে গেছে । যেন ইচ্ছে করেই স্থির হয়ে গেছে । ধোঁয়া লাগার মত দম বন্ধ হয়ে আসছে । কত বিচিত্র, মানুষে মানুষে কত ব্যবধান । দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায় সে । চাঁদ বা তারার কোন আলো নেই । ঘন অন্ধকার চারিপাশে । অন্ধকারেই পা ফেলে সে এবার । অন্ধকারেই তো তাকে চলতে হবে । কতটা পথ- তা কী সে জানে ?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:২৫

কল্লোল পথিক বলেছেন: বাহ!দারুন হয়েছে।

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৫

ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: ধন্যবাদ নিবেন ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.